লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা....
লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৭:৫৫:২৪ সন্ধ্যা
আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা
আসো যদি বাঁশবাগানে , আসো যদি বাঁশবাগানে
আবার হবে দেখা বন্ধু , আবার হবে দেখা ...
হঠাৎ বাঁশিতে টান পড়লে চমকে উঠলো রমিজ । সত্যি সত্যি বাঁশবাগানের একপাশে বসে বাঁশি বাজিয়ে একমনে গান গাইছিল সে । মাথা ঘুরিয়ে দেখে জুলেখা দাঁড়িয়ে আছে । চোখ মুখ অন্ধকার । হাত ধরে জুলেখাকে পাশে বসালো রমিজ ।
আশ্বিনের মাঝামাঝি । কোথাও কোন কাজ নেই । চারিদিকে অভাব অনটন । মঙ্গা শুরু হয়েছে । জুলেখার মুখ কেন অন্ধকার রমিজ জানে । আবার নিশ্চয়ই চাল ফুরিয়ে গেছে । কয়েকদিন থেকেই সামান্য একটু করে চাল দিয়ে চলছে । ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনে সামান্য একটু করে ভাত আর বেশি করে ভাতের ফেন খেয়েই কাটাচ্ছে গত তিন দিন । কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা , চার বছর বয়স , আর ছোট মেয়েটা দুই বছর বয়স । ওদের তো না খাইয়ে রাখা যায় না ।
এই গ্রামে গেরস্ত পরিবার বেশি নাই । দুই-তিনটি পরিবার স্বচ্ছল আছে । কিন্তু ওরাই বা কয়জনকে সাহায্য করবে ? তবু ওদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এরই মাঝে কয়েকবার চাল আনা হয়ে গেছে ।
কামলা খাটা ছাড়া কোন কাজ জানা নেই রমিজের । আর জানলেও বা কী হতো ? মুচি কামার কুমার সবার বাড়িতেই এখন অভাব অনটন ।
- কলিমের বাপ, এক বাটি চাউল আছে, রাইতটা কোনমতে চইলবে । কাইল কী খামো ?
জুলেখা বলেই ফেলে কথাটা ।
রমিজ বাঁশিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে । বাঁশবাগানের ভেতর একটা ঘুঘু ডাকছে । বুকটা হাহাকার করে ওঠে রমিজের ।
জুলেখাকে কত আশা দিয়েছিল । কোনদিন কষ্ট দেবে না । রক্ত পানি করে হলেও জুলেখার মুখের হাসি ধরে রাখবে । আজ কোথায় সেসব আশ্বাস ! এখন কী করবে রমিজ ?
পাশের গ্রামেই জুলেখার বাপের বাড়ি । সেসময় বাবার সাথে ক্ষেতে কাজ করতে যেত রমিজ । যাওয়া আসার পথে চোখ পড়ে জুলেখার ওপর । জুলেখাও কেন যেন তাকিয়ে থাকতো রমিজের দিকে । পড়ন্ত বিকেলে কাজ শেষে ফেরার পথে দরাজ গলায় গান গাইতো রমিজ । আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
জুলেখার ছোটবোন একদিন রমিজকে ডেকে বলে – ভাইজান , বুবু তোমাক ডাকায় ।
সেই থেকে প্রতিদিন একটি দুটি করে কথা হয় যাওয়া আসার পথে । কাজের ফাঁকে বাঁশি বাজায় রমিজ । দূর থেকে সে বাঁশির সুর কান পেতে শোনে জুলেখা ।
একান ওকান করে কথা চলে যায় রমিজের বাবার কানে । রমিজের বাবা কথা বলেন জুলেখার বাপের সাথে । এক চৈত্রের রাতে জুলেখার সাথে বিয়ে হয় রমিজের ।
হঠাৎ করে রফিকের কথাটা মনে পড়ে গেল রমিজের । রফিকের চুরির অভ্যাস আছে । অনেকেই জানে ব্যাপারটা , কিন্তু কোনদিন সে ধরা পড়ে নাই । তার বাড়িতে আহামরি কোন জিনিসপত্রও নাই । কোনদিন রফিকের বাড়ি থেকে কোন চুরির জিনিস উদ্ধার হয় নাই । কিন্তু তার সংসারে অভাব জিনিসটাও নাই । এই মঙ্গায়ও রফিকের বাড়িতে নিয়মিত চুলায় হাড়ি ওঠে ।
দুইদিন আগে মন খারাপ করে নদীর ধারে হাটছিল রমিজ । রফিকের সাথে দেখা । রফিকই এগিয়ে এসেছিল রমিজকে দেখে ।
- ও রমিজ , মন খারাপ নাকি ?
- রফিক ভাই, এইভাবে কয়দিন চলমো ? ঘরত চাউল নাই । ধার দেনা করি কয়দিন খামো কন ? আর এত ধার দিবে কায় হামাক ?
- মোর সাথে কাম করবু নাকি রে রমিজ ?
- কী কাম ভাই ? কোন বাড়িত তো কাম কাজ নাই ।
- দিনের কাম নায় রে রমিজ , রাইতের কাম । করবার চাইলে কও , তোক একদিন সাথে নিয়া যাইম । ভালো থাকার উপায় কি কও, প্যাটত ভাত না থাকলে সব কামেই করা যায় । অভাব থাইকলে স্বভাব কয়দিন ভালো রাখবার পারবু ? তুই দোস্ত মানুষ । তোর কষ্ট সহ্য হয় না ।
ইঙ্গিতটা রমিজ বোঝে । তার মন সায় দেয় না । ব্যবস্থা একটা না একটা হবেই । সেদিন রমিজ বলেছিল – ‘না রফিক ভাই, ঐগুলা কাম মোর দ্বারা হইবে না’ ।
- জুলেখা , আর একবার মেম্বার চাচার বাড়িত যাইয়া দেখনা । চাচীর হাত পাও ধরি এক সের চাউল দিবার কও ।
- সে মুই সকালে গেছিনু । চাচী কইল, আর চাউল দেওয়া সম্ভব নায় ।
চোখ ছল ছল করে জুলেখার । কোন কথা না বলে আবার বাঁশি বাজাতে শুরু করে রমিজ ।
আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা...
ভালো না হাতের লেখা, আসো যদি বাশবাগানে...
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রমিজ । বিকালেই রফিক ভাইর সাথে দেখা করে তার আগ্রহের কথা জানাবে ।
২।
উফ কী গরম ! জুলেখা, যাই একটু গায় হাওয়া লাগায় আসি । তুই ঘুমা ।
রমিজ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায় । সন্ধ্যাবেলায় চাঁদ উঠেছিল এক ফালি , এখন কোন চিহ্ন নেই । চারিদিকে অন্ধকার । গাঁয়ের সবাই গভীর ঘুমে অচেতন । রমিজেরও এক দফা ঘুম হয়ে গেছে । ছোট বাচ্চাটা একটু পরপর কেঁদে উঠছিল । জ্বর এসেছে , গায়ে হাত দিয়ে দেখেছে রমিজ । আজ যদি ভালোয় ভালোয় কাজটা করে ফেলতে পারে , বাচ্চাটার জন্য ঔষধও কিনতে পারবে ।
চুপচাপ মাঠ পার হয়ে তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় রমিজ । রাস্তার ধার থেকে উঠে আসে রফিকও । বিকালেই সব প্ল্যান করেছে । রমিজের যেহেতু প্রথম দিন , ওকে বেশ কিছু কায়দা কানুন শিখিয়ে দিয়েছে রফিক ।
হেঁটে হেঁটে দুই মাইল পেরিয়ে এলো ওরা । এই এলাকার করিম সাহেব বেশ ধনী লোক । তার গোলাঘরটা বাড়ির একপাশে । সেখান থেকে ধান চুরি করে ওরা রাতেই চলে যাবে দূরের বটতলা হাটে । কাল হাটবার । সকাল সকাল বিক্রি করে ফেলবে ধান । টাকাটা ভাগ করে নিয়ে দুইজন ভিন্ন ভিন্ন পথে বাড়ি ফিরবে ওরা ।
- রফিক ভাই, মোর ভয় নাগচে যে...
- ধুর, এই কামে ভয় হইলো এক নম্বর শত্রু বুঝলি রমিজ । ভয় ডর বিন্দুমাত্র মনে রাখলে চইলবে না । তোক যা যা কছি মনত আছে তো ? কোন শব্দ করা চইলবে না । শব্দ হৈছে দুই নম্বর শত্রু ।
খড়ের গাদার পেছনে লুকিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশের অবস্থা দেখলো ওরা । কুকুর নাই এ বাড়িতে এটা আগে থেকেই জানা আছে রফিকের । বাড়ির চাকরটাও আজ থাকার কথা না । তার মায়ের অসুখ , বাড়িতে গেছে ।
অবস্থা অনুকূলে বুঝে ধীরে ধীরে ওরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে । এদিকে কয়েকটি লেবুগাছ ঝোপের সৃষ্টি করেছে । লেবুগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেড়ার বাঁধন আলগা করে দিল । বের হবার সময় বড় জায়গা লাগবে ।
এবার আসল কাজের পালা । ধানের গোলা মাচানের ওপর । মাটি থেকে কোমর সমান উঁচু পর্যন্ত ফাঁকা । বস্তা নিয়ে দুজনেই ঢুকে পড়লো মাচানের নিচে । নিচ থেকে ছিদ্র করে দিলেই ধান পড়া শুরু হবে । বস্তা ধরলেই হবে ।
ভালো কায়দা জানে রফিক । ধারালো চাকু দিয়ে কীভাবে কীভাবে জানি ছিদ্র করে ফেললো সে । রমিজ বস্তা মেলে ধরলো । আধা ঘণ্টার মধ্যে ধানে ভরে গেল বস্তা ।
৩।
ফযরের আযান হচ্ছে । আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার...আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম... মুয়াজ্জিনের কন্ঠটা খুব ক্ষীণ । খালি গলার আজান । এই গ্রামে এখনো মাইক আসে নাই । তবু আযানের সময় হলেই জুলেখার ঘুম ভাঙ্গে । ছোট বাচ্চাটা আবার কাঁদছে ।
- কলিমের বাপ, ছাওয়াটাক থামান তো ।
উঠে বসে জুলেখা । রমিজ বিছানায় নেই । হয়তো বাইরে গেছে । জুলেখা উঠে অযু করে নামাজ পড়লো । বাচ্চাটার জ্বর আরো বেড়েছে । মাথায় পানি ঢালতে হবে । সকালের খাবারও জোগাড় নাই । কারো বাড়ি থেকে একটু পান্তাভাত চেয়ে বাচ্চাদুটাকে খাওয়াতে হবে । জুলেখা আজ রোযা রাখবে । নিয়াত করে ফেললো সে ।
থালা বাসন ধুয়ে বারান্দায় বসেছে জুলেখা । লোকটা গেল কৈ ? তার মনে পড়লো , রাতে শরীরে হাওয়া লাগানোর জন্য ঘর থেকে বের হয়েছিল রমিজ । তাহলে কি আর ঘরে ফেরে নাই কলিমের বাপ ?
- কই গো মা জুলেখা , রমিজ আছে নাকি বাড়িত ?
- নাই চাচা, কাইল রাইতত একবার ঘর থাকি বাইর হছিল, আর দেখা নাই । কোনটে যে গেল লোকটা ?
- মাগো, একটা খবর পাইনু মা । কাইল্কাপুর গ্রামত নাকি একজন চোর ধরা পড়ছে, তার নাম নাকি রমিজ । মুই একবার দেখি আসিম নাকি মা, কাইল্কাপুর বাজারত নিয়া আসছে নাকি ।
রহমান চাচার কথা শুনে জুলেখার বুকটা ধ্বক ধ্বক করে উঠলো । আবার নিজেকেই নিজে বোঝালো সে । না , কলিমের বাপ এমন কাম কইরবার পারেনা । তবু মন মানেনা । বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে সে নিজেই বাজারের দিকে পা বাড়ালো ।
৪।
কাইল্কাপুর গ্রামের বাজারের বটগাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে চোরটাকে । সবাই ইচ্ছামত পেটাচ্ছে । কেউ খালিহাতে , কেউ লাঠি দিয়ে , কেউ গাছের ডাল ভেঙ্গে পিটাচ্ছে । প্রতিযোগিতা করে পেটাচ্ছে ।
কে কত জোরে , কতক্ষণ ধরে পেটাতে পারে তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে যেন । চোর পেটাতে আর বউ পেটাতে কেউ ক্লান্ত হয়না ।
সবকিছু ঠিকই ছিল । কিন্তু বিপত্তি বাঁধে মাচানের নিচ থেকে বের হবার সময় । ইদুর মারার একটা ফাঁদ বসানো ছিল , ওটায় পা পড়ে যায় রমিজের । সইতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে সে । লোকজন জেগে উঠে তাড়া করে ওদের । রফিক পালিয়ে যায় । রমিজের পায়ে ইদুর মারার ফাঁদটা আটকে যাওয়ায় সে বেশিদূর দৌড়াতে পারেনা । ধরা পড়ে যায় ।
প্রথম প্রথম খুব চিৎকার করলেও ধীরে ধীরে ব্যথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে রমিজ । একটা চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না । ডান কান থেকে রক্ত পড়ছে । হাত পায়ের একটা করে হাড় ভেঙ্গে গেছে । মাংস থেতলে গেছে । এখন আর কিছুই গায়ে লাগছে না তার । জুলেখা আর বাচ্চা দুটার চেহারা ভেসে আসছে চোখের সামনে । মাঝে মাঝে মাগো, বাবাগো, জুলেখা বলে গোঙ্গাচ্ছে রমিজ ।
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে হুঁশ নেই ।
ও আল্লা ও আল্লা চিৎকার শুনে চোখ খুললো রমিজ । জুলেখা এসেছে । হাত পা বাধা রমিজের । জুলেখা চিৎকার করে কাঁদছে - কলিমের বাপ, ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন । সবায় না খেয়া মরি গেইলেও ভালো আছিলো । ক্যানে এই কাম কইরবার গেইলেন...
চোখ বন্ধ করার আগে অনেক কষ্টে শেষ কথাটা বললো রমিজ- জুলেখা, মোক তুই মাফ করি দেইস বউ ...।
বিষয়: সাহিত্য
১৩৭২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন