প্রতিপক্ষ দমনের সহজ উপায়
লিখেছেন লিখেছেন অপ্টিমিস্ট রোকন ১৪ জুন, ২০১৩, ০৪:৩৮:০৫ বিকাল
ইংরেজিতে একটা কথা আছে 'গিভ দ্য ডগ এ ব্যাড নেম এন্ড হ্যাং হিম'। এর মানেটা সহজ। আপনি যদি কাউকে আক্রমণ করতে চান, তাহলে আক্রমণের পূর্বে আপনার শিকার সর্ম্পকে কিছু মিথ্যা কথা সমাজে প্রচার করুন। প্রতিষ্ঠিত করুন আপনার শিকার এই এই ভয়ঙ্কর অপরাধের সাথে যুক্ত। এতে আপনার উদ্দেশ্য হাসিল নিষ্কন্টক হবে। কীভাবে? প্রথমত, লোকে জানবে অমুক তো খারাপ লোক, তাই তার উপর আক্রমণ চালানোতে দোষের কিছু নেই। আপনার হামলায় আহত-নিহত শিকারের ব্যাথা-বেদনা দেখে লোকে আহা-উহু করবে, কিন্তু দোষ চাপাবে শিকারের উপরই। বলবে কেন তোরা এই কাজগুলো করতে গেলি? দ্বিতীয়ত, আক্রমণ করার সময় আপনার কিছু সঙ্গী-সাথী-অস্ত্র-অর্থের প্রয়োজন হতে পারে, ঐ প্রচারণা আপনাকে সঙ্গী-সাথী-অস্ত্র-অর্থ পাইয়ে দেবে। তৃতীয়ত, আপনার শিকারের সঙ্গী-সাথীদের কনফিডেন্স নষ্ট হবে। তারা ভাববে, শিকার ব্যক্তিটি সত্যি সত্যি এরকম খারাপ কাজ করেনি তো! এমনকি কিছু সঙ্গী-সাথী সেই প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে শিকার ব্যক্তিটির সঙ্গও ত্যাগ করবে। চতুর্থত, শিকার ব্যক্তিটির কয়েক প্রজন্মকে সেই মিথ্যা কথাগুলোর দায় বহন করতে হবে। ফলে ঐ শিকার বংশ পরম্পরায় সমাজে অপরাধী হিসেবে পরিচিত থাকবে।
বর্তমান দুনিয়ার কয়েকটি ঘটনার উপর চোখ বুলালে আক্রমণকারীদের উপরোক্ত কৌশলগুলো বোঝা সহজ হবে। আফগানিস্তানে হামলার পুর্বেবুশ-ব্লেয়ার চক্র সারা পৃথিবীতে প্র্রচার করলো ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর দুজন ভয়ঙ্কর লোক। এই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা চালিয়ে কয়েক হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। আফগানিস্তানে জঙ্গি রাষ্ট্র কায়েম করে সারা পৃথিবীকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সুতরাং পৃথিবীর নিরাপত্তার স্বার্থে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানো দরকার। মিডিয়ার মাধ্যমে সার্থকভাবে এই প্রচারণা চালানোর পর ওয়ান ফাইন মর্নিং বুশ ব্লেয়ারের কার্পেট বোমায় প্রকম্পিত হলো কাবুল, ধ্বংশ হলো আফগানিস্তান। লোকে বললো, কেন তোরা টুইন টাওয়ারে হামলা চালাতে গেলি। মোল্লা ওমর আর বিন লাদেনের প্রতি যাদের ভালোবাসা ছিল তারাও আহা-উহু করে তাদের দায়িত্ব শেষ করলো। এবার আসেন ইরাকের কথায়। বুশ-ব্লেয়ার চক্র আফগানিস্তান ধ্বংশের পর মনযোগ দিল ইরাকের উপর। বিবিসি সিএনএন কয়েক বছর ধরে প্রচার করলো ইরাকে ব্যাপক বিধ্বংশী অস্ত্র আছে যা সারা পৃথিবীর জন্য হুমকি। প্র্রচারণা তুঙ্গে থাকা অবস্থায় কোন এক স্নিগ্ধ সকালে প্রাচীন নগরী বাগদাদ কেঁপে উঠলো বোমার আঘাতে। মুসলিমদের রক্তে লাল হলো মরুভূমি। লোকে বললো, তুই ব্যাটা স্বৈরাচারী সাদ্দাম মার্কিনীদের সাথে এত টক্কর দিতে গেলি কেন? সাদ্দামের বন্ধু-প্রতিবেশিরাও চোখ-কান বন্ধ করে রাখলো আর বললো এত বাড় বেড়েছিলি যখন, বোঝ্ এবার মজা।
শুধু আফগানিস্তান বা ইরাক নয়, একই কায়দায় গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। চেচনিয়া, বসনিয়া সহ পৃথিবীর যেখানেই আক্রমনকারীরা হামলা করেছে, হামলার পূর্বে শিকারকে সমাজে দানব হিসেবে চিত্রিত করে সেই হামলাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যদি প্রশ্ন করা হয় এটা কি বুশ ব্লেয়ারের আবিষ্কৃত নতুন কৌশল? উত্তর হলো না। এটা বুশ ব্লেয়ারের নবআবিষ্কৃত কৌশল নয়। বরং এটা সৃষ্টির আদি থেকে অনুসৃত অত্যন্ত পুরোনো একটি কৌশল। এই কৌশল প্রয়োগ করেছিল ফিরআউন বনী ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করার সময়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “ফেরাউনের সম্প্রদায়েরর্সদাররা বলল, তুমি কি এমনি ছেড়ে দেবে মূসা ও তার সম্প্রদায়কেদেশময় হৈ-চৈ করার জন্য এবং তোমাকে ও তোমার দেব-দেবীকে বাতিল করে দেবার জন্য। সে বলল, আমি এখনি হত্যা করব তাদের পুত্র সন্তানদিগকে; আর জীবিত রাখব মেয়েদেরকে। বস্তুতঃ আমরা তাদের উপর প্রবল (৭:১২৭)।” এই আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি বনী ইসরাইলের উপর নির্মম হত্যাকান্ড চালানোর জন্য ফিরআউন ও তার সঙ্গী-সাথীরা সমাজে প্রচার করেছিল যে মূসা ও তার সম্প্রদায় হৈ চৈ করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
এবার আসুন নজর দেই ষষ্ঠ শতাব্দিতে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করা মুহাম্মাদ (সা) নামক এক ব্যক্তির দিকে। পিতৃহীন মুহাম্মাদের (সা) একমাত্র আশ্রয়দাতা আবু তালিব ছিলেন সমাজের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। মক্কার নেতারা আবু তালিবের কাছে গিয়ে মুহাম্মাদের (সা) নামে নালিশ জানিয়ে মুহাম্মাদকে (সা) তার কাজ থেকে নিবৃত করার চেষ্টা করতো। কিন্তু আবু তালিব তার স্নেহের ভাতিজাকে কখনো এব্যাপারে চাপ দেননি। কাফির সর্দাররা যে ভাষায় মুহাম্মাদের (সা) বিরুদ্ধে নালিশ জানাতো তা এরকম। “হে আবু তালিব, আপনি আমাদের মধ্যে বয়সেও প্রবীন, মান-মর্যাদায়ও শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত। আমরা দাবি করেছিলাম যে আপনার ভাতিজার অত্যাচার থেকে আপনি আমাদের বাঁচাবেন। কিন্তু আপনি কিছুই করলেন না। আল্লাহর কসম আমাদের বাপ দাদাকে যেভাবে গালি দেয়া হচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষকে যেভাবে বেকুফ ঠাওরানো হচ্ছে এবং আমাদের দেবদেবীর যেভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে, তা আমাদের কাছে অসহ্য। আপনি যদি ওকে না ঠেকান, তবে আমরা ওকেও দেখে নেব, আপনাকেও দেখে নেব। হয় আমরা বেঁচে থাকবো, না হয় মুহাম্মাদ ও তাঁর সমর্থকরা বেঁচে থাকবে (সীরাতে ইবনে হিশাম)।” এই ছোট্ট সংলাপেই বোঝা যায় মক্কায় রাসুল মুহাম্মাদকে (সা) প্রতিরোধ করার জন্য তার প্রতিপক্ষরা মুহাম্মাদ(সা) সম্পর্কে সমাজে অনেক মিথ্যা কথা প্রচার করতো যেন তাকে দমন করতে গেলে দর্শকরা এই দমন-পীড়নকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়।
প্রশ্ন হলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রতিপক্ষকে দমন করার এই যে প্রচারণা কৌশল, এটা কি এখন থেমে গেছে? উত্তর হলো না, থামেনি। বরং পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চি জমিতে, যেখানেই যুক্তিকে পেশী দিয়ে দমন করার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে, সেখানেই পেশীবানরা আক্রমণের পূর্বে তাদের প্রতিপক্ষকে সমাজে দানব হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে যেন দর্শকরা তাদের আক্রমণকে অবৈধ না ভাবে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, কতজন নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন তার কোন তালিকা এমনকি কোন পরিসংখ্যান না থাকা স্বত্বেও জামায়াতে ইসলামীকে ত্রিশ লক্ষ মানুষের হত্যাকারী ও দুই লক্ষ নারীর শ্লীলতা লুটকারী বলে সমাজে প্রচার করা হচ্ছে যাতে এই অজুহাতে তাদেরকে দমন করা যায়। শিবিরের কেউ কারও রগ কেটেছে এমন কোন প্রমাণ না থাকা স্বত্বেও শিবিরকে রগকাটা বলে সমাজে প্রচার করা হচ্ছে যেন এই অজুহাতে শিবিরের উপর দমন-পীড়ন চালানো যায়। এভাবে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ও অগ্রসরমান ইসলামী দলের শীর্ষ সব নেতাকে ফাঁসি এবং অন্যান্য সব নেতা-কর্মীকে জেলে দেয়ার জন্য এই দলটিকে সমাজে দানব হিসেবে চিত্রিত করার আদিমতম প্রচারণা কৌশল প্রয়োগ করে যাচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষরা।
তবে আশার কথা হলো, শত কৌশল প্রয়োগ করেও ফিরআউন যেমন মুসাকে (আ) দমন করতে পারেনি, আবু জেহেল গং যেমন মুহাম্মাদকে (সা) দমন করতে পারেনি, বাংলাদেশেও ইসলামের অগ্রযাত্রাকে ফিরআউন-আবু জেহেলের উত্তরসূরীরা দমিয়ে রাখতে পারবে না ইন শা আল্লাহ।
বিষয়: রাজনীতি
১৪৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন