আব্দুল্লাহ সাহেবের ঈদ উদযাপন
লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ১৩ আগস্ট, ২০১৩, ১২:৩০:১৮ রাত
এশার নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হলেন আব্দুল্লাহ সাহেব । কয়েকদিন পরেই ঈদ । টুকিটাকি কিছু কাজ সারতে হবে । এছাড়া তিনি একটু মার্কেটেও যাবেন । মার্কেটে যাওয়াটা এখন এক ঝক্কির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু তবু তিনি যাবেন । এবার তিনি 'ঈদ উদযাপনে মানসিকতার বিবর্তন' শীর্ষক একটা প্রবন্ধ লিখছেন । একটা বিখ্যাত সাইকিয়াট্রি ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার কথা রয়েছে ।
মার্কেটগুলো খুব জমজমাট মানুষের ভিড়ে । সাজুগুজু করা ললনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে । মার্কেটের সামনে কিছু বখাটে ছেলে আড্ডা দিচ্ছে । একটা দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি খুবই বিরক্ত হলেন । হাই ভলিউমে গান বাজানো হচ্ছে । কোন ভাষা কে জানে ! কথার কোন ঠিক নেই- শুধু ড্রাম আর গিটারের শব্দই বোঝা যায় । এটা কী ধরণের আধুনিকতা তাঁর বুঝে আসে না ।
তিনি মার্কেটে ঢুকে এক জোড়া মোজা কিনলেন । আসলে মার্কেটের পরিস্থিতি দেখাটাই উদ্দেশ্য । বের হয়ে একটা রিক্সায় উঠলেন । নামলেন গিয়ে একটা সেলুনের সামনে । রিক্সাওয়ালা ৩০ টাকা দাবি করলো । আসলে ভাড়া বিশ টাকা । আব্দুল্লাহ সাহেব বিশ টাকা দিলেন রিক্সাওয়ালাকে । বললেন- তুমি ভাড়া বেশি দাবি করাতে তোমাকে নির্দিষ্ট ভাড়াটাই দিলাম , নাহলে হয়তো কিছু বেশিই দিতাম । যাও । তিনি মনে করেন যারা অতিরিক্ত ভাড়া চায় এদেরকে বেশি দেয়াটা ঠিক নয়- কারণ এতে করে এরা শহরে নতুন কিংবা গরীব লোকদের কাছেও ভাড়া বেশি দাবি করতে পারে । রিক্সাওয়ালার অবস্থান থেকে এটাই জুলুম । জুলুম শব্দটা শুধু ধনী এবং ক্ষমতাবানদের জন্য নির্দিষ্ট নয় , সবাই যার যার অবস্থান থেকে জুলুম করতে পারে ।
রিকশাওয়ালা দের প্রায়ই ভাড়া বেশি দেন তিনি । অনেক রিক্সাওয়ালাকে দেখে মায়া হয় । তাদেরকে বেশি দেন । তবে ব্যাপারটা স্পষ্ট করেই দেন- দেখো, তোমার আসল ভাড়া এত টাকা, আর এইটা দিলাম বখশিস । কেউ কেউ নিজেরাই চেয়ে নেয় । ভাইজান- আপনেরা জ্ঞানী গুণী মুরুব্বি মানুষ , আপনাদের কাছ থেইকা যদি দুই টাকা বেশি না নেই তাইলে আমরার জেবন চলবে কেমনে ? আব্দুল্লাহ সাহেব ওদেরকেও বেশি দেন । যাও, তবে মানুষের কাছে কখনো অতিরিক্ত ভাড়া দাবি কইরা নিবা না । ঠিক আছে ?
তিনি সেলুনে ঢুকলেন । মাথাভর্তি বড় চুল রাখা তাঁর ছোটবেলার অভ্যাস । তবে ঈদের আগে একটু সাইজ করে নিতে হয় । এটাও ঈদের প্রস্তুতির মধ্যে পড়ে । নাপিতদের ব্যাপারে তিনি মহা খ্যাপা । মনমত করে চুল কাটাতে পেরেছে এমন নাপিত জীবনে কদাচিৎ জুটেছে । একটা না একটা ঝামেলা করবেই । হয় একটু বড় রাখবে, অথবা বেশি ছোট করে দেবে । তবে বড় রাখলে তাও কিছুটা রক্ষা , আবার কেটে ছোট করা যায় । কিন্তু ছোট করে ফেললে তো আর তৎক্ষণাৎ বড় করার সুযোগ নাই । খুবই খারাপ লাগে । মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেই চুল কাটার একটা দোকান দেন । কিন্তু সমস্যা হলো- নিজের চুল তো আর নিজে কাটা সম্ভব না ।
সেলুনে ঢুকে তিনি দেখলেন নাপিত বেশ বয়স্ক । বয়স ৪৫ থেকে ৫০ হবে হয়তো । একটা ছেলে সেলুনে ঢুকে আবার বের হয়ে গেল । বয়স্ক নাপিত, হালের ফ্যাশানে চুল কাটাতে পারবে বলে তার বিশ্বাস হয়নি !
আব্দুল্লাহ সাহেব অবশ্য একেই পছন্দ করলেন । যে নাপিতের বয়স চল্লিশের বেশি সে নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবে !
সেলুনে চলছিল রাজনৈতিক আলোচনা । সামনে কী হবে, কোন দল মার খাবে , কে জেলে যাবে , কে দেশ থেকে পালিয়ে যাবে ইত্যাদি । দেশের রাজনীতির সুতিকাগার মনে হয় নাপিতের দোকান আর চায়ের দোকান । আব্দুল্লাহ সাহেব খেয়াল করলেন - বেটা নাপিত রাজনীতির বিশ্লেষণ খারাপ করছে না । টকশোতে বসিয়ে দিলে জনগনকে মাত করে দিবে । বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি হিসেবে টকশোতে গলাবাজি করে বাকি জীবনটা ভালোই কাটিয়ে দিতে পারবে ।
চুল কাটতে কাটতে নাপিত বললো- ভাইসাহেব , আপনি মনে হয় চুলে তৈল দেন না । আপনি চুলে তৈল দিবেন গৈ বুঝলেন ! চুলের খাইদ্য হইলো গিয়া তৈল বুঝলেন । আমাদের নবিজীও চুলে তৈল দিতেন ।
চুলের খাদ্য তৈল ! কথাটা আব্দুল্লাহ সাহেবের বেশ মনে ধরলো । এইটা নিয়া গবেষণা করা যায় । একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলা যাবে । তিনি এই বিষয়টা মনে রাখলেন । লেখার আগে আরেকবার এসে এই নাপিতের সাথে কথা বলে যেতে হবে ।
এখনি বাসায় ফেরার দরকার নেই । ইচ্ছাও নেই । কারণ একটা গুরুত্বপুর্ণ কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে । তিনি কিছুক্ষণ এদিন সেদিক তাকিয়ে একটা সিটি বাসে উঠে পড়লেন । বাসের ড্রাইভার যুবক । কিন্তু কন্ডাকটর এবং হেল্পার দুজনেই অল্পবয়স্ক ।
বাসের পেছনের একটা সিটে গিয়ে বসলেন তিনি । চলছে বাস চলুক । সিটি বাস, শহরের বাইরে তো আর যাবে না ।
বাসের ড্রাইভার , কন্ডাকটর -হেল্পারদের জীবনটা অন্যদের কাছে যেন তুচ্ছ । বাসে উঠলেই সবাই নবাবের পুত হয়ে যায় । একটু বাস থামালেই ড্রাইভারকে গালিগালাজ শুরু । ঐ বেটা বারবার দাড়াস ক্যান ? বাস ছাড়বি না ? আর কত লোক তুলবি ? তোগো পেট ভরে না ? শুয়োরের বাচ্চা কোনহানকার ।
আবার এই লোকই হয়তো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বাস না পেলে কিংবা বাস না থামালে গালি শুরু করেন- কুত্তার বাচ্চারা বাস নিয়া কই যায় ? হেগোরে বাস দিছে কি জইন্যে ?
একই ব্যক্তি হয়তো অন্য কোন বাসে ঠিকই বাদুরঝুলা হয়ে উঠে পড়েন । আবার বলেন- এত লোক যে কইত্থাইকা আসে । দ্যাশটা মাইনষে ভর্তি হইয়া গেছে । বাসে একটা সিট পাওয়া পর্যন্ত যায় না !
কন্ডাকটরের সাথে এক টাকা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে কেউ কেউ । এই ব্যাটা এক টাকা বেশি নিলি ক্যান ? দে টাকা দে । দুই মাস আগেই তো ভাড়া আছিল ৩ টাকা, তুই চার টাকা নিলি ক্যান ?
কখনো কখনো কন্ডাকটর হেল্পারকে চড় থাপড়ও মারে কোন কোন 'ভদ্রলোক' । কেউ প্রতিবাদ করে না । সবাই থাকে ঐ 'ভদ্দরলোকের' পক্ষে । শালা ছোটলোকের বাচ্চার উচিৎ শিক্ষা হইছে । অগোরে আরো পিটান দরকার !
বাসে চড়ে এইসব অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছে আব্দুল্লাহ সাহেবের । আজও তিনি পেছনে বসে পরিস্থিতি দেখছিলেন । একটা কিশোর ছেলের ঘাড়ে একটা বড় ব্যাগ । সে ব্যাগটা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে । ভিড়ের ভেতর ব্যাগটা কাধে নিয়ে বাসে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে । হয়তো ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছে । এরই মধ্যে একজনের গায়ে একটু হয়তো ধাক্কা লেগেছে- সে ক্ষেপে গিয়ে ছেলেটাকে ধমকাচ্ছে । আরে মিয়া কি শুরু করছ তুমি ? ব্যাগ নিয়া উঠছে গাড়িতে ।
আব্দুল্লাহ সাহেব ওই লোকটাকে ডাকলেন ।
এই যে ভাই , শোনেন । আপনার কী অসুবিধা হয়েছে ?
দেখছেন না ব্যাগটা আমার গায়ে লাগলো ।
আপনার শুধু একটু গায়ে লেগেছে , আর ছেলেটা যে ব্যাগটা কাধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কষ্ট হচ্ছে না ?
তাতে আমার কী ? ব্যাগ নিয়া তারে উঠতে কইছে কে ? সে নাইম্যা যাইতে পারে না ?
আপনার কি ঠ্যাং নাই , আপনিও তো নেমে যেতে পারেন ।
আমি নামুম ক্যান, গাড়ি কি অর বাপের ?
আপনাকে দেখেও তো এই বাসের মালিকের ছেলে মনে হচ্ছে না । বাসের মালিকের ছেলে ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে যাতায়াত করে এইরকম তো আমি কল্পনাও করতে পারিনা । খোলাফায়ে রাশেদার যুগ এসে পড়লো নাকি ?
আশেপাশের লোকজন কেন যেন বেশ মজা পেয়ে গেল । হো হো করে হেসে উঠলো কয়েকজন ।
এতটুকুতে আনন্দ পেয়ে গেছে । এইজন্যেই বাংলাদেশের মানুষ- এত অন্যায় অবিচার শোষণ নির্যাতনের ভেতরেও সুখী । তারা অল্পতেই সুখ খুজে পায় ।
বাস থেকে একে একে লোকজন নেমে যেতে লাগলো । ফাকা হয়ে যেতে লাগলো বাস । কন্ডাকটর ছেলেটা ভাড়া চাইতে এসেছিল । আব্দুল্লাহ সাহেব তাকে একশ টাকার একটা নোট দিয়েছেন ।
কই নামবেন ?
যেখানে তোমাদের গন্তব্য শেষ সেখানে নামবো ।
ছেলেটা তখন অবাক হয়ে ফিরে গিয়েছিল । কত টাকা ভাড়া রাখবে বুঝতে না পেরে বলেছিল- নামার সময় বাকি টাকা নিয়েন খেয়াল কইরা ।
বাস থেমে গেলে তিনি কন্ডাক্টর ও হেল্পারকে ডাকলেন ।
তোমাদের বাড়ি কোথায় ?
আমার বাড়ি ভোলা ।
আমার লক্ষীপুর ।
তোমাদের বাড়িতে কেউ নাই ? বাবা মা ভাই বোন ?
একজন বললো তার বাবা মারা গেছে ছোটবেলায় । গ্রামে মা আছে , অন্যের বাড়িতে কামলা খাটে । হেল্পার ছেলেটার কেউ নাই । চাচারা আছে । তারা ওর খোজ রাখে না ।
আব্দুল্লাহ সাহেব তাদের দুজনকে একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন । বললেন- তোমাদের যা ইচ্ছা খাও । তারা গরুর গোশত দিয়ে পেটপুরে ভাত খেল । তারপর তিনি তাদের সাথে কথা বলতে বলতে একটু দূরে একটা কাপড়ের দোকানে নিয়ে গেলেন । ওদের শার্ট প্যান্ট ছেড়া ময়লা । দুজনকে পছন্দ মত শার্ট প্যান্ট কিনে দিলেন । ছেলে দুটো হতভম্ব হয়ে গেল । তারা হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছিল না । হেল্পার ছেলেটার মুখ হাসিখুশি, কিন্তু কন্ডাক্টর ছেলেটার চোখে পানি । মার কথা মনে পড়েছে । ছোটবেলায় বাবা বেচে থাকতে একবার এরকম শার্ট প্যান্ট কিনে দিয়েছিলেন । সেকথাও মনে পড়েছে তার ।
আব্দুল্লাহ সাহেব ওদের আদর করে বিদায় করলেন । একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি । কদিন পরেই ঈদ । কার ঈদ ?
আজ ২৫ রমজানের রাত । শবে কদর হবার সম্ভাবনাও আছে । রমজানের শেষ দশদিনের বিজোড় রাতগুলোতে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এক রাত্রির সন্ধান করতে বলা হয়েছে । সেই রাত্রিতে আল্লাহর বানী মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল হয়েছিল । শুধু নফল নামাজ পড়ে সেই রাত্রি পাওয়া যায় কিনা, আল্লাহকে পাওয়া যায় কিনা তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে । তাঁর ধারণা, যায় না । কুরআনের মূল উদ্দেশ্য- মানুষের প্রতি ইনসাফ- ভালোবাসা না করে শুধু নফল নামাজে আল্লাহকে পাওয়া যাবে না । তিনি এই রাত্রিগুলোয় সত্যিকার দুঃখী মানুষের সন্ধানে বের হন । ঈদের আনন্দটা তিনি পেয়ে যান ঈদের আগেই । ঈদের দিন তাঁর মনটা প্রশান্তিতে ভরে থাকে । প্রতিবছর তিনি এভাবেই অনাথ শিশুদের মুখে হাসি ফুটিয়ে ঈদ করতে চান ।
আকাশে মেঘ জমেছিল । দুএক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো । ঠান্ডা বাতাসে বুকটা ভরে গেল আব্দুল্লাহ সাহেবের । তিনি ধীরে ধীরে হাটা ধরলেন । বাসায় পৌঁছে নামাজ পড়তে হবে ।
................................................
আব্দুল্লাহ সাহেবের ঈদ / ০৮-০৮-২০১৩
বিষয়: সাহিত্য
১৩২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন