মালিকা পর্বতের গুপ্তধন সয়ফুল মুলক লেকে...

লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ ২৩ জুন, ২০১৪, ১২:০৩:৪৮ রাত



ইসলামাবাদে মে মাস থেকে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাপমাত্রা প্রায়ই ৪৫ ডিগ্রি অতিক্রম করছে। হোস্টেলের ছোট্ট রুমটাতে হাঁসফাঁস করতে করতে কি যে অস্থির হয়ে পড়ছিলাম! সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তরাঞ্চলের ঠাণ্ডা এরিয়ায় ক'দিনের জন্য ঘুরে আসব। সেই মোতাবেক ২০জুন'১৪ সকালে বের হলাম উত্তরের প্রদেশ বালতিস্তানের রাজধানী স্কারডুর উদ্দেশ্যে। ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ৮০০কি.মি. দূরত্ব। ওদিকে সারাবছরই প্রায় শীতকাল থাকে। আর ২/১ মাস থাকে গরমকাল, তবে সেটাও আমাদের দেশের স্বাভাবিক শীতকালের মত।

স্কারডু যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে। একটা কারাকোরাম হাইওয়ে ধরে, অপরটি কাগান-নারানের পর্বতময় দূর্গম পথ ধরে। প্রচলিত কারাকোরাম হাইওয়ের পরিবর্তে ভাবলাম পাহাড়ী বনাঞ্চলের পথ ধরে যাই তাহলে পুরো পথটাই দারুন এক উপভোগ্য সফর হবে। সকালে সাড়ে ৮টার দিকে রওনা হয়ে প্রায় ৪ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে প্রথমে মানসেহরা গেলাম। সেখান থেকে নারান উপত্যকাগামী এক মাইক্রোতে চেপে বসলাম। পাহাড়ী পথ। দুপাশে আকাশেছোঁয়া পাহাড় আর মাঝে ছোট্ট অথচ প্রচণ্ড খরস্রোতা নদী কুনহার। বালাকোট শহর পার হওয়ার পর গাড়ী ক্রমে আরো উপরে উঠতে থাকে। নীচের কুনহার নদীটা আরো সরু হতে থাকে। রাস্তার পাশের খালি জায়গায় বানিজ্যিকভাবে মধুর চাষ করা হচ্ছে। কৃত্তিম উপায়ে বানানো টিনের মৌচাকে ভর্তি পুরোটা পথ। শোগরান, পারাস, কাগান ভ্যালি হয়ে প্রায় ৯০ কি.মি. পথ পাহাড়ী রাজ্যের অপরূপ রূপসুধা উপভোগ করতে করতে নারান পৌঁছে গেলাম বিকাল ৫টার দিকে।



পথিমধ্যে সহযাত্রী হিসাবে পেশোয়ারের ৩ স্টুডেন্টকে পেয়েছিলাম। ওরা নারান নেমেই মালিকা পর্বত চূড়ার (৫২০০ মিটার উচ্চতা) কাছাকাছি সাইফুল মুলক লেক (৩২০০মিটার) দেখার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছিল। আমিও ওদের সহযাত্রী হলাম। ১৮০০ রুপী দিয়ে একটা জীপ ভাড়া করা হল। যে রাস্তা দিয়ে চূড়া অভিমুখী যাত্রা শুরু হল ওটা আসলে মোটেও গাড়ি চলাচলের উপযোগী রাস্তা না। সারা রাস্তায় বড় বড় পাথরের স্তুপে ভরা আর সেই সাথে হিমবাহ গলা ঝর্ণার পানির স্রোত।



তার উপর দিয়ে গাড়ি যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে শুরু করল, তাতে আমরা আতংকিত হয়ে পড়লাম। ড্রাইভার তো গাড়ি চালাচ্ছে না, ব্যায়ামবীরের মত শারীরিক কসরৎ করে যাচ্ছে। শক্তি খাটিয়ে গাড়ী সামলাতে সে রীতিমত যুদ্ধ করছে। তার রগ টানটান করে প্রতি মুহূর্তে আসন্ন ঝুকির মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত চেহারা দেখলে মনে হয় যেন কোন সৈনিক এ্যামবুশ করে শক্রর মুখোমুখি হওয়ার জন্য অপেক্ষমান। পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রায় ১০-১৫ মিটার উঁচু চওড়া গ্লাসিয়ার রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় পথ মাঝে মাঝে আটকে রেখেছে। মাটিকাটার গাড়ি দিয়ে বরফ কেটে রাস্তা চালু রাখা হয়েছে। দুইপাশে উঁচু বরফের প্রাচীরের মধ্য দিয়ে গাড়ি যখন যাচ্ছিল তখন ভেজা শীতল বাতাসে মনে হচ্ছিল আস্ত ফ্রিজের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।





একেবারে চূড়ায় উঠার পর আসল সেই স্বর্গীয় মুহূর্তটি। নীল পানির বিশাল ঝিল বা লেক। আর ঝিলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে মালিকা পর্বতের নর্থ ও সাউথ চূড়া এবং সেখান থেকে নেমে আসা অপরূপ শ্বেত-শুভ্র গ্লাসিয়ার। বিপরীত দিক থেকে শেষ বিকেলের নরম মনোমুগ্ধকর আলোয় স্বর্ণজ্জল হয়ে আছে পাহাড়ের কিছু অংশ। রূপকথার রাজ্যের মত সুন্দর এই স্থানটির নাম রূপকথার রাজপুত্র ‌‌‌'সাইফুল মুলকে'র নামানুসারে রাখা হয়েছে 'সাইফুল মুলক ঝিল'। পৃথিবীর অন্যতম উঁচু ও সুন্দরতম লেক এটি। তাপমাত্রা এখানে হিমাংকের বরাবর কিংবা কিছুটা নীচে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল। চাদরটা গাড়িতে রেখে এসেছিলাম আলসেমি করে। এখন নীচে ‌আসার পর মনে হচ্ছে উপর পর্যন্ত উঠতে উঠতে ঠাণ্ডায় জমে বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। প্রায় আধাঘন্টা অবস্থানের পর আবার জীপে ফিরে আসলাম। সূর্য ডুবতে তখনও আধাঘন্টা বাকি।





প্রায় দেড় ঘন্টা পর পাহাড়ের নীচে শহরে এসে পৌঁছলাম রাত ৮টার দিকে। জিপের অনবরত ঝাকুনীতে আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় শরীরের অবস্থা তখন একেবারে কাহিল। গাড়ি থেকে নেমে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী শিক কাবাব খেয়ে পুনরায় ফিরতি পথে রওনা হলাম। রাত ১২টার দিকে বালাকোট পৌঁছলাম। তারপর সেখানে আমার পূর্বপরিচিত ফিল্ড হাসপাতালের বন্ধুদের সাথে রাত্রিযাপনের পর পরের দিন দুপুরে ইসলামাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।





স্কারডু আর যাওয়া হল না। কারণ নারান রোড দিয়ে স্কারডু যাওয়ার রাস্তাটি এখন বন্ধ। পুনরায় মানসেহরা ফিরে সেখান থেকে অন্য রাস্তায় যেতে হবে। কিন্তু শরীরের অবস্থা তথৈবচ। এত লম্বা সফরের জন্য যথেষ্ট ফিট মনে হচ্ছে না। তাই এবারের মত স্কারডু যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করে দিলাম।

(প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে-)

বিষয়: বিবিধ

১৮৮০ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

237714
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০২:০৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : খুবই ভাল লাগল আপনার ভ্রমন এর বিবরন এবং ছবিগুলি। ঝিল সায়ফুল মুলক এর ভ্রমন কাহিনি অনেক পুরানএকটি বইতে পড়েছিলাম। বইটির নাম ছিল "সিন্ধু নিলাব দেশে"। তখন কিন্তু সেখা যেতে হতো ঘোড়ার পিঠে চড়ে। এটি পৃথিবির অন্যতম সুন্দর এলাকা বলে বিখ্যাত। স্কার্ডু যাওয়ার সুযোগ হলে লিখবেন আশাকরি। সেখানে এখনও আলেকজান্ডার এর সাথে ভারতে আসা গ্রিকদের কিছু বংশধর নাকি বসবাস করে।
২৩ জুন ২০১৪ সকাল ০৮:৪১
184344
আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ লিখেছেন : ধন্যবাদ..
হ্যা জগলুল হায়দারের লেখা এই বইটার নাম শুনেছি..পড়া হয়নি। গুগলে সার্চ করেও পেলাম না। বইটার কোন লিংক থাকলে দিতে পারবেন? অনেক উপকার হতো।

ঠিকই বলেছেন...আপনি তো অনেক অভিজ্ঞ মানুষ দেখছি মাশাআল্লাহ...ইনশাআল্লাহ অবশ্যই লিখব ঐ পাহাড়ের সাম্রাজ্যে যা্ওয়ার সুযোগ হলে। ওখানে ২৬০০০ বর্গমিটারের মধ্যে ৪টি এইট থাউজান্ডার সহ (কেটু, নাঙা পর্বত) ৬০টিরও বেশী পর্বতচূড়া আছে যেগুলো ৭০০০ মিটারের উপরে..সেখানে যা্ওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি...
237720
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০২:১৯
ভিশু লিখেছেন : খুব ভালো লাগ্লো...Happy Good Luck
২৩ জুন ২০১৪ সকাল ০৮:৪১
184345
আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ লিখেছেন : ধন্যবাদ....Happy Happy
237748
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৩:৩৪
মাটিরলাঠি লিখেছেন : অসাধারণ পোস্ট। খুবই ভালো লাগলো। এধরনের পোস্ট স্টিকি হওয়া উচিত। Good Luck Good Luck
২৩ জুন ২০১৪ সকাল ০৮:৪২
184346
আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য..Happy Happy
237996
২৩ জুন ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১৭
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ভালো লিখেছেন। পরবর্তী কাহিনীর জন্য অপেক্ষায় থাকবো। জাযাকাল্লাহ্
২৩ জুন ২০১৪ রাত ০৯:২৪
184577
আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ লিখেছেন : ধন্যবাদ..Good Luck
268487
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:০৪
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ভাল লাগল। আমি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে আততাহরিক পত্রিকা পড়েছিলাম। অনলাইনেও কয়েকবার পড়েছি। ছহি হাদীস নির্ভর লেখা ভাল লেগেছিল।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File