এক সন্ধ্যার গল্প

লিখেছেন লিখেছেন কানামাছি ১৬ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:৪১:২০ রাত

আব্বাজানের দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যা।এর ভিতর নতুন করে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে।স্থানীয় ক্লিনিকের ডাক্তারকে দেখালেও মন বলছিল,ঢাকায় এনে চেকআপ করালে ভালো হত।যে চিন্তা সেই কাজ।আব্বাজানকে বললাম,“একটু কষ্টকরে হলেও আগামীকালের সকালের ট্রেনে আম্মাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসেন,আপনাকে ঢাকার বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব”।আব্বাজান যথারীতি সকালের ট্রেনে ঢাকায় চলে আসলেন।দুপুরে দুমুঠো খেয়ে বিকাল পাঁচটার ভেতর এক বড় ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে গিয়ে হাজির হলাম।বড় ডাক্তার! তাইতো দুই-তিন আগে থেকেই সিরিয়াল দিতে হয়।এক পরিচিত ভাইয়ের সহায়তায় অনেক কষ্ট করে সিরিয়ালে নাম লিখালাম।বড় ডাক্তার সাহেব প্রতিদিন ৭৫ জন রোগী দেখেন,ভিজিট ৭০০ টাকা।আমাদের সিরিয়াল নাম্বার ৭৪। সিরিয়াল ৭৪ হলেও মন খারাপ করলাম না,বড় ডাক্তারের চেম্বারে এসেছি,সিরিয়ালে যে নাম লেখাতে পেরেছি এও কম কিসের।মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ পড়লাম।

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে বড় ডাক্তার সাহেব চেম্বারে হাজির হলেন।চেম্বারের সামনের রিসিপসন রুমে একপাশে ৩০ টা চেয়ার সাজানো।আমি দেয়াল ঘেঁষে পাঁচ নম্বর সারির তিন নম্বর কলামের চেয়ারটায় বসলাম।আমার আব্বাজান বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেননা,তাইতো কিছুক্ষণ পর পর চেয়ার থেকে উঠে এদিক ওদিক হাঁটাচলা করতে লাগলেন।আমার ব্যাগে হান্স অ্যান্ডারসনের একটা ছোটগল্পের অনুবাদ ছিল।কলিকাতার নামকরা বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক বইটির অনুবাদ করেছেন।কিন্তু পড়ে একটুকুন সাহিত্যরস পেলাম না।মনে হচ্ছিল যেন বই নয় কুইনাইন গিলছি।ইতোমধ্যে পুরো রিসিপসন রুম প্রায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে।শুধুমাত্র আমার বামপাশের দুটো চেয়ার খালি পড়ে ছিল।হঠাৎ এক মহিলার আর্তচিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

“ ও আল্লাহ ...আমি মরে গেলাম ,আমাকে বাঁচাও ... ডাক্তার সাহেব আমাকে বাঁচান ...ও আল্লাহ...ও খোদা... আমি মরে গেলাম...লা ইলাহ ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ...লা ইলাহা...”

কিছুক্ষণ পর এক ভদ্রলোক(পড়ে অবশ্য জানতে পারলাম উনার ছেলে) তাকে ধরে এনে বাইরের দিকের চেয়ারটায় বসালেন।মাঝখানের চেয়ারটা তখনো খালি পড়ে ছিল।উনার আর্তনাদ কিছুটা থামলে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম,“খালাম্মা আপনার কি হয়েছে”?উনি বললেন,বাবা আমার কিডনিতে সমস্যা।একটুকু বলার পর...

“ ও আল্লাহ ...আমি মরে গেলাম ,আমাকে বাঁচাও ... ডাক্তার সাহেব আমাকে বাঁচান ...ও আল্লাহ...ও খোদা...আমি মরে গেলাম...লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ...লা ইলাহা...”

বইটা যে আর মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারবোনা এটা নিশ্চিত হয়ে যত্ন করে বইটি ব্যাগের ভিতর রেখে দিলাম।চোখ নাকি মনের কথা বলে,তাই আজ এই পরীক্ষা করার জন্য আনমনে কিছুক্ষণ খালাম্মার চোখের দিকে চেয়ে রইলাম।পাশাপাশি বসাতে খুব ভালোভাবে চোখ দেখতে পারিনি তবে যতটুকু বিশ্লেষণ করেছি তাতে মনে হয়েছে,খালাম্মার হৃদয়ের মাঝে যে দুঃখের সাগর প্রবাহিত হচ্ছে চোখের জল সে তুলনায় খুবই নগণ্য।এরই মাঝে এক ষোড়শ বয়সী তরুণী তার মাকে নিয়ে আমাদের খালি চেয়ারটার দিকে আসছিল।সেই তরুণীর মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, তার কিডনিতে যেন প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে ! কিন্তু একদম সুস্থিরভাবে মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলছিলেন।তাকে দেখে কেমন যেন মায়ায় পড়ে গেলাম।ঐদিকে খালাম্মার আর্তনাদ কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে চলছে।চেয়ারের কাছাকাছি এসেই খালাম্মাকে বললেন, “excuse me, aunty.আপনি কি ভিতরের চেয়ারটায় যাবেন ? আমি একটু বসব”।খালাম্মা জবাব দিলেন “আমি অসুস্থ ভিতরে যেতে পারবোনা, এর পর আবারও...ও আল্লাহ... ও খোদা আমাকে বাঁচাও... আমি মরে গেলাম...” মহিলাটি কোন প্রতিউত্তর না দিয়ে আরও আন্তরিকতার সাথে বললেন, “excuse me, aunty.আপনি কি একটু ভিতরের চেয়ারটায় বসবেন? খালাম্মা যেন আরও ক্ষেপে গেল।ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “আমি ভিতরে যেতে পারবনা”।মহিলাটি বলল, “তাহলে আপনি একটু উঠুন,আমি ভিতরে বসি”।কিন্তু না,তিনি উঠবেনও না।তিনি ঐ মহিলাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, “তুমি এই দুই সারির ফাঁক দিয়ে যেতে পারলে যাও আর না হয় এখানে দাঁড়িয়ে থাকো,আমি অসুস্থ,ও আল্লাহ আমি মরে গেলাম... ও মা... ও ...”।

এই বয়সী একজন মানুষের আচরণ এমন অমানবিক হতে পারে আমি ভেবে পেলাম না ! অন্যদিকে এত অন্যায় করার পরও ঐ মহিলা কিছু বললনা? উনি কেমন মানুষ ? মনে হচ্ছিল,উনার হয়ে আমি কিছু কথা শুনিয়ে দেই কিন্তু আমি বলতে যাব,ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি আস্তে করে বললেন,“খালাম্মা আমিও অসুস্থ,আমরা এ জন্যই তো হাসপাতালে এসেছি”।অবাক করা কাণ্ড,এ কথা শুনে খালাম্মা একদম চুপ হয়ে গেল।আর কোন কথা না বলে চেয়ারটা ছেড়ে দিল।

আব্বাকে বড় ডাক্তার দেখিয়ে রাঁত সাড়ে এগারটার দিকে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন ভাবছিলাম।“মানুষের অন্তরে যখন প্রশান্তি থাকেনা তখন তার মন-মানসিকতাও ভালো থাকেনা।একজন মানুষ তা যতই লুকানোর চেষ্টা করুক একসময় তা বেড়িয়ে আসবেই।অন্যদিকে অন্তরে প্রশান্তি থাকলে বাইরের আঘাত নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়।পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই সত্যের পতাকাবাহীরা মানুষের সামনে যখন সত্যকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে,তখন তাদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়গ।কিন্তু এই দৈহিক অত্যাচার তাদের প্রশান্তচিত্ত অন্তরে খুব বেশী প্রভাব ফেলতে পারেনি।যার ফলশ্রুতিতে যুগে যুগে শত অত্যাচারের পরও প্রশান্তচিত্ত মুমিনেরা জয় লাভ করেছে।আর অস্থিরচিত্ত মুমিনেরা দুনিয়ার ভোগবিলাসে মত্ত থেকে হারিয়ে গেছে কালের গহবরে"।

বিষয়: সাহিত্য

১৩৯৯ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

284988
১৬ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৪৬
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৬ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:৪৯
228296
কানামাছি লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
285016
১৭ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৩৫
নাছির আলী লিখেছেন : অনেক ভাল হয়েছে।সবর ও সদ্বব্যহার মানুষকে কোথাই নিয়ে যায়? সহজ সরল সাবলিল ভাষায় বর্ণনা টা অনেক অনেক সুন্দর হয়েছে। যাযাকাল্লাহ
১৭ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:০৯
228365
কানামাছি লিখেছেন : আমার মত মানুষদের উৎসাহ অনেক বেশী প্রয়োজন।ধন্যবাদ আপনার আন্তরিক উৎসাহের জন্য।আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক এই কামনা করি।
285018
১৭ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৩৯
আফরা লিখেছেন : পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই সত্যের পতাকাবাহীরা মানুষের সামনে যখন সত্যকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে,তখন তাদের উপর নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়গ।কিন্তু এই দৈহিক অত্যাচার তাদের প্রশান্তচিত্ত অন্তরে খুব বেশী প্রভাব ফেলতে পারেনি।যার ফলশ্রুতিতে যুগে যুগে শত অত্যাচারের পরও প্রশান্তচিত্ত মুমিনেরা জয় লাভ করেছে।আর অস্থিরচিত্ত মুমিনেরা দুনিয়ার ভোগবিলাসে মত্ত থেকে হারিয়ে গেছে কালের গহবরে"। খুব খুব খবই সুন্দর বলেছেন ভাইয়া ।
১৭ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:১২
228368
কানামাছি লিখেছেন : প্রশংসা শুনতে সবার ভালো লাগে তবে আমার প্রশংসা হলেই চলবেনা একটু দুয়া চাই।একেবারে মন থেকে দুয়া। হে আল্লাহ আমরা যেন আমাদের গুণগুলোকে আল্লাহর কাজে লাগাতে পারি।
285063
১৭ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৩:৪৬
শেখের পোলা লিখেছেন : অত্যন্ত সঠিক উপসংহার দিয়েছেন৷ ধন্যবাদ৷
১৭ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:১৫
228369
কানামাছি লিখেছেন : সারাদিন চিন্তা করছিলাম কি দিয়ে উপসংহার আনব।আলহামদুলিল্লাহ আমি নিজেও খুশী এ ধরণের উপসংহার টানতে পেরে।আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ।
285105
১৭ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:২৮
মামুন লিখেছেন : “মানুষের অন্তরে যখন প্রশান্তি থাকেনা তখন তার মন-মানসিকতাও ভালো থাকেনা।একজন মানুষ তা যতই লুকানোর চেষ্টা করুক একসময় তা বেড়িয়ে আসবেই।অন্যদিকে অন্তরে প্রশান্তি থাকলে বাইরের আঘাত নিতান্তই তুচ্ছ মনে হয়। - খুব সুন্দর বলেছেন। Good Luck Good Luck
285124
১৭ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৩৫
কানামাছি লিখেছেন : আপনি সময় নিয়ে আমার লিখাটা পড়েছেন এজন্য ভালো লাগলো।আমার জন্য দুয়া করবেন।
285332
১৮ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১২:৫৯
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : আপনার লেখার স্টাইল সুন্দর। তুলনা এবং বিশ্লেষণ দু'টোই ভাল লাগল।

১৮ নভেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫১
228878
কানামাছি লিখেছেন : আপনার মত একজনের কাছ থেকে এত বড় প্রশংসা।আম কি হজম করতে পারব ? দুয়া করবেন আপু।আল্লাহ যেন আমার যোগ্যতা বাড়িয়ে দেন।আমিন।
১৯ নভেম্বর ২০১৪ সকাল ০৬:২৫
229118
রেহনুমা বিনত আনিস লিখেছেন : 'আপনার মত একজন'! - আমি কি এতই খারাপ? Worried Crying
286312
২০ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৩১
কানামাছি লিখেছেন : হুম আপনি অনেক অনেক .....

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File