মতিঝিলে বিভিষীকাময় বার ঘন্টা
লিখেছেন লিখেছেন রোকন উদ্দিন ০৮ মে, ২০১৩, ১১:০১:৩১ সকাল
পাঁচ মে ছিল আমার জীবনের বিভিষীকাময় একটা দিন। সকালে আব্দুল্লাহপুর-টঙ্গী এলাকায় গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়েছি। যোহরের নামাজ ও দুপুরের খাওয়া শেষে বসে যাওয়া গলা নিয়ে মতিঝিলের উদ্দেশে রওয়ানা দেই। মগবাজার থেকেই টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আসতে থাকে। তবু হাজার হাজার জনতার সাথে মিছিল নিয়ে দুপুর তিনটার কিছু পরে উপস্থিত হই মতিঝিলে। বেলা দুইটা থেকেই পল্টন, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম মার্কেট, কাকরাইল, শান্তিনগর এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পুলিশের ফাঁকা গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে এই এলাকাগুলো তখন রণক্ষেত্র। দুপুর তিনটার মধ্যে এত বিশাল এলাকা জুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে যে আমি ভবিষ্যৎ শঙ্কায় রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কারণ আমি জানি সেন্ট্রাল কিংবা রিমোট সব ধরনের কমান্ডের অনুপস্থিতিতে লাখো জনতার এই সক্রিয়তা যে কোন সময় যে কোন মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমি জাকির ভাইকে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বার বার বলার চেষ্টা করি, ভাই পরিস্থিতি খুব নাজুক, শুধু নাজুকই নয়, ভয়ঙ্কর রকমের নাজুক। শুনে জাকির ভাই হাসেন। যদিও আমি জানি, জাকির ভাইয়ের কিছুই করার নেই, তবু কেন যেন রাগ হয় তার উপর, কেন এই জনতার উপর কোন কমান্ডের ব্যবস্থা থাকছে না, সে জন্য হাতের কাছে কাউকে না পেয়ে অবুঝের মতো জাকির ভাইকেই দায়ী করে নিজেকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করি।
মঞ্চে বক্তৃতা চলছে। পাশাপাশি ফকিরাপুল, বিজয়নগর, দৈনিক বাংলা, বায়তুল মোকাররম এলাকায় চলছে সংঘর্ষ। পুলিশের গুলি, টিয়ার শেল, গ্রেনেডের জবাবে হেফাজতের কর্মীদের অস্ত্র হলো ইটের টুকরা ও বাঁশের লাঠি। সংঘর্ষে অংশ নেয়া কর্মীরা মঞ্চের খবর জানেন না, মঞ্চের বক্তারাও সংঘর্ষের সব খবর জানেন বলে মনে হলো না। উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যেই আসর ও মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। আল্লামা শফী সাহেব তখনও মঞ্চে এসে উপস্থিত হননি, বক্তারা বলছেন দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান চলবে। আমার ভ্রু ক্রমেই কুঁচকে যেতে থাকে। রাত আটটা বা সাড়ে আটটার দিকে খবর পেলাম সংঘর্ষরত কর্মীরা বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট ও বিজয়নগরের দখল ছেড়ে দিয়ে যথাক্রমে দৈনিক বাংলা ও ফকিরাপুলে অবস্থান নিয়েছে। এক হেফাজত কর্মীর লাশ এসে পৌঁছেছে মঞ্চে। আরও অসংখ্য হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে ইতিমধ্যেই বিক্ষোভকারীরা পুড়িয়ে দিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসসহ বেশ কিছু দোকানপাট ও স্থাপনা। আওয়ামীলীগ-যুবলীগের সাথে সংঘর্ষ করতে গিয়ে হেফাজত কর্মীরা মার খেয়েছে, মার দিয়েছে। এরকম নাজুক পরিস্থিতিতে আমার দুর্ভাবনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। কারণ হেফাজতে ইসলাম যত শক্তিশালী সংগঠনই হোক না কেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরা এখনও শিশু। রাজনৈতিক পরিপক্কতা না থাকার জন্যেই হেফাজত ভেবেছে যে সরকার লক্ষ লক্ষ জনতার এই সমাবেশ গুলি চালিয়ে ভন্ডুল করার ঝুঁকি নেবে না। কিন্তু আমি একজন সামাণ্য রাজনীতিবোদ্ধা হওয়া স্বত্বেও খুব সহজেই বুঝতে পারছিলাম যে আওয়ামী লীগ কোনভাবেই এই সমাবেশকে রাত অতিক্রম করতে দেবে না। বিকেলে সৈয়দ আশরাফের কঠোর বক্তব্য আমার শঙ্কাকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।
আমি বসেছিলাম মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবের সামনের গলিতে। রাত নয়টার দিকে পুলিশের একটি সাজোয়া যান সমাবেশের দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মঞ্চের প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। আমরা শ পাঁচেক লোক রুখে দাঁড়াই। ইট-পাটকেল আর আগুনের বেরিকেডে ব্যর্থ হয়ে সাজোয়া যানটি চলে যায় দৈনিক বাংলার দিকে। আমি জাকির ভাইয়ের ফোন পেয়ে বলাকা মোড় ছেড়ে দিয়ে পৌঁছাই নটরডেম কলেজের দিকে। মঞ্চের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ করি মঞ্চে উপবিষ্ট বক্তারা মাইকে জিকির করছেন আর মঞ্চের আশে-পাশে অবস্থানরত ক্লান্ত শ্রান্ত হেফাজত কর্মীরা জায়নামাজ বিছিয়ে ঝিমাচ্ছেন অথবা জিকির করছেন। নটরডেম কলেজের গেটের কাছে ঘন্টা খানেক সময় অতিক্রম করি গল্প-গুজবের মাধ্যমে।
খবর পাই, বেগম জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন যে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেন হেফাজতের পাশে এসে দাঁড়ায়। এই ঘোষণায় অনেককেই খুশি দেখলেও আমি মোটেই খুশি হলাম না, বরং বেগম জিয়ার এরকম অর্বাচীন সিদ্ধান্তের জন্য খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। হেফাজতের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি বেগম জিয়ার আহ্বান ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত যার খেশারত দিতে হয়েছে হেফাজতের লাখ লাখ কর্মীকে। প্রথমত, বেগম জিয়া যদি হেফাজতের সাথে অংশ নিতেই চাইতেন তাহলে তার উচিৎ ছিল বিকেলের মধ্যেই কমপক্ষে এক ডজন নেতা ও লাখ খানেক কর্মীকে মতিঝিলে পাঠানো এতে করে রাজনীতির হিসাব-নিকাশটা অন্য রকম হতো। আওয়ামী লীগকেও তখন হামলা করতে কয়েকবার ভাবতে হতো। দ্বিতীয়ত, পরের দিন নেতাকর্মীদের পাঠানোর প্ল্যানই যদি থাকে তাহলে রাতে এরকম ঘোষণা দেয়ার কোন দরকার ছিল না। মাথা মোটা বিএনপি এই সাধারণ জিনিসটা বুঝতে পারেনি যে শত্রুকে নিজের রণকৌশলের খবর আগেই জানিয়ে দিলে যুদ্ধে জেতা যায় না। বিএনপি বরং যেটা করতে পারতো সেটা হলো রাতটা ভালোয় ভালোয় কাটানো গেলে পরদিন সকালে ঘোষণা দিয়ে নেতাকর্মীদের মাঠে নামাতে পারতো। তখন বিপুল লোকের সমাগম ঘটানো গেলে আওয়ামী লীগ এমন ক্র্যাক ডাউনের সিদ্ধান্ত হয়তো নিত না। আমার বিবেচনায় বেগম জিয়ার ঘোষণাই হেফাজতের উপর আওয়ামী ক্র্যাক-ডাউনকে অনিবার্য করে তুলেছে। বিএনপির ঘোষণা শোনার পর আওয়ামী লীগ তার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে খেপা কুত্তার মতো হেফাজতের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
হেফাজতের উপর দুপুর একটা থেকে পরিচালিত পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের নির্দয় আক্রমন আমরা ঠেকিয়ে রেখেছিলাম রাত দুইটা বিশ মিনিট পর্যন্ত। এই সময়ের পূর্বে তাদের সর্বশেষ আক্রমণের ঘটনা ছিল রাত বারটা এক মিনিটে। ফকিরাপুল এলাকায় বারটা এক মিনিটে পুলিশ-বিজিবি-র্যাবের বিশটি গাড়ি আচমকা মতিঝিলের দিকে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ করে বসে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় স্লোগান, লাঠি দিয়ে লাইট পোস্টে আঘাত করে শব্দ সৃষ্টি, আগুনের বেরিকেড ও ইট নিক্ষেপ। চলবে…
বিষয়: রাজনীতি
১৪১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন