রমাদানের প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী
লিখেছেন লিখেছেন অনুসন্ধান ৩০ জুন, ২০১৩, ১২:৩৩:৩২ দুপুর
চট্টগ্রাম ৩০ জুন (সিটিজি টাইমস ডটকম)- রমাদান ইবাদাতের ভরা মৌসুম। আল্লাহর আনুগত্যের স্বর্ণসময়। স্রষ্টার আনুকূল্যধন্য, অপূর্ব বৈশিষ্ট্যরাজির অনুপম সমাহার। গভীর আকুলতা নিয়ে মুমিন যে মাসের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে প্রতিনিয়ত। অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে যে মহান অতিথির শুভাগমন মূহুর্তটির জন্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে অগন্তুক বছরে শুধু একবারই আসে। শুধু দেয়ার জন্য, কিছু নেয়ার জন্য নয়। যার পদধ্বনি আকাশ-বাতাসকে মুখরিত করে মুমিন হৃদয়ে এসে আল্লাহর অপার রহমতের সুরভি ছড়ায়।
যে মাসে নেক আমলের সাওয়াব হয় হুবগুণে বর্ধিত, মুমিনের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে উন্নীত, পুণ্য জোয়ারে অন্তরাত্মা বিধৌত, জান্নাতের দুয়ার অবারিত। যে মাসে রহমতের দরিয়ায় ভেসে যায় রাশি রাশি পাপ, বরকত নেমে আসে এ ধরায়, মুছে যায় জীবনের অভিশাপ। জাহান্নামের দরজা হয় বন্ধ, শৃঙ্খলিত শয়তান, ভাইয়ে-ভাইয়ে কেটে যায় নিত্যদিনের দ্বন্দ্ব। এই মাস তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, জিকর, তাসবীহ, তিলাওয়াত, দান-খয়রাত, তাওবাহ ও রহমাতের মাস।
মুমিন জীবনে রমাদান একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত গবেষক আব্দুর রহমান বিন আবদুল আজীজ আস-সুদাইছ বলেন,
إذا كان الأفراد والأمم محتاجين إلى فترات من الصفاء والراحة؛ لتجديد معالم الإيمان، وإصلاح ما فسد من أحوال، وعلاج ما جدّ من أدواء، فإن شهر رمضان المبارك هو الفترة الروحية التي تجد فيها هذه الأمة فرصة لإصلاح أوضاعها، ومراجعة تاريخها، وإعادة أمجادها، إنه محطة لتعبئة القُوى الروحية والخُلُقية، التي تحتاج إليها كل أمة، بل تتطلع إليها الأفراد والمجتمعات المسلمة،إنه مدرسة لتجديد الإيمان، وتهذيب الأخلاق، وشحذ الأرواح، وإصلاح النفوس، وضبط الغرائز، وكبح الشهوات
“জাতির জীবনে এমন কিছু মূহুর্ত অতিবাহিত হওয়া জরুরী, যখন আত্মার পরিশুদ্ধি ও তৃপ্তি সম্পন্ন হবে। যখন ঈমানের মাইলফলকগুলো নবায়ন করা হবে। যা কিছু নষ্ট হয়েছে, তা সংস্কার করা হবে। যেসব রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে তা সারিয়ে তোলা হবে। রমাদান সেই আধ্যাত্মিক মূহুর্ত যেখানে মুসলিম উম্মাহ তাদের বিভিন্ন অবস্থা সংস্কার করার সুযোগ পায়, তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পায়। আর এ আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা প্রতিটি জাতিরই কর্তব্য। মুসলমানরা এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। এটা ঈমান নবায়নের একটা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যমন্ডিত করার সময়। আত্মাকে শানিত করার সময়। নাফসকে ইসলাহ করার সময়। প্রবৃত্তিকে কনট্রোল করার সময়। কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার সময়”।
এই সুবর্ণ সুযোগ মুমিন অবহেলা করতে পারে না। বরং সে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে প্রভুর নৌকট্য লাভে সৎকর্মের ময়দানে যুদ্ধরত সৈনিকের মত, বজ্রকঠোর প্রতীজ্ঞা আর অপরাজেয় প্রতিযোগিতার চেতনায়। যেমনিভাবে স্বয়ং স্রষ্টার ও তাঁর রাসূল (স.) নির্দেশ করেছেন।
“وَفِي ذلِكَ فَلْيَتَنَافِسِ الْمُتَنَافِسُوْن”
“আর প্রতিযোগিতাকারীদের উচিৎ এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা” (আল-মুতাফফিফীণ:২৬)। রাসূল (স.) বলেন:
افْعَلُوا الْخَيْرَ دَهْرَكُمْ ، وَ تَعَرَّضُوا لِنَفَحَاتِ رَحْمَةِ اللهِ ، فَإِنّ لله نَفَحَاتٍ مِّن رَّحْمَتِهِ يُصِيْبُ بِهَا مَن يَّشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَ سَلُوا اللهَ أن يَّسْتُرَ عَوْرَاتِكُمْ وَ أَن يُّؤَمِّنَ رَوْعَاتِكُم
“তোমরা সর্বদা ভালো কাজ কর। আর আল্লাহর অপার রহমাতভরা বিশেষ বিশেষ সময়গুলোকে কাজে লাগাও। আল্লাহ তাঁর এ সব রহমাত দিয়ে বান্দাদের মধ্যে যাকে খুশি ধন্য করেন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর, তিনি যেন তোমাদের অবাঞ্জিত জিনিসগুলোকে ঢেকে রাখেন এবং তোমাদেরকে ভয়-ভীতি থেকে নিরাপত্তা দান করেন”।
তবে সেজন্য দরকার সঠিক পূর্ব প্রস্তুতির মাধ্যমে রমাদানকে স্বাগত জানাতে উদ্যোগী হওয়া।
রমাদানকে স্বাগত জানানো রাসূলের সুন্নাত:
রমাদানের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ ও তাকে মনেপ্রাণে স্বাগত জানানো রাসূলের সুন্নাত। রাসূল (স.) রমাদানকে স্বাগত জানাবার জন্য প্রায় পুরো শাবান মাস জুড়েই রোযা পালন করতেন। যেমনটি হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবা-তাবেয়ীদের রমাদান পূর্ব প্রস্তুতিও ছিল এ সুন্নাতেরই ধারাবাহিকতা।
রমাদানকে স্বাগত জানানোর পূর্বপ্রস্তুতিসমূহ:
রমাদানকে স্বাগত জানাতে আমাদের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত? কিভাবে আমরা বরণ করব এ মহিমান্বিত মাসকে?
এখন আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করবো।
এক. রমাদান পাওয়ার জন্য দু‘আ করা:
‘হে রব! আমাদেরকে রমাদান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও। আমরা যেন সুস্থতার সাথে রমাদানকে তোমার সন্তোষজনক পন্থায় উদযাপন করতে পারি। এর প্রতিটি মূহুর্ত থেকে ঈমানের পাথেয় সঞ্চয় করতে পারি’।
প্রত্যেক মুমিনের উচিত প্রাণ খুলে এ মাসের বরকত আহরণের জন্য আল্লাহর দরবারে এভাবে প্রার্থনা করা। রাসূল (স.) ও সাহাবীরা (রা.) এ দু‘আ করতেন। এ মর্মে ইমাম তাবারানী হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। নবী (স.) রজব মাসের পদার্পণে এ দু‘আ করতেন,
اَللّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَب وَشَعْبَان وَبَلِّغْنَا رَمَضَانَ .
“হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবানে তুমি বরকত দাও। আমাদেরকে রমাদান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও”।
হযরত মুঅল্লা বিন আল-ফাদল বলেন:
كَانُوْا ” يعني الصحابة ” يَدْعُوْنَ اللهَ سِتَّةَ أَشْهُرٍ أَن يُّبَلِّغَهُمْ رَمَضَانَ ، ثُمَّ يَدْعُوْنَهُ سِتَّةَ أَشْهًرٍ أَن يَّتَقَبَّلَهُ مِنْهُمْ
সাহাবাগণ ছয় মাস আল্লাহ কাছে দু‘আ করতেন যেন রমাদান মাস পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে পৌঁছিয়ে দেন। আর ছয় মাস দু‘আ করতেন যেন, তাদের ইবাদাত আল্লাহ কবুল করেন”।
হযরত ইয়াহইয়া বিন আবি কাসির বলেন:
كَانَ مِنْ دُعَاِئِهْم : اللهمَّ سَلِّمْنِيْ إِلَى رَمَضَانَ، اللهمَّ سَلِمْ لِي رَمَضَانَ، وتسلمه مني متقبلاً.
“তারা এভাবে দু‘আ করতেন: “হে আল্লাহ! আমাকে রমাদান পর্যন্ত নিরাপদে রাখ। রমাদানকে আমার জন্য নিরাপদে রাখ। আমার রমাদানকে তুমি কবুল কর”।
দুই. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাভারে আনত হওয়া:
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রমাদানের মত একটি সুমহান মাস দান করেছেন। সেজন্য আমাদের উচিত তাঁর প্রতি হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তি-অনুরাগ নিঃসারিত করে কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জ্ঞাপন করা। শুকরিয়া দ্বারা নিয়ামত স্থায়ী ও বর্ধিত হয়। কুরআনে বলা হয়েছে,
لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আযাব বড় কঠিন’ (সূরা ইব্রাহীম:৭)।
এজন্য একজন মনিষী বলেছেন, قيد النعمة بالشكر“শুকরিয়ার শিকল দিয়ে নিয়ামতকে বন্দী করে রাখ”। তাছাড়া, কত মানুষ আছে রমাদানের প্রতীক্ষায় থাকে, কিন্তু তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিংবা মৃত্যু বরণ করে। গত বছর এই দিনে এমন অনেক লোক ছিল, যারা আজ আমাদের মাঝে নেই। চিরবিদায় নিয়ে পরকালে চলে গেছে। পৃথিবীতে প্রতি অর্ধসেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়। ঘন্টায় প্রায় ৩৬০০ লোক মৃত্যু বরণ করে। প্রতি মিনিটে গর্ভজনিত জটিলতায় মারা যায় একজন নারী। এভাবে প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে। আল্লাহ আমাদেরকে হায়াত দারাজ করেছেন। আমরা রমাদান পালন করার সুযোগ পেতে যাচ্ছি। সেজন্য মহান মনিবের সমীপে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা পেশ করা উচিত। রমাদান বরণের এটি একটি অন্যতম উপাদান। আরো মনে রাখতে হবে কৃতজ্ঞতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন তার মধ্যে পাঁচটি জিনিস পাওয়া যায়:
ক. নিয়ামাতের স্বীকৃতি;
খ. নিয়ামাত দাতার প্রশংসা;
গ. নিয়ামাত দাতার প্রতি ভালোবাসা;
ঘ. নিয়ামাত দাতার প্রতি আনুগত্য;
ঙ. নিয়ামাত দাতার নিয়ামাতকে তার সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যবহার করা;
তিন. আনন্দানুভূতির বহিঃপ্রকাশ:
রমাদানের আগমন মুমিনের জন্য আসমানী সুসংবাদ। তাই এ মাসের আগমনে আনন্দানুভূতি ও গভীর সন্তোষের বহিঃপ্রকাশ থাকা উচিত আমাদের আচার-আচরণে, কথায়-কর্মে। পরস্পরের মধ্যে এ উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনের আদান-প্রদান করা উচিত। আল্লাহর নিয়ামত পেয়ে আনন্দিত হয় না, কোন মুমিন কি এমন হতে পারে? এ দিকে ইঙ্গিত করেই ইরশাদ হয়েছে,
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ
“বল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নি%
বিষয়:
১৩৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন