জেল বৃত্তান্ত
লিখেছেন লিখেছেন রোকন উদ্দিন ৩১ মে, ২০১৩, ০৬:৫৪:৪৬ সন্ধ্যা
কাল সন্ধ্যায় রংপুরের বিখ্যাত পিয়াসী হোটেলে এক জুনিয়রের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি (তাকে আসলে জুনিয়র বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না, কারণ সে রীতিমত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এসিসট্যান্ট প্রফেসর। হায়! আমি এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গেলাম!)। আমাদের চা পর্ব প্রায় শেষ, উঠি উঠি করছি, হঠাৎ ভুতের মতো উদয় হলো আমার গ্রামের যুবদলের একনিষ্ঠ কর্মী সোহেল ভাই। ধপ করে একটা চেয়ারে বসে বললেন, 'সাড়ে তিন মাস জেল খেটে কাল মাত্র বের হলাম। কেমন আছো তোমরা?'
বললাম, 'ভালো আছি। জেলে গেলেন কেমনে? কেমন ছিলেন?'
সোহলে ভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'এক হরতালের আগের রাতে আমাকে পাড়া থেকে ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। তারপর তো তিন মাসের ধাক্কা। বহুবার জামিন চাওয়ার পর অবশেষে কাল জামিন পেলাম। জেলের ভেতরের অবস্থা জানতে চাচ্ছো, ভেতরের অবস্থা খারাপ বললে কম বলা হবে।'
'কী রকম?' আমি ব্যাখ্যা দাবি করলাম।
সোহেল ভাই এক মুহূর্ত থামলেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে বললেন, 'শোনো রংপুর জেলের বন্দী ধারন ক্ষমতা ৯০০। কিন্তু এখন সেখানে অবস্থান করছে ২১০০ বন্দী। এই ২১০০ বন্দীর মধ্যে ৫০/৬০ জন সাধারন বন্দী, বাকিরা সবাই বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদল, জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের নেতা-কর্মী। সেলগুলোতে এই বিপুল পরিমাণ বন্দীর রাতে শোয়ার কোন ব্যবস্থা নাই। এক গ্রুপ ঘুমায় অন্য গ্রুপ জেগে থাকে। আবার মধ্যরাতে জেগে থাকা গ্রুপটি ঘুমাতে যায়, ঘুমানো গ্রুপটি উঠে জেগে থাকে। এভাবে পালা করে রাতে ঘুমাতে হয়। অর্ধেক রাত ঘুমানোর সুযোগ পেলেও একজন বন্দী শোয়ার জন্য ছয় ফিট বাই তের ইঞ্চি জায়গা বরাদ্দ পেয়ে থাকে। এই হলো রংপুর জেলের অবস্থা।'
আমি বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে জিজ্ঞেশ করলাম, 'খাওয়া দাওয়ার কী ব্যবস্থা?' সোহেল ভাই বললেন, 'সকালের বরাদ্দ হলো একটা গমের আটার রুটি আর গুড়। দুপুর বারটায় মোটা চালের দুর্গন্ধযুক্ত ভাত, সাথে একমাত্র তরকারী হলো মশুড়ের ডাল। সন্ধ্যায় সেই মোটা ভাত, একটুখানি সেদ্ধ সবজি আর এক টুকরো মাছ। তোমার বাসার কুকুর বেড়ালকেও যে খাবার তুমি খেতে দেবে না, সেই খাবারই জেলের দৈন্দদিন খাবার।'
আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে জিজ্ঞেশ করলাম, 'শিবিরের ছেলেদের কী অবস্থা?' সোহেল ভাইয়ের চোখ এবার উজ্বল হয়ে উঠলো, 'শিবিরের রংপুর মহানগরীর সাবেক সভাপতি এডভোকেট কাউসারের নেতৃত্বে শিবিরের ছেলেরা প্রতিদিন ফজর ও আসরের নামাজের পর জেলের বন্দীদের মাঝে কুরআন ও হাদীসের আলোচনার ব্যবস্থা করে। মজার ব্যাপার হলো যে বন্দীরা বাইরে নামাজ কালামের ধার ধারতো না, এরাই জেলের ভেতরে শিবিরের সংস্পর্শে এসে নিয়মিত নামাজ পড়ছে। কিন্তু একটা বিষয় খুব পীড়া দেয়রে ভাই!'
'কী বিষয়?' আমার আগ্রহ বাড়ে।
সোহেল ভাই দুঃখ জড়ানো কন্ঠে বললেন, 'বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে শিবির ও হেফাজত সন্দেহে ক্লাস সিক্স-সেভেন পড়ুয়া বাচ্চাদের নিয়ে এসে শিশু ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। এই বাচ্চারা জেলের ভেতর সারা দিন চিৎকার করে কাঁদে। এদের কান্না শুনে অন্যান্য বন্দীদেরও চোখ ভিজে যায়।'
আমি অন্যদিকে তাকাই। আমার নিজের চোখ দুটোতে কি যে পড়েছে ছাই। ঝর ঝর করে পানি বেরিয়ে আসছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। বেসিনের সামনে গিয়ে চোখ-মুখে পানি ছিটাই। নাহ! পৃথিবীর সব কিছুকে বশ মানানো গেলেও অবুঝ চোখকে বশ মানানো যায় না।
বিল মিটিয়ে দিয়ে সোহেল ভাইকে সাথে নিয়ে পিয়াসী হোটেল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসি। একটা রিকশায় উঠে সোহেল ভাইকে পাশে বসাই। সোহেল ভাইকে বলতে ইচ্ছে করছে, রংপুর জেলের ২১০০ বন্দী শুধু নয় বাংলাদেশের ১৬ কোটি বন্দী এখন মুক্তির প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। আমার ভেজা চোখ আর ধরা গলায় কিছুই বলা হয় না। রিকশা সামনের দিকে এগিয়ে চলে।
বিষয়: বিবিধ
১২৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন