মুসলিম ব্রাদারহুডের রক্তাক্ত ইতিহাস...
লিখেছেন লিখেছেন খামচি বাবা ২৬ মার্চ, ২০১৪, ১০:১০:৩৯ রাত
ব্রাদারহুডের রক্তাক্ত অধ্যায়
১৯২৮ সালের কোন এক দিন। ছয় জন মিশরীয় মুসলিম শ্রমিক নামাজ আদায় করতে গেলেন একটি মসজিদে। সুয়েজ খালের তীরবর্তী ইসমাইলিয়া শহরের ওই মসজিদে তখন বয়ান করছিলেন একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষক। মিশরে তখন চলছে ব্রিটিশ শাসন।
ছয় জন দরিদ্র শ্রমিক মসজিদে ঢুকেই শুনতে পেলেন, 'আরব এবং মুসলমানদের আজ কোন মর্যাদা নেই।' কথাটি শুনে যেন জ্বলে উঠলেন ছয় যুবা শ্রমিক।
তারা বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠলেন স্কুল শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বললেন, "আমরা আর বিদেশিদের দ্বারা শোষিত হতে চাই না। আপনি যে অমর্যাদার কথা বললেন আমরা আর সে পথে হাঁটতে চাই না।"
যুবকেরা স্কুল শিক্ষককে তাদের নেতা হওয়ার আহ্বান জানালেন। তিনি তাদের আহ্বানে সাড়া জানালেন। মুসলমান ভাইদের আবদার তিনি ফেলতে পারলেন না। গঠিত হয়ে গেল মুসলিম ভাইদের নিয়ে এক নতুন সংগঠন 'মুসলিম ব্রাদারহুড' বা 'মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব'। এতক্ষণে নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন স্কুল শিক্ষকটি কে? তিনি হলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না। এর আরবি নাম হচ্ছে 'ইখওয়ানুল মুসলিমিন'। মিশরে প্রতিষ্ঠিত এই রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনটির শাখা এখন রয়েছে প্রতিটি আরব রাষ্ট্রে।
সেই ছয় জন যুবকের হাত ধরে গড়ে উঠা মুসলিম ব্রাদারহুড আট দশকেরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে। ব্রাদারহুডের ভিত্তিভূমি মিশরে আজ আবার আলোচনায় সেই সংগঠন। মিশর তথা পুরো আরব বিশ্বের গত দুইশ বছরের ইতিহাস মানেই সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন, একনায়কত্ব। আর এই সামরিক স্বৈরতন্ত্রে একটি গণতান্ত্রিক সংগঠন টিকে কীভাবে? আসলেই টিকেনি। দশকের পর দশক এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের উপর চালানো হয়েছে খড়গ। সেই সামরিক আর একনায়কত্বের বেড়াজাল ভেঙ্গে গিয়েছিল একবিংশ শতাব্দীতে এসে। মিশরের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেয়েছিল। তাদের অধিকারের প্রথম রায়টিই মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে দিলেন মিশরবাসী। কিন্তু সামরিক জান্তা? তাদের সহ্য হলো না সেই গণরায়। তারা আবারো শৃঙ্খলে বাঁধতে চাইলো ব্রাদারহুডকে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের ইতিহাস লিখতে গিলে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সংখ্যাই বেশি হবে। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিশরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক জান্তা। এরপর থেকেই আবারো শুরু হয় দমন-পীড়ন। সামরিক জান্তার নৃশংস হামলা-নির্যাতনে এখনো পর্যন্ত কয়েক হাজার ব্রাদারহুড নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য, কারাগারে বন্দী রয়েছেন অগণিত নেতা-কর্মী। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্টকে সেই গত জুলাই থেকেই কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এদিকে চলছে সংবিধান কাঁটা-ছেঁড়ার মহোৎসব। সংবিধানকে নিজেদের মতো বানিয়ে নিয়েছে জান্তা। এই সংবিধান সামরিক বাহিনীর জন্য, মিশরবাসীর জন্য নয়। খুব শীঘ্রই আয়োজন করা হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নাটক। সেই নাটকের 'নায়ক' হলেন অভ্যুত্থানকারী সেনা প্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। তাকেই প্রেসিডেন্ট ধরে নেয়া হচ্ছে, যদি না সামরিক বাহিনীর মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এরই মধ্যে ২৪ মার্চ, সোমবার আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনা করল মিশর। তবে, মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য এটি তেমন নতুন কিছু নয়। সোমবার দেশটির সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত আদালত ব্রাদারহুডের ৫২৯ জন সমর্থককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। চলুন ব্রাদারহুডের ইতিহাসের পরতে পরতে এরকম আরো অনেক রক্তাক্ত অধ্যায় লেখা রয়েছে। সেই অধ্যায়গুলি দেখে আসি চলুন-
১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে ব্রাদারহুড। খুব দ্রুত ব্রিটিশ শাসনবিরোধী বিদ্রোহ মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার তার তাঁবেদার সরকারকে মিশরের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। হাসান আল বান্না প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েও অনুমতি পাননি। বরং তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে রাখা হয়।
নাসেরের আমলে ব্রাদারহুড: গামাল আবদ আল-নাসের মিশরের ক্ষমতায় আসেন ১৯৫৪ সালে। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান। ব্রাদারহুড কর্মীদের নির্যাতনের জন্য তিনি নির্যাতন সেল (কনসেনট্রেশন ক্যাম্প) গড়ে তোলেন। এসব ক্যাম্পে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে নির্যাতন করা হয়।
মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে এক পর্যায়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগে অন্তত ১৮ হাজার ব্রাদারহুড নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এদের মধ্যে ১০০ থেকে ২০০ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। নির্যাতনে নিহত হন অন্তত ৩৮ জন। মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন শীর্ষস্থানীয় ও তাত্ত্বিক নেতা সাঈয়্যেদ কুতুবসহ তিনজনকে ফাঁসি দেয়া হয়। একজন 'রাষ্ট্রদ্রোহী' লুকিয়ে আছে, এই অভিযোগে একটি পুরো এলাকার লোকজনকে আটক করা হয় এবং তাদের সবার উপর চালানো হয় নির্যাতন।
এভাবে নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয় ব্রাদারহুড নেতা-কর্মীদের উপর। পরে জানা যায় যে, কথিত এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সাজানো নাটক।
আনোয়ার সাদাতের আমলে ব্রাদারহুড: গামাল নাসেরের পর ক্ষমতায় আসেন আনোয়ার আল-সাদাত। তার আমলে ১৯৭১ সালে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ব্রাদারহুডের আটক নেতা-কর্মীদেরকে ধীরে ধীরে মুক্তি দেয়া শুরু করেন সাদাত। তার আমলে ব্রাদারহুডের মূল দাবি ছিল দেশে শরীয়াহ আইন চালু করা। সাদাত সংবিধান সংশোধন করে চালু করেন যে, ইসলামী শরীয়াহ হবে সকল আইনের উৎস।
তার আমলে মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অনুমতি দেয়া হয়। তবে, নির্বাচনে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। ১৯৭৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলিম ব্রাদারহুডসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদেরকে গণহারে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন সাদাত।
মোবারকের আমলে ব্রাদারহুড: সাদাতের পর ১৯৮১ সালে ক্ষমতায় আসেন হোসনি মোবারক। তার আমলেও ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ থাকে। ব্রাদারহুডকে অফিসিয়ালি বৈধতা দেয়নি মোবারক জান্তা। কোন প্রকাশনা বা সমাবেশের অনুমতি ছিল না তার আমলে এবং কোন কারণ ছাড়াই আটক করার নিয়ম করেন মোবারক। তার আমলে মুসলিম ব্রাদারহুড গোপনে গোপনে উন্নতি করতে থাকে। ব্রাদারহুডের অগ্রযাত্রা থামাতে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেন মোবারক। সমস্ত পেশাদারি সংগঠনগুলোকে সরাসরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ব্রাদারহুডের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়। এরপর আসে যুগান্তকারী আরব বসন্ত। আরব বসন্তের হাওয়ার তোড়ে ভেসে যায় মোবারকের সিংহাসন। মিশরে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালের জুনে। নির্বাচনে জয়লাভ করেন মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ৩ জুলাই সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন মুরসি। মিশরে আবারো নেমে আসে সামরিক শাসনের ভূত। এখন দেশ চালাচ্ছে মূলত সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার। সূত্র: উইকিপিডিয়া, ইখওয়ানওয়েব, আলজাজিরা ও আল আহরাম।
ফেসবুক থেকে সংগ্রীহিত
বিষয়: বিবিধ
২৬৩৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো ভালো লাগলো ভালো লাগলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন