কলিগ কথন-৩
লিখেছেন লিখেছেন রোকন উদ্দিন ২৮ মে, ২০১৩, ১২:০৩:৩৫ দুপুর
আজ কলিগের উপর একটা যুৎসই আক্রমণ করবো বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম। অফিসে এসে তক্কে তক্কে থাকলাম একটা সুযোগের অপেক্ষায়। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বস গেছে কী এক কাজে অফিসের বাইরে। এই সুযোগে তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসলাম।
কন্ঠ ঝাজালো করার চেষ্টা করলাম আমি। ‘সেদিন কইলেন, খালেদারে জেলে ঢুকায়া তার কয়েকজন নেতার হাতে ধানের শীষ তুলে দিয়ে পাতানো নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ। আবার কালকে কইলেন জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচনে আপনার দল হারলে জাতীয় নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। দুইটা কথা পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল না? জাতীয় নির্বাচন যদি পাতানোই হয়, তাহলে সিটি নির্বাচনে আপনারা হারলেও যা জিতলেও তা! এখানে ঝুঁকির তো কিছু নাই। আর সিটি নির্বাচনে যদি ঝুকিই থাকে, তাহলে তো এটাই বুঝতে হয় যে পাতানো নয়, আগামি জাতীয় নির্বাচন ফ্রি-ফেয়ারভাবে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে?’
কলিগ হাসলেন। ‘আপনাদের সমস্যা হলো রাজনীতিকে আপনারা পাটিগণিতের সরল অংক মনে করেন। প্রথম লাইনের পর দ্বিতীয়, তারপর তৃতীয়। সবশেষে সঠিক উত্তর। আসলে রাজনীতি এত সহজ হিসাবে চলে নারে ভাই। নেত্রী যা করতাছেন তা হলো আগামি টার্মে তার ক্ষমতা হারানোর যতগুলো পথ আছে সবগুলো বন্ধ কইরা দিতেছেন।’
‘কী রকম সেটা?’ আমার চোখে বিস্ময়।
‘শোনেন তাহলে।’ কলিগ একটা বড় দম নিয়ে শুরু করলেন। ‘নেত্রী তত্ববধায়ক বাতিল করে দেখতে চাইলেন তার প্রতিপক্ষরা এইটাকে কেমনে ফেস করে। তখন তিনি ভাইবা রাখছিলেন যদি প্রতিপক্ষ এইটারে ভালোমত ব্যবহার কইরা দেশে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে তিনি তত্বাবধায়ক দিয়ে দেবেন। আর তত্বাবধায়কের প্রধান হিসেবে অনুগত খাইরুল সাহেবতো রেডি আছেই। কিন্ত বিএনপি তত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করতো পারলো না। তাই নেত্রীকেও অযথা আর তত্বাবধায়ক দিতে হইল না। সুতরাং নেত্রীর পতনের প্রথম পথ তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেল। এখন আসেন দ্বিতীয় পথের দিকে। বাংলাদেশের আর্মির মধ্যে সবচেয়ে চৌকশ ও দক্ষ অফিসাররা পিলখানায় নিহত হবার পর আর্মি মোটামুটি ঠান্ডা হইলেও চার বছরে আর্মি আবার মোটামুটি দাঁড়ায়া গেছে। তো এই আর্মিকে কব্জা করার জন্য নেত্রী যা যা করার সবই করলেন। যে অফিসারদের পরিবার-আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিরোধী দলের ন্যূনতম কানেকশন আছে তাদের সবার চাকুরি খাওয়া হলো। অনুগত লোকদের প্রমোশন দিয়ে সর্বত্র সেট করা হলো। এই মুহূর্তে আর্মির মধ্যে সরকারের প্রতি অনুগত নয় এমন অফিসার একজনও নেই। তো আর্মির মাধ্যমে নেত্রীর পতনের দ্বিতীয় পথও এখন বন্ধ।’
কলিগ থামলেন। কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেছেন, একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করলেন তিনি। ‘এবার আসেন তৃতীয় পথের দিকে। আমাদের দেশের উপর ইউরোপ-আমেরিকার একটা চাপ কাজ করে, বিশেষভাবে নির্বাচনকে ঘিরে। বিদেশীদের এই চাপকে সামাল দেয়ার জন্য ইন্ডিয়ারে লেলিয়ে দিয়েছেন নেত্রী। এবং ইন্ডিয়া সেইটা সফলভাবে করতে সক্ষম হইছে। তো এই পথও এখন বন্ধ। চতুর্থ কম গুরুত্বপূর্ন পথগুলোর কথায় আসেন এবার। জুডিশিয়ারীকে সফলভাবে আওয়ামীকরণ করা গেছে। তাই জুডিশিয়ারীর কাছ থেকে নেত্রীর কোন ভয়ের আশঙ্কা নাই। বিরোধী দলের সাথে কানেকশন আছে এমন সব আমলা এখন চাকুরিচ্যূত। সরকারের অনুগত আমলারা প্রমোশন পাইয়া দাপটের সাথে দেশ চালাইতাছে। জনতার মঞ্চ টাইপের কিছু হওনের আশঙ্কাও এখন নাই। পুলিশের ভেতর গোপালগঞ্জী ছাড়া যে কয়টা আছে সব কয়টি নেত্রীর পরিক্ষীত। সেদিক থাইকাও ভয়ের কোন কারণ নাই। মিডিয়ার কথা যদি বলেন, বিরোধ মিডিয়াগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ, এক নয়া দিগন্ত ছাড়া। তো এইটাও সময় হইলে বন্ধ কইরা দেবেন নেত্রী।’
একটু থেমে কী যেন চিন্তা করে কলিগ বললেন, ‘নেত্রী তার পতনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পথটি বন্ধ করেছেন সেইটা বলতেই ভুলে গেছি। বিএনপির কমপক্ষে তিনজন স্থায়ী কমিটির সদস্য শেখ হাসিনার হয়ে কাজ করছে। বিএনপির আরো প্রায় ডজন খানেক নেতাকেও কিনতে সক্ষম হইছেন তিনি। ফলে বিএনপির আন্দোলনের কথা শুইনা নেত্রী ভয় তো পানই না, উল্টো হো হো কইরা হাসেন।’
‘এখন আসি আপনার কথায়।’ আমার দিকে আঙ্গুল তাক করলেন তিনি। ‘আমি কইছি সিটিগুলোতে হারার ভয় আছে, খামাকা এই ঝুকি নেয়ার দরকার কী! এইটা কেন কইছি জানেন? ওই যে নেত্রীর পলিসি, পতনের সব পথ বন্ধ করো। এখন এই সিটি নির্বাচনে হারলে পতনের পথগুলোর সামনে যে পাথরগুলো দিয়া বাধা দেয়া হইছে আচমকা তার দুই একটা পাথর যে আলগা হবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে বলেন? কোন পাথরই যেন আলগা না হয় সেই জন্যই তো সিটি নির্বাচন বন্ধ করা দরকার। বুঝলেন এবার?’
আমি মাথা নাড়ি, যেন সব বুঝেছি। হঠাৎ বস চলে এলে আমি কলিগের ডেস্ক থেকে উঠে পড়লাম। এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছি জানতে পারলে একগাদা বকা শুনতে হবে।
নিজের ডেস্কে গিয়ে বসার সময় মনে পড়লো উস্তাদ আবুল আলার একটি হেভিওয়েট কথা। তিনি বলেছিলেন ‘পৃথিবীর স্বৈরশাসকগণ তাদের পতনের সকল ফুটো বন্ধ করলেও একটি ফুটো বন্ধ করতে পারে না, আর সেটি হলো সেই ফুটো যে ফুটো দিয়ে আসলেই তার পতন হবে।’
বিষয়: রাজনীতি
১১০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন