গাজাকে রেখেই ঈদ করবে মুসলিম বিশ্ব
লিখেছেন লিখেছেন অরুণোদয় ২৭ জুলাই, ২০১৪, ০৪:৩৬:৩৭ বিকাল
গাজা, বর্তমান সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু। দৈর্ঘ্যে ৪১ কিলোমিটার, প্রস্থে কোথাও ৬, আবার কোথাও ১২ কিলোমিটার। ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপত্যকাটি আজ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে হায়েনাদের আক্রমণে। ৬২ কিলোমিটার সীমান্তরেখার ৫১ কিলোমিটারই ইসরায়েলের সঙ্গে। বাকি ১১ কিলোমিটার মিশরের সঙ্গে। আরেকদিকে ভূমধ্যসাগর।
ছোট্ট এই উপত্যকাটি আমাদের দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুরের চেয়েও আয়তনে ছোট। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মতো আরব মুসলিম অধ্যুষিত এই ছোট্ট উপত্যকাটিতেও আর মাত্র দু-একদিন পরই ঈদুল ফিতরের চাঁদ উঠবে। কেমন কাটবে গাজার শিশুদের ঈদ? চলুন দেখে আসি.....
শনিবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলায় নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন ৫,৮৭০ জন ফিলিস্তিনি। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা। এমন বাড়ি খুব কমই পাওয়া যাবে যেখানে কেউ হতাহত হননি। গত ৮ জুলাই থেকে গাজায় অনবরত নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এমন কোন শক্তি নেই যা প্রয়োগ করছে না ইসরায়েল। স্থল, জল ও আকাশ- সব পথেই আক্রমণ চালাচ্ছে মানবতার ভয়ংকর শত্রু এই দেশটি। যার নেই কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, না আছে কোন সামরিক বাহিনী, না আছে একটি বিমান, না আছে একটি ট্যাংক, না আছে একটি যুদ্ধজাহাজ; তার বিরুদ্ধে এত বড় আক্রমণ চালানো হচ্ছে বিশ্ববিবেকের সামনেই। এটিকে যুদ্ধ বলা কী করে সম্ভব? এখানে কার সাথে কার যুদ্ধ হচ্ছে?
বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া বলে আসছে হামাসের সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু এটি কী করে যুদ্ধ হয়, আমার বোধগম্য নয়। হামাস যে কাজটি করছে তা হচ্ছে স্রেফ প্রতিরোধ। হামাসের প্রতিরোধ যুদ্ধের সাথে আমাদের ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মিল ব্যাপক। '৭১-এর যেমন আমরা পাকিস্তানে গিয়ে হামলা করিনি, বরং আমরা কেবল তাদেরকে প্রতিহত করেছি। তেমনি হামাসও তার দেশকে গুঁড়িয়ে দিতে আসা অসুর ইসরায়েলকে প্রতিহত করে যাচ্ছে সাধ্য অনুযায়ী। আর রকেট হামলা কেন করে হামাস? এই প্রশ্নের উত্তরটি সবসময়ই দিয়ে আসছে হামাস। কিন্তু হামাসের এই উত্তরটি বিশ্বের গণমাধ্যমে খুব কমই প্রতিধ্বনিত হয়। হামাস জানাচ্ছে- ইসরায়েল তার দেশে সারা বছর প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কীভাবে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, বিশ্ববাসীর কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দিতেই হামাসের রকেট হামলা। হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলের তেমন কোন ক্ষয়-ক্ষতি হয় না। রকেট হামলা হচ্ছে স্রেফ প্রতিবাদের ভাষা। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরায়েল। ধ্বংসযজ্ঞের এই মাত্রা কখনও একটু বাড়ে, কখনওবা একটু কমে। তবে, কখনোই তা বন্ধ থাকে না। প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনের কোন না বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়, প্রতিদিনই কোন না কোন ফিলিস্তিনিকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয় বা বিনা বিচারে, বিনা নোটিশে কোন না কোন ফিলিস্তিনিকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়; আটকে রাখা হয় দিনের পর দিন। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের এই আচরণ নিত্যদিনের। এটি যারা নিয়মিত গণমাধ্যমে চোখ রাখেন তাদের দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয়।
হামাস অবৈধভাবে গড়ে উঠা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। এর পিছনে যুক্তিও আছে- আজকের ইসরায়েল হচ্ছে মূলত এক সময়ের ফিলিস্তিন। ইসরায়েল বলে কোন রাষ্ট্র এখানে কখনও ছিল না। ইহুদিবাদী ও পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের ফসল আজকের ইসরায়েল। ইসরায়েল হচ্ছে এমন এক 'রাষ্ট্র' যার নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ড নেই। প্রতিদিনই 'কিছুটা' বেড়ে যায় ইসরায়েল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের আয়তন।
শনিবার (২৬ জুলাই) ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ১২ ঘণ্টার সাময়িক এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার সময় গাজায় ইসরায়েলের হামলা সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। এই ১২ ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংসস্তুপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৮৫টি মৃতদেহ। গাজার অবরুদ্ধ অধিবাসীরা খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের জন্যে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন।
গাজার এই দুর্দিনে বিশ্বের গুটি কয়েক দেশে ছাড়া কেউ কোন উচ্চবাচ্য করছে না। এমনকি গাজার আরব মুসলমানদের স্বজাতি অন্যান্য আরব দেশগুলোও এ ব্যাপারে ভয়ানক রকমের নীরবতা অবলম্বন করছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলছে কেবল ইরান, তুরস্ক ও কাতার। তবে, প্রতিবাদ করা ছাড়া এই দেশগুলোর আর তেমন কিছুই করার নেই। কেননা, ইসরায়েলের পিছনে রয়েছে বিশ্বের শক্তিশালী সব সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র বলে সুপরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল ও মিশর সফর করেও ইসরায়েলি হামলা থামাতে পারেননি। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সংগঠন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও ইসরায়েল সফল করে গেছেন কদিন আগে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ইসরায়েল এমনই এক শক্তি, যে শক্তির রাশ কেউ টেনে ধরতে পারছে না।
গাজা তথা ফিলিস্তিনের নিকটতম প্রতিবেশী মিশর। আরব স্বজাতি মিশর ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করে। সৌদি আরব অসম্ভব রকমের নীরবতা অবলম্বন করছে। অন্যান্য আরব ও মুসলিম বিশ্বও একই পথ অনুসরণ করছে। তবে, মুসলিম দেশগুলোর সরকারগুলোই মূলত নীরব; মুসলিম জনগণ ঠিকই ফুঁসলে উঠছেন। প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে (যেমন- ফেসবুক) ইসরায়েলের বর্বর হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মানবতার শত্রু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র হিসেবে সরব রয়েছে কেবল ইরান ও তুরস্ক। ইরান বলছে, সমস্যাটি এখানে নয়; সমস্যাটির সমাধানে এর মূলে হাত দিতে হবে। ইসরায়েলকে শিকড় থেকেই কেটে ফেলতে হবে। ১৯৪৮ সালে আরবের বুকে বিশ্বের ক্যান্সারখ্যাত ডাকাত দেশ ইসরায়েল যে শিকড় গেঁড়েছিল, সেই শিকড়টি কেটে দিতে হবে। কিন্তু সেই শিকড় কাটার কাজটি কে করবে? কবে কাটা হবে সেই শিকড়? কবে মুক্তি পাবে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণ? কবে ফিলিস্তিনিরা ফিরে পাবে তাদের হারানো ঘর আর ভিটেমাটি?
বিশ্বের সাতশো কোটিরও বেশি শান্তিকামী মানুষ, দেড়শ কোটিরও বেশি মুসলমান, জাতিসংঘের সনদ-চুক্তি, আন্তর্জাতিক সব চুক্তি, মানবাধিকারের সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাজায় নির্মম-নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে অসুর শক্তি ইসরায়েল। আমরা যারা সংবাদকর্মী তারা প্রতিনিয়তই আঙ্গুলে গুণে যাচ্ছি ফিলিস্তিনিদের লাশের হিসেব। আঙ্গুলগুলো বারবার ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে; কিন্তু গণনা শেষ হয় না। প্রতিদিনই গুনতে হয় ফিলিস্তিনিদের লাশের হিসাব। তবে, এবার আর পারা যাচ্ছে না! ঘুম থেকে উঠেই নিউজরুমে দৌড়াতে হয় ফিলিস্তিনিদের লাশ গুনার জন্য। লাশ গুনতে গুনতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি আমরা। লাশের মধ্যে একটু পর পরই ভেসে উঠে কচি ও নিষ্পাপ শিশুটির মুখ, এক স্নেহশীলা মায়ের মুখ। আতঙ্কগ্রস্ত মা তার সন্তানের অপেক্ষায় প্রহর গুণে যাচ্ছেন। আমার মা-ও অপেক্ষা করছেন- 'ঈদ' করতে বাড়িযাবে তাঁর সন্তান। হ্যাঁ আমরা সবাই গাজায় বুলেটে বিধ্বস্ত মাকে আর তাঁর সন্তানদেরকে রেখেই ঈদ করতে বাড়ি চলে যাবো।
আমরা যখন ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে নিতে ঈদের নামাজের জন্য মাঠপানে ছুটে যাবো; ফিলিস্তিনি বাবাও ছুটে যাবেন(!) তার সন্তানের লাশ কাঁধে করে।
- See more at: http://www.timenewsbd.com/news/detail/19705#sthash.70awa88E.dpuf
বিষয়: বিবিধ
১১৬১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন