ইতিকাফ যখন ইসলামাবাদে (১)
লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ ৩১ আগস্ট, ২০১৪, ০৭:২৯:১৯ সন্ধ্যা
পিমস হাসপাতাল, ইসলামাবাদ
রামাযানে পবিত্র উমরা পালন ও মাসজিদুল হারামে ইতিকাফের একটা সুযোগ এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মত পাকিস্তানেও সিঙ্গেল ওমরাযাত্রীদের জন্য সর্বনিম্ম ৪০ বছর বয়সসীমা নির্ধারিত থাকায় বাংলাদেশ দুতাবাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেশ ক'দিন দৌঁড়াদৌঁড়ি করেও সমস্যাটির সুরাহা করা গেল না। ফলে মাঠে মারা গেল সুযোগটা।
তবে ইতিকাফের নিয়তটা ধরে রেখেছিলাম। সেই মোতাবেক রামাযানের শুরুতেই আল-হূদা ইন্টারন্যাশনালের জামে মসজিদে রেজিস্ট্রেশনটা করে রাখলাম। এখানে আবার মসজিদগুলোতে আগেভাগেই ইতিকাফের জন্য সিরিয়াল দিতে হয়, নতুবা পরে টানাটানি পড়ে যায়। এদেশে ইতিকাফের এমন জোরালো চর্চাটা দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলাম, যেটা বাংলাদেশে দেখাই যায় না। ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সকলেই বেশ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এই ইবাদতটি পালন করেন।
ইতিকাফের দু'দিন পূর্বে ১৭ জুন বৃষ্টিমুখর দুপুরে শাহিনকে নিয়ে ইসলামাবাদ শহরে মটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম কিছু জরুরী কাজে। করাচী কোম্পানী, পেশোয়ার মোড় থেকে পুনরায় ব্লু এরিয়া হয়ে ই-৭ সেক্টরের কুয়েত হোস্টেলে ফিরছিলাম। বাদশাহ ফয়সাল মসজিদের সামনে টার্নিং নিতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তি। বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত রাস্তায় একটু কায়দা করে টার্নিং নিতে গিয়েছিলাম। বেশ জোরের উপরই হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। ব্যাস, আর যায় কোথায়! ভুসস্ করে মটরসাইকেলটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে লাগল। আবছাভাবে টের পাচ্ছিলাম সবই, কিন্তু কিছুই করার ছিল না। মুহূর্তকাল পর সম্বিত ফিরলে নিজেকে হাতপা ছড়িয়ে শোচনীয়ভাবে ভুপাতিত অবস্থায় পেলাম। মটরসাইকেলটাকে দেখলাম কয়েকহাত দূরে কাত হয়ে আছে। তেল গড়াচ্ছে ট্যাংকি থেকে। পিছন থেকে শাহিন ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসল। দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে মটরসাইকেলটা তুললাম আর এদিক-ওদিক তাকালাম কেউ দেখেনি তো! শরীরে কোথাও কাটাছেড়া হতে পারে সে হুঁশ ছিল না। কেবল অপরাধী অপরাধী চেহারায় লোকচক্ষুর আড়াল হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। শাহিন বলল, তোমার পায়জামা তো রক্তে ভিজে যাচ্ছে। এ্যা! এতক্ষণে নিজের দিকে তাকালাম। তবে হাত-পা কাটা নয়, প্রিয় জামাটার হাতা আর পায়জামার নীচে তেরছা ভাবে ছিড়ে যাওয়া দেখে আফসোস হল বড্ড। মটরসাইকেল এ্যাকসিডেন্ট হলে সাধারণভাবে হাটু-কনুই ছিলে যাওয়া যা যা হয় সবই হলেও আল্লাহর রহমতে অনেক কমের উপর দিয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো যে সামনে পিছনে কোন গাড়ি ছিল না, নইলে বিপদটা আরো বাড়তে পারত। ফালিল্লাহিল হামদ।
শাহিনের অবশ্য বাহু থেকে কনুই পর্যন্ত বেশ লম্বাভাবে ছিলেছে। ও বলল, হাসপাতালে গিয়ে ড্রেসিং না করলে হবে না। হাবীব হোস্টেলেই ছিল। ওকে ফোনে ডাকতেই ছুটে আসল আর হৈ চৈ করে ট্যাক্সি ডাকা শুরু করল। আমরা তখন ফার্স্ট এইড নিচ্ছিলাম সিডিএ'র ভ্রাম্যমান এ্যাম্বুলেন্সে। ইসলামাবাদের বিভিন্ন পয়েন্টে সরকারী ব্যবস্থাপনায় এই এ্যাম্বুলেন্সগুলো সবসময় প্রস্তুত থাকে। ৯১১ নাম্বারে রিং করলেই এ্যাম্বুলেন্সগুলো কয়েক মিনিটে উপস্থিত হয়। ফয়সাল মসজিদের পার্শ্বেই একটি পয়েন্ট থাকায় আমরা সরাসরি সেখানেই গিয়েছিলাম। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে পিমস হাসপাতালে রওয়ানা হলাম। হাসপাতালে পৌঁছার পর ড্রেসিং সেরে হাতের বুড়ো আঙ্গুলের কালশিটে পড়া জায়গাটা এক্সরে করা হল। এক্সরে রিপোর্ট দেখে শাহিন বলল, তেমন কিছু হয়নি মনে হচ্ছে, কেবল টিস্যুগুলোতে হয়ত টান পড়েছে। ফলে ডাক্তারকে আর দেখালাম না। সোজা ফিরে আসলাম কুয়েত হোস্টেলে। ফিরতে ফিরতে শাহিন বলল, একটা জিনিস খেয়াল করলে, আমরা এ্যাকসিডেন্ট করার পর যাত্রী ছাউনি থেকে কেউ ছুটে আসল না আমাদের উঠানোর জন্য! অথচ আমাদের দেশে এমনটা হলে লোকজন তো হৈ হৈ করে ছুটে আসত! বললাম, আমিও ঠিক এই কথাই ভাবছিলাম যে ব্যাপারটা কি! সত্যিই বোধহয় আন্তরিকতায়, পরোপকারে আমাদের দেশের মানুষ অন্যদের চেয়ে এখনো বেশ অগ্রসর! অবশ্য সেটা হিতেবিপরীত হয়ে যায় যখন দায়ী গাড়ির ড্রাইভারদের উপর মানুষ মারমুখী হয়ে তেড়ে যায়।
হাসপাতাল থেকে আবার কুয়েত হোস্টেলে হাবীবের রুমে আসলাম আর নিজের উপর বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলাম নিছক অসাবধানতায় এমন একটি দূর্ঘটনা ঘটানোর জন্য। পরে অবশ্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম আরো বড় কিছু না হওয়ার কারণে। হয়ত আল্লাহ ছোট বিপদ দিয়ে বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নিলেন।
ক্ষয়ক্ষতিটা অল্পের উপর দিয়ে যাওয়ায় শাহিন ডাক্তার সাবের স্বস্তির হাসি...
আছরের পর দেখি হাতের ব্যাথাটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শাহীন এক্সরেটা আবার দেখার পর বলল, মনে হচ্ছে ফ্রাকচার আসলেই হয়েছে, ডাক্তারকে দেখানোই ভাল ছিল তখন। তার কথাটা শোনার পর অনুভব করলাম ব্যাথাটা হঠাৎ বেশ বেড়ে গেছে। অস্থির হয়ে উঠলাম হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সামান্য পথটুকু যেতে ট্যাক্সির আগুনে ভাড়ার কথা ভেবে দমে গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন হাবীব আসে অফিস থেকে মটরসাইকেলটা নিয়ে। মাগরিবের আগে হঠাৎ আব্দুর রাজ্জাক ভাই ফোন করে জানালেন উনি ইসলামাবাদ এসেছেন, কাল আমার সাথে দেখা করবেন। আমি সুযোগ পেয়ে এ্যাকসিডেন্টের কথা জানালাম এবং দ্রুত আসতে বললাম আমার এখানে। আধাঘন্টার মধ্যে উনি উপস্থিত হলেন এক বন্ধুর মটর সাইকেল নিয়ে। দীর্ঘ দশ বছর পর আজ তার সাথে দেখা। দীর্ঘ কুলাকুলি আর কুশল বিনিময়ের পর হাসপাতাল রওনা হলাম। ডাক্তার এক্সরে দেখে বললেন, আঙ্গুলে জয়েন্টে ফ্রাকচার হয়ে গেছে, প্লাস্টার করা লাগবে। প্লাস্টারের কথা শুনে অজানা অস্বস্তিতে মনটা খচখচ করতে লাগল। সামনে যে ইতিকাফে বসতে হবে, তারপর ঈদের পর ছুটিতে থিসিসের জন্য কাজ করতে হবে একটানা, টাইপ করতে পারব তো প্লাস্টার লাগালে! ঘন্টাখানিক পর প্লাস্টার লাগিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হলাম। তারপর আব্দুর রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। দীর্ঘ দশ বছর পর দেখা। গল্পে গল্পে সেদিন একেবারে সাহারীর সময় হয়ে গেল। সাহারীর পর সামান্য রেস্ট নিয়ে আবার গল্প শুরু হল। জুমআর ছালাতের আগ পর্যন্ত তাতে আর কোন বিরতি পড়ল না।
বিকালে আব্দুর রাজ্জাক ভাইকে বিদায় দেয়ার পরই শাহিন আসল। রাতটা থেকে পরদিন শনিবার দুপুরে সেও বিদায় নিল। সপ্তাহখানিক বাদেই সে দেশে ফিরবে একেবারে। সুতরাং আপাতত আর দেখা হচ্ছে না। পাকিস্তানে আসার পর থেকে ওর সাথে একটা ভাল সময় কেটেছে। কোয়েটা, পেশোয়ারের মত বিপদজনক জায়গাগুলো ওর সাথেই ঘুরেছি। মারীর বরফের রাজ্যে আত্মহারা হয়ে বরফ ছোড়াছুড়ির ছেলেমানুষীতে ওই ছিল সাথী। তাছাড়া ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিণ্ডিতে বাজার করতে গেলেই ওর সঙ্গ পেয়েছি সবসময়। পাকিস্তানের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে কতদিন লম্বা গপসপ আর হাসিঠাট্টা হয়েছে। আদতে স্বল্পভাষী ও নম্রগোছের হলেও বন্ধুমহলে ও এক চৌকস আড্ডাবাজ আর বিশিষ্ট নীতিবাগীশ। মৃদু হাসি আর সুমিষ্ট ব্যবহারে মানুষকে কনভিন্স করতে পারে খুব সহজেই। তাই ওর বিদায়টা আজ একটা বড় শূন্যতা জাগিয়ে দিয়ে গেল।
ইতিকাফের সময় মসজিদে এসেছিলেন ইউথ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট রাজা জিয়াউল হক্ব
(ক্রমশ)
বিষয়: বিবিধ
১৬০৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন