১৫ই আগস্ট- আমার কান্নার দিন
লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ১৫ আগস্ট, ২০১৩, ০৫:৫৩:৫৮ সকাল
১।
১৫ই আগস্ট । ১৯৭৫ । ১৯৬৯ । ৭৫ কিংবা ৬৯ কোনটাই দেখা হয়নি, জন্মেছি ৮৯ এ । ৭৫ সম্পর্কে যাকিছু জেনেছি এন্থনি মাসকারেনহাসের লিগ্যাসি অব ব্লাড এবং হুমায়ুন আহমেদের দেয়াল থেকে । ধানমন্ডির বাসায় শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল । হত্যা করা হয়েছিল তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকেও । ছোট্ট বালক শেখ রাসেলকেও ।
শেখ মুজিবুর রহমান কেমন ছিলেন ? ইতিহাস থেকে জেনেছি তিনি একজন ভালো নেতা ছিলেন- যিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে জানতেন । যার নেতৃত্ব মানুষ ভালোবাসতো ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু রুঢ় বাস্তবতা তাঁর জীবনকে ব্যর্থতায় পৌঁছে দিয়েছিল । তিনি স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন , কিন্তু স্বাধীনতার চুড়ান্ত সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন । তিনি দেশের প্রধান হয়ে দেশকে গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন । সেজন্যই তাঁকে প্রচন্ড মনোকষ্ট নিয়ে বলতে দেখা যায়- ‘সবাই পায় সোনার খনি হীরার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খুনি’ । কিংবা ‘সাত কোটি কম্বল এনেছি, আমার কম্বল কোথায় ?’ তিনি জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন – তাই রক্ষীবাহিনী দিয়ে জনগনের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন । তিনি ক্ষমতালোভী হয়ে পড়েছিলেন – যেকারণে জনগনের ভোট না নিয়েই , নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি করার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন ।
তিনি দাম্ভিক হয়ে পড়েছিলেন , তাই সিরাজ শিকদারকে বিনা বিচারে হত্যা করে সংসদে দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন –‘আজ কোথায় সিরাজ শিকদার ?’ তিনি অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন – তাই বিরোধী মতের পত্রিকাগুলি বন্ধ করে দিয়েছিলেন । ‘গণকন্ঠ’ এর সম্পাদক আল মাহমুদকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিলেন । সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতাটি হলো- তাঁর মৃত্যুতে মানুষ উল্লাস করেছিল ! একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া কেউ এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করেনি ।
গতকাল রাতে বৃষ্টি নামলে আমি রিক্সায় বেরিয়ে পড়েছিলাম । উদাসমনে ভিজতে ভিজতে ঢাকার রাস্তায় অনেক ব্যানার , দেয়াললিখন ও পোস্টার দেখেছিলাম । কোন কোনটাতে লেখা ছিল- ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ ।
নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমার কি কাঁদা উচিৎ ? যে নেতার জন্য বাংলার মানুষ তাঁর মৃত্যুর দিনে কাদেনি, তাঁর জন্য আজ এত বছর পরে আমার কাঁদা উচিৎ কিনা সে বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি । তবে ভেবে সিদ্ধান্তে এসেছি- শেখ রাসেলের জন্য আমার কাঁদা উচিৎ । একজনের অপরাধের শাস্তি আরেকজন পেতে পারে না । যদি শেখ মুজিব তাঁর হত্যাকারী সেনা এবং জনগনের কাছে অপরাধী হয়েও থাকেন, তার জন্য শেখ রাসেল শাস্তি পেতে পারেনা । তার জন্য শেখ মুজিবের নিরীহ পুত্রবধূ শাস্তি পেতে পারেনা । আমাকে যদি কাঁদতেই বলো, আমি কাঁদবো । শেখ রাসেলের জন্য , শেখ মুজিবের নিরীহ পুত্রবধুর জন্য কাঁদবো ।
২।
১৫ ই আগস্ট ১৯৬৯ । ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে একজন ছাত্র মৃত্যুবরণ করেন । না, তিনি মরেননি- তাঁকে খুন করা হয়েছিল । তিনি শহীদ হয়েছিলেন । তাঁর নাম ছিল আব্দুল মালেক । কুচকুচে কালো , মুখে একচিলতে হাসি ঝুলিয়ে রাখা ভাবুক ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।
পাকিস্তান সরকার শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল । শিক্ষানীতি কেমন হওয়া উচিৎ ? এই নিয়ে সেমিনার চলেছিল ঢাকা বিস্ববিদ্যালয়ের নিপা ভবনে । আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিরা চায় ধর্মহীন শিক্ষানীতি । ছাত্রলীগ ও ছাত্রইউনিয়নের নেতারা তাদের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন । অডিয়েন্স কনভিন্সড হয়েছিল কিনা – হয়তো হয়েছিল অথবা হয়নি ! কিন্তু আব্দুল মালেক সুযোগ নিয়ে পাঁচ মিনিটের একটি বক্তৃতা দিলেন । ছেলেটি কালো বটে, কিন্তু কথার তুবড়ি ছোটাতে জানে ! তাঁর বক্তব্য ছিল – শিক্ষানীতি অবশ্যই ইসলামের নীতির আলোকে হওয়া দরকার । অডিয়েন্স তাঁর কথায় একেবারে কনভিন্সড হয়ে গেল ।
গা জ্বলে উঠলো ছাত্রলীগ ও ছাত্রইউনিয়নের নেতাদের । ১২ই আগস্ট ১৯৬৯ । তাঁরা মুখ ও মস্তিষ্কের শক্তিতে পরাজিত হয়ে পেশির জোরে আব্দুল মালেককে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেন । টিএসসির মিটিং শেষে বাইরে বেরিয়ে এলে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তারা হিংস্র পশুর মত হামলে পড়লেন আব্দুল মালেকের ওপর । সেদিন এই হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- তোফায়েল আহমেদ ।
তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১৫ই আগস্ট আব্দুল মালেক সত্যিই স্তব্ধ হয়ে গেলেন ।
কাঁদবো ? হ্যা । আজ ১৫ই আগস্ট আমি কাঁদবো । আব্দুল মালেকের জন্য আমি অবশ্যই কাঁদবো ।
৩ ।
আজ ২০১৩ সালের ১৫ই আগস্ট ! না কেঁদে আমি থাকি কী করে ? এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির কথা আমি ভুলতে পারি না । নীলফামারি জেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে । তাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে- মানি না , মানি না । একজন আলেমে দ্বীন , তাফসিরকারক, কুরআন যার কন্ঠ হতে মানুষের কানে আসে মধুর মত সুমিষ্ট হয়ে, যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে দল-মত নির্বিশেষে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা , সেই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসি দেয়ার চক্রান্ত মানতে চায় নি গ্রামের এইসব খেটে খাওয়া মানুষও । তারা প্রতিবাদ করতে এসেছে । খালি হাতে । শিশু কিশোর বৃদ্ধ যুবক কে নেই সেখানে ? দশম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর ‘আপণ’ও তাদেরই একজন । স্কুল ছুটির পর মায়ের হাতে দুটো ভাত খেয়ে সেও ছুটে এসেছিল প্রতিবাদী জনতার মাঝে । কে তাঁকে বাধা দিয়ে আটকাতে পারে ?
শান্তিপুর্ণ প্রতিবাদ মিছিল শেষে ফিরে যাচ্ছিল জনতার মিছিল । হঠাৎ পেছন হতে ফটাস ফটাস শব্দ । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়লো ‘আপণ’ । ঘাতক বুলেট তাঁর বুক পিঠ এফোঁড়- ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি করে একটা ভ্যানগাড়িতে উঠিয়ে ছুটলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে । কিন্তু তাকে হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ হলো না । বুঝলাম- স্তব্ধ হয়ে গেছে বাবা-মার আদরের একমাত্র সন্তান , খুব ভালোবেসে যার নাম রাখা হয়েছিল ‘আপণ’ । তাঁর নাম হয়তো শেখ রাসেল নয় , কিন্তু শেখ রাসেলের মত ‘আপণ’ও এক নিষ্পাপ কিশোর । এদের বুকে বুলেট ছুঁড়েছে শেখ রাসেলের শোকে শোকাহত বড় বোন !
সে একা নয়, সেদিন দেড়শতেরও বেশি এরকম ‘আপণ’ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারাদেশে । বাংলাদেশের সবুজ ঘাস, কালো পিচঢালা রাস্তা লাল হয়ে গিয়েছিল আপণের রক্তে ভিজে যাওয়া আমার হাতের মতই ।
গতকাল ছিল ১৪ই আগস্ট ২০১৩ । গতকালও ঘাতকের বুলেটে হারিয়ে গেছে আরো একজন ‘আপণ’, সদা হাস্যোজ্বল খলিলুর রহমান ।
আগস্ট ১৯৬৯ থেকে আগস্ট ২০১৩ । ১২ই আগস্ট, ১৫ই আগস্ট, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ৫ই মে কোন দিনটির কথা উল্লেখ করবো ? আব্দুল মালেক থেকে খলিলুর রহমান । কতজনের নাম আমি লিখতে পারবো ?
হ্যা । আমাকে কাঁদতেই হবে । আজ ১৫ই আগস্ট, আমি আজ অঝোরে কাঁদবো ।
………………………………
১৫ই আগস্টের কান্না / ১৫-০৮-২০১৩
বিষয়: বিবিধ
১৪০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন