ডাঃ বকুলের ঈদের দিন
লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ৩০ জুলাই, ২০১৪, ০৮:২০:৩৫ সকাল
বিষন্ন মনে ডক্টরস রুমে বসে আছেন ডাঃ বকুল । আগে থেকেই একটু মন খারাপ ছিল । ঈদের চাঁদ ওঠার পর থেকে মন খারাপের মাত্রাটা বেড়েছে । সারারাত ঘুমাতে পারেননি । রোগীর চাপ তেমন নেই । তবুও ঘুম আসেনি । সারারাত এ পাশ ও পাশ করে কাটিয়েছেন । রাতে নামাজ পড়ে কিছু সময় কাটিয়েছেন । সকাল বেলা শারমিন ফোন করেছিল । বাচ্চাটা ‘বাপু কোথায়’ ‘বাপু কোথায়’ বলে কাঁদছে । তখন থেকে মনটা খুব খুব বিষন্ন ।
বাচ্চার বয়স তিন বছর । নাম রেখেছেন খালিদ । গত বছরও বাচ্চাটাকে সাথে নিয়ে ঈদ করতে পারেননি । বিয়ের আগে মনে মনে কল্পনা করতেন , একটা ফুটফুটে বাচ্চা হবে, বাচ্চাটাকে নতুন ছোট্ট পাঞ্জাবি-পাজামা-টুপি পড়িয়ে , আতর দিয়ে সাথে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে যাবেন । ছোট্ট শিশু , আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে – নিজের একটা শিশু ডান হাতের আঙুল ধরে হাটবে । পাশে বসে ঈদের নামাজ পড়বে । ভাবতে খুব ভালো লাগতো । স্বপ্নের মত যেন । শারমিন বলতো – আমি নিজ হাতে ওর গায়ে পোষাক পরিয়ে দেব, তুমি কিন্তু ভাগ বসাতে আসবে না ।
খালিদের জন্মের প্রথম বছরে বাড়িতে ঈদ করতে পেরেছেন ডাঃ বকুল । তখনো তাঁর পোস্টিং হয়নি কোথাও । কিন্তু এর পরের বছর থেকে –গত দুবছর ঈদ করতে হচ্ছে বাড়ির বাইরে । পোস্টিং যেখানে- বাড়ি থেকে প্রায় সাতশ কিলোমিটার দূরের এক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স । বাচ্চাটাকে নিয়ে ঈদ করা হয়নি গত বছরও । কিন্তু গতবছর সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি । এবার সে বুঝতে পারছে যে ‘বাপু’ নেই । সকাল থেকে তাই কাঁদছে । অনেক কষ্টে ডাঃ বকুলের বাবা, খালিদের দাদা তাকে থামিয়েছেন ।
ডাঃ বকুলের আব্বা তাঁকে বাপু বলে ডাকতেন ছোটবেলা থেকে । এখনো বলেন । সেখান থেকেই খালিদ শিখেছে ‘বাপু’ ।
তাকে যতই শেখানো হয়- ‘বাবা’ বলতে , সে ঘুরেফিরে বলে ‘বাপু’ ।
এখন আবার যুক্তি দেওয়া শিখেছে- দাদু যে তোমাকে বাপু বলে ডাকে ? আমিও ডাকবো ।
শুধু বাচ্চাটা কেন ? শারমিনেরও কি মন খারাপ নেই আজকে ? তারও তো অধিকার আছে , আশা আছে ঈদের দিনটা একসাথে কাটানোর । ঈদের পরদিন কোথাও ঘুরতে যাবার । বাবার বাড়ি- বোনদের বাড়িতে যাবার । বিয়ের মাত্র চার বছর হলো । শ্বশুর বাড়ি বলে হয়তো বাইরে হাসিখুশি ভাবটা ধরে রাখবে । কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে তারও ।
একটাই রক্ষা যে শারমিন নিজেও ডাক্তার । তাই সে ডাক্তারের জীবনটা বোঝে । আর তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুবই ভালো । সকাল বেলা শারমিন যখন ফোন করলো, বকুল ভেবেছিল ওকে সান্তনা দেবে । কিন্তু শারমিন নিজেই আগ বাড়িয়ে বকুলকে সান্তনা দিল । চিন্তা করো না । বাড়িতে আমরা সবাই মিলে ঈদ করছি – আমাদের নিয়ে ভেবো না । আর তাড়াতাড়ি চলে আসার চেষ্টা করো । আগেই টিকেট কেটে রাখবে ।
শারমিন এই ব্যাপারগুলো খুব ভালো বোঝে । বকুল মোটামুটিভাবে ইমোশনাল । শারমিন বুঝেছিল- যদি তাঁর কথায় একটু কষ্ট প্রকাশ পায় – বকুল হয়তো কেঁদেই ফেলবে । আর তাঁর কষ্ট তো বকুলের চেয়ে কম । বকুল কত দূরে একা , কিন্তু বাড়িতে তো বকুল ছাড়া আর সবার সাথে ঈদ করতে পারছে তারা । খালিদকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সান্তনা দিয়ে রাখতে পারলেই হলো ।
ঈদের তিনদিন পরে বকুলের ছুটি । এবার দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে তারা । বিয়ের প্রথম বছর যা একটু ঘোরাঘুরি করেছে । গত দুই বছর ছোট বাচ্চা , তাই দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি । হাসপাতালে ডাঃ করিম ভাইকে ম্যানেজ করে ছুটি একটু বেশি নিতে হবে । করিম ভাই এখন বকুলের কিছু ডিউটি করে দেবেন , পরে বকুল করিম ভাইয়ের ডিউটি করে দেবে ।
বিয়েটা হঠাৎ করেই হয়ে গিয়েছিল । বকুল ইন্টার্ণশিপ শেষ করে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়াশোনা করছে । বেকার । মাঝে মাঝে ক্লিনিকে ডিউটি করে পেট চালানোর মত কিছু রোজগার করে । একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে শারমিনের সাথে পরিচয় । শারমিন তখন ফিফথ ইয়ারে । বকুল শারমিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল । তাঁর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । বিষয়টা খেয়াল করে বন্ধু মাসুদ মাথায় চাট্টি মেরে বলে – কিরে দোস্ত , তুই তো কারো দিকে তাকাস না । আজ কী হলো ? লাগবে নাকি ?
শারমিন মাসুদের আত্মীয় । ওদিকে শারমিনও নাকি লুকিয়ে বকুলকে দেখে নিয়েছিল । মাসুদ যেদিন বকুলের পক্ষ হয়ে শারমিনদের বাসায় হাওয়া বুঝতে গেল- শারমিন নিজেই আগ বাড়িয়ে বকুল সম্পর্কে খোজখবর নেয়া শুরু করলো । ভাইজান- আপনার বন্ধুর খবর কি ?
ওমা ! এ যে দেখি চুম্বকের দুই প্রান্ত । বাহ বাহ । শেষে যা হবার তাই হলো । ছ’মাসের মাথায় বিয়েটা হয়ে গেল ওদের ।
‘আসতে পারি ?’ একটা নারীকন্ঠ দরজাটা একটু ঠেলে জিজ্ঞেস করলো ।
‘হ্যা হ্যা আসুন’ । ‘এখন কী অবস্থা খুকুমনির ?’
স্বামী স্ত্রী দুজনে রুমে প্রবেশ করলেন । শিক্ষক দম্পতি । দুজনেই কলেজের প্রভাষক । বাচ্চার বয়স আড়াই বছর । ঈদের নামাজের পর হঠাৎ করেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বাচ্চার । এজমা এক্সাজারবেশন । তাড়াতাড়ি তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁরা । শংকায় ছিলেন , হাসপাতালে আদৌ ডাক্তার আছেন কিনা । কিন্তু হাসপাতালে এসে তাঁরা দুজনেই খুব সন্তুষ্ট । শুধু সন্তুষ্ট বলাটা যথেষ্ট না- বলা উচিৎ ‘বিমোহিত’ । ডাঃ বকুল খুবই আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা দিলেন । ডাক্তারের রুমে আসার আগে ওরা নিজেরা বলাবলি করছিলেন- ডাঃ বকুলের মনটা ঠিক বকুল ফুলের মত স্নিগ্ধ । তবে একটু মলিন লাগছে মুখটা । নামটা তাঁরা জেনে নিয়েছেন নার্সের কাছে ।
মেয়েটা এখন ভালো । মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে চান তাঁরা । ডাক্তারের সাথে পরামর্শ এবং ডাক্তারকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য দেখা করতে এসেছেন ।
‘ভাই, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই । আপনার মুখটা মলিন দেখাচ্ছে । আপনার বোধহয় মন খারাপ । সকালে সেমাইও বোধহয় খাননি’ ।
বাচ্চাটির বাবা বললেন ।
ডাঃ বকুল কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না । সকাল থেকে আসলেই তিনি কিছু খাননি । ভালো লাগছে না । মনের এই অবস্থায় কি মুখে কিছু রোচে ?
এই দম্পতিকে দেখে খুব ভালো মানুষ মনে হচ্ছে । অনেকেই তো চিকিৎসা নিয়ে চলে যায় । কৃতজ্ঞতাবোধ খুব কম লোকেরই থাকে । এরা তাদেরই একজন । অনেক আন্তরিকতা নিয়েই জিজ্ঞাসা করেছে কথাটা । চোখেমুখে বিনয় ও কৃতজ্ঞভাব স্পষ্ট ।
ডাঃ বকুল কাঁপা গলায় শুধু বললেন , বাড়িতে আমারও একটা বাচ্চা আছে । তিন বছর বয়স ।
বাচ্চাটির মায়ের চোখ কেন যেন ছলছল করে উঠল । এক ফোটা অশ্রু চোখের কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এল । মেয়েরা এমনিতেই বেশি ইমোশনাল হয় । বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে কথা উঠলে তারা আর সহ্য করতে পারে না ।
‘ভাই, ভাবীর মোবাইল নাম্বারটা কি একটু দেবেন । আমি উনার সাথে কথা বলবো’ ।
মোবাইলে শারমিনের সাথে কথা বলছিল বাচ্চাটির মা । এমনভাবে কথা বলতে লাগলো যেন তারা কতদিনের পরিচিত বান্ধবী । বেশ গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা । কলেজে পড়ায় তো । একটা কথা ডাঃ বকুলের কানে আটকে গেল । বাচ্চাটির প্রভাষিকা মা শারমিনকে বলছিলেন- ‘ভাবী, এই ঈদের দিনে যদি কাউকে নিয়ে মানবতার জয়গান গাওয়া যায় – সে আপনার স্বামী । একজন ডাক্তার’ ।
বিষন্ন মনে এই কথাটা খুব ভালো লাগলো ডাঃ বকুলের । কষ্টটা যেন কমে আসতে লাগলো । আসলেই, ঈদের দিনে যাদেরকে নিয়ে মানবতার জয়গান গাওয়া যায়- তাদের একটা লিস্ট যদি করা হয় – সবার উপরে লিখতে হবে ‘ডাক্তার’ ।
নিশ্চয়ই শারমিনেরও খুব ভালো লেগেছে কথাটা ! খালিদ যখন বুঝতে শিখবে, তারও ভালো লাগবে হয়তো ।
বিষয়: সাহিত্য
১৬২৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন