"ঢাকা শহরে মৃত্যুর অনুভূতি বদলে গেছে"
লিখেছেন লিখেছেন কানামাছি ১৩ মার্চ, ২০১৩, ০১:৫১:১০ দুপুর
আমার বন্ধু পলাশ।সদা প্রাণচঞ্চল এক মানব।খুনসুটি করতেই বেশি ভালবাসে। ওর এই চটপটে স্বভাবের জন্য আমি প্রায়ই ওকে অনেকটা গম্ভীর হয়ে বলি, পলাশ, দেখো তুমি দিন দিন বড় হচ্ছ, স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েরও পাঠ চুকাতে যাচ্ছো আর তুমি কিনা এখনো ছেলেমানুষি ছাড়তে পারলে না। পলাশ একগাল হেসে বলে, “আমি বাবা আমার এই স্বভাব বদলাতে চাইনা। আমি যেমন আছি তেমনই ভালো, খুব গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে থাকলেই হয়না, আমি চাই, সবাই তার আসল চরিত্রটিই অন্যের সামনে প্রকাশ করুক। একটা আলগা official ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগেনা”। আমি ওকে বললাম, তোমার এই সরল, সদা চঞ্চল স্বভাবের দরুণ কিছু মানুষ তোমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে, তোমার কি তা ভালো লাগে? পলাশ গম্ভীর হয়ে বলল, “কে কি বলল আমার তাতে কিছু যায় আসে না”। আমি ওর মনের অবস্থা বুঝে বিষয়টা পাল্টালাম।
পলাশ হাসিখুশি, বেখেয়াল ভাব নিয়ে থাকলেও মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে পন্ডিতের মত প্রশ্ন করে। এই তো সেদিন আমরা পাচ বন্ধু গল্পে মত্ত ছিলাম। হঠাৎ পলাশ এসে হাজির। ও আচ্ছা একটা কথা বলে রাখা ভালো, এমনিতে পলাশ হাসি-ঠাট্টা নিয়েই ব্যস্ত, এর মাঝে আবার আমাদের ডিপার্টমেন্টে ৭ দিনের এক দুর্দান্ত সফর হয়ে গেল। সেখানে এক সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম আমরা, ও আবার সেই অনুষ্ঠানে নংপুংসক (হিজড়া) এর অভিনয় করেছিল। আর তার রেশ এখনো কাটেনি। সুযোগ পেলেই তাই পলাশকে এ নিয়ে খুনসুটি করতে ছাড়েনা কেউ। তারপর পলাশ আমাদের পাচজনের সামনে এক প্রশ্ন ছুড়ে দিল। ও বলল, “আচ্ছা তোরা বল তো “Good Approach মানে তোরা কি বুঝিস?” কৌশিক সাথে সাথে বলেই ফেলল, শোন পলাশ, ধর তোকে কেউ একটা থাপ্পড় দিল, আর তুই সেটিকে Negative হিসেবে না নিলেই তো এটা Good Approach. সবাই তো হো হো করে হেসে উঠল। মাছুম, আমি, আদনান অবশ্য নিজেদের পান্ডিত্য জাহির করার যথাসার্ধ চেষ্টা করলাম।পরে অবশ্য বুঝলাম আমাদের কথায় পলাশ এর কান ভারী হলেও মন ভরেনি। ওহ একটা মজার বিষয় আছে, যদি কোন যুক্তি বা কথা পলাশ এর ভাল লাগে, তাহলে পলাশ তার হাতটা বুকের উপর রেখে হাসে আর বলে, ভাল লাগলো গো, একেবাবে এইখানে ধরেছে। এইতো গেল Good Approach এর বিশ্লেষণ। এর কিছুদিন আগে Library তে পড়ছিলাম, কোথ্থেকে যেন পলাশ এসে হাজির। আমাকে বলল, বের হও কথা আছে। আমি বুঝলাম নিশ্চিত নতুন কোন Approach. বের হয়েই বলল, আচ্ছা Good Personality বলতে তুমি কি বুঝ? আর কিভাবেই বা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হওয়া যায়? আমিও একটু পন্ডিতের মত বেশ কিছু সবক দিলাম, তাতে পলাশ সন্তুষ্ট হলো,তবে বোঝা গেল পুরোপুরি না। আমি পরামর্শ দিলাম যাদের ব্যক্তিত্ব তোমার ভাল লাগে তাদের তুমি পর্যবেক্ষণ কর, তাদের সাথে Consult কর, ভালো ফল পাবে আশা করি। গতকাল বিকেলে ও আবার আমার বাসায় (মেস বলতে ইচ্ছে হয়না) এসেছিল ঘুরতে। আমি আবার আজিমপুর থাকে। দুই বন্ধু plan করেছিলাম লালবাগ কেল্লা দেখতে যাব। ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় কবরস্থান “আজিমপুর কবরস্থান”, যা পাড়ি দিয়ে কিনা আমাদের বাসায় আসতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন আশরাফুল মাখলুকাতকে না ফেরার দেশে যেতে দেখি। সেদিন বাসায় এলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পলাশ
কি খাবে বন্ধু? বনরুটি না বাকরখনি? আমার দিকে যেন কোন খেয়ালই নেই। বুঝলাম ও কোন বিষয় নিয়ে ভাবছে। পলাশ বললো, দেখ বন্ধু একটা বিষয় খেয়াল করেছো ঢাকা শহরের কি অবস্থ। আমি বললাম কি? পলাশী থেকে আমার বাসা পর্যন্ত জ্যাম এই তো বলছিলি তাইনা। পলাশ বললো, না বন্ধু আমি ওসব জ্যাম-ট্যাম নিয়ে ভাবছিনা। আমি বললাম তাহল কি নিয়ে ভাবছো বন্ধু? পলাশ বলল, দেখ ঢাকা শহরটা যেন একটা লাশ/প্রাণহীন নগরে পরিনত হয়েছে।
। আমাদের গ্রামে যদি কেউ মারা যায় তাহলে তাকে খাটিয়ায় করে কিছু মানুষ ধীরে ধীরে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যায় কবর দিতে। কেন জানি, এই কংক্রিটের দেয়ালে ঘেরা শহরটির মত সবকিছু প্রাণহীন হয়ে গেছে। গ্রমের মেঠোপথ দিয়ে যখন একজন মৃত মানুষকে খাটিয়ায় করে না ফেরার দেশে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মাঝে মৃত্যূর অনুভূতিটা একবার হলেও অন্তত দোলা দিয়ে যায়। আর আসার সময় দেখলাম ট্রাকে করে একজন মনুষকে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানিনা এই লক্ষ লক্ষ লোকের মাঝে ঠিক কতজনের মাঝে মৃত্যুর অনুভূতি মনে করে দিয়ে গেল। একগাল হতাশা নিয়ে পলাশ বলল, দেখ দোস্ত…. ঢাকা শহরে মৃত্যুর অনুভূতি বদলে গেছে……আমি স্থির হয়ে শুনছিলাম আমার বন্ধু পলাশের কথা আর ভাবছিলাম সদা চঞ্চল, রসিক পলাশের আলোচনার কথা/ভাবনার কথা। আর মনে মনে বললাম, কংক্রিটের এই দেয়াল ঘেরা ঢাকা শহরে আজো কিছু মাটির মানুষ আছে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন