বৃষ্টি (গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০৭:৩৮:১৮ সন্ধ্যা

শাহবাগের উদ্দেশ্যে মহাখালি থেকে বাসে উঠলো জনি । মহাখালি গিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটা কাজে । এমবিবিএস পাস করার পর কিছুদিন বেশ দৌড়াদৌড়ি করতে হয় । সার্টিফিকেট তোলো , বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নাও, এখানে ওখানে কাগজপত্র দাও এইসব । অবশ্য এইসব কাজ করতে একধরণের আনন্দও আছে ।

কিন্তু আজকে জনি যে কাজে গিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সেটা নিয়ে সে একটু বিরক্ত । এই দেশে কোনকিছুই নিয়মমাফিক হয় না । রাজনৈতিক সুপারিশ আর টাকা ছাড়া কোন কাজ হয় না । কিন্তু জনি এর কোনটাতেই নেই । সে বিরোধী দলের কর্মী, আর টাকা দিয়ে কোন কাজ করার ইচ্ছা তার নেই । কিন্তু এখন একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে । এখানে থাকতে হলে হয় জায়গামত টাকা পয়সা দিয়ে কাজ করাতে হবে, নাহয় আজীবন নিগৃহীত হয়েই থাকতে হবে । বিকল্প নাই ।

জনি ভাবছিল, মেডিকেল কলেজে পোস্টিং পাওয়াটা তার ন্যায্য অধিকার । কেন তাঁকে পোস্টিং দেয়া হচ্ছে না ? তাহলে কি কিছু টাকা খরচ করবে এবার ? এটা কি নীতিবিরুদ্ধ হবে ? কেন হবে ? বিপদে পড়লে শুকরের গোশতও খাওয়া জায়েজ । আল্লাহই ভালো জানেন , কিন্তু এসব আর সহ্য হয় না ।

মাঝে মাঝে ভাবে- বিদেশে চলে যাবে । কিন্তু বাবা- মা, ছোট ভাইটাকে রেখে যেতে হবে- মনে হলেই সে ইচ্ছাটা উবে যায় ।

বিসিএস দেয়ার পর সে বছরেই এফসিপিএস পার্ট ওয়ান পাস করে জনি । চার বছর হয়ে গেল- আজো সে গ্রামে পড়ে আছে । এর মাঝে ট্রান্সফারও হয়েছে কয়েক বার । পটুয়াখালি, কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি- প্রত্যন্ত সব এলাকা । নাগরিক সুযোগ সুবিধা বলতে কিছু নেই । তার জুনিয়ররা পোস্টিং নিয়ে আসে, মাস দুমাসের মধ্যেই আবার চলে যায় । মেডিকেল কলেজে পোস্টিং পায় । কেউ কেউ বলেছিল, জনি ভাই- এভাবে আর কতদিন থাকবেন ? কিছু একটা করেন ।

বয়স ত্রিশ হয়ে যাচ্ছে, বিয়েটাও করা হল না । এবার একটা এস্পার কি ওস্পার করতেই হবে । সেই ভেবে আজ গিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে । কিন্তু নাহ- কিছু হলো না ।

জানালার পাশে একটা সিটে বসেছে জনি । চোখে কালো সানগ্লাস । সানগ্লাসটা খুলে হাতের ওপর রাখলো । মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ।

ডাক্তার হবার ইচ্ছেটা কি ভুল ছিল ? কেন যেন ছোটবেলা থেকেই মনে হত ডাক্তার হতে হবে । মনে আছে – ও যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেল, বাবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেন । জনি বৃত্তি পেয়েছে । সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় । সে সবার দোয়াপ্রার্থী । একই কাজ বাবা করেছেন এসএসসির রেজাল্টের পরও । সেই একই কথা- জনি এ প্লাস পেয়েছে । সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় । সে সবার দোয়াপ্রার্থী ।

পেপার কাটিং গুলো এখনো বাবার ড্রয়ারে সংরক্ষিত আছে । জনিরও তখন ভালোই লেগেছিল । পত্রিকায় ছবি এসেছে- খারাপ কি ? বিজ্ঞাপনের পাতা হাতে নিয়ে বাবার সেকি উচ্ছাস ! চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলার জোগাড় । আমার ছেলের ছবি পত্রিকায় ! অথচ তিনিই টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন । জনির মনে পড়লে একটু হাসিও পায় । বড় মানুষরাও কীরকম ছেলেমানুষি যে করে ! বিশেষ করে বাবারা ।

বিজ্ঞাপন দেয়ার আগে বাবা কিন্তু জনিকে জিজ্ঞেস করেননি সে কী হতে চায় । তিনি নিজেই লিখে দিয়েছেন- জনি ডাক্তার হতে চায় । অবশ্য পত্রিকায় আরো যতজনের ছবিসহ বিজ্ঞাপন সে দেখেছিল- প্রায় শতভাগের কথা ছিল তারা ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চায় । জনির মনে হয়েছিল- ডাক্তার হওয়াটাই বুঝি ভালো ছাত্রদের জন্য দরকার ।

কথাটা ভুল নয় । আসলে এটা একটা মধ্যবিত্ত চেতনা । মধ্যবিত্তরা সম্মানের কাঙ্গাল । তারা সম্মান চায় । অসম্মান করলে তারা খুব কষ্ট পায় । তারা নিজেরা অন্যদের খুব সম্মান করে । ডাক্তাররা সম্মানের পাত্র, সেই ভেবে মধ্যবিত্ত বাবা মা-রা তাঁদের সন্তানকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখেন ।

কিন্তু বেশিরভাগ ডাক্তারের জীবন হতাশার । অন্তত একটা বয়স পর্যন্ত । ছোটবেলা থেকে কঠিন পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে- ভার্সিটিতে উঠে একটু রিল্যাক্স থাকবে , খুব আশা থাকে মনে । কিন্তু না , তা আর হয় না । মেডিকেল কলেজে পরীক্ষার ওপর পরীক্ষা । আইটেম-কার্ড-টার্ম-প্রফ । প্রতিটা সাবজেক্টে পাচ-ছয়টা পার্ট । পাস করার জন্য পেতে হবে প্রতি অংশে সিক্সটি পার্সেন্ট মার্কস । বিশাল মার্কস ভাইভায় । স্যার ম্যাডামদের কোনভাবেই সন্তুষ্ট করা যায় না । গাধার খাটুনি খেটে পড়াশোনা, ওয়ার্ড ডিউটি, স্যার ম্যাডামদের বকাবকি । শীতকালীন-গ্রীষ্মকালীন ছুটি নেই । যেন এক বিভীষিকাময় জীবন । হতাশার শুরু হয় সেখানেই ।

তারপর আবার বিসিএস , এফসিপিএস, এমডি । বিসিএসএর জন্য আবার বাংলা ব্যাকরণ খোল- সমাস কাহাকে বলে পড় । সুদ-কষার অংক কর । বান্দর তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে কতটা উঠতে পারলো হিসাব করো । সংজ্ঞা মুখস্ত কর- নদী কাহাকে বলে । পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সেনাপতি কে ছিল, সোমালিয়ার প্রেসিডেন্টের নাম কি এইসব হাবিজাবি । ডাক্তারির সাথে এগুলোর কী সম্পর্ক একমাত্র সরকার বাহাদুরই জানে , আর ঐ পিএসসিই জানে । তার ওপর যদি কোটা ভুক্ত না হয় তাহলে তো চান্স কমে যায় একলাফে প্রায় শতকরা ষাট ভাগ । কারণ নানান কোটায় মোট বিসিএস এর পঞ্চান্ন ভাগ খেয়ে ফেলেছে । এর ওপর আছে রাজনৈতিক প্রভাব । জায়গামত মন্ত্রী ফোন না করলে ভাইভায় আউট । সরকারি দল না হলে এই সেই ভেরিফিকেশনের নামে বাতিল করা হয় গেজেট । অন্ততপক্ষে নন-ক্যাডার করে রাখা হয় ।

আবার বিসিএস হলে অজপাড়াগায়ে পোস্টিং । বছরের পর বছর সেখানে পড়ে থাকা । ক্লাসের পেছনের বেঞ্চের বন্ধুটি আজ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে , মাস শেষে মোটা অংকের বেতন পায় । বউ বাচ্চা নিয়া মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে । অন্য সব ক্যাডারের পোস্টিং মিনিমাম উপজেলা শহরে । আছে গাড়ী, কোয়ার্টার সুবিধা । একমাত্র ডাক্তারদের পোস্টিং আছে ইউনিয়ন-গ্রামে । নেই কোয়ার্টার, নেই গাড়ী , নেই পিয়ন-আর্দালি, নেই বডিগার্ড, নেই প্রটোকল । ডিগ্রি নেয়ার জন্য কোথাও যাবারও উপায় নেই, আবার ডিগ্রি না নিতে পারলে কোনদিন প্রমোশনও হবে না ।

ইন্টার্ণশিপ করার সময় একদিন সার্জারির সহকারী অধ্যাপক স্যার বলেছিলেন, জনি মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে । আমার কত জুনিয়ররা আজ সহযোগী অধ্যাপক হয়ে গেছে- আর আমি আজও সহকারী অধ্যাপক রয়ে গেলাম । আমার ছাত্ররা আজ আমার সাথে এক কাতারে , সহকারী অধ্যাপক । এই আমাদের দেশ । নেতাদের পিছনে ঘুরঘুর করো, জায়গামত টাকা ঢালো- তোমার প্রমোশন হবে । নাহলে সারাজীবন পঁচে মরো, দেখার কেউ নেই ।

বাস এসে থেমেছে ফার্মগেট খামারবাড়ি মোড়ে । জনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল । কিছুক্ষণের মধ্যেই জানালার পাশে আরো বাস এসে থামলো । জ্যাম লেগে গেছে । জ্যামের কারণে ঢাকা শহরে চলাফেরা করাটাই দায় । এক ঘন্টার পথ তিন ঘন্টা লাগে । পল্টন থেকে শ্যামলী যেতেই কোন কোন দিন আড়াই ঘন্টা লেগে যায় । উত্তরা থেকে শাহবাগ আসতে লাগে তিন ঘন্টা । মহা মুশকিল । এই জ্যাম যে কতক্ষণে ছুটবে আল্লাহ মালুম ।

জনি বাসের ভেতরে দৃষ্টি ফেরালো । সাথে সাথে চোখটা নামিয়েও নিতে হল । মহিলা সিটে একটা মেয়ে বসে আছে । মেয়েটা বেশ মায়াবী চেহারার । একবার চোখ পড়লে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে যে কারো । এবং সেটাই হচ্ছে । বেশ কিছু লোক তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে । জনি চোখ নামিয়ে নিয়েছে । সে জানে, পুরুষের পর্দা হলো চোখ । আমাদের সমাজে শুধু মহিলাদের পর্দার ব্যাপারে কথা বলা হয়, পুরুষেরটা বলা হয় না ।

কিন্তু অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, চোখ সামলানো অত সহজ না । রাস্তাঘাটে চলাফেরা করাটাই দায় হয়ে পড়েছে । কতক্ষণ চোখ সংরক্ষণ করা যাবে ? সর্বত্র বেপর্দা, সাজুগুজু করে বের হওয়া মেয়েদের কথা যদি বাদও দেয়া হয়- মরার ওপর খড়ার ঘা হয়ে আছে যেখানে সেখানে বড় বড় বিলবোর্ড । সকল বিলবোর্ডেই মেয়েদের ছবি । বিজ্ঞাপনের জন্য বেপর্দ হয়ে ছবি তোলা- এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে মডেলিং । গাড়ি, রড, আইসক্রিম, এমনকি প্রকাশ্যে কনডমের বিজ্ঞাপনও দেয়া হচ্ছে বিলবোর্ডে । রাস্তার মোড়ে মোড়ে, রোড ডিভাইডারের ওপর । সব সময় তো আর চোখ নামিয়ে চলা যাবে না , তাহলে তো টেম্পু-সিএনজি মেরে দিয়ে যাবে । ওগুলো একেকটা বদ ।

এই মেয়েটাকে অবশ্য বেপর্দা বলা যায় না , কিন্তু ঠিকমত পর্দা করেছে তাও বলা যায় না । পর্দার উদ্দেশ্য যে ব্যাহত হয়েছে তা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ।

সমস্যা হলো মেয়েটা জনির দিকে তাকিয়ে ছিল । জনিও এমন জায়গায় বসেছে , চোখ তুললেই মেয়েটার ওপর চোখ পড়ছে । বাস থেকে বের হয়ে যাবে কিনা ভাবছিল জনি । দরজার দিকে তাকাতেই আবারো চোখ পড়ল । এবার তো চোখাচোখিই হয়ে গেল ।

মহা মুশকিল । বাইরে আবার এরই মধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে । খোলা জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে দিল জনি । বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে মাথায় । ভিজে যাচ্ছে ঝাঁকড়া চুল ।

বৃষ্টি দেখলেই জনির বৃষ্টিবিলাসী মন উথাল পাথাল করে । বৃষ্টিতে না ভিজলে ভালো লাগে না । অন্তত দু হাতের পাতা হলেও একবার ভেজাতে হবে ।

জ্যাম ছুটতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে ! এখান থেকে হেঁটে ফার্মগেট যেতে পারলেই ওপাশের বাসে উঠে পড়া যাবে । ভিজলে ক্ষতি কী ? ও আচ্ছা , মোবাইল আর মানিব্যাগ সমস্যা । ওগুলো তো ভিজে যাবে । কন্ডাকটারকে ডাকলো জনি- এই একটা পলিথিন দাও ।

বাসে পলিথিন রাখা হয় । বাসে উঠে বাচ্চা কাচ্চারা- কখনো বড়রাও বমি করে । বাস যেন নোংরা না হয় সে জন্য পলিথিনের ব্যবস্থা রাখা হয় ।

সবাই একবার জনির দিকে তাকালো । এই ছেলে বমি করবে নাকি ? জনি মোবাইল ও মানিব্যাগ বের করে পলিথিনে মুড়িয়ে নিলো । তারপর উঠে দরজা দিয়ে নেমে গেল ফুটপাতে । বৃষ্টি পড়ছে । ক্যাটস এন্ড ডগস নয়, টাপুরটুপুর । কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি থেমে যাবে পুরোপুরি । হালকা বৃষ্টির সাথে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া আসছে দমকে দমকে । জনির শরীরে একবার শিহরন খেলে গেল ।

একশ গজের মত এগিয়েছে , হঠাৎ পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল – ‘জনি ভাই ! আমি বৃষ্টি !’

পেছন ফিরে জনি অবাক । ঐ মেয়েও বাস থেকে নেমে পড়েছে । সে পেছনে এসেছে কেন ?

বৃষ্টি... কোন বৃষ্টি ? সে কীভাবে জনিকে চেনে ? দাঁড়িয়ে থাকা বাসের জানালা দিয়ে লোকজন তাকিয়ে আছে । জনি এখন কী করবে ?

..............................

বৃষ্টি / ২৯-০৭-২০১৩

বিষয়: বিবিধ

১৮৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File