মুসাফির

লিখেছেন লিখেছেন সহিদুল ইসলাম ০১ জুন, ২০১৩, ০১:৩৪:৫৭ দুপুর



অমাবস্যার রাত, ভয়ানক নিস্তব্ধতা, ভীতিকর আঁধার,

ভয়াল বিরান ভূমিতে শব্দ যেন কোথাও মানবতার,

একজন মুসাফির আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,

হে আদমের বেটা জনবসতি ছেড়ে কোথা নিয়ে এলেন?

ভয়ানক নিস্তব্ধতা, এ ঘন আঁধারে তুমি হোঁচট খাবে,

তোমার সন্তানদের হিংস্র জন্তুরা থাবা মেরে নিয়ে যাবে।

কাফেলাপতি বল্লেন, হোঁচট খাইতে বাকি নাহি আছে যেন,

হোঁচট না খেলে, কাফেলা এখানে মাথা ঠুকছে কেন?

নিরাপত্তার চিন্তারকথা বলোনা, তোমারা সাথী ভাই,

নিরাপত্তা হল বড়ই কষ্টের, এক বেদনাদায়ক অধ্যায়।

মুসাফির বল্লেন, তুমি কি বলছো? একটু বল খুলে,

আমরা বুঝি এসেছি এক পরাভূত,গভীর রহস্যের কূলে।

কাফেলাপতি শ্বাস নিয়ে বল্লেন, হয়ত কিছু এমনি,

শুনে কি করবে, আমার ব্যর্থতার দুঃখময় কাহিনী?

সত-সহস্র বছর পার করেছি ঘুরে এ উপাত্যকায়,

বহু সহমর্মী পথিক আমাদের সাথে কাটিয়েছে অপেক্ষায়,

বিপদসংকুল বন্দিখানা হতে পাইতে পরিত্রাণ,

তোমার মত সকলেই চেষ্টা করছে অফুরান।

হৃদয়বিদারক -মুসিবতের কষ্ট যখন বলতাম তাদের কাছে,

বলত তারা, এ জখমের ঔষধ মানুষের কাছে নাহি আছে।

তবে যাবার সময়, বলছে যে, অপেক্ষার প্রহর গুন,

তোমার ঔষধ আসমান থেকে হয়ত হবে আচ্ছন্ন।

কাফেলাপতি বললেন শোন মুসাফির, চলে যাও ভাই

আমাদের করুন কাহিনী শুনে পূর্ববর্তীরা করেছিল তাই,

এতটুকু শুনে মনের মধ্যে এমন আগ্রহ হয়েছে, হয়ত বলবে,

দুঃখগাঁথা শুনা ব্যতীত এখান হতে কেউ নড়াতে নাহি পারবে।

আমি হব না ঐ পথিকদের মত, দেখ বিশ্বাসের সাথে বলি,

দুঃখ শুনে যারা তোমাকে সজল নয়নে রেখে গিয়েছে চলি ,

আমি নিজেও দুঃখ-বেদনার দোলনায় হয়েছি পালিত,

তোমার হৃদয়ের ছটফট রহস্য শোনার জন্য হয়েছি উদ্যত,

চরিত্রে ও স্বভাবে কতইনা মিল আছে মানবের,

ঠিক যেমনটি ছিল তোমার পূর্ববর্তী পথিকের।

আমার কাহিনী শুনতে একগুঁয়ে হয়েছো! তো শুন,

এ আশায় বলছিনা যে, সমস্যার জট খুলে যাবে যেন।

শুধু এ জন্যই, যে কাফেলা হতে ভগ্নান্তর যেন না যাও,

(কাফেলার সর্দার) বলছি এবার, কাহিনী শুনে নাও।

বহুদিনের কথা, তখন ভূপৃষ্ঠে পড়েনি মানুষের আঁচড়,

জগৎস্রষ্টা আসমানে বসালেন বহু বড় এক দরবার।

পর্বতের সারি নিয়ে, কিনারাহীন এক বিস্তৃতি ছিল যার,

অন্য দিকে পড়ে ছিল জমিনের বৃত্ত গোলাকার।

যখন স্রস্টার সমস্ত সৃষ্টি এসে জানান দিল উপস্থিতির।

ঠিক শাহী পদপ্রান্তে মানবাত্মারা যখন করছিল ভিড়।

অদ্বিতীয় প্রভু, আপন মর্যাদা-মাহাত্ম্যের চাঁদরাভ্যন্তর,

বের করে আনলেন তিনি, একটি হীরা চির সুন্দর।

হীরার সৌন্দর্যের চমকের কথা কি বলবো যে আর,

সাধ্য কারো ছিলনা যে, তাকে চোখ তুলে দেখার।

বেশ দৃষ্টিতে তীব্র এক কিরণ পড়ল সবার চোখে,

আঁধারেতে পড়ল সবাই চোখে নাহি কিছু দেখে।

আল্লাহতা’আলা বললেন সকল উপস্থিতিকে করে সম্বোধন,

দেখ! এটি আমার আমানত, কূদরত-খনির অতি মূল্যবান।

এগিয়ে আস, কে পারবে, এটার সংরক্ষণ-দায়িত্ব পালন,

তাহার কাছে এই অতি মূল্যবান হীরা আমি করিব অর্পণ।

তবে,শর্তযোগে যে, এক দীর্ঘ মেয়াদ শেষে একটি বসাব দরবার,

ওই দিন এ আমানত সম্পূর্ণ এ অবস্থায় ফেরৎ দিতে হবে আবার।

এ-ও শুনে নাও যে, এটি আদায়ে যদি বিন্দু মাত্র ত্রুটি হয় তোমার,

অঙ্গীকারের বিনিময় আছে যেমন, তেমনি দন্ডও রয়েছে অবাধ্যতার।

আসমানের চওড়া-সমান বক্ষ তুলে নেবে এ আমানতের ভার,

সাধারণ ভাবে এমনই ধারণা ছিল মনেতে সবার।

আমানত অর্পণের কথা শুনে, আশ্চর্যের সীমা ছাড়িয়ে আসমান,

চওড়া-সমান বক্ষ নিয়েও আমানত ভারে, ভয়ে কম্পমান।

আসমানের অস্বীকৃতির পর শাহী সম্বোধন পেল পর্বত চূর্ণ,

এ আমানত কি রেখে দেব তোমাদের বক্ষ করে বিদীর্ণ ?

এ কথা শুনে পাহাড়ের অহংকারী ললাটে ঘর্ম এসে গেল,

সংকোচিত হয়ে মহান প্রভুর দরবারে আবেদন জানাল।

আমাদের চূড়াকে উচ্চতার মুকুট দানকারী মালিক আমার!

বক্ষ ফাটবে, কোমর টুটবে,দাও যদি এ আমানতের মহিমাভার

এবার জমিনের পালা, এল দরবার হতে সুলতানী ফরমান,

আমার খনির এ হীরা তুমিই রাখবে অন্তরে আপন।

জমিন তার ধূলিধূসর চেহরা শাহী অট্টালিকার দরজা রেখে দিল,

মহাপ্রভাবশীল বাদশাহর নিকট, কাঁপতে-কাঁপতে বলল,

ছোট-বড় সৃষ্টির পদে দলিত-মথিত, আমার কোথায় এত হিম্মত,

আমি কি বহন করতে পারি প্রভু, আপনার এ মহান আমানত!

ওই ভরপুর দরবারে সকলের চেহেরায় যখন বিবর্ণতা,

ইনসান দাঁড়িয়ে তখন করছিল যে চিন্তা।

এ যুক্তিতর্কের সাথে কি সম্পর্ক যে, এক সরল বান্দার,

তার মাঝে কি আছে-কি নেই? আমানতের আদায়ে প্রাপ্যতার।

আল্লাহর ইচ্ছা এ আমানত যদি কাউকে সোপর্দ করতে চায়,

তবে এদিক-সেদিক কেন করা হচ্ছে গ্রহণে তাহায়,

যিনি আমানত দিচ্ছেন, তিনি যোগ্যতাও দিবেন তায়,

ধরি, যদি বন্ধুর কারণে আমাদের সকল ধ্বংসও হয়ে যায়।

তাতে কি ক্ষতি, এ চিন্তা করে মানুষ আগ বাড়িল,

আগ-পিছ, এবং পরিণতি না ভেবেই হীরা তুলে নিল।

দরবারের সকলেই আশ্চর্য হয়ে মানুষের দিকে তাকিয়ে রইল,

তাদের নগ্ন দুঃসাহসে বড়-বড়দের হিয়া কেঁপে ওঠিল।

বিশ্বের পতি, স্বয়ং স্রষ্টা, শঙ্কাহীন মানুষের সাহস দেখে যিনি,

“জালেম এবং পরিণতির খবরহীন মানুষই” বললেন তিনি।

অতঃপর দুনিয়ায় শুরু হল, মানুষের আসা-যাওয়া,

ক্রমান্বয়ে পৃথিবীতে শুরু হল তার বংশ বৃদ্ধি পাওয়া।

যুগে-যুগে পৃথিবীতে বিশেষ কিছু মানব এসেছেন,

যারা ধারাবাহিক ভাবে এ হীরার সংরক্ষণ করেছেন।

সমস্ত মানবের তরে, পুরো জীবন হেদায়েতের খবরদার!

হীরা বিনষ্ঠ হলে, মানবের জন্য বড়ই লজ্জা অনুষ্ঠিতব্য দরবার।

দয়াবান মুসাফির! আজ হাজার হাজার বছর বয়ে গেল,

শাম দেশের এক বৃদ্ধ কর্তা আপন দুগ্ধপোষ্য শিশু ও স্ত্রী নিয়ে এল।

যখন তাদের রেখে গেলেন, তৃণ-বারি হীন পাহাড়ের উপত্যকায়,

তার বড়ই করুণ মুনাজাত ছিল বিদায় বেলায়।

আপন বংশ আবাদ করেছি, এই তৃণ-বারি হীন এক মরুপ্রান্তর,

এখন আপনিই তাদের রক্ষক, হে আমার পরওয়ারদিগার!

সম্মানিত পিতা দুনিয়া হতে চির বিদায়ের বেলায়।

আসমানি হীরা নিজের ওই প্রিয়পুত্রকে সোপর্দ করে যায়।

আমাদের যে কাফেলা তুমি দেখতে পাচ্ছ তাঁরই বংশধারা,

পূর্বপুরুষ নশ্বর পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছিলেন যারা।

বংশের বড়দের কাছে ডেকে, আশ-পাশে করলেন একত্রিত,

ওই হীরা খানা বের করে বললেন শোন পতি-গোত্র,

দেখ! মৃত্যু আমার শিয়রে আছে দাঁড়া।

অচিরেই সে, বিচ্ছেদের এক প্রাচীর করবে খাঁড়া।

দৃষ্টিশক্তি লোপ পাচ্ছে, এখনি তোমাদের হইতে হইব পর

বংশ পরম্পরায় পাওয়া আসমানী হীরা তোমাদের করব হস্তান্তর।

জীবনের এ শেষ বাক্য তোমরা হৃদয়ের পলকে লিখে নাও,

সকল কথা ভুলিও কিন্তু এ কথা যেন ভুলে নাহি যাও।

দেখ! এ পৃথিবী এখন নিজের শেষ সময় করিতেছে পার,

অচিরেই তা ওই বিন্দুতে পৌঁছবে, যেখানে সূচনা হয়েছে তার।

আমিও ওখানেই যাচ্ছি যেখান থেকে হয়েছি আগত,

কিন্তু আমার পূর্বে লক্ষ মানুষের কাফেলা হয়েছে প্রত্যাগত।

স্বাক্ষী থাক যে, তোমরা পর্যন্ত আমি, পৌঁছিয়ে দিলাম এ আমানত,

এখন তোমাদের হাতে রয়ে গেল মানব জাতির সম্মান-ইজ্জত।

পার হতে হবে তোমাদের জীবনের কঠিন-বিপদজনক তীর,

পদে পদে ওত পেতে বসে আছে ডাকাতের ভিড়।

তোমাদের সফর সফল ও নিরাপদ হোক এই কথা বলি,

আমাদের গোত্রের বৃদ্ধ পিতা চিরদিনের জন্য গেলেন চলি।

এখানে পৌঁছে কাফেলাপতির, চোখে জল, করুণ হল গলা,

অল্প বিরতির পর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফের শুরু হল বলা,

শোন হে, আমার সহানুভূতিশীল মুসাফির!

ওই হীরা, কাফেলায় হাত বদলিয়েছে, কেটেছে কয়েক শত বছর।

কাটছিল আনন্দে, বইছিল জীবনে আনন্দের গতিধারা,

একদা উপাত্যকা অতিক্রমে, এক পাথরের ধাক্কায় হারাল ঐ হিরা।

আঁধার রাতে হারিয়েছি হিরা, বহু ভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছি,

ওই সময় হতে আজ পর্যন্ত, ওই হীরার জন্যই আটকে আছি।

কাফেলা মোদের হয়েছে ঘায়েল, খেয়ে রজনীতে অবিরাম আঘাত,

কতবার আমরা ঘুমিয়ে জেগেছি, আবার কতনা রজনী হয়নি প্রভাত।

আহ! এখন আমরা আসমানি দরবারে হাজির হবো কোন মুখ নিয়ে,

পূর্বে মোদের গিয়েছে যারা, তারা সকলে অপেক্ষায় রয়েছেন চেয়ে ।

আমরা তো আমাদের জীবন-সম্বল হারিয়ে হয়েছি অসহায়,

অনুষ্ঠিতব্য আসমানি দরবারে কি জবাব দিব? আমরা হায়!

কাফেলা পতির আদ্যোপ্রান্ত কাহিনী শুনে, বললেন মুসাফির,

মাথা তুলে, হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে বললেন, শোন কাফেলা বীর,

তোমার জীবনগল্প দুঃখ-কষ্টের সন্দেহ নেই তাতে,

তোমাদের কাফেলা এখন রয়েছে যে উপত্যকাতে।

এ সম্পর্কে এক নিগূঢ় রহস্য আমার বক্ষেও জমা আছে,

শোন তাহা, যাহা প্রসঙ্গক্রমে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

বহু আগে, নিজ গোত্রের ১ পর্যটকের উপত্যকা পারে

হঠাৎ দামান জড়িয়ে গেল তার, এক সূচালো পাথরে।

যখন সে ঝুঁকে গিয়ে ব্যস্ত ছিল, নিজ দামান মুক্ত করতে,

হঠাৎ মসৃণ চতুস্কোণা এক পাথর এসে পড়ল তার হাতে।

পাথরটি সে তুলে নিয়ে, আলোতে এসে দেখতে পায়,

ওটি লোহিত পদ্মরাগমণির ফলক, সবুজ রঙের লেখা গায়।

কুফর ও গোমরাহির অন্ধ ঊপত্যকা, এটি আঁধারের রাজধানী,

সূর্যের এখানে প্রবেশ নিষেধ, কেউ আজো বিহান দেখেনি।

নিশ্চিত, তোমার জন্য এটি দুঃখ-দুর্দশার বড় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা,

স্বীয় অভিষ্টের ধন তালাশে ব্যাপৃত আছ, বেশ! ঘাবড়িয়োনা।

মুসিবতের এ আঁধার ঘরে কোন আলো অবশ্যই, অবতীর্ণ হবে,

মুসাফির বলে, প্রবোধের সুরে, হারানো হীরা অবশ্যই ফিরে পাবে।

কাফেলাপতি বলে দুর্ভাগ্যের প্রান্তে এসে, সৌভাগ্য কী করে হবে?

মহারাজের দয়া আর্শের চূড়া হতে আমাদের সাহায্যে কি আসবে!

এতটুকু বলতেই কাফেলা পতির শব্দ কন্ঠে আটকা পড়ল,

হায় আমার হীরা বলে, হাঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগল।

মুসাফির এ বেদনাবিধুর অবস্থা সহ্য করতে নাহি পারলেন,

জগতপতির দেহধারী দয়া তোমারই সামনে দাঁড়িয়ে,বললেন

মাতম করছো! বলেই তড়িৎ নিজ চেহরার পর্দা তুলে নিল,

পর্দা উল্টাতে না উল্টাতেই চতুর্দিক আলোতে উদ্ভাসিত হল।

নিজ সার্বভৌম দৃষ্টির এক তীব্র কিরণ বিচ্ছুরণ করলেন বালিচরে,

‘ওই দেখ তোমার হীরা চমকাচ্ছে’ বললেন, আঙ্গুলের ইঙ্গিত করে।

কাফেলাপতি এক দৌঁড়ে তাহা হাতে তুলে নিলেন,

এ অত্যাশ্চর্য ঘটনায় কাফেলার সবাই হতচেতন হলেন।

স্বস্ব অবস্থানে সবাই হতবিহ্বলতার দেওয়াল হয়ে রইল দাঁড়িয়ে,

আনন্দ প্রকাশ করতেও ভুলে গেল, হারানো মানিক ফিরে পেয়ে।

কাফেলাপতি এ দিকে হীরা তুলে নিলেন,

ওই দিকে মুসাফির আপন মুখ ঢেকে নিলেন।

মুসাফির বিদায় চাইলেন, “আচ্ছা যাচ্ছি, ওখানেই দেখা হবে,

যেখানে এ মহান আমানত তোমাদের ফেরৎ করতে হবে।”

আমি বিধাতার শেষ নূর, বলে যখন মুসাফির পা বাড়াল,

কাফেলাপতি এগিয়ে এসে তার দামান আঁকড়ে ধরল।

এখন তুমি কোথায় যেতে পার, হে সাহায্যকারী আমার!

আমাদের চোখে তারকারাজি, উৎসর্গ করব কদমে তোমার।

অচেনা এক মুসাফিরের মত এসেছেন আমাদের কাফেলায়,

কিন্তু কর্ম দিয়ে, আমাদের হৃদয়রাজ্য করে নিয়েছেন জয় ।

কি আপনার পরিচয়? রাজধানী ছেড়ে যাচ্ছেন আবার কোথা?

কাফেলা প্রধান অতি বিনম্র সুরে বললেন এ কয়টি কথা।

দামান হেঁচকা দেওয়া রীতি আমার না,

আমি কে? তুমি এটি জানতে চেয়ো না।

তোমার আরাধ্য ধন, পেয়েছ তুমি ফিরে,

বেশ সানন্দে আপন পথ নাও তুমি ধরে।

তোমাদের জন্য যা করেছি আমি, বিনিময় চাই না তাতে,

মুসাফির উত্তর দিলেন, এক পরিপূর্ণ অমুখাপেক্ষীতার ভঙ্গিতে।

কোন ব্যাক্তির পরিচিতি জানাতো মানুষের জন্মগত অধিকার,

রীতিমত তাইতো আপনার পরিচয় জানার প্রচেষ্টা আমার।

আপনি দামান হেঁচকা দেবেন না, আমি দামান নাহি দেব ছেড়ে,

বলুন, আমার এর চেয়ে বড় আনন্দের মুহূর্ত আর কি হতে পারে?

দণ্ড দিয়ে দিন মোরে, অতীত কালের মত সময় দীর্ঘ করে,

কাফেলাপতি কথাগুলো উচ্চারণ করলেন বড়ই মিনতি করে।

কাফেলাপতি হয়ে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা তোমার কাজ না,

সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আবশ্যকতার আওতায় পড়েনা।

আমার দামানের সাথে জড়িত,

লক্ষ-কোটি দুর্দশাগ্রস্ত মানবের আকাঙ্খা,

যেতে দাও মোরে,করো না রহিত,

কতইনা সজল আঁখি পথ চেয়ে আছে, করছে অপেক্ষা।

অপ্রাসঙ্গিক কথার উত্তর দেবার, মোটেও সময় নেইতো আমার,

কথাগুলি, অতি গম্ভির সুরে কাফেলা পতিকে বলে মুসাফির।

নাইবা বললেন আপনি কে? কিন্তু মনের ধাঁধা হচ্ছেনা তো দূর,

আপনি ছিলেন পর্দাবৃত, ছিল তখন চতুর্দিকে অন্ধকারের ঘোর,

পর্দা তোলায়, আঁধার হল আলোকিত, আপনার রূপের আলোকে,

এখন আপনিই বলুন, কি মনে করতে পারি আমি আপনাকে?

মানুষ না ফেরেশতা ? অধিকন্ত ফেরেশতার রূপ তো এরূপ হয়না,

আবার চিন্তা করি, মানবের চেহরা তো কখনো সূর্য হতে পারেনা।

কাফেলাপতির আব্দার, রাগ করবেননা, হে আমার হৃদয় বিজেতা,

আপনি আশ্চর্যজনক এক নূতন সৃষ্টি, বললেন নিয়ে সংকোচতা ,

তোমাকে কতইনা বল্লাম যে,আমি কে? এর পেছনে পড়োনা,

কিন্তু বলতো কেন তুমি তোমার আপন একগুঁয়েমি ছাড়ছ না?

আমি কে? যার উত্তর তোমার বোধ-বুদ্ধির অনেক ঊর্ধ্বস্থিত,

আমার প্রভু ছাড়া কেউ জানেনা, আমি কে, আমার অস্তিত্ব।

এখনও যদি তোমার সান্তনা না আসে তবে বলছি আমি শোন,

আমার প্রকৃত রূপে অনেক পর্দা, সেথায় তোমাদের দৃষ্টিশক্তি সঙ্কীর্ণ।

আমি তোমাদের সমাবেশে পদার্পন করেছি মানবাকৃতির পর্দা পরি,

যাতে আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে খোদা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি।

মানব দৃষ্টি, রাখেনা শক্তি, দেখতে আমার হাকীকতের মহত্ত্ব।

তাদের বুদ্ধির দৌঁড়, দেখতে কেবল আমার বহ্যিক চমৎকারিত্ব।

এ দৃষ্টিভঙ্গিতেই দুনিয়াবাসী আমাকে মানব বলে, বুঝেছ এবার,

অতঃপর নয়ন ভরে দেখ তুমি, আমি কে? জিজ্ঞাসা করোনা আর।

আমার রূপ-রাজ্য চোখে দেখার অনুমতি আছে, নেই প্রশ্নের অবকাশ ,

সীমা অতিক্রম করোনা, মুসাফির দার্শনিক ভঙ্গিতে করিলেন প্রকাশ।

অধিকন্তু আপনিতো এ বুনিয়াদি প্রদীপেও মানবীয় গুণের অতীত,

এ সব দৃষ্টির অলৌকিকতা নয়, আপনারই দৃশ্যমান দ্যূতির কেরামত।

আপনার বাহ্যিক আকৃতি, যেটাকে করেছেন স্থির আমার দৃষ্টির সীমান্ত,

তা আপনার হাকিকতের সৌন্দর্যের ইঙ্গিতবাহী, এটি নয়তো দৃষ্টি ভ্রান্ত।

কাফেলাপতির কথাগুলির পরে, মুসাফির কয়, এক বাস্তব হাকিকত!

এটি বহু দুর্বোধ্য!! এ যেন এক মেঘের আড়ালে চন্দ্রিমা রাত!!!

অতঃপর তুমিই চিন্তা করে দেখ , যদি এ সম্ভাবনা হয় ভিত্তিহীন,

তবে প্রভুর মহত্ত্বের কাচারি হতে কেন এ ঘোষণার হল প্রয়োজন।

দৃষ্টি আপন পরিদর্শনে স্বাধীন থেকেও আমাকে মানুষই বুঝেছে,

এখন তুমিই বল, এটি কোন আশঙ্কার দ্বার রুদ্ধ করা হয়েছে।

কথোপকথনের মূল উদ্দেশ্য তুমি বুঝতে পেরেছ, মনে হচ্ছে আমার,

মুসাফির বলে যেতে দাও এবার, সংহার টানছি সকল ধারাবাহিকতার।

আবেগ-আকর্ষণের এ অনিচ্ছাকৃত অপরাধ ক্ষমা করবেন মোরে,

অনেক জ্বালাতন করেছি আপনাকে আমি অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে।

আপত্তি না থাকলে আপনার, না হয় আর একটু কষ্ট দিলাম,

যাবার কালে আপনার কাছে ক্ষমা চাই, বলবেন কি আপনার নাম!

হয়ত আপনাকে পাবনা, তবে আপনার নাম স্মরণে অন্তর আমার

প্রশান্তি করতে থাকব, কাফেলাপতি কথাগুলি বলল নিয়ে শিষ্টাচার।

বড়ই আশ্চর্য! জমিন-আসমানের এপিঠ ওপিঠ থেকে গোড়াপত্তন,

যার নাম, জন্নাত ও আর্শের দরজার অস্তিত্ব দপ্তরে রয়েছে অঙ্কন।

এর পরেও কি তোমাকে, আমার নাম বলার আছে প্রয়োজনীয়তা,

ধরে নাও, যিনি আপন প্রকৃতিতে নিষ্পাপ, কলঙ্ক মুক্ত এক সত্ত্বা,

যার স্বভাব-প্রকৃতি, চমৎকারিত্ব, মান-মর্যাদা অতি উচ্চ ও সুমহান,

যিনি আপন চেহেরা, সৌন্দর্য ও পূর্ণতায় জমিন থেকে আসমান,

জমিন থেকে আরশ পর্যন্ত সকল সৃষ্টি প্রশংসা কীর্তন করে যার,

এমন সত্ত্বাকে তুমি কি নামে ডাকবে? মৃদু হাস্যে বলে মুসাফির।

কাফেলাপতি বল্ল, তাঁর নাম মুহাম্মদ (সঃ) ছাড়া কি হতে পারে আর!

(হতচকিত হয়ে) তবে কি আপনিই মুহাম্মদ(সঃ)? হায় সৌভাগ্য আমার!

আপনি অভ্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার সংবাদ ঈসা (আঃ) দিয়েছিল,

আত্মহারা হয়ে, মত্ততায় ডুবে কাফেলাপতি যখন কথাগুল বলছিল,

গাছপালা, পর্বতমালা ঝুঁকে গেল সবখান হতে এ ধ্বনি আসতে লাগল।

সবাই হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে প্রেম ও ভক্তির এ সভায় শামিল হয়ে গেল,

ফজরের আযানের শব্দ কানে এল, কাফেলাপতির নিদ্রা টুটে গেল।

আযানের পূর্বে নভ-জমিনের সকল কিছু একযোগে গাইতে লাগল

আসসালাতু ওয়াস্ সালামুআলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ,

আসসালাতু ওয়াস্ সালামুআলাইকা ইয়া নবীয়্যাল্লাহ,

আসসালাতু ওয়াস্ সালামুআলাইকা ইয়া শাফিয়াল মুজলিমিন,

আসসালাতু ওয়াস্ সালামুআলাইকা ইয়া রাহমাতাল্লিল আলামিন।

[আরশাদুল ক্বাদেরী (রহ.)’র জীবনী অবলম্বনে]

মোহাম্মাদ সাহিদুল ইসলাম (সিঙ্গাপুর প্রবাসী)

মেইল_

H/P_6584027281

বিষয়: সাহিত্য

১৪৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File