প্রবল ইসলামবিদ্বেষী ডাচ রাজনীতিবিদের অবশেষে ইসলামে ফেরা

লিখেছেন লিখেছেন আহমাদ ফিসাবিলিল্লাহ ২১ মে, ২০১৩, ১১:৪৪:৪৩ রাত



আর্নোড ভ্যান ডুর্ন (Arnoud Van Doorn)

[শেষ পর্যন্ত ইসলামই গ্রহণ করে ফেললেন আর্নোড ভ্যান ডুর্ন (৪৬)। তাঁর টুইটার এ্যাকাউন্টে এখন শোভা পাচ্ছে কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তিনি হঠাৎ করেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। নেদারল্যাণ্ডের ইসলামবিদ্বেষী ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ‘পিভিভি’-এর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এই ডাচ পার্লামেন্টারিয়ান ২০০৮ সালে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় তোলা ১৭ মিনিটের প্রবল ইসলাম বিদ্বেষী তথ্যচিত্র ‘ফিৎনা’ নির্মাণকারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ইউরোপ জুড়ে ইসলামের বিস্তারে উদ্বিগ্ন হয়ে এই কুখ্যাত তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করা হয়। এর প্রতিবাদে সারাবিশ্বে মুসলমানরা যে ক্ষুব্ধ ও আবেগী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তা-ই তাকে ইসলাম নিয়ে আগ্রহী করে তোলে। অবশেষে ইসলাম ও রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে সম্পর্কে দীর্ঘ প্রায় বছরখানিক পড়াশোনার পর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এক বছর পূর্বেই তিনি স্বীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন এবং হেগের সিটি হলে একজন পরামর্শক হিসাবে যোগদান করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি হেগের মেয়রের নিকট স্বীয় চাকুরীস্থলে ছালাতের জন্য বিরতি চেয়ে আবেদন করেন। গত ২১ এপ্রিল তিনি মক্কায় উমরা হজ্জ পালন করেন এবং মক্কা ও মদীনার প্রখ্যাত আলেম-ওলামাগণের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, মিডিয়ার কারণে ইউরোপিয়ানরা ইসলামের সঠিক চিত্রটি জানতে পারে না। যদি তারা জানত যে, ইসলাম ধর্ম কত মাধুর্যময় ও বিজ্ঞতাপূর্ণ, তাহলে তারা প্রত্যেকেই ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য হত। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তাঁর নিম্নোক্ত সাক্ষাতকারটি ইংরেজী থেকে অনুবাদ করে দেয়া হল]

অনুবাদ : আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব

গৃহীত : তাওহীদের ডাক, মে-জুন ২০১৩




প্রশ্ন : প্রথমে আপনার ইসলাম গ্রহণের কাহিনীটি বলুন। কিভাবে আপনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি কৌতুহল বশত কুরআন পড়া শুরু করেছিলাম ১ বছর পূর্বে। ইতোপূর্বে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক গল্পই আমার শুনে এসেছি। কুরআন এবং সাথে সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ আমি যতই পড়তে লাগলাম, আমি বুঝতে পারলাম ইসলাম বাস্তবিকই কত সুন্দর ও বিচক্ষণতাপূর্ণ। যেহেতু খৃষ্টান হিসাবে আমার যথেষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান ছিল, তাই নৈতিক মূল্যোবোধের দিক থেকে আমি অনেক দৃঢ় ছিলাম। আমার মনে হয় একজন অবিশ্বাসীর চেয়ে একজন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীর জন্য ইসলাম গ্রহণ করা অধিকতর সহজ, কেননা আগে থেকেই নবী, ফেরেশতা এবং ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান থাকে।

প্রশ্ন : ইতোপূর্বে আপনি একটি সুপরিচিত ইসলামী বিদ্বেষী দলের সদস্য ছিলেন। এমনকি আপনার দলের নির্দেশনায় রাসূল (ছাঃ)-এর অবমাননা করে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে যেটা মনে হয়েছে যে, তারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক কোন জ্ঞান রাখে না। এতদস্বত্তেও কেন তারা ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি পদক্ষেপ নিল?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি আসলে কখনই চরমপন্থী ডান ছিলাম না। এমনিতে অন্যান্য অনেক মানুষের মত মুসলমানদের সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট বাজে ধারণা ছিল। যেমন- তারা হল ধর্মান্ধ, নারী নির্যাতনকারী, অসহিষ্ণু, পশ্চিমাবিদ্বেষী ও উগ্র। আমার পার্টির সদস্যরা মানুষ হিসাবে খুব বন্ধুবাৎসল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আমার পার্টির সমালোচনাসমূহ আমার কাছে খুব যুক্তিগ্রাহ্য ছিল। কিন্তু ইসলাম ও আরব বিশ্ব সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব দলটি পোষণ করত, তা অবর্ণনীয়। মুসলমান মাত্রই সকলকে এ দলটি কলংকজনকভাবে চিত্রিত করত। ভীতি সৃষ্টি এবং মেরুকরণ মানুষকে বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য খুব সহজ একটি পন্থা। কেননা এটা মানুষের জাত্যাভিমান, একদেশদর্শিতা ও পক্ষপাতিত্বকে উস্কে দিতে পারে।



প্রশ্ন : ইসলাম গ্রহণের পর আপনার প্রতি আপনার প্রাক্তন দলীয় সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আসলে গত বছর পার্টি ছাড়ার পর থেকে পার্টির সাথে আর যোগাযোগ রাখি নি। তাই তাদের প্রতিক্রিয়াও জানতে পারিনি। আর মূলতঃ যারা ‘পিভিভি” থেকে পদত্যাগ করে তাদেরকে ‘অস্তিত্বহীন’ হিসাবে ধরা হয়। তাই আমার প্রাক্তন সহকর্মীরা আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে ভয় পান। কেননা এটা করলে পার্টিতে তাদের অবস্থান হুমকির মুখে পড়বে।

প্রশ্ন : আপনি কি অনুতপ্ত এমন একটি দলের সদস্য হওয়ার জন্য?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : না, কারণ আমি শিখেছি যে, জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা অর্জনের পিছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে। যাইহোক এর মাধ্যমে যে জ্ঞান আমার হয়েছে, তার বদৌলতেই আমি সন্দেহহীনভাবে এমন একটি ভিন্নধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।

প্রশ্ন : সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : কোন কোন মানুষের চোখে আমি একজন বিশ্বাসঘাতক। তবে অধিকাংশই মনে করে যে আমি খুব ভাল একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাইহোক প্রতিক্রিয়া সাধারণভাবে ইতিবাচকই ছিল। আর টুইটারেও আমি মানুষের কাছ থেকে খুব সমর্থন পেয়েছি। এটা খুব ভাল লাগছিল যে, যে সব মানুষ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না, তারাও আমার অবস্থানটি বুঝতে পেরেছে এবং আমার সিদ্ধান্তে সমর্থন জুগিয়েছে।



প্রশ্ন : যদি কোন অমুসলিমের কাছে আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিতে বলা হয়, তবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে আপনি তাকে কোন বিষয়টি উদ্ধৃত করবেন?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি আগেই বলেছি, ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করুন, নিজেকে পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত করুন। আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন যে, ইসলাম সত্যিই মহান ইতিহাস, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন একটি সুন্দর ও অতি বিশুদ্ধ ধর্ম। আমরা এখানে পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধা ভাগাভাগি করি। এই ধর্ম আপনাকে আত্মিক প্রশান্তি আর প্রজ্ঞা দিয়ে সমুন্নত করবে। আপনার আধ্মাতিক জীবনকে আরো সুগভীর করবে। পশ্চিমাদের চোখে সাফল্যের সাধারণ উপাদান তথা অর্থ ও বস্তুবাদের চেয়ে জীবনের মর্মার্থ আরো গভীর। মুসলিম হওয়ার মাধ্যমে তাই আপনি আরো বলিষ্ঠ ও উত্তম মানুষে পরিণত হবেন।

প্রশ্ন : পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামকে জঙ্গীবাদ, মানবাধিবার লংঘন ও নারীর প্রতি অসদাচরণ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো বিস্তারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। এ সব অভিযোগের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কি?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আবারও বলছি এসব পক্ষপাতদুষ্ট ধারণার সৃষ্টি হয় অজ্ঞতার কারণে। পৃথিবীর যে কোন ধর্মেই উগ্র ও চরমপন্থী রয়েছে। এদের সংখ্যা মাত্র ১%। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ১% চরমপন্থীর কথা টিভি ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয় এবং অনেক বড় করে দেখানো হয়। বাকি ৯৯% মুসলিম যারা কঠোর পরিশ্রমী ও শান্তিকামী তারা রয়ে যায় আড়ালে। মূলতঃ সত্যিকার ইসলাম সম্পর্কে একজন যতই পড়াশোনা করবে, ততই সে তার মধ্যে সৌন্দর্যের আঁধার খুঁজে পাবে।

প্রশ্ন : বর্তমানে নাস্তিকতার প্রসারে যত সব প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তার পশ্চাতে কি কারণ নিহিত আছে বলে আপনার মনে হয়? আর যারা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভুগছে তাদের জন্য আপনার উপদেশ কি?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমার কেবলই মনে হয় প্রভাবশালী পশ্চিমারা এবং অধিকাংশ রাজনীতিবিদরা ধর্মকে কোন ভাবেই পছন্দ করেন না। আর বিশ্বাসের উপর টিকে আছে কম মানুষই। বেশীরভাগই অর্থোপার্জন, ভোগবাদিতা আর বস্তুগত উন্নতিকে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করে ফেলেছে। পশ্চিমা শিল্পপতিরা মূলতঃ চায় জনগণ আত্মীক শক্তি অর্জনের পরিবর্তে ভোগমুখী হোক। ‘সম্পদ খরচ এবং ভোগ’ই হোক সুখের মানদণ্ড। কিন্তু বিশ্বাসীরা আত্মীকভাবে শক্তিশালী হয় এবং বস্তুবাদী বিষয়াদির উপর কম নির্ভর করে। তাই রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী মহল কখনই চায় না যে মানুষ তাদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেদের উপর অধিকতর নির্ভরশীল হোক এবং নিজেদের অন্তর্জগতকে বলিষ্ঠ করে তুলুক। একই কথা আমি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘেরাটোপে থাকা সংশয়বাদীদের উদ্দেশ্যেও বলব।

প্রশ্ন : যে সব লোক আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে এখনও সন্দিহান তাদের ব্যাপারে কি বলবেন?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : আমি বুঝতে পারছি অনেকেই এ ব্যাপারে সন্দিহান কেননা এটা অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত। তবে যারা আমার কাছাকাছি থাকেন তারা জানেন আমি গত এক বছর থেকেই কুরআন, হাদীছ এবং অন্যান্য ইসলামী বইসমূহ নিয়ে গবেষণা করছি। একই সাথে আমি মুসলমানদের সঙ্গে অনেকবারই ধর্ম নিয়ে আলোচনায় বসেছি। সুতরাং এটা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। আমি মোটেও এটা হালকাভাবে গ্রহণ করিনি।

প্রশ্ন : আপনি কি আর কিছু বলতে চান?

আর্নোড ভ্যান ডুর্ন : অনেকের মত আমিও জীবনে অনেক ভুল করেছি। এ সব ভুল থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তবে ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার অনুভূতি এমনই যে, আমি অবশেষে আমার পথ খুঁজে পেয়েছি। আমি উপলব্ধি করছি যে, এটা আমার জীবনের নতুন সূচনা এবং আমার আরো বহু কিছু শেখার আছে। আমি জানি আমাকে আরো অনেক বাঁধার সম্মুখিন হতে হবে, বিশেষতঃ কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসী আল্লাহ সেই মুহূর্তগুলোতে আমাকে সাহায্য করবেন এবং সঠিক পথ দেখাবেন।



উমরা হজ্জ পালনকালে পবিত্র কাবার গিলাফে ক্যালিগ্রাফি অংকনে অংশগ্রহণ

বিষয়: বিবিধ

২৭৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File