বাতিঘর
লিখেছেন লিখেছেন কানামাছি ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৪০:০৩ সকাল
বৈশাখ মাস,গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ। গেল বছর শহর থেকে একশ টাকা দিয়ে আম গাছের দুইটা কলমের চারা কিনেছিল সোহেল মল্লিক। কলমের চারা হওয়ায় এবছরই তাতে মুকুল এসেছে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে আনমনে চেয়ে আছে মল্লিক সাহেব সেই গাছের দিকে।হঠাৎ ঘুঘু পাখির ডাকে তার সে নিরবতা ভাঙ্গে।একা একা হেসে উঠেন তিনি।
মল্লিক সাহেব সিরাজগঞ্জ জিলার রায়গঞ্জ থানার সিনিয়র কৃষি অফিসার।গত বছর রাজশাহী থেকে প্রমোশন পেয়ে এখানে এসেছেন। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মদনপুর থানার ইছামতী গ্রামে।বাবা-মা আর পাঁচ ভাই বোন মিলে তাদের পরিবার। ভাইদের মাঝে তিনি দ্বিতীয়। বড় বোন হেলেনার দুধে আলতা গায়ের রঙ দেখে এক হাঁস-মুরগী ব্যবসায়ি অল্প বয়সেই তাকে বিয়ে করে নেত্রকোনা শহরে নিয়ে বসবাস শুরু করেন।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্তানের মা হয় হেলেনা।বিয়ের পর জামাই মহাব্বত আলী অনেক অনুরোধ করে তাকে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার জন্য কিন্তু হেলেনার অনাগ্রহেই পড়াশুনা আর হয়ে উঠেনা শেষ পর্যন্ত। ছোট ভাই কামালের পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ থাকলেও দুই দুইবার টাইফয়েড জ্বর হয়ে শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়,আর তাতেই ছেদ পড়ে যায় তারও পড়াশুনার। অন্য বোন ফাতেমার বয়স এখন এক বছর। এক আধটু কথা বলতে শিখেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে,নতুন কোন মানুষ দেখলে তার কোলে আসতে চায়।যেন সবার তার আপনজন।আর সবার বড় ইব্রাহীম থেকেও যেন নেই,ছোটবেলায় হারিয়ে যায় ঈশ্বরদী রেলষ্টেশন থেকে।অনেক খুঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায়নি। সবার আশা হয়ত কোন একদিন ফিরে আসবে সে।মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে ছেলেকে স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠেন মা আমেনা বেগম।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাবল ফাস্ট ক্লাস নিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে সোহেল মল্লিক।স্বপ্ন ছিল জীবনে বড় কিছু হবার।এই দেশ এবং পৃথিবীর জন্য কিছু করার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্রের প্রিয় ছাত্র ছিল সোহেল মল্লিক।ছাত্র-শিক্ষক একসাথে মিলে গবেষণাগারে ধানের নতুন জাত আবিস্কার করবে এই আশা ছিল বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ীদের। কিন্তু বাবার আর্থিক অবস্থা হঠাৎ খারাপ হবার দরুন গবেষনার পথ ছেড়ে জীবনযুদ্ধে নামতে হয়েছে তাকে।
বাবা তাসনিম মল্লিক নেত্রকোনা শহরে এক অফিসে পিয়নের চাকরি করতেন। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে অফিসে যেতেন। একদিন রাতের বেলায় বাড়ি ফেরার সময় ডান চোখে ঝি ঝি পোকা পড়ে। বাড়িতে এসে হারুন ডাক্তারের কাছে গেলে হারুন ডাক্তার গাছ গাছড়া দিয়ে এক প্রকার ওষুধ বানিয়ে তার চোখে দিতে বলেন।ওষুধ দেয়ার কিছুদিন পর চোখ ফুলে একেবারে কদবেলের মত হয়ে যায়।সোহেল বাড়িতে এসেই বাবাকে মোমেনশাহী মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তার যা বলে তাতে সোহেলের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।তার বাবার ডান চোখ চিরদিনের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে।
গ্রামের মানুষ বলাবলি করে হারুন ডাক্তার হিংসে করেই এ কাজ করেছে।কিন্তু তাসনিম সাহেব আবার এসব কান কথায় বিশ্বাস করতে চায়না।তার মতে হারুন ডাক্তার শহরের ডিগ্রিধারী ডাক্তারের চেয়েও অনেক বেশি জানেন।সারা জীবন কত মানুষের যে ফ্রি চিকিৎসা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।সাপে কাঁটা রোগী থেকে ডেলিভারি রোগী সব চিকিৎসায় তার হাত পাকা।মানুষের বিপদে-আপদে রাত-বিড়াতে একাই বেরিয়ে পড়েন লন্ঠন হাতে।আর সবচেয়ে বড় কথা সেই তো মানুষ,ভুল তো মানুষই করে।সবাই যে যাই বলুক,তাসনিম সাহেব এতকিছুর পরেও হারুন ডাক্তারকে দেখলে সবার আগে সালাম দেয়।
ডান চোখটি নষ্ট হয়ে যাবার পর থেকেই সারাক্ষন বাড়িতে থাকেন তাসনিম সাহেব।আর দুইটা বছর কাজ করলেই পেনশনের পুরো টাকাটা পেতেন।কিন্তু সোহেলের পিড়াপিড়িতে আর কাজে যাওয়া হয়ে উঠেনা।নেত্রকোনা শহর থেকে একটা রেডিও কিনে আনে সোহেল তার বাবার জন্য। গাছ লাগানোর শখ থাকলেও এতদিন তা লাগানো হয়ে উঠেনি তাসনিম সাহেবের। কিন্তু এবার যখন অসুস্থ হয়ে বাড়িতে অবসর সময় কাটাচ্ছেন তখন সকল রকমের ফলের গাছ লাগিয়ে বাড়ি ভর্তি করে ফেলেছেন তিনি।আর তাইতো আপাতত রেডিও শোনা আর গাছের সেবা করতেই সারাদিন পার হয়ে যায় তার।
রায়গঞ্জের সরকারি কোয়াটারে সোহেল একাই থাকে। সকালে আর রাতে এসে এক মহিলা রান্না করে দিয়ে চলে যায়।ছেলেবেলা থেকেই বই পড়ার দারুন নেশা সোহেল মল্লিকের,তবে একাকি আর কত সময় বই পড়ে কাটানো যায়।একাকীত্ব ঘুচানোর জন্য অনেকদিন ধরেই ছেলের বিয়ের জন্য চেষ্টা করছে তাসনিম সাহেব কিন্তু কেন জানি নিরবতাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সোহেল। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও সপ্তাহের তিনদিন তাই রাত্রিবেলা গ্রামের ছাত্রদের নিয়ে অঙ্ক কষতে বসেন।জটিল জটিল সমস্যার সব সহজ সমাধান বের করে দেওয়াতে গ্রামের ছেলে বুড়ো সব মানুষের কাছে সোহেল মল্লিক এখন কৃষি অফিসারের চেয়ে অঙ্কের মাস্টার হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছেন।
মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং শেষ সপ্তাহে গণিতের উপর একটা করে কুইজের আয়োজন করেন তিনি ছাত্রদের নিয়ে।মাসের প্রথম সপ্তাহে কুইজ হয় পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের নিয়ে এবং শেষ সপ্তাহে কুইজ হয় নবম এবং দশম শ্রেণীর ছাত্রদের নিয়ে।পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে থেকে যে প্রথম হয় সে পায় কোন সফল মানুষের আত্মজীবনীমূলক বই আর দ্বিতীয় আর তৃতীয় যারা হয় তারা প্রত্যেকে পায় একটি করে “ঈশপের গল্প সমগ্র”। শেষ সপ্তাহে যে প্রথম হয় তার জন্য থাকেনা কোন পুরষ্কারের ব্যবস্থা।তবে পুরষ্কারের ব্যবস্থা না থাকলেও শেষ সপ্তাহের কুইজেই ছাত্রদের অংশগ্রহন তুলনামূলক বেশি দেখা যায়।এই কুইজ প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হয় তাকে নিয়ে সোহেল মল্লিক নিজ খরচে ঢাকায় বেড়াতে আসেন।আর বেড়ানোর সেই জায়গাটা আর কোথাও নয়,তা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং বুয়েট ক্যাম্পাস।সারাদিন তার স্বপ্নের ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখান।(ছাত্রদের মাঝে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার আগ্রহ তৈরি করার জন্যই মূলত তার এই প্রচেষ্টা)।তার এই অদ্ভুত শখের ফলে গ্রামের বেশির ভাগ ছেলেরই জ্ঞান-অর্জনের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা আর নিজেদেরকে দেশসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবিস্কার করার তীব্র বাসনা জেগেছে।কার্জন হলের লাল বিল্ডিং এর গল্প প্রাইমারীর ছাত্রছাত্রীদের কাছেও এখন আর তাই অপিরিচিত নয়। এভাবে প্রায় চারটি বছর এই স্বপ্ন বুননের কাজ করে যায় সোহেল মল্লিক রায়গঞ্জের এক নির্জন পল্লীতে ।হঠাৎ একদিন রাতের বেলায় অংক কষতে এসে অদ্ভুত এক অবস্থার সম্মুখিন হয় তার স্বপ্নের সারথিরা।সোহেল সাহেবের বাড়িতে এসে দেখে,তার বাসায় গেটে ইয়া বড় একটা থ্রি-সার্কেল চায়না তালা ঝুলছে।বাড়ির দারোয়ানকে জিজ্ঞাস করতেই দারোয়ান মাসুম আলি হলুদ খামের একটা চিঠি তাদের হাতে ধরিয়ে দেন।চিঠিটি পেয়েই কালবিলম্ব না করে খামটি ছিড়ে ফেলে মাসুদ রানা।
পুরো পৃষ্ঠাই খালি শুধু মাঝখানে বড় বড় করে লিখা ...
“মোতাসিম,রাতুল,জনি,রতন,মাসুদ,রোকন- তোমরা তোমাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখ”
প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনায় হু হু কেঁদে উঠে রতন।সোহেল মল্লিক এবার বদলি হয়ে পাবনা জিলার সাথিয়া থানায় আসেন।এখানেও থেমে থাকেনা তার স্বপ্ন বুননের কাজ।
বাতিঘর বেঁচে থাক,দূর হোক অজ্ঞানতার অন্ধকার।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন