অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যু ও জামায়াত সমর্থকদের অতি আবেগের বালখিল্য

লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ২৫ অক্টোবর, ২০১৪, ১১:৪০:২৮ রাত

মারা গেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির সর্বাধিক আলোচিত ব্যক্তি জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম । এরপরেই তাঁর জীবন ও মৃত্যু নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনার তুফান ওঠে মিডিয়ায় । অনলাইন মিডিয়া ফেসবুকে জামায়াত সমর্থকদের একটি অংশ অধ্যাপক গোলাম আযমের মৃত্যুর ক্ষণ নিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে । আরবি হিসেবে তিনি শুক্রবারের প্রথম প্রহরে ইন্তেকাল করেন । ইংরেজি হিসেবে বৃহস্পতিবার রাত ১০ টার কিছু পরে ।

কয়েক মাস আগে প্রায় একই সময়ে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ ও সম্ভাবনাময় বুদ্ধিজীবি নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে । এই বিশেষ সময়ে তাঁদের মৃত্যুকে শুধুমাত্র ‘শুক্রবারে মৃত্যু’র কারণে মহিমান্বিত হিসেবে তুলে ধরার একটা হাস্যকর আবেগী প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় জামায়াত সমর্থকদের মধ্যে ।

তাদের বক্তব্য ছিল- শুক্রবারে মৃত্যু হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের ওপর রহমতের প্রমাণ বহন করে । কতটা বালখিল্যতাপুর্ণ মন্তব্য !

অথচ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা আল্লাহর কাছে কে কতটা প্রিয় তা নির্ভর করে তাঁর কর্মের ওপর, মৃত্যুর ক্ষণের ওপর নয় । নবী (সাঃ) সহ সাহাবায়ে কেরাম, যুগে যুগে ঈমাম গন সবাই তো শুক্রবারে ইন্তেকাল করেননি । তাহলে কি তাঁরা আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত নন ?

সমস্ত সময়ই তো আল্লাহর, আল্লাহ যাকে যখন চান ফিরিয়ে নিয়ে যান ।

আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ইন্তেকাল করেন সোমবারের সকালে । ঈমাম বুখারী(রঃ) ইন্তেকাল করেন শনিবার রাতে, হযরত আবু বকর (রাঃ) মঙ্গল বার রাতে, জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী(রঃ) ইন্তেকাল করেন শনিবার । ইমাম ইবনে তাইমিয়া(রঃ) ইন্তেকাল করেন সোমবার । জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যাপক নাজির আহমদ ইন্তেকাল করেন মঙ্গলবার । মাওলানা একেএম ইউসুফ মারা যান রবিবার ।

এর অর্থ কি এই যে, তাঁদের মৃত্যু মহিমান্বিত ছিলনা ?

আবেগী সমর্থকদের বোঝা উচিৎ, গোলাম আযমের মৃত্যুর মহিমা তাঁর শাহাদাতে, ‘শুক্রবারে’ নয় ।

দ্বিতীয় যে ব্যাপারে বালখিল্য প্রদর্শন করেছে জামায়াত সমর্থকরা সেটা হলো- অধ্যাপক গোলাম আযমের নামের সাথে অতিমাত্রায় ‘ভাষা সৈনিক’ শব্দটির ব্যবহার । তিনি ভাষা সৈনিক ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই । কিন্তু সারাবিশ্বে তাঁর আসল পরিচয় ইসলামী আন্দোলনের নেতা হিসেবে । ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে । জামায়াতের আবেগী সমর্থকরা ‘ভাষা সৈনিক’ পরিচয়টাকে ‘ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনের নেতা’ পরিচয়টির উর্দ্ধে স্থান দিয়েছে । এটা এক ধরণের হীনম্মন্যতা তো বটেই, অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রতি বেয়াদবিও বলা চলে । যে মানুষ দুনিয়ার এইসব খেতাবী সম্মান অর্জনের ব্যাপারে কখনো চেষ্টা করেন নি, পাত্তা দেননি- অথচ তাঁর অনুসারী দাবিদাররা তাঁর আসল পরিচয়ের উপরে এই খেতাবী সম্মান দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ।

তৃতীয় যে ব্যাপারে বালখিল্য প্রদর্শন করেছে জামায়াত সমর্থক অনলাইন গোষ্ঠী- তা হলো, জানাজায় উপস্থিত মানুষের সংখ্যায় জনপ্রিয়তা নির্ণয়ের প্রচেষ্টা এবং আবারো এই ভুল বাটখারায় অধ্যাপক আযমকে ওজন করার চেষ্টায় । ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্নার(রঃ) জানাযায় তো অল্প কিছু মানুষ উপস্থিত ছিলেন । তার মানে কি তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না ? তাঁর জীবন মহিমান্বিত নয় ?

অথচ এইরকম জনপ্রিয়তা অর্জনের কোন চেষ্টা কোনদিন করেননি অধ্যাপক গোলাম আযম । বরং তিনি চরম বিরোধিতা, অজনপ্রিয়তার ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন । চাইলে অনেকের মত তিনি লন্ডন কিংবা সৌদিআরবে ঘাঁটি পেতে অনেক অনেক কিছু করতে পারতেন । কিন্তু তা তিনি করেননি । বাংলাদেশে ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী আন্দোলনের যে চেতনা তাঁর ভেতরে সৃষ্টি হয়েছিল- তার জন্য সব ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন ।

একাত্তরে পাকিস্তানের অখন্ডতা চেয়েছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায় তিনি কখনো অস্বীকার করেননি । যদিও একাত্তরের ঐ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁর জীবনের পার্থিব অর্জনের ষাট ভাগ খেয়ে ফেলেছে । কিন্তু অপরাধ যাকে বলে- খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, এইসবের সাথে কোনরকম সম্পর্ক থাকলে তাঁর দেশে ফেরার সাহস হতোনা এটা নিশ্চিত করে বলা যায় ।

তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন এই ভূখন্ডে ইসলামের ঝান্ডা তুলে ধরার জন্য । তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য এমন কোন চেষ্টা বাকি নেই যা চালানো হয় নাই । কিন্তু তবু তিনি দেশ ছাড়েন নাই ।

অধ্যাপক গোলাম আযম ইসলামের জন্য তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন- আল্লাহর কাছে তাঁর মর্যাদা তাঁর কাজের জন্য । তাঁর জীবনের অর্জন, সফলতা যা কিছু সবই- ইসলামের জন্য তিনি যা করেছেন তাতে নিহিত । শুক্রবারে মৃত্যু, ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব, জানাযায় মানুষের উপস্থিতি এইসব ভুল নিক্তিতে তাঁর মূল্য মাপার প্রচেষ্টা প্রকারান্তরে তাঁকে অপমান করার শামিল ।

বিষয়: রাজনীতি

১৭৮৩ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

278148
২৬ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০১:৫৩
মেরাজ লিখেছেন : সুন্দর উপলব্ধি
278155
২৬ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০২:৩৫
শেখের পোলা লিখেছেন : সহমত৷
278197
২৬ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৭:১২
কাহাফ লিখেছেন :
অসাধারণ নান্দনিক উপলব্ধিতে ভরপুর এই লেখনী।
ভালবাসার আধিক্য-আবেগপ্রবনতা ছোট-খাট বিষয় কে এড়িয়ে যায়।এ ক্ষেত্রেও তেমনি।
অনেক ধন্যবাদ উপস্হাপনার জন্যে।
278225
২৬ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৯:৩৫
অনুরণন লিখেছেন : সংযম পালনের উপদেশ দিতে গিয়ে আপনি নিজেই অসংযমের পরিচয় দিয়েছেন পুরো লেখায়।

শুক্রবার রাতে মৃত্যু নিয়ে কেউ 'উল্লাস' করেছে এরকম চোখে পড়েনি। বরং শুক্রবার রাতে হওয়ায় সবাই হামদ পড়েছে এবং স্বস্তি প্রকাশ করেছে। শুক্রবার দিন/রাতে মৃত্যুর ব্যাপারে পরিষ্কার হাদীস আছে,
Messenger of Allaah (peace and blessings of Allaah be upon him) said: “there is no Muslim who dies on the day of Friday or the night of Friday, but Allaah will protect him from the trial (fitnah) of the grave.”

স্কলাররা এটিকে ভালো পরিনামের বেশ কিছু চিহ্নের মধ্যে একটি বলেছেন।

ভাষা সৈনিক হওয়াটা তার রাজনৈতিক একটা এচিভমেন্ট এবং বাংলাভাষীদের মাঝে সেটা তুলে ধরায় কি সমস্যা। 'অতিমাত্রা' কোথায় দেখলেন কে জানে। এই ব্লগের পোষ্টগুলি দেখতে পারেন, বেশিরভাগ যায়গায় ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবেই উনাকে সম্বোধন করেছে প্রায় সবাই।

জানাযায় উপস্থিতি অবশ্যই তার জনপ্রিয়তা এবং তার কর্মীবাহিনীর ডেডিকেশনের প্রমান। এবং এটা আরও বেশি প্রচার দরকার। ব্যাপক উপস্থিতির যে একটা ইমপ্যাক্ট আছে সেটা সব চ্যানেল/নিউজ মিডিয়ায় উনার যানাজা এবং গায়েবানা জানাজায় বিপুল উপস্থিতির খবর/ছবি না ছাপাই প্রমান করে দেয়। এই ছবিগুলোর ব্যাপক প্রচার করে জামায়াতের কর্মী/শুভাকাঙ্খীরা ভালো কাজ করেছে বলেই মনে করি।


" যদিও একাত্তরের ঐ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তাঁর জীবনের পার্থিব অর্জনের ষাট ভাগ খেয়ে ফেলেছে ।"

এই ষাটভাগ মাপার বাটখারাটা কিরকম?


মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File