একটি অমানবিক গল্প

লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ২৮ মে, ২০১৪, ০৮:১৬:০২ রাত

কানাকানি হতে হতে খবরটা জোবায়দার কানে এসে যখন পৌঁছলো , তখন জোবায়দা বাস করছিল কল্পনার জগতে । বান্ধবীরা গাইছিল বিয়ের গীত । কথায় কথায় নানান রসিকতা আর ফোড়ন কাটা চলছিল সমানতালে । কিন্তু সেদিকে কান ছিলনা জোবায়দার । সে ভাবছিলো কেমন হবে মারুফের আজকের সাজ । বর হিসেবে মারুফকে কেমন লাগবে । কেমন হবে প্রথম চোখাচোখি , প্রথম হাত ধরার অনুভূতি । কী কথা হবে আজ ? ভাবনার সাথে সাথে ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছিল জোবায়দার মুখের মানচিত্র । খুব বেশি সাজেনি জোবায়দা । আজকাল যেভাবে পার্লারে কণে সাজানো হয় , তার কিছুই হয়নি । বান্ধবীরা তবু কম সাজায়নি । একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল জোবায়দা , জেরিনটাই জোর করে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল । 'দ্যাখ্‌ রাজকন্যা , নিজের রুপ দ্যাখ্‌ । আমি ছেলে হলে তোরে কিছুতেই হাতছাড়া করতাম না কিন্তু !'

জোবায়দা নিজেও কম অবাক হয়নি । বান্ধবীগুলো যেন এক একটা জিনিয়াস বিউটিশিয়ান ।

অতীত ভবিষ্যত্‍ সবকিছু যেন তার মনে একসাথে খেলা করছিলো । এই ঘর , বাবা মা , বুবুর নেওটা ছোট ভাইটা , সবাইকে আজ ছেড়ে যেতে হবে । জানে , সব মেয়েদেরই এমন করতে হয় । দাদী , নানী , মা সবাইকে একদিন শৈশব কৈশোরের চিরআপন পরিবেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল । তবুও ভেতরে একটা কান্নার দলা পাকিয়ে উঠতে চাচ্ছে যেন । জোবায়দা সেটাকে জোর করে ঠেলে ভেতরে পাঠাচ্ছে বারবার । মারুফের মুখটা চোখের সামনে ধরে রাখার চেষ্টা করছে । যেন চিনে নিতে চাচ্ছে মারুফের মুখ ও কপালের প্রতিটি রেখা ।

দেখাদেখির দিন লজ্জা সংকোচ না করে মারুফের মুখটা ভালো করেই দেখে নিয়েছে সে । গোলগাল হাসিহাসি মুখ । হালকা দাড়ি আছে পুরোটা জুড়ে । কথার মধ্যে একটা দৃঢ়তা আছে , বেশ ধীর স্থির । কোনকিছুতে তাড়াহুড়ো নেই । তবে একটু জড়তা ছিল । যেসব ছেলের মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যেস নেই তাদের এমন একটা জড়তা থাকে । আর তাছাড়া বিয়ের দেখাদেখি । এ তো এক বড় ডিসিশানের ব্যাপার । জড়তা থাকতেই পারে । জোবায়দার ভালই লেগেছে । সবচেয়ে বড় কথা , চেহারায় একটা সরলতা ছিল মারুফের । এটা সবার থাকেনা ।

আরো খোঁজখবর আগেই জেনেছিল । ছেলে নামাজী , ভার্সিটি ছাত্র হলেও কুরআন হাদীসের ভালো জ্ঞান রাখে । দেখাদেখির দিনেও জোবায়দার কয়েকটি প্রশ্নের এমন ব্যাখ্যা দিয়েছে - সত্যি বলতে কি , জোবায়দা জীবন নিয়ে ওভাবে আগে ভাবেনি ।

একটা সাহসী ছেলেকে নিজের স্বামী হিসেবে সবসময় কামনা করেছে জোবায়দা । অবশ্য সব মেয়েই মনে হয় তা-ই চায় । পুরুষ যদি হয় ভীতুর ডিম , তাহলে কেমন করে হবে ? কেউ কেউ অবশ্য ভ্যাবলা ছেলেই পছন্দ করে , যেমন জেরিন । ওর কথা হলো স্বামীকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে । এমন স্বামী সে চায়- বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মত । করে নাকো ফোঁসফাস , মারে নাকো ঢুসঢাস । উল্টাপাল্টা দেখলেই জেরিন ওর স্বামীকে ‘তেড়ে মেরে ডান্ডা , করে দেবে ঠান্ডা’ । একথা বলতে বলতে জেরিন প্রায়ই হেসে গড়িয়ে পড়ে ।

জোবায়দা সেরকম না ।

মারুফ যে সাহসী সেটা বোঝা যায় । সে ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি সচেতন । রাজনীতি করেছে । সরকারী দলের লুতুপুতু সুবিধাবাদী রাজনীতি না , বিরোধী রাজনীতি । ইসলাম পন্থি দল , এদের আচার ব্যবহারের মাধুর্য আর সততা সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয় । কিন্তু বিরোধী দলের রাজনীতি মানে সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা । সে কি যা তা ব্যাপার ? পুলিশ বাহিনী , আদালত সবকিছুকে সরকার ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করার জন্য । মারুফের নামেও নাকি মামলা আছে । পলিটিকাল মামলা । মিথ্যা মামলা । জোবায়দা এ নিয়ে ভাবেনা । সত্য কথা বলে নবী রসুলরা যেখানে মিথ্যা অভিযোগ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন , সেখানে এই সময়ে তো এমনটা হবেই । না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক ।

দেখাদেখির দিন কথাবার্তায় যা মনে হয়েছে , মানসিকতার মিল রয়েছে বেশ । মানসিকতার মিল , ভালোবাসার সাথে সহযোগিতা সহমর্মিতার মনোভাব খুব বেশি দরকার যৌথ জীবনের পথচলায় । জোবায়দা এদিক থেকে পুরোপুরি একমত । সে জানে , দুজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা । দুজনের সবকিছু কীকরে দুজনেরই পছন্দ হবে ? কিছুনা কিছু তো অপছন্দ থাকবেই । সব ব্যাপারেই দুজনের মতামত এক হবে কীকরে ? এটাতো সম্ভব নয় । একই মায়ের দু সন্তানও একরকম হয়না । সেজন্য মেনে নিতে হবে । ছাড় দিতে হবে । মারুফ কতটুকু ছাড় দেয়ার মানসিকতা রাখে ? অবশ্য সেদিনের কথায় মনে হয়েছে , মারুফও এমন চিন্তা করে । তবু বলা যায় না , কেমন হবে আগামীর দিনগুলো । সারাজীবন একসাথে থেকেও হয়তো একজন মানুষকে পুরোপুরি চেনা যায়না । বাবা অথবা মা তাঁদের সন্তানকে অনেক ভালো বোঝেন । কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে কি পারেন ? পারেন না । দেখা যাক । সময়ই সবকিছু বলে দেবে ।

বিক্ষিপ্ত চিন্তায় মাঝে মাঝেই ছেদ পড়ছিলো । বদমাশ বান্ধবীগুলোর চিমটি কাটার বদভ্যাস । চিমটি কেটেই ক্ষান্ত হয়না । নানান কথা ওদের । আহারে , রাজপুত্তুরের কথা ভেবে ভেবে দোস্তটার বুক ফেটে যাচ্ছেরে । এত দেরি করছে কেন হ্যা ? সখীর যে আর তর সইছে না রে !

তারপর অট্টহাসি । কেউ একজন বলে , চল্‌ রাজকন্যাকে বন্দী করে রাখি । রাজপুত্তুরের হাতে এত সহজে তুলে দেবো ? হাউ মাউ খাউ ।

আরেকজন বলে , সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ঠিকমত লুকিয়ে রাখিস । সহজে যেন খুঁজে না পায় ! হাউ মাউ খাউ ।

ওদের এত দুষ্টুমি ভালো যেমন লাগছিল , মন খারাপও লাগছিল । আহা , এরা কত আত্মার আত্মীয় । এদের সাথে আর যখন তখন দেখা হবেনা । ছেলেরা বিয়ের পরও বন্ধু হারায় না । কিন্তু মেয়েদের হারাতে হয় । বিয়ের পর কে কোথায় যায় , কতদিন পর কারো সাথে দেখা হয় , কারো সাথে হয়তো আর কোনদিনই দেখা হয়না । এরা যে এখন এত হাসি তামাশা করছে , এরা কি বোঝেনা ? বোঝে । জোবায়দা চলে গেলে এই ঠাট্টা তামাশা করা বান্ধবীরাই একা একা কেঁদে বালিশ ভেজাবে । প্রাণের বান্ধবীকে নতুন জীবনে সাহস দিতে হবে , এই ভেবে ওরা সব কষ্টকে বুকের ভেতর ছাইচাপা দিয়ে অভিনয় করে যাচ্ছে । যতক্ষণ ওরা পাশে আছে , সত্যিই সাহস লাগছে জোবায়দার । মারুফ কি পারবে এদের মত বন্ধু হতে ?

পাঁচটা পেরিয়ে গেছে আধাঘন্টা আগে । পাঁচটার মধ্যেই বরযাত্রী আসার কথা ।

কিরে , বর এখনো আসেনা ক্যান ? পদব্রজে আসছে নাকি ?

নাহ , বোধহয় গাধার পিঠে চড়ে আসছে !

এলোমেলো আলাপের মাঝে জেরিন উঠে যায় । দেখি খবর নিয়া আসি , রাজকন্যাকে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে !

একটু পরে শুকনো মুখে জেরিন এসে মুন্নুকে ডেকে নিয়ে যায় । বাইরে বসে ওরা জোবায়দার বাবার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করে । কীভাবে খবরটা জোবায়দাকে বলবে ? জোবায়দা এমনিতে শক্ত মেয়ে , কিন্তু এটা সইতে পারবে তো ? একটা মেয়ের জীবনে এমন সময় কি বারবার আসে ?

জোবায়দার বাবা , জেরিন , মুন্নু তিনজনে ঘরে এসে ঢোকেন । সবাই চুপ হয়ে যায় । আংকেলের মুখ গম্ভীর । জেরিন এবং মুন্নুর চোখ ছলছল করছে । সবাই বুঝলো , কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । জোবায়দার বুকটাও ধ্বক করে উঠলো । কী হলো ?

জোবায়দার বাবা ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন , মা , বিয়েতে আসার পথে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ মারুফকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে । সবই আল্লাহর ইচ্ছা মা । ধৈর্য রাখ্‌ । আল্লাহর ওপর ভরসা হারিও না ।

জোবায়দা স্তব্ধ হয়ে শুনলো । জেরিন এবং মুন্নু আর সামলাতে পারলো না । অনেকক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ছিল । হু হু করে কেঁদে উঠলো দুজনেই ।

জোবায়দা ধীর পায়ে উঠে গেল । মারুফের মুখটা একবার কল্পনা করলো , বরের পোষাকে কেমন আছে মানুষটা পুলিশ কাস্টডিতে ?

মারুফের জন্য ওর ভালোবাসা বেড়ে গেছে অনেক । যতদিন লাগে , মারুফের জন্য অপেক্ষা করবে জোবায়দা । বান্ধবীরা কাঁদছে , কাঁদুক । এই অবস্থায় জোবায়দার অনুভূতি ওরা ছাড়া আর কে ভালো বুঝবে ?

ওয়াক্ত হয়েছে । ওযু করে আসরের নামায পড়বে । বুক ফেঁটে কান্না আসছে ওরও । সেও কাঁদবে , কিন্তু এখানে না । নামাযে দাঁড়িয়ে কাঁদবে সে । এই জুলুমের , এই অমানবিকতার বিচার চাইবে আল্লাহর কাছে ।

টীকাঃ

সেদিন ফেসবুকে হঠাৎ চোখ পড়ে এক বোনের স্ট্যাটাসে । তাঁর বিয়ে হবার কথা ছিল শুক্রবারে । আসার পথে বরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ।

এ কেমন অমানবিকতার চর্চা চলছে দেশে ?

জানি, এইসব ঘটনা হয়তো লেখা থাকবেনা ইতিহাসে । অন্তত লেখা থাকুক ক্ষুদ্র একজন সাধারণ মানুষের ডায়েরীতে । থাকুক খুব সাধারণ একটি গল্প হয়ে । এই নষ্ট সময়ে , এক ভ্রষ্ট রাষ্ট্রের অমানবিক গল্প ।

বিষয়: বিবিধ

১২৭৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

227640
২৮ মে ২০১৪ রাত ০৮:৪৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : এত এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। অমানবিক কি মানবিক এই বিবেচনা বাংলাদেশের সরকার এবং এর অঙ্গগুলি করেনা। গর্ভবতি নারি কে দাঁড় করিয়ে রাখে। চোখের সামনে দেখেছি অপারেশনের রোগিকে নামিয়ে ট্যাক্সি চেক করছে।
227660
২৮ মে ২০১৪ রাত ০৯:৫১
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : ভালো লাগলো পিলাচ
227668
২৮ মে ২০১৪ রাত ০৯:৫৮
ভিশু লিখেছেন : অমানবিক সরকারের দেশে আবার অসম্ভব কি আর আছে?
227673
২৮ মে ২০১৪ রাত ১০:০৫
বুঝিনা লিখেছেন : এই জুলুমের , এই অমানবিকতার বিচার চাইব আল্লাহর কাছে ।
227706
২৮ মে ২০১৪ রাত ১০:৪০
বিন হারুন লিখেছেন : আল্লাহ'ই উত্তম ফয়সালাকারী.
227783
২৯ মে ২০১৪ সকাল ০৫:২৩
চেয়ারম্যান লিখেছেন : Surprised Surprised Crying Crying Crying I Don't Want To See I Don't Want To See
227825
২৯ মে ২০১৪ সকাল ১০:৫০
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : কিছু বলার নেই, আরও অনেক কিছুই হচ্ছে যা আরও অমানবিক, সেখানেও কিছু করার নেই।
227853
২৯ মে ২০১৪ সকাল ১১:৩৮
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : পুলিশগুলি আর মানুষ হলোনা।
;Winking ;Winking

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File