একটি ভয়ংকর বন্দুকযুদ্ধের গল্প

লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৮:৫৮:৪০ রাত

১।

জিপটাতে মোট এগারো জন । দুইজন আসামী । সাতজন স্পেশাল ফোর্সের সদস্য । সবার পরণে কালো পোষাক । টপ টু বটম কালো । কামাল বসেছেন সামনের সিটে , ড্রাইভারের পাশে । গাড়ি চলছে ফাঁকা কোন জায়গার উদ্দেশ্যে ।

রাত তিনটা বাজতে দশ মিনিট বাকি আছে । জিপের আর সাতজনের কাউকেই ভালো চেনেন না কামাল । ওরা সবাই বিশেষ বাহিনীর সদস্য । র্যা বের ৫ জন , বিজিবির ২ জন । মোট সাত জন , গতকাল এসেছে । আগে এদের কারো সাথে কোনদিন দেখাও হয়নি । খুব বেশি কথা বলেনি ওরাও । কথা কম , কাজ বেশি । এখনো সবাই চুপচাপ । অবশ্য কথা বলার মত পরিবেশও নয় এখন । জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি । বাংলা মাস কি পৌষ না মাঘ মনে করার চেষ্টা করলেন কামাল । কিন্তু কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারলেন না । অন্য সময় হলে মাকে ফোন করে জেনে নেয়া যেত । মা এখনো বাংলা মাসের হিসাব রাখেন । এখন এত রাতে তো মাকে ফোন করা যাবে না ।

প্রচন্ড ঠান্ডা আর কুয়াশা পড়েছে । হেডলাইটের আলোতেও বেশিদূর সামনে চোখ যাচ্ছে না । মনে হয় মাঘ মাসই হবে । সামনে বসায় গায়ে বাতাস লাগছে বেশি । ব্যাপার না । মাঘের শীতে নাকি বাঘেও কাঁপে ।

এটা সেটা ভেবে মনটাকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন কামাল । জিপের ভেতর যে দুইজন আসামীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে , তাদের কথা মনে করতেও ভয় হচ্ছে । কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে তাদের কথাই মনে আসছে । কে জানে , হয়তো সারাজীবন তাদের কথা তাড়া করবে ।

২।

পরশু সকালে কেবল অফিসে গিয়ে পৌঁছেছেন , এমন সময় ফোন ।

- কামাল সাহেব , এস পি বলছি ।

- স্যার , জ্বি স্যার । চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান কামাল সাহেব । এই থানার ওসি ।

- আপনার এলাকায় তো বেশি ঝামেলা হচ্ছে , ঘটনা কী ? এভাবে চললে তো আপনার ব্যাপারে আমাদের চিন্তা ভাবনা করতে হবে ।

- স্যার স্যার । আপনি তো জানেন, এখানে তো স্যার বিএনপি জামায়াতের ঘাটি স্যার । আমি স্যার চেষ্টা করছি স্যার ।

- দুইজনের নাম বলেন যাদেরকে ঠান্ডা করলে এলাকা ঠান্ডা হয়ে যাবে । কারা এইসব কাজ করছে ?

- স্যার এখানে তো স্যার ওদের অনেকেই এক্টিভ । তবে জামায়াতের আরিফ আর বিএনপির মারুফকে মিছিল মিটিং অর্গানাইজ করতে দেখা যায় স্যার ।

- ঠিক আছে, আমি কাল লোক পাঠাবো । ওদের সহযোগিতা করবেন ।

- স্যার, ইয়েস স্যার ।

নাম দুটি বলেও অস্বস্তিতে পড়লেন কামাল । এই মারুফ আর আরিফ, এরা রাজনীতি করলেও ভদ্র ছেলে । বয়স কম । লোকজনকে সাথে নিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে । মূল নেতারা তো সবাই প্রায় বৃদ্ধ । আন্দোলনে তেমন একটা দেখা যায় না । হরতাল অবরোধ এইসব কর্মসূচীতে এই ছেলেগুলোই রাস্তায় নামে । ওদেরকে ধরার জন্য বেশ কয়েকবার ওদের বাসাবাড়িতে অভিযানও চালানো হয়েছে , কিন্তু ধরা যায়নি ।

আন্দোলন তো করবেই । এটাই তো গনতন্ত্রের নিয়ম । বিরোধী দল আন্দোলন করবে । এটা তো নতুন কিছু না ।

২০০৯ সালে যখন তিনি এই থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন তখন পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে থানায় কোন অভিযোগ ছিল না । ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এদের নামে বেশ কিছু মামলা হয়েছে । সবগুলোতেই অবশ্য সরকার, মানে পুলিশ বাদী । কোথাও কোন ঘটনা ঘটলেই আওয়ামী লীগের নেতারা এসে বলেন , এদের নামে মামলা দিতে হবে । কী আর করা , ওদের কথা না শোনার উপায় কী ? মামলা দেয়া হয় ।

৩।

এসপি সাহেবের লোক এসেছে গতকালই । এরা যৌথ বাহিনীর সদস্য । মারুফ এবং আরিফের ব্যাপারে সমস্ত তথ্য তাদের হাতে দিয়েছেন কামাল ।

মারুফ, বয়স ৩২ । যুবদলের সেক্রেটারি । বিবাহিত । একটা বাচ্চা আছে, বাচ্চার বয়স ২ বছর । গ্রামের বাড়ির ঠিকানা, নিকটাত্মীয়দের নাম ঠিকানা ।

আরিফ, বয়স ৩০ । জামায়াতের এই থানার কমিটির সহকারি সেক্রেটারি । বিবাহিত । বাবা মা মারা গেছে । দুই ভাই । বাড়ির ঠিকানা , নিকটাত্মীয়দের বাড়ির ঠিকানা ।

এই বাহিনী বেশ কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে । প্রথমে সংগ্রহ করা হল মারুফের বউয়ের মোবাইল নাম্বার । সেই মোবাইল নাম্বারের সকল ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল বিশ্লেষণ করে সনাক্ত হল কোনটি আসলে মারুফের কল । এরপর সেই নাম্বারের কললিস্ট ও অবস্থান বের করা হলো । সেই এলাকায় গোপনে খোঁজ খবর নেয়া শুরু হলো ।

আরিফের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হলো । দেখা গেল, ওরা দুজনেই জেলার ভেতরেই আছে ।

কামালের কিছু করার নেই । ওরা যা যা চায়, শুধু সেগুলোর তথ্য সরবরাহ করেন । প্রয়োজনে লোক পাঠান ।

রাত দুটা বাজার পর সাতজনের টিম নিয়ে বিশেষ বাহিনী অভিযানে বের হলো । একঘন্টার মধ্যে মারুফ এবং আরিফ দুজনকেই ধরে ফেলা হলো । দুজনকেই ঘুমন্ত অবস্থাতেই ধরা হয়েছে । মারুফ ঘুমিয়েছিল তাঁর শ্যালকের শ্বশুরবাড়িতে । আর আরিফ ঘুমিয়েছিল একটা দোকানের ভেতর । দুজনেরই চোখ মুখ বেঁধে নিয়ে আসা হয় । রাখা হয়েছিল একটা গোপন জায়গায় ।

৪।

জিপ থামানো হলো । এই জায়গাটা একেবারে নিঃশব্দ । আশেপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন বাড়িঘর নেই । বেশ কিছু ঘন জঙ্গল আছে এদিক সেদিক ।

জিপ থেকে নামানো হলো মারুফ এবং আরিফকে । গতকাল রাতে গ্রেপ্তারের পর আজ সারাদিন ওদের ওপর টর্চার করা হয়েছে । অবশ্য গ্রেপ্তারের কথা বাইরে স্বীকার করা হয় নাই । ওদের পরিবারের লোকেরা এসেছিল , সাংবাদিকরাও এসেছিল । কারো কাছে স্বীকার করা হয় নাই । বলা হয়েছে- ওদের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ আছে । আমরা তাদের খুজছি । তবে এই মুহূর্তে তাদের ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই ।

টর্চার সহ্য করতে না পেরে মারুফ তো বিএনপির প্রায় সব তথ্যই দিয়ে দিয়েছে । র্যা বের লোকেরা টর্চারের নানান পৈশাচিক কৌশল জানে বটে । কথা না বলে কেউ থাকতে পারবে না । কামাল হলেও পারতেন না ।

তবে আরিফ ছেলেটা খুবই শক্ত । জামায়াতের ব্যাপারে ওর কাছ থেকে কোনভাবেই কোন তথ্য পাওয়া গেলনা । কোন কথাই বলে নাই । যতই পেটানো হয় শুধু আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করে ।

প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে । এবারের শীতটা অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশিই মনে হচ্ছে কামালের কাছে । আর কুয়াশাও পড়েছে ঘন । বেশিদূর তো নয়ই, এখানে কয়েকহাত সামনেই যেন দেখা যাচ্ছেনা ।

মারুফ আর আরিফের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হলো ।

- যা শালারা । দৌড় দিয়ে চলে যা । বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো বিশেষ বাহিনীর একজন ।

কী ঘটতে চলেছে কামাল বুঝতে পারেন । পুলিশের লোক হয়েও তাঁর শরীরটা শিরশির করে ওঠে । ভাবতেও অবাক লাগছে , এরা কি এই দেশের মানুষ ? গ্রেপ্তার করা হয়েছে, জেলে পাঠালেই হয় । মামলার পর মামলা দিয়ে বছরের পর বছর আটকে রাখা যাবে । কিন্তু তা না করে একেবারে...

অবাক বিস্ময় নিয়ে কালো পোষাকধারীদের দিকে তাকালো মারুফ । আরিফের কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই । দুজনের কেউই অবশ্য নড়ছে না । বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এভাবে ছেড়ে দেয়া হবে তাদেরকে । ছেড়েই যদি দেবে, এত রাতে এভাবে কেন ?

- কী হলো , যা । নাইলে কিন্তু গুলি করে দিমু । ধমকে উঠলো আবার কালো পোষাক পড়া একজন ।

ধীরে ধীরে পা বাড়াতে শুরু করে মারুফ । আরিফও চেষ্টা করে হাঁটার । ওদের কারোরই পায়ে শক্তি নেই দৌড়াবার মত ।

১০ গজের মত হেটেছে । পেছন থেকে হঠাৎ করেই দুটি করে গুলি এসে লাগলো দুজনকেই । একটা পিঠে, একটা মাথায় । ঢলে পড়লো ওরা । মৃত্যুর আগে মনে মনে কালেমা তৈয়েবা পাঠ করলো । মুখে উচ্চারণের শক্তি নেই ।

৫।

একদিন পর ।

ওসি কামাল বসে আছেন বাসার ড্রয়িংরুমের সোফায় । চায়ে চুমুক দিতে দিতে আজকের পত্রিকার পাতায় নজর দিচ্ছিলেন । সামনের পাতায় ডান দিকে বক্স নিউজ করেছে । বন্দুকযুদ্ধে জামায়াতকর্মী ও যুবদল নেতা নিহত । স্থানীয় থানার ওসি কামাল উদ্দিন জানান, গতকাল গভীর রাতে যুবদল নেতা মারুফ ও জামায়াতকর্মী আরিফকে গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে হামলা চালায় । এসময় পুলিশ ও র্যা ব পাল্টা গুলি ছুড়লে নিহত হয় মারুফ ও আরিফ । সকালে তাদের লাশ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে ।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে হঠাৎ কেমন যেন বিস্বাদ লাগলো কামালের । তাঁর মনে হলো , এ যেন চা নয় – মারুফ আর আরিফের রক্ত ।

বিষয়: সাহিত্য

১৩২৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

172142
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:১০
মোঃজুলফিকার আলী লিখেছেন : অনেক সুন্দর গল্প। সময়পোযোগী বলা যায়। অনেক ধন্যবাদ।
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ০৯:২৯
125869
মুহসিন আব্দুল্লাহ লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File