লক্ষ্যবিচ্যূতি
লিখেছেন লিখেছেন আবদুল্লাহ সাঈদ খান ২৮ জুন, ২০১৩, ০৪:৫৬:৪৮ বিকাল
১.
আপনার মেসের বাবুর্চি সবুজকে বলা হল আজকে বাজার থেকে মাছ নিয়ে এসে মাছ রাঁধতে হবে। সবুজ প্লাস্টিকের একটা ব্যগ নিয়ে মাছ কিনতে বেরিয়ে পড়ল। মাছের বাজারে গিয়ে সে দেখে সেখানে তুলকালাম কাণ্ড। মাছওয়ালারা মাছের বিশাল দাম হেকে বসে আছে। বাজারের বিভিন্ন কোণায় মাছের দাম নিয়ে কথাকাটাকাটি চলছে। একজন চিংড়ী মাছের কেজি ৩০০০ টাকা হেঁকে বসে আছে, আরেকজন ইলিশ মাছের কেজি ৫০০০ টাকা চাচ্ছে। এসব দেখে সবুজেরতো মাথা গরম। তার ইচ্ছে করছে মাছওয়ালাদের সাথে মারামারি শুরু করে দিতে। অন্যান্য ক্রেতাদেরও মনে একই অবস্থা বলেই তার মনে হচ্ছে। পশ্চিমদিকে একদলের ঝগড়ায় গিয়ে সেও শামিল হয়ে গেল। এসব ঝামেলায় জড়িয়ে সে ভুলেই গেল যে তাকে দুপুরে রাঁধতে হবে, আজকে মাছ না রাঁধলেও চলবে।
২.
রফিক সাহেব আপনাদের কম্পানিতে শেয়ারহোল্ডার এমপ্লয়ী। শেয়ারহোল্ডার মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হল যে, যারা একটি ফ্ল্যাট বুকিং করিয়ে দেবে তাদের পাঁচ শতাংশ কমিশন দেয়া হবে। তবে কমিশন নেয়া কখনই মূল উদ্দেশ্য না। উদ্দেশ্য বিক্রি বাড়ানোর জন্য সবার মধ্যে একটি অনুপ্রেরণা বজায় রাখা এবং কম্পানির মূল উদ্দেশ্য সামগ্রিক লাভ অর্জনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু রফিক সাহেব কমিশনের লোভে এমপ্লয়ী হিসেবে একাউন্টস-এ তার মূল কাজ বাদ দিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রিতে এমন ভাবে মজে গেলেন যে বছরান্তে অডিটের সময় হিসেবে নিকেশের তের অবস্থা।
৩.
কামাল সাহেবের ছেলের জ্বর হয়েছে। চিকিৎসক হিস্ট্রি নিয়ে, তাকে জ্বর কমানোর জন্য নাপা এবং টাইফয়েড সন্দেহ করে জ্বরের কারণ দূর করার জন্য এন্টিবায়োটিক দিয়েছেন। তবে চিকিৎসক খুব বেশী ‘টেস্ট’ করাননি। কামাল সাহেব আবার যে কোন কিছু নিয়ে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করেন। টাইফয়েড নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে দেখতে পেলেন টাইফয়েড জ্বরে এন্টিবায়োটিক দেয়ার আগে ব্লাড কালচার করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই মাতব্বরি করে এন্টিবায়োটিক খাওয়ালেন না, বরং চিকিৎসককেই প্রশ্ন করতে লাগলেন যে কেন পরীক্ষানিরীক্ষা না করে এন্টিবায়োটিক দিলেন। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের ক্লিনিক্যাল জাজমেন্ট-এর একটা ব্যপার যে আছে, সেটা তার মাথায় এল না। সপ্তাহ দুই পরে কামাল সাহেব তার ছেলেকে নিয়ে আই.সি.ইউ-তে। সেপটিসেমিয়া হয়ে গেছে। নাপা দিয়ে জ্বর ভাল হলেও কারণ দূর হলো না। চিকিৎসায় লক্ষ্যবিচ্যূতি হল।
৪.
সেলিম সাহেব তার সন্তান রাসেলকে পড়ালেখায় উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সময় শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন গিফ্ট কিনে দেন, তবে পড়ালেখা করে ভাল রেজাল্ট করলে ভবিষ্যতে তার ক্যারিয়ারে কোন সমস্যা হবে না সেটাও বুঝিয়ে বলেন। রাসেল ছোট হওয়ায় মূল লক্ষ্য ‘ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার’ মনে রাখতে পারে না। সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার চেষ্টা করে যেন Immediate result গিফ্টটা পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুদিন পর সে লক্ষ্য করল তার বন্ধু জনি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করুক বা না করুক একই গিফ্ট ঠিকই পাচ্ছে। ফলে রাসেলও পড়ালেখায় অনাগ্রহী হয়ে পড়ে, বন্ধুদের মত খেলাধুলা ও আড্ডাতে বেশী মনোনিবেশ করে এবং রেজাল্ট খারাপ করতে থাকে। এখানেও দূরবর্তী মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যূতি হয়েছে।
এখানে, কতগুলো পরস্পরবিচ্ছিন্ন উদাহরণ আনা হয়েছে। সবগুলো ঘটনাতেই লক্ষ্যণীয় ‘Minor Details’ কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেক ব্যক্তিই কোন কাজের মূল লক্ষ্যকেই ভুলে বসেন। এমনকি মাঝে মাঝে ছোট ছোট বিষয়গুলো নিয়েই ঝগড়াঝাটি চলতে থাকে এমনকি হাতাহাতি মারামারির পর্যায়ে চলে। ওদিকে মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যূত হয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। (উদাহরণ ১,২ ও ৩)
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। যারা ইসলামকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, তারা ভারসাম্যের খুব সূক্ষ্ন প্রান্তে অবস্থান করেন। একটু এদিক সেদিক হওয়া মানেই লক্ষ্যবিচ্যূতি। সবারই মূল লক্ষ্য মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কারো কার্যক্রম হয়ে যাচ্ছে ‘দাড়ি ও টুপি কেন্দ্রিক’, কারও ‘নামাজে হাত বাঁধার নিয়ম কেন্দ্রিক’, কারও প্রচেষ্টা হয়ে যাচ্ছে শুধু ‘ক্ষমতা অর্জন’ কেন্দ্রিক, আবার কারও প্রচেষ্টা ‘আন্দোলনের পদ্ধতির বৈধতা’ কেন্দ্রিক। কিন্তু কেন্দ্র হওয়ার কথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, যেটা করতে গিয়ে Minute Details গুলোকে Overlook করার প্রয়োজন হতে পারে।
একজন হয়ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, কিন্তু টাকনুর উপর প্যান্টটা ঠিকমত পড়ছে না। আরেকজন শুভাকাঙ্খী তাকে সতর্ক করতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে সেটা নিয়ে সমালোচনা যদি লক্ষ্য হয়ে বসে তাহলে সমস্যা। যে টাকনুর উপর প্যান্ট পড়ছে না তাকে প্যান্ট পড়ানোর চেষ্টা করার চেয়ে যে তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে তাকে পাঁচ ওয়াক্ত পড়তে উৎসাহিত করাটা বেশী যৌক্তিক বলেই মনে হয়। এখন আপনি যদি দুটোই নিয়মিত আমল করেন, তাহলেতো অবশ্যই আল্লাহ আপনাকে বেশী পুরস্কৃত করতেই পারেন। জান্নাতের stratification-তো এজন্যই নাকি?
আবার একজন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চাচ্ছেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি তার অনুসৃত পদ্ধতিতে অমুসলিমদের অনুসৃত ডিস্ট্রাকটিভ ও অবৈধ বিষয়গুলো (যেমন: ঘুষ দেয়ানেয়া, মিথ্যাচার) ঢুকে পড়ে তাহলেও মূল লক্ষ্য বিচ্যূত হবে। অর্থাৎ Attention-টা যদি ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে’ এই বাক্য থেকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে’ হয়ে যায় তাহলেই সমস্যা। এতে মূল লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যেতে পারে। In fact, এমতাবস্থায় অন্যকেউ যদি সাময়িক ভাবে এমন একটি রাষ্ট্র দেখাতে পারে যেখানে ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াই মানুষের অধিকার নিশ্চিত’ হচ্ছে, তাহলে অসম্ভব নয় যে প্রথোমক্ত ব্যক্তি ইসলাম থেকেই বিচ্যূত হয়ে যাবে। (উদাহরণ: ৪)
ইসলামের ইতিহাস পড়ে দেখেন, আল্লাহর রাসূলের প্রাথমিক দাওয়াত কিন্তু ছিল এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’; মাক্কী সুরাগুলোও শেষ বিচার, জান্নাত জাহান্নামকে Focus করেছে। কিন্ত মুসলিমদের মূল লক্ষ্য যেন বিচ্যূত হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এরকম- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পর্দা করতে হবে, সামাজিকভাবে পর্দা প্রতিষ্ঠা করলে ধর্ষণ কমে যাবে’ এখান থেকে বিচ্যূতি হয়ে এখন আমাদের শিক্ষা চলছে ‘সামাজিকভাবে পর্দা প্রতিষ্ঠা করলে ধর্ষণ কমে যাবে'; এমতাবস্থায় সচলায়তনের পক্ষীবিশারদরা যখন আমাদের সামনে কিউবার রাস্তায় অবস্থানরত বিকিনি পরিহিত অর্ধনগ্ন মহিলাদের ছবি দিয়ে বলে যে সেখানেতো ধর্ষণ হচ্ছে না, অতএব পোষাকের ব্যাপারে আদেশ দেয়ার দরকার কি? তখন স্বাভাবিকভাবেই কোন কোন মুসলিমের মনে পর্দার হুকুম নিয়েই সন্দেহ জাগতে পারে। এর কারণ আর কিছুই না লক্ষ্যবিচ্যূতি তথা ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পর্দা করতে হবে, সামাজিকভাবে পর্দা প্রতিষ্ঠা করলে ধর্ষণ কমে যাবে’ এই শিক্ষা থেকে সরে আসা।
............
আশা করি পাঠকরা নিবন্ধের বিষয়বস্তু বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। নবীরা ছাড়া কাউকে ভুল থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নেননি। অতএব, আমার এই Understanding-এ ভুল থাকলে সেটার যৌক্তিক সমালোচনার দাবী আমি করতেই পারি।
বিষয়: বিবিধ
২০৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন