হুমায়ুন কথন

লিখেছেন লিখেছেন মুহসিন আব্দুল্লাহ ২০ জুলাই, ২০১৩, ১২:০৮:৩৫ রাত

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অন্তত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা জানেন তিনি নিম্নবিত্তের জীবনবোধ ও মনস্তত্ব কতটা গভীর ভাবে বুঝতেন । আমি মনে করি শুধুমাত্র ঐ গল্পটিই তাঁকে একজন ‘অসাধারণ’ কথাশিল্পী হিসেবে চিত্রিত করার জন্য যথেষ্ট ।

মানিক বন্দোপাধ্যায় যেভাবে নিম্নবিত্ত শোষিত শ্রেণীর জীবনকে বুঝতেন, হুমায়ুন আহমেদ ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনধারাকে বুঝতেন । গত কয়েক দশকে তাঁর মত এত সহজ সুন্দরভাবে মধ্যবিত্তের জীবনকে সাহিত্যে তুলে আনতে সম্ভবত কেউ পারেননি । তিনি লিখেছেন জীবনের বাস্তবতা নিয়ে, জীবনের রহস্য নিয়ে, জীবনের বৈরাগ্য নিয়ে ।

কেউ ভালোবাসে হিমুকে , কেউ মিসির আলীকে । আর আমি ভালোবাসি ‘মধ্যাহ্ন’ । আমি ভালোবাসি ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নন্দিত নরকে’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘তেঁতুল বনে জোছনা’, ‘নলিনী বাবু বিএসসি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কবি’ ...... সবকিছুর ওপরে আমি স্থান দেই মধ্যবিত্তের জীবনধারাকে গভীর থেকে সুচারুরুপে তুলে আনার তাঁর অসাধারণ দক্ষতাকে ।

হুমায়ুন আহমেদের লেখাগুলোকে নির্দিষ্ট কোন ক্রাইটেরিয়াতে আবদ্ধ করা সহজ নয় । তাঁর একই লেখায় হাসি কান্না একসাথে খেলা করে । সবকিছু নিয়ে হাসি তামাশা করার এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাঁর ভেতর লক্ষ্য করা যায় । আবার হাসির মাঝেই গুরুতর তত্বকথা এবং দর্শনকে তুলে আনতে দেখা যায় । ‘এনায়েত আলীর ছাগল’কে নিয়ে হাস্যরসকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান, আবার বাকের ভাইকে ফাঁসি দিয়ে মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেন ।

হুমায়ুন আহমেদ তাঁর লেখায় সততা বজায় রেখেছেন । তাঁর ভাই জাফর ইকবালের মত অসততা তিনি করেননি । তাঁর কোন লেখায় তিনি কোন ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন নি । দাড়ি টুপি ওয়ালা মানেই রাজাকার – তাঁর লেখায় এই মিথ্যাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি । বরং ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ একজন ঈমামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তুলে এনেছেন । রাজাকার মানেই যুদ্ধাপরাধী নয়, আবার মুক্তিযোদ্ধা মানেই ফেরেশতা নয়- তাঁর লেখায় এই সত্যটিও স্পষ্টভাবেই উঠে আসে । তাঁর নানা রাজাকার ছিলেন , মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি রাজাকারের আশ্রয়ে ছিলেন - সে কথাও তিনি স্বীকার করেন অকপটে ।

জীবনকে হেসেখেলে কাটিয়ে দিয়েছেন হুমায়ুন । জীবনের শেষবেলায় তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে বিতর্ক হয়- তিনি আস্তিক নাকি নাস্তিক । আমি এই বিতর্ককে প্রয়োজনীয় মনে করিনা । প্রথম আলো এবং ঐ ধারার মিডিয়া গোষ্ঠীর একটা সাধারণ প্রবণতা হলো- খ্যাতিমান ব্যক্তিদের যেকোনভাবে নাস্তিকতা ও কম্যুনিজমের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রমাণ করার চেষ্টা । হুমায়ুন আহমেদের ক্ষেত্রেও তারা সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছে ।

ঈমানের ভিত খুব বেশি শক্ত না হলে সাহিত্যিকরা প্রায়শই সংশয়বাদিতায় ভোগেন । তাঁরা মানুষ নিয়ে চিন্তা করেন, মানুষের জীবন নিয়ে ভাবেন, লেখেন । ঈশ্বর নিয়ে কতটা ভাবেন সেটা অজানা । কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই দিনশেষে আস্তিক, ঈশ্বরে বিশ্বাসী প্রমাণিত হন ।

সরকারি - বেসরকারি চাকুরে, আইনজীবি, পুলিশ, ডাক্তার, শিক্ষক সবার জীবনকেই তিনি ভালোভাবেই বুঝেছেন । মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণের অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাঁর । ‘তেঁতুল বনে জোছনা’র সাইকেল ডাক্তার সবার মন ছুঁয়ে যায় । তবে ‘কোথাও কেউ নেই’ এবং ‘আজ রবিবার’ এর ডাক্তার চরিত্রগুলি একটু যেন বেখাপ্পা মনে হয়েছিল ।

‘রুপালি রাত্রি’র নায়িকা ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল । ‘চান্নি পসর’ গানটা শুনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল । হুমায়ুন কি জানতেন- তাঁকেও একদিন পরাজিত করবে সর্বনাশা ক্যান্সার ?

গুন্টার গ্রাস, অরহান পামুক- আরো অনেক নোবেলবিজয়ীর লেখা পড়েছি । হুমায়ুনের বইগুলি ইংরেজীতে খুব একটা অনুবাদ হয়নি । তাঁর বইগুলি অনুবাদ করা উচিৎ । আমরা বিশ্বাস করতে চাই- একদিন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীদের তালিকায় আমাদের হুমায়ুন আহমেদের নামটাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে ।

বিষয়: বিবিধ

১৮৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File