সরকারি হাসপাতালে গণভোগান্তি - সব দায় ডাক্তারের ?
লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ০২ মার্চ, ২০১৪, ০৫:০৩:০৩ বিকাল
‘সরকারি হাসপাতালে গণভোগান্তি’ শিরোনামে দৈনিক নয়া দিগন্ত আজ লিড নিউজ করেছে । এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল নিয়ে করেছে আলাদা আলাদা নিউজ । এবং যথারীতি সব অব্যবস্থাপনা , অপরিচ্ছন্নতার দায় বর্তানো হয়েছে ডাক্তারদের ওপর । সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে , জনগনের স্বার্থে যেকোন অনিয়ম নিয়ে নিউজ করা সংবাদপত্রের দায়িত্ব । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের সাংবাদিক ভাইদের দায়িত্বজ্ঞান যৎসামান্য । যে বিষয়ে নিউজ করবেন সে বিষয়ে তারা বিন্দুমাত্র পড়াশোনা করারও দরকার মনে করেন না । দায়িত্বে অবহেলার নিউজ করেন , অথচ জানেনই না অধ্যাপকের দায়িত্ব কী, রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব কী । সংবাদটির বিশেষ কিছু অংশের দিকে নজর দেই-
১। ‘গণভোগান্তির অপর নাম সরকারি হাসপাতাল। যেখানে নামমাত্র মূল্যে উন্নত স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার, সেখানে বিনামূল্যে মিলে হয়রানি আর সীমাহীন অবহেলা। চিকিৎসার নামে নৈরাজ্য সর্বত্র। সেবা প্রদানের মানসিকতা আর পেশাদারিত্বের পরিবর্তে আগ্রাসন চলছে অসাধুতা ও দুর্নীতির। মানুষের দুরবস্থাকে পুঁজি করে একশ্রেণীর চিকিৎসক এবং সরকারি কর্মচারীরা জাঁকিয়ে বসেছে অসৎ বাণিজ্যে’ ।
এখানে প্রথমেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হয়েছে – সরকারি হাসপাতালে মেলে ‘সীমাহীন অবহেলা’ । আর এর দায় প্রথমত চিকিৎসকের ওপরেই বর্তানো হয়েছে । একশ্রেণীর চিকিৎসক মানে কী ?
২।
'রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবার দশা বেহাল। হাসপাতালগুলোই যেন অধিক রোগাক্রান্ত। রোগী হয়রানির ব্যাধি সবখানে। দালাল আর মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের সাথে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসকদের অপেশাদারি বাণিজ্যিক মনোভাব। সরকারি চাকুরে চিকিৎসকদের ‘প্রাইভেট প্র্যাক্টিস’ (ব্যক্তিগত অনুশীলন) গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেই পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কোনো নীতিমালা বা আইনের অনুশাসনই তাদের দমাতে পারছে না। নেই সরকারের মনিটরিং-ব্যবস্থাও'।
- এখানে ডাক্তারদের চেম্বার প্রাকটিসকেই দায়ী করা হয়েছে গোটা স্বাস্থ্যবিভাগের পঙ্গুত্বের কারণ হিসেবে । আজব ব্যাপার । অথচ আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি এই সাংবাদিক ভ্রাতৃগণ নিজেরা অসুস্থ হলে ঠিকই অধ্যাপক স্যারের চেম্বারে যান । সরকারি হাসপাতালে পদধূলি দেন শুধু একটি ‘সংবাদ’ এর প্রয়োজনে ।
৩।
‘বেতনভুক সরকারি চিকিৎসকদের শতভাগই ব্যস্ত ব্যক্তিগত অনুশীলনে। মূলত তাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই চলছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রাইভেট হাসপাতাল, কিনিক এবং ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের ৮০ ভাগের অবস্থানই সরকারি হাসপাতালগুলোর আশপাশে। এসব তথাকথিত স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকও সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। ফলে সাধারণ রোগীরা সুলভে সরকারি চিকিৎসাসেবার পরিবর্তে পান চরম অবহেলা ও দুর্ব্যবহার' ।
- সরকার কি ২৪ ঘন্টার বেতন দেয় নাকি ? কেউ যদি তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন শেষে অতিরিক্ত শ্রম দিয়ে রোগী দেখে সেটাতেও দোষ খোঁজা হয়েছে । ডাক্তারদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই চলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ? অথচ বাস্তবে বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতালের মালিক ব্যবসায়ীরা । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তাররা যে চেম্বারে বসেন সেটাও ভাড়া ।
৪।
'সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসক রোগীর সাথে দুই মিনিট কথা বলার ফুরসৎ পান না তিনিই প্রাইভেট হাসপাতালে নিজের চেম্বারে বসে একই রোগীর সাথে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। ক’ঘণ্টা আগের গোমরামুখো ডাক্তার সাহেব সন্ধ্যার পর নিজের চেম্বারে হাসি দিয়েই রোগীর অর্ধেক রোগ সারিয়ে তুলেন। কেননা চিকিৎসকের ব্যবহারে এ বিস্তর ফারাকের নেপথ্যে রয়েছে টাকা। একজন চিকিৎসক এক সন্ধ্যায় ব্যক্তিগত চেম্বারে বসে রোগী দেখে যে টাকা উপার্জন করেন, তা সরকারি হাসপাতালে তার চাকরির মাসিক বেতনের চেয়েও বেশি' ।
- ডাক্তার ভালো ব্যবহার করেন সেটাও নাকি দোষ ! সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার যদি রোগীর সাথে খোশগল্প করেন তাহলে বেশিরভাগ রোগীকেই চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যেতে হবে । সরকারি হাসপাতালে একজন ডাক্তারকে যখন ঘন্টায় গড়ে ৪০-৫০ জন রোগী দেখতে হয় ।
৫।
রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোতে দেশের সবচেয়ে আধুনিক ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা উপকরণ থাকলেও পরিচালনার অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে সেগুলোর ব্যবহার হচ্ছে না। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা এসব মেশিন বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। টেকনিশিয়ানের অভাব দেখিয়ে একপর্যায়ে সেগুলোকেই বাতিল মাল হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতালে। এসবের নেপথ্যে রয়েছে ত্রিমুখী বাণিজ্য। প্রথমত, মেশিন ক্রয়ের সময় ওভার ভ্যালুতে কেনা হচ্ছে। অতিরিক্ত টাকা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। দ্বিতীয়ত, মেশিন চালুর পর টেককিনিশিয়ানের অভাব দেখিয়ে সেগুলো ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে রোগীরা মাত্র ২০০ টাকা ব্যয় করে যে পরীক্ষা করাতে পারতেন তা চিকিৎসকদের পছন্দের ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে করাচ্ছেন তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। এ ক্ষেত্রে কমিশন পাচ্ছেন চিকিৎসক। তৃতীয়ত, কোটি কোটি টাকা দামের মেশিনগুলো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিয়ে সেখান থেকেও মোটা দাগের কমিশন নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ রোগী ভাগানো থেকে শুরু করে যন্ত্রাংশ বিক্রি পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াতেই জড়িত সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সিন্ডিকেট।
- এই ব্যাপারে মন্তব্য করাটা বাহুল্য । সরকার টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয় না, সেটার দায়ও ডাক্তারের ! যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে সেটার দায়ও ডাক্তারের ! ঠিকাদার বেশি মূল্য দেখায় সেটার দায়ও ডাক্তারের ?
৬।
জানা যায়, ঢাকার প্রধান সরকারি হাসপাতাল ঢাকা মেডিক্যাল, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল (পিজি), বক্ষব্যাধি, ক্যান্সার হাসপাতালসহ সবক’টি হাসপাতালেই রোগীরা যাতে স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা না পান সেজন্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং দালাল নিয়োগ করা আছে। তারাই টিকিট কাটা থেকে শুরু করে ডাক্তার পর্যন্ত পৌঁছতে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সরকারি হাসপাতালে সিট না পাওয়া, চিকিৎসকদের অবহেলা, রোগ নিরূপণ না হওয়া, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ না পাওয়া, সময়মতো অপারেশন না হওয়া সবই একই সূত্রে গাথা। এতসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে চিকিৎসা পেতে গিয়ে রোগীর সুস্থতার পরিবর্তে তার স্বজনেরাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে বেশির ভাগ লোকই বাধ্য হয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন' ।
- সেই একই ব্যাপার । দালালরা দালালি করে ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সেটার দায়ও ডাক্তারের । অথচ প্রায় প্রতিমাসেই কোন না কোন সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের সাথে কর্মচারীদের এবং দালালদের মারামারি পর্যন্ত হচ্ছে । দালালদের হাত থেকে রোগীদের রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে ডাক্তাররাই ।
৭।
'সরকারি হাসপাতালে সব সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকার পরও রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অপর দিকে চিকিৎসকদের অবহেলা এবং অতিমাত্রায় পরীক্ষানির্ভরতার কারণে প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ফলে যাদের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে তারা চলে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশী নাগরিক চিকিৎসার জন্য ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। এতে চলে যাচ্ছে শতাধিক কোটি টাকা' ।
- রোগী বিদেশে চলে যাচ্ছে সেটার দায়ও ডাক্তারের ! আসলে তো সেটার দায় এই নির্বোধ সাংবাদিকদের । এই দেশের ডাক্তারের লেখা বই পড়ে ডাক্তারি শিখছে দেশ বিদেশের ছাত্ররা আর আমাদের নেতারা ‘স্বাস্থ্যপরীক্ষা’ করানোর জন্য যান সিঙ্গাপুর !
আরেকটি সংবাদে দেখলাম ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তাররা নাকি রোগীদের ধরে ধরে নির্যাতন করছেন ! রোগীরা ফ্লোরে থাকছে সেটার জন্যেও ডাক্তারদের দোষারোপ করা হয়েছে । হাসপাতাল অপরিস্কার, সেটার জন্যেও ডাক্তারদের দোষারোপ করা হয়েছে ।
আমিও দুইবছর সাংবাদিকতা করেছি । লাইব্রেরি থেকে বই কিনে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করেছি । যদিও বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করতে বই পড়া লাগেনা , একটু গুছিয়ে লিখতে পারলেই হয় । ভালো পড়াশোনা করা সাংবাদিকও আছেন , কিন্তু সেই সংখ্যাটা অত্যন্ত নগন্য । সাংবাদিক ভাইদের অনুরোধ করবো – দয়া করে হিংসার বশবর্তী হয়ে , আবেগতাড়িত হয়ে দেশের স্বাস্থ্যখাতের বারোটা বাজাবেন না । একমাত্র স্বাস্থ্যখাতেই আমরা মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করেছি । সরকারকে জিজ্ঞেস করুন , কেন ডাক্তারের পদ খালি । ইউএনওর জন্য গাড়ি , বাংলো, বডিগার্ড থাকলে গ্রামে পোস্টিং দেয়া ডাক্তারের জন্য ভাঙ্গা চেয়ার কেন ? সবার বয়স বাড়লে প্রমোশন হয়, ডাক্তারের হয়না কেন ? জানেনই না যে ডাক্তারকে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নাক ডুবিয়ে পড়াশোনা করতে হয় । আইন-শৃংখলা বাহিনীকে বলুন, কেন দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না । কেন হাসপাতালে মাস্তানরা এসে মাস্তানি করার সুযোগ পায় ? আর দয়া করে নিউজ করার আগে কোন একজন ডাক্তারের কাছে গিয়ে একটু জেনে নিবেন, কীভাবে কী হয় । একটু পড়াশোনা করে নিবেন ।
ডাক্তারদের মধ্যেও যে খারাপ লোক নেই তা বলছি না, কিন্তু ঢালাওভাবে সবকিছুর জন্য ডাক্তারদের দোষারোপ করবেন না । এতে দেশ ও জনগন ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
বিষয়: বিবিধ
৯৫৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন