তোমরা যারা 'ও ডাক্তার' গান গাও...(৭)
লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ০৭ মার্চ, ২০১৪, ১১:০৩:৫৯ রাত
ভুল চিকিত্সায় রোগীর মৃত্যু : ডাক্তারকে পিটিয়েছে জনতা
এরকম খবর আমরা প্রায়ই দেখি পত্রিকায় । ব্যাপারটা ভালো করে খেয়াল করুন । রোগীরা চিকিত্সা পেয়ে সুস্থ হবে এটাই সবার কাম্য । কিন্তু সবসময় যে সুস্থ হবেই এরতো কোন নিশ্চয়তা নেই । যদি তাই হতো তাহলে তো কোন ডাক্তার কখনোই মারা যেতনা !
রোগী যে সমস্যা নিয়েই আসুক মেডিকেল ট্রিটমেন্ট এর প্রথম ধাপই হলো জীবন বাঁচানো । পরে অন্য চিকিত্সা । রোগীর চিকিত্সা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর । রোগী কোন অবস্থায় কতক্ষণ পরে এলো Early নাকি Late, সমস্যার প্রকৃতি Acute না Chronic , ঠিকমত সমস্যা বলা (Proper History) , যে হাসপাতালে এসেছে তাতে লোকবল , অবকাঠামো , প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জরুরী ওষুধপত্রের মজুদ ইত্যাদি সহ আরো অনেক বিষয়ের ওপর । Patient compliance ও একটি গুরুত্বপুর্ণ অংশ । রোগীর আর্থিক সঙ্গতিও নজরে আনতে হয় ।
এরমধ্যে ডাক্তারের জ্ঞান- দক্ষতা- আচরণ কিংবা অবহেলা একটি অংশ মাত্র । অন্য যে ফ্যাক্টরগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো কোনটাই কিন্তু ডাক্তারের আওতার মধ্যে নেই । কিছু রোগীর আওতায় , কিছু পরিচালনাকারি প্রশাসনের কাজ । ডাক্তারের কাজ শুধু বিদ্যমান Condition এর আওতায় চিকিত্সা করা - যতটুকু সম্ভব সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো । কিন্তু এখন পর্যন্ত পত্রিকায় কখনো দেখলাম না যে লোকজন হাসপাতালের অবকাঠামো উন্নয়নের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছে ! কিংবা কোন কর্তাব্যক্তিকে মেরেছে ! তারা পারে শুধু কর্তব্যরত ডাক্তারকে পেটাতে । আর পত্রিকার পাতায় এই সংবাদ এমনভাবে দেয়া হয় যাতে একজন মানুষ পড়ার সাথে সাথে নিজের অজান্তে বুঝে ফেলে 'উচিত্ কাজ হয়েছে । সব দোষ ঐ ব্যাটা ডাক্তারের !' এ যেন এক পৈশাচিক আনন্দ ! ডাক্তারদের নিরাপত্তার পক্ষে কোন পত্রিকার সম্পাদকীয়ও এখন পর্যন্ত দেখিনি ।
ডাক্তারের কর্তব্যে অবহেলা কিংবা কোন Misconduct এর জন্য রয়েছে আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ ।এতে ডাক্তারের নিবন্ধন বাতিল হতে পারে , জেলও হতে পারে । (ডাক্তারিপেশার আইনগত দিক শিক্ষার জন্য মেডিকেল কারিকুলামে ফরেনসিক মেডিসিন নামে একটি সাবজেক্ট ২ বছর পড়ানো হয় । তাতে মেডিকেল ইথিকস সহ আইনগত বিভিন্ন দিক পড়ানো হয় ।) কিন্তু সেইটা কেউ করেছে বলে শুনিনি , সবাই ডাক্তারকে পিটিয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে । স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের নিরাপত্তার দিকটা এখন ডাক্তারদের কাছে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের প্রতি ডাক্তারদের সহিংস আচরণ এর একটা নমুনা সূচনা বলা যায় ।
শিরোনামটা আবার দেখুন । 'ভুল চিকিত্সায় রোগীর মৃত্যু' ! এভাবেই সংবাদের শিরোনাম করা হয় ।চিকিত্সা ভুল ছিল এটা রোগীর আত্নীয় কীভাবে বুঝলেন ? সাংবাদিক কীভাবে বুঝলেন ? চিকিত্সায় ভুল ছিল কিনা এটা বলতে পারবেন ঐ বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক । কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো চিকিত্সাবিজ্ঞানের এক লাইনও না পড়েই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক এবং বিচারকের ভূমিকা পালন করেন !
Calculated risk বলে একটা কথা আছে । মেডিকেল টার্ম হিসেবে আমরা Prognosis শব্দটি বেশি ব্যবহার করি । লাখ লাখ রোগীর ওপর দীর্ঘমেয়াদী জরিপ ও গবেষণা চালিয়ে চিকিত্সাবিজ্ঞানীরা এগুলো বের করেছেন । রোগীর সার্বিক অবস্থা দেখে অনেক সময় ডাক্তার বলে দিতে পারেন , রোগী কতক্ষণ বাঁচবে !
ডাক্তারের প্রতি অভিযোগ থাকলে তাঁর সাথে কথা বলা যেতে পারে , আদালতে বিচার হতে পারে । সেখানেই প্রমাণিত হবে চিকিত্সায় 'অবহেলা' বা 'ভুল' ছিল কিনা । কিন্তু ডাক্তার পেটানো আর নিজেই 'চিকিত্সায় ভুল' হওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে , ডাক্তারকে কসাই গালি দিয়ে বিকৃত পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করতে থাকলে আখেরে এটা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবেনা । (সাংবাদিক ভাইদের জন্য যে মঙ্গল হবেনা সেটাতো ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে নাকি!)
একদিন পত্রিকায় দেখলাম আমাদের চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন ওয়ার্ড নিয়ে একটা রিপোর্ট । সম্ভবত প্রথম আলো তে । তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই ।
শিরোনামটা এরকম 'চমেক হাসপাতালের বারান্দায় রোগীদের দুর্ভোগঃ পরীক্ষার অজুহাত !'
মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে এমনিই চাপ বেশি থাকে । স্বাভাবিক সময়েই অনেক রোগী বেড পায়না । অতিরিক্তদেরকে তো আর বিনা চিকিত্সা ঘাড় ধরে বের করে দেয়া যায়না ! তাদের স্থান দেয়া হয় 'X' বেডে । অর্থাত্ এক্সটেনসনে- ফাঁকা মেঝেতে অথবা বারান্দায় । তো ঐদিন প্রফ অথবা এমডি পরীক্ষা চলছিল । বারান্দায় তো আগে থেকেই রোগী ছিল , পরীক্ষার জন্য আরো কয়েকজন এক্সটেনসন বেডের রোগীকে বারান্দায় পাঠাতে হয়েছিল । এমন সময় মহানহৃদয় সাংবাদিক মহোদয় উপস্থিত । এই অবস্থা দেখে তার অন্তর কেঁদে উঠল । তিনি দুএকজন রোগীর সাথে কথা বললেন । এরপর ক্ষিপ্ত হলেন । 'ব্যাটা ডাক্তাররা কসাই , অসুস্থ মানুষগুলোকে কত কষ্ট দিচ্ছে !' এরপর তিনি তার অগ্নিঝরা কলম দিয়ে লিখে দিলেন পত্রিকায় । শিরোনামটা আগেই উল্লেখ করেছি ।
বলাবাহুল্য , তিনি সব দায় মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান বেচারা এফসিপিস এমডি পিএইচডি ডিগ্রীধারী কসাই 'ডাক্তারের' ওপর চাপিয়েছিলেন !
সব দোষ ডাক্তারদের । ওদের আবার কিসের এমডি পরীক্ষা ? যত্তসব ফাউল ! পরীক্ষার নামে রোগীদের কষ্ট দেয়া ! বসার দরকার হলে ডাক্তার বারান্দায় বসবে , পরীক্ষা বারান্দায় হবে ! শুনেছি ডাক্তারদের বাড়িতে নাকি নরম বিছানা আছে । সব রক্তচোষা , কেন ওদের বাসায় বিছানা থাকবে ? ওগুলো সব হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে ।
একবার একটি পত্রিকায় খবর দিয়েছে , ঈদ উপলক্ষে গতকাল শনিবার সরকারি ছুটি থাকা সত্বেও 'বিশেষ ব্যবস্থায়' খোলা রাখা হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ বিভাগ !
বেকুব আর কাকে বলে ! পত্রিকার নামটা শুনতে মনচায় ? তাহলে শুনুন , আপনারই প্রিয় পত্রিকা দৈনিক....। থাক , ওতে আর কাজ নেই ।
আমি পালাই । মহানহৃদয় সাংবাদিক জানলে নিশ্চিত আমার বিরুদ্ধে ভুল চিকিত্সার অভিযোগ তুলবেন ! কসাই-রক্তচোষা , সেতো বলবেনই !
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৩ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মানুষ চিকিৎসা বাবদ খরচ করার সামর্থ কিংবা কয় টাকা ভাতা পাই সে সব চিন্তু না করে আপনারা যখন আমাদের চিকিৎসার নামে আমাদের জিম্মি করে সাধ্যর বাইরে ফি নেন। তখন আমরা এই অবিচারের প্রতিবাদ সরূপ ও ডাক্তার গান শুনি আর মনকে মিছে মিছি মনকে হালকা করি। ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটি নোট লিখার জন্য নিন্দুক নয়, সমালোচক ইউথ শুভকাঙ্খি হতে চাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন