ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার (তৃতীয় কিস্তি) ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল্-আযহারী
লিখেছেন লিখেছেন অনুসন্ধান ০২ জুন, ২০১৩, ০৬:১০:৩২ সন্ধ্যা
চট্টগ্রাম ০২ জুন (সিটিজি টাইমস ডটকম)- الحمد لله رب العالمين. والصلاة والسلام على سيد المرسلين، محمد وعلى آله وصحبه أجمعين:
তিন. নারীশ্রম:
যে সব বিষয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রভেদ বা ভিন্নতা রয়েছে, শ্রম তার মধ্যে একটি অন্যতম বিষয়। আজকের আলোচনায় আমরা এ বিষয়টি উপস্থাপন করব, ইনশাআল্লাহ।
ভূমিকা:
এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, নারী-পুরুষের সমন্বিত চেষ্টা-প্রচেষ্টা, শ্রম-সাধনার মাধ্যমেই মানব সভ্যতা রচিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারো চেয়ে কারো অবদান কম নয়। যেহেতু, তারা একজন আরেকজনের সম্পূরক ও সহযোদ্ধা। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কন্ঠে এ সত্যই উচ্চারিত হয়েছে এ ভাবে:
“পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেত তার করিয়াছে নারী অনেক তার নর”।
তবে এ কথাও সত্য যে, নারী ও পুরুষের শারীরিক, মানসিক গঠন, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, রুচি-অভিরুচি যেহেতু সার্বিকভাবে এক নয়, তাই তাদের কর্মক্ষেত্র ও কাজের ধরন-প্রকৃতিও সর্বাবস্থায় সমান হবে না, এটাই স্বাভাবিক। ইসলাম যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত স্বভাবজাত ধর্ম, তাই এই বাস্তবতা ইসলামে স্বীকৃত হয়েছে। এবং এরই ভিত্তিতে ইসলাম শ্রম বন্টন নীতি অবলম্বন করেছে। ক্ষেত্র ও স্থান বিবেচনায় শ্রম প্রধানত দুভাগে বিভক্ত। ঘরের ভেতরের শ্রম ও বাইরের শ্রম। নর-নারীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ইসলাম নারীকে গৃহাভ্যন্তরীণ শ্রম এবং পুরুষকে গৃহবহির্ভুত শ্রমের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এতে কারো মান-মর্যাদা ও অধিকার বিঘ্নিত হয়নি। এভাবে একটি চূড়ান্ত ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে ‘প্রজন্ম প্রতিপালন’ করা। এটি নারীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সুমহান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে কোন কারো কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। এই দায়িত্ব পালনের সর্বাত্মক যোগ্যতা দিয়েই নারীকে তৈরি করা হয়েছে। এ পৃথিবীর কিছুই এ ব্যাপারে নারীর বিকল্প হতে পারে না। এর উপরই নির্ভরশীল জাতির ভবিষ্যত। এর মাধ্যমেই তৈরি হয় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার নাম হলো ‘মানবসম্পদ’।
এ কারণেই নীলনদের কবি হাফিজ ইবরাহীম বলেছিলেন,
الأم مدرسة إذا أعددتها أعددت شعبا طيب الأعراق
মাতা হলেন জ্ঞানালোকের প্রথম বাতি,
তাকে যদি গড়তে পার, জন্ম নিবে সভ্য জাতি।
তবে এ সবের অর্থ এই নয় যে, নারী ঘরের বাহিরে কোন কাজ করতে পারবে না, শরীয়তে তা নিষিদ্ধ। এমন কথা বলার অধিকার কারো নেই। কারণ কোন কিছু হারাম/নিষিদ্ধ করতে হলে সে ব্যাপারে বিশুদ্ধভাবে সাব্যস্ত, সুস্পষ্ট অর্থ সম্পন্ন শরঈ ভাষণ প্রয়োজন। কারণ সাধারণ বিষয়াদিতে মৌলিক অবস্থাই হলো বৈধতা। তবে ঘরের বাহিরে নারী শ্রমের বৈধতা শর্তহীন ও নীতিমালামুক্ত অবারিত নয়। বরং সে জন্য কতগুলো শর্ত রয়েছে।
যে সব শর্তে ঘরের বাহিরে নারীশ্রম বৈধ:
১. শ্রমের একান্ত প্রয়োজনীয়তা থাকতে হবে: হযরত আইশা (রা.) পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পরের একটি ঘটনা বর্ণনা করছেন। তিনি বলেন, হযরত সাওদাহ (রা.) কে বাইরে যেতে দেখে হযরত ‘উমার (রা.) তাঁর সমালোচনা করলে তিনি (কোন কথা না বলে) ঘরে ফিরে আসেন এবং নবী (স.) এর কাছে বিষয়টি বলেন। এর পরপরই নবী (স.) এর উপর অহী নাযিল হওয়ার লক্ষণ দেখা দিল। এ অবস্থা দূরীভূত হলে তিনি বললেন, إنه أذن لكن أن تخرجن لحاجتكن
“প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের অনুমতি দিয়েছেন”।
এই প্রয়োজনীয়তার তিনটি পর্যায় রয়েছে।
ক. ব্যক্তিগত প্রয়োজন: যেমন, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা কিংবা একেবারেই বিয়ে হয়নি এমন নারী। যার কোন আর্থিক উৎস নেই। নেই কেউ তাকে ভরণ-পোষণ করার মতও। অথচ সে শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনের ক্ষমতা রাখে। এভাবে সে ভিক্ষাবৃত্তির লাঞ্জনা থেকে বাঁচতে পারে।
খ. পারিবারিক প্রয়োজন: পরিবাবেরর প্রয়োজনেও নারী অনেক সময় শ্রমের বোঝা মাথা পেতে নিতে পারে। যেমন, স্বামীকে সাহায্য করা, ছোট ভাই-বোনদের ভরণ-পোষণ করা কিংবা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সহযোগিতা করা। উদাহরণ স্বরূপ কুরআনে বর্ণিত হযরত শুআইব (আ.) এর দু’কন্যার ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। যারা ছাগল পালের দেখাশোনার মাধ্যমে বৃদ্ধ পিতাকে সাহায্য করত। একদা ছাগল পালকে পানি পান করাতে গেলে সেথায় মিশর থেকে আগত হযরত মুসা (আ.) এর সাথে তাদের সাক্ষাত হয়। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে:
وَلَمَّا وَرَدَ مَاء مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِّنَ النَّاسِ يَسْقُونَ وَوَجَدَ مِن دُونِهِمُ امْرَأتَيْنِ تَذُودَانِ قَالَ مَا خَطْبُكُمَا قَالَتَا لَا نَسْقِي حَتَّى يُصْدِرَ الرِّعَاء وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ {২৮/২৩}
“আর যখন সে মাদইয়ানের পানির নিকট উপনীত হল, তখন সেখানে একদল লোককে পেল, যারা (পশুদের) পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের ছাড়া দু’জন নারীকে পেল, যারা তাদের পশুগুলোকে আগলে রাখছে। সে বলল, ‘তোমাদের ব্যাপার কী’? তারা বলল, ‘আমরা (আমাদের পশুগুলোর) পানি পান করাতে পারি না। যতক্ষণ না রাখালরা তাদের (পশুগুলো) নিয়ে সরে যায়। আর আমাদের পিতা অতিবৃদ্ধ’ (সূরা কাসাস:২৩)।
গ. সামাজিক প্রয়োজন: সামাজের প্রয়োজনেও নারীকে কখনো কখনো শ্রমের দায়িত্ব নিতে হয়। যেমন, নারী রোগীদের চিকিৎসা-সেবা, নারী শিক্ষা ইত্যাদি যা কিছু নারীদের সাথে সম্পৃক্ত, সে সব ক্ষেত্রে। এ ব্যাপারে সর্বোত্তম নীতি হলো, নারীদের পরিবেশে নারীরা কাজ করবে। পুরুষদের সাথে নয়। হ্যাঁ, একান্ত যদি নারী না পাওয়া যায় তবে বিশেষ প্রয়োজনের নীতি অবলম্বন করে সেথায় পুরুষের সহযোগিতা নেয়া যাবে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনকে প্রয়োজনের পরিমাপে নির্ধারণ করতে হবে। ঢালাওভাবে গ্রহণ করা যাবে না।
দ্বিতীয় শর্ত: শ্রম অবশ্যই বৈধ হতে হবে:
সুতরাং ঐ সব শ্রম নারীদের জন্য বৈধ নয়, যা মৌলিকভাবেই হারাম। কিংবা মৌলিকভাবে হালাল; কিন্তু আনুসঙ্গিক কোন কারণে তা হারামের পর্যায়ভুক্ত হয়ে গেছে। প্রথম প্রকারের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বার ইত্যাদিতে মদ পরিবেশন করা, কিংবা যৌন উত্তেজক নর্তকী হিসেবে কাজ করা। দ্বিতীয় প্রকারের দৃষ্টান্ত হলো, নির্জনে অবিবাহিত লোকের সেবা করা, কিংবা এমন অফিস বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করা, যেথায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা পরপুরুষের সাথে নির্জনে মেলামেশার অপরিহার্যতা রয়েছে। অথবা বিমান বালা হিসেবে কাজ করা। যেথায় অনৈসলামিক পোশাক পরা, যাত্রীকে নিষিদ্ধ খাদ্য-পানীয় পরিবেশন কিংবা সফরের দূরত্বে একাকী রাত্রী যাপন করতে হয়। কারণ পরপুরুষের সাথে নির্জনতা কিংবা অবাধ মেলামেশা ইসলামে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে হাদীসে রয়েছে:
“لا يخلون رجل وامرأة ، إلا كان ثالثهما الشيطان”.
“একান্ত নির্জনে বেগানা নর-নারী যখন কথাবার্তা বলে, শয়তান তখন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে যায়”।
“إياكم والدخول على النساء
নারীদের সাথে অবাধে মেলামেশা করা থেকে সাবধান হও।
তৃতীয় শর্ত: ইসলামী আচরণ ও রীতি-নীতি অনুসরণ করা:
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই নারীকে পোশাকে-চলনে-বলনে ইসলামী মূল্যবোধ, আদব-আখলাক মেনে চলতে হবে। এ সবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কুরআনে বর্ণিত নিন্মোক্ত নিদের্শনাসমূহ:
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ
“আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে” (আননূর:৩১)।
وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا
“আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার” (আননূর:৩১)।
إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا
যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে (আহযাব:৩২)।
ولا تبرجن تبرج الجاهلية الأولى- (الأحزاب: ৩৩).
“তোমরা মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না”Ñ (আল্-আহযাব: ৩৩)।
يا أيها النبي قل لأزواجك وبناتك ونساء المؤمنين يدنين عليهن من جلابيبهن ذلك أدنى أن يعرفن فلا يؤذين (الأحزاب: ৫৯).
“হে নবী, আপনি নির্দেশ দিন আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে এবং সকল মুসলিম রমণীদেরকে তারা যেন, নিজেদের গায়ে পুরা দেহ পরিব্যপ্তকারী চাদর ব্যহার করে, এটাই হচ্ছে তাদেরকে (সম্ভ্রান্ত বলে) চিনার প্রকৃত ব্যবস্থা। ফলে কষ্ট প্রাপ্ত হবে না” (আহযাব: ৫৯)।
চতুর্থ শর্ত: অভিভাবকের অনুমতি থাকতে হবে
পঞ্চম শর্ত: মূল দায়িত্ব পালনের প্রতি উদাসীন হতে পারবে না: যেমন, স্বামী-সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে উদাসীন হওয়া। কারণ এগুলো তাঁর মৌলিক দায়িত্ব।
ষষ্ঠ শর্ত: ফিতনা সৃষ্টি না করা: রাসূল (স.) বলেন, ما تركت بعدي فتنة أضر على الرجال من النساء “আমার পরে পুরুষদের জন্য নারী অপেক্ষা অধিকতর ফিতনা আর কিছুই রেখে যাই নি”।
নারীর কর্মক্ষেত্র:
ইসলাম নারীর কর্মতৎপরতার ব্যাপক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে দিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা থেকে শুরু করে ইসলাম প্রচার, যুদ্ধ-জিহাদ, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারিগরী ও বিভিন্ন পেশা-বৃত্তি সর্বত্র রয়েছে তার পদচারণার অধিকার। নিন্মে এ মর্মে মহিলা সাহাবীদের জীবনপাতা থেকে নারীর কর্মক্ষেত্রের কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হলো:
ক. শিক্ষা : এ মর্মে হযরত আইশা (রা) এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রবীন সাহাবারা পর্যন্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমাধান ও জ্ঞানান্বেষণে তাঁর শরণাপন্ন হতেন। অন্য হাদীসে রয়েছে, হযরত শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ বলেন, একদিন তিনি হযরত হাফসাহ (রা.) এর কাছে বসেছিলেন। এই সময় নবী (স.) বললেন,
ألا تعلمين هذه رقية ، كما علمتيها الكتابة
“তুমি একে যেমন লিখতে শিখিয়েছ, তেমনি কি ক্ষুর ফাটা রোগের দুআও শিখাবে না?”
খ. দাও‘আহ তথা আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান:
বর্ণিত আছে যে,
كانت أم شريك غزية بنت جابر بن حكيم الدوسية بعد أسملت ، وهي بمكة، جعلت تدخل على نساء قريش سرا، فتدعوهن وترغبهن في الإسلام، حتى ظهر أمرها لأهل مكة ، فاظهدوا وعذبوها.
হযরত উম্মু শরাইক গাযিয়্যাহ বিনতে জাবির বিন হাকিম আদ-দুসিয়্যাহ মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর গোপনে গোপনে কুরাইশী মহিলাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহ্বান ও অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। এরপর তাঁর বিষয়টি মক্কাবাসীদের কাছে ফাঁস হয়ে গেলে তারা তাঁর প্রতি জুলুম ও নির্যাতন চালায়।
গ. যুদ্ধ-জিহাদ:
হযরত উম্মু আতিয়্যাহ (রা.) থেকে বর্ণিত।
غزوت مع رسول الله سبع غزوات، أخلفهم في رحالهم، فأصنع لهم الطعام، وأداوي الجرحي ، وأقوم على الزمني.
তিনি বলেন, আমি রাসূলের সাথে সাতটি যুদ্ধ করেছি। আমি কাফেলার পেছনে থাকতাম। তাদের জন্য খাদ্য তৈরি করতমা। আহতদের চিকিৎসা করতাম ও জটিল রোগাক্রান্তদের পরিচর্যা করতাম।
عن الربيع بنت معوذ الأنصارية قالت: ” كنا نغزو مع رسول الله ـ صلى الله عليه وسلم ـ نسقي القوم ونخدمه ونرد القتلى والجرحى إلى المدينة
“রবি’ বিনতে মুআওয়্যায আনসারীয়্যাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতাম। লোকদেরকে পানি পান করাতাম এবং সেবাযত্ম করতাম। নিহত ও আহতদেরকে মদীনায় পাঠাতাম”।
উম্মে সুলাইম হনাইনের যুদ্ধে একটি খঞ্জর নিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী আবু তালহা যখন জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন,
اتخذته إن دنا مني أحد من المشركين بقرت بطنه
আমি এজন্যই এটি নিয়েছি যে, কোন মুশরিক আমার নিকটবর্তী হলে আমি তার পেট বিদীর্ণ করে দেবো”।
প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী উম্মু ইমারাহ উহুদ যুদ্ধে প্রচন্ড বিরত্বের পরিচয় দেন। এমন কি রাসূল (স.) তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। রিদ্দার যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেন। মুসাইলামাতুল কাজ্জাব নিহত হলে তিনি ফিরে আসেন। এবং তার দেহে দশটি আঘাতের চিহৃ পাওয়া যায়।
ঘ. চিকিৎসা সেবা:
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত।
كان رسول الله يغزو وأم سليم ونسوة من الأنصارمعه إذا غزا، فيسقين الماء، ويداوين الجرحى
“রাসূল (স.) যখন যুদ্ধ করতেন, তখন উম্মু সুলাইম ও একদল আনসারী মহিলা তাঁর সাথে থাকতেন। তারা পানি পান করাতেন এবং আহতদের চিকিৎসা সেবা দিতেন”।
ঙ. কৃষিকাজ:
সাহল বিন সা‘দ একজন মহিলার কথা উল্লেখ করেছেন যার নিজের কৃষিক্ষেত্র ছিল। সে তার কৃষিক্ষেত্রের সেচ খালের পার দিয়ে গাজরের চাষ করতো। সাহল বিন সা‘দ এবং অন্যান্য সাহাবাগণ জুমু‘আর দিন তার সাথে সাক্ষাতের জন্য গেলে সে তাঁদের গাজর ও আটার তৈরী এক প্রকার হালুয়া খেতে দিত।
হযরত আসমা (রা.) তাঁর সাংসারিক জীবনের প্রথম দিককার অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, হয়রত যুবায়েরের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। তাঁর শুধু একটি পানিবাহি উট ও একটি ঘোড়া ছাড়া আর কোন অর্থ সম্পদ, কাজের লোক বা অন্য কোন জিনিস ছিল না। আমি নিজেই তাঁর ঘোড়াকে ঘাস ও পানি দিতাম এবং পানির পাত্র ভর্তি করতাম। রাসূল (স.) হযরত যুবায়েরকে আমার বাড়ী থেকে দুই মাইল দূরে একখন্ড জমি চাষ করে তার ফসল গ্রহণ করতে দিয়েছিলেন। আমি সেই জমি থেকে খেজুরের আঁটি সংগ্রহ করতাম”।
كنت أنقل النوى على رأسي من أرض الزبير ، وهي من المدينة على ثلاثي فرسخ
চ. ব্যবসায়-বাণিজ্য:
ফায়লা নান্মী এক মহিলা সাহাবী নবী (স.) কে বললেন, إني امرأة أبيع وأشتري আমি একজন মহিলা। আমি নানা প্রকার জিনিস ক্রয়-বিক্রয় করে থাকি (অর্থাৎ আমি ব্যবসায়ী)। এরপর সে ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় নবীর কাছে থেকে জেনে নিল।
হযরত ‘উমারের যুগের একটি ঘটনা। আসমা বিনতে মাখরাকে তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ বিন আবু রাবীয়াহ ইয়ামান থেকে আতর পাঠাতো আর তিনি ঐ আতরের কারবার করতেন।
ছ. শিল্প ,কারিগরি, কুটির শিল্প ও বৃত্তিমূলক পেশা
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদের স্ত্রী শিল্প ও কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ ছিলেন। এ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তিনি তাঁর নিজের, স্বামীর এবং সন্তানদের ব্যয় নির্বাহ করতেন। একদিন তিনি নবী (স.) এর খেদমতে হাজির হয়ে আরজ করলেন, إني مرأة ذات صنعة، أبيع منها، ليس لي ولا لزوجي ولا لولدي شيئ “আমি কারিগরি বিদ্যায় দক্ষ একজন নারী। আমি বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী তৈরী করে বিক্রি করি। (এভাবে আমি উপার্জন করতে পারি) আমার স্বামী ও সন্তানদের (আয়ের কোন উৎস) কিছুই নেই”। তিনি জানতে চাইলেন, তিনি কি তাদের জন্য ব্যয় করতে পারেন? নীব (স.) বললেন, তুমি তাদের জন্য করতে পার। এ জন্য পুরস্কার লাভ করবে।
হযরত সাহল বিন সা‘দ বলেন, এক মহিলা রাসূলের কাছে একটি চাঁদর নিয়ে আসলেন। যার প্রান্তদেশগুলোতে ছিলো শৈল্পিক কাজের ছোঁয়া। মহিলা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই চাদরটি আমি নিজ হাতে তৈরী করেছি। আমি এটি আপনাকে পরাবো। অতঃপর রাসূল তা গ্রহণ করলেন। রাসূলের তখন এটি প্রয়োজনও ছিলো। পরে তিনি সেটিকে লুঙ্গি বানিয়ে আমাদের কাছে আসলেন।
নারী শ্রমের ব্যাপারে তথাকথিত নারীবাদী ও বুদ্ধিজীবি, সুশীলদের অবস্থান:
নারী-পুরুষের অবাধ ও বাঁধভাঙ্গা মেলামেশায় বিশ্বাসী, কাল্পনিক নারী স্বাধীনতার প্রবক্তা এক শ্রেণীর নারীবাদী, বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ ইসলামের এই সুস্পষ্ট, যৌক্তিক, চিরকল্যাণকর, শাশ্বত শিক্ষা তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয় না। বরং ইসলামের নারী শ্রম নীতির উপর জঘন্যতম অপবাদের কালিমা লেপনের ঔদ্ধতাও দেখিয়ে থাকে। তারা শ্রমের প্রশ্নে নারী-পুরুষের মধ্যে কোন প্রকার ক্ষেত্রভিত্তিক পার্থক্য মেনে নিতে চায় না। তাদের দাবী, নারী স্বাধীনভাবে ঘরে-বাহিরে, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে যে কোন কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করতে পারবে। কোন প্রকার শর্ত ও বাধ্যবাধকতা দিয়ে এই স্বাধীনতা হরন করা যাবে না। ইসলাম ও নারীর প্রশ্ন আসলেই তারা দুচোখ দিয়ে শুধু দেখে মধ্যযুগীয় অন্ধকার ও নির্যাতনের চিত্র। জলাতঙ্গ রোগীর মত। ইউরোপের মধ্যযুগীয় অন্ধকারকে তারা ইসলামের উপর টেনে এনে নারী মুক্তির স্বর্নযুগ, রাসূল (স.), সাহাবাহ, তাবেয়ীদের যুগকে ম্লান করে দিতে চায়। অনেকটা জোনাকীর আলো দিয়ে সূর্য কিরণকে নিষ্প্রভ করার মত। নারী-পুরুষের মধ্যে শ্রম-বন্টন নীতি তাদের কাছে এক প্রকার দাসত্বের নামান্তর। যদিও তারা সরাসরি নারীকে তার স্বভাব ও নারীত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কথা বলে না। এটি তাদের একটি কৌশল। উদ্দেশ্য হলো, নারীত্বকে নিষিদ্ধ ভোগপণ্য হিসেবে কিংবা হারাম উপার্জনে ব্যবহার করা। তাদের ভাবখানা এমন, যেন তারাই নারীর একনিষ্ঠ কল্যাণকামী ও উপকারী বন্ধু। এ অবস্থান প্রমাণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে তারা যে সব বিভ্রান্তি ছড়ায়, সেগুলো হচ্ছে:
ক. পাশ্চাত্যের অনুকরণ : পাশ্চাত্য বিশ্ব নারী শ্রম কাজে লাগিয়ে সভ্যতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে। সভ্যতার বিভাজন যেহেতু সম্ভব নয়, তাই উন্নতির দারপ্রান্তে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকেও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে।
খ. সামাজিক স্বার্থ: নারী সমাজের অর্ধ্বেক। তাই তাদেরকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখার অর্থ দাঁড়ায়, অর্ধ্বেক শক্তিকে নিষ্ক্রীয় করে রাখা। যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ অশনি সংকেত। অতএব, সমাজের স্বার্থেই নারী শ্রম অনস্বীকার্য।
গ. পারিবারিক স্বার্থ: আধুনিক জীবনযাত্রা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। নারী শ্রম পরিবারিক আয় বৃদ্ধির অন্যতম উপায় এবং জীবনের ব্যয়ভার লাঘবে পুরুষের জন্য সহায়ক। বিশেষ করে সীমিত আয়ের পরিবারে।
ঘ. নারীর আপন স্বার্থ: সমাজ সংষ্পর্শ নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ। এতে তার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। যা চার দেয়াল বেষ্টিত জীবনে অর্জন করা সম্ভব নয়।
ঙ. বিপদের বন্ধু: স্বার্থসংঘাতে জর্জরিত এ সমাজ ও পৃথিবীতে নারী যে কোন অনাকাংখিত পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। তার বাবা মরে যেতে পারে। স্বামী তাকে তালাক দিতে পারে। কিংবা সন্তান কর্তৃক অবহেলিত হতে পারে। এমতাবস্থায় শ্রম হতে পারে নারীর হাতে জীবন রক্ষার অস্ত্র।
বিভ্রান্তির অপনোদন:
এক. ইসলাম নারী শ্রমকে হারাম বা নিষেধ করেনি। বরং ঘরের বাহিরে নারী শ্রমকে বাস্তবসম্মত, জীবনঘনিষ্ঠ দিকনির্দেশনা দিয়ে সুবিন্যস্ত করেছে। নারী-পুরুষের মধ্যে শ্রম বন্টন করে একটি ভারসাম্য মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। নারী-পুরুষের দৈহিক-মানসিক গঠন পার্থক্যের কারণেই এমনটি হয়েছে। একমাত্র পাগল ব্যতীত এই সত্যকে কেউ উপেক্ষা করতে পারে না।
দুই. পাশ্চাত্য আমাদের আদর্শ নয়। আমাদেরকে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের নির্দেশ দেয়া হয়নি। আমাদের আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। ইসলামী সভ্যতা বিরোধী কিছু আমরা মেনে নিতে পারি না। যা-ই হোক তার অবস্থান। তাছাড়া, পাশ্চাত্য সভ্যতা যে সফল, সে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ তা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে বলা যায়। দুই শত, আড়াই শত বছর একটি সভ্যতার প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, পাশ্চাত্য নারী স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতার যে স্তরে উপনীত হয়েছে, সে স্থান থেকে সরে না আসলে সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন এ সভ্যতা নিজেই নিজের মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে।
তিন. পাশ্চাত্যের নারীরা কল-কারখানা, মিল-ফ্যাক্টরি, দোকানপাটে শ্রমিকের দায়িত্বভার স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছে, বিষয়টি এ রকম নয়। ক্ষুধার কষ্ট তাদেরকে ওখানে ঠেলে দিয়েছে। এক মুঠো খাদ্যের জন্য পুরুষের সাথে ভিড় জমিয়ে ঠেলাঠেলি করছে। এমন এক নিমর্মম সমাজে, যেখানে নারীর ভরণ-পোষণ করার মত কোন পুরুষ নেই। যেখানে ছোটকে ছোট হিসেবে, নারীকে নারী হিসেবে কেউ মমত্ব প্রদর্শন করে না। আল্লাহ তা‘আলা ইসলামী শরীয়তে নারীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে লাঞ্জনার হাতে থেকে নারীকে রক্ষা করেছেন।
সি, এন এন ও রেডিও ইউ, এস টুডের যৌথ এক জরীপেও এ সত্য ফুটে ওঠেছে। এতে অংশ নেয়া ৪৮% নারী মনে করেন, গত বিশ বছরে পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর কর্মতৎপরতা তার জীবনকে আরো জটিল করে দিয়েছে। এবং ৪৫% নারী গৃহাভ্যন্তরে নারীর অবস্থান ও ঘরের বাহিরে পুরুষ শ্রমের দাবী জানিয়েছে।
প্রখ্যাত গবেষক, ড. ইউসূফ কারাদাভীর শিক্ষক আল্লামা মুহাম্মাদ ইউসূফ তার বিখ্যাত গ্রন্থ الإسلام وحاجة الإنسانية إليه এ প্রসঙ্গে তাঁর জীবনের একটি বাস্তব ঘটনার অবতারণা করেছেন। তিনি এক সময় ফ্রান্সে অবস্থান করছিলেন। যে বাসায় তিনি উঠেছিলেন একটি মেয়ে সেখানে প্রতিদিন কাজ করতে আসতো। তিনি একদিন জিজ্ঞেস করলেন, এ মেয়েটিকেতো দেখে অনেক উচুঁ বংশোদ্ভূত মনে হয়। অথচ সে এখানে গৃহ পরিচারিকার কাজ করছে? তাকে জানানো হলো, সত্যিই মেয়েটি ভালো পরিবারের। কিন্তু তার মা-বাবা নেই। আছে চাচা। সে যথেষ্ট ধনী হওয়া সত্বেও তার খোঁজ-খবর রাখে না। তিনি বললেন, মেয়েটি কোর্টে কেস করতে পারে না? তারা বললো, কোন লাভ নেই। কারণ এদেশে এমন কোন আইন নেই। তখন লেখক মেয়েটিকে ইসলামী আইনে ভরণ-পোষণ নীতির ব্যাখ্যা দিলেন। মেয়েটি তা শুনে বলেছিলো (লেখকের ভাষায় যার অনুবাদ হলো)
“ومن لنا بمثل هذا التشريع؟ لو أن هذا جائز قانونا عندنا، لما وجدت فتاة أو سيدة تخرج من بيتها للعمل في شركة أو مصنع أو معمل أو ديوان من دواوين الحكومة”
“এ রকম আইন কে করবে আমাদের জন্য? সত্যি যদি এ রকম আইন আমাদের থাকতো, তাহলে কোম্পানী, কল-কারখানা কিংবা সরকারী অফিস-আদালাতে কাজের জন্য কোন নারীকে বের হতো দেখা যেত না”।
চার. পাশ্চাত্য নিজেই এখন নারী শ্রমের অপকারিতা ও অনিষ্টতার অভিযোগ করছে। সেথায় নারী নিজেই এখন এই মুছিবত থেকে মুক্তি চাচ্ছে। জোর করে যা তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রসিদ্ধ লেখিকা অহহধ জড়যফব, এ প্রসঙ্গে বলেন, “কারখানায় শ্রমের চেয়ে আমাদের মেয়েদের জন্য কারো বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করা অনেক ভালো ও সহজ। কারণ কারখানার ময়লা-আবর্জনার দূষণে তাদের জীবন-সৌন্দর্য চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে। নিশ্চয়ই ইংরেজীভাষী দেশ গুলোর জন্য এটা লজ্জার বিষয় যে, তারা পুরুষের সাথে লাগামহীন মেলামেশার মাধ্যমে নারীকে নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত বানিয়েছে। কেন আমরা পুরুষের জন্য পুরুষশ্রম ছেড়ে দিয়ে নারীকে তার স্বভাবসম্মত গৃহাভ্যন্তরীণ শ্রমের দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছি না? নারীর সম্মান-মর্যাদা রক্ষা করছি না?”
পাঁচ. নারীকে তাঁর গৃহের মূল দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এনে ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, প্রসিকিউটার, বিচারক, বা কারখানার শ্রমিক পেশায় নিয়োজিত করার দ্বারা সমাজের প্রকৃত কোন স্বার্থ অর্জিত হয় না। বরং সমাজের প্রকৃত স্বার্থ নিহিত রয়েছে নারীকে তার ঐ মূল দায়িত্বে নিয়োজিত করা, যার তার স্বভাব ও যোগ্যতার সাথে শতভাগ সঙ্গতিপূর্ণ। কলকারখানা, ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালাতে কাজ করার চেয়ে এর গুরুত্ব, মর্যাদা ও প্রয়োজনীয়তা কোন অংশে কম নহে। এ জন্যই নেপোলিয়ন কে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ফ্রান্সের সর্বাধিক দুর্ভেদ্য দুর্গ কোনটি? তিনি জবাব দিলেন, সুযোগ্য, আদর্শবান মায়েরা।
ছয়. যারা মনে করে যে, নারী ঘরের মধ্যে অকর্মণ্য, বেকার বসে থাকে, তারা হয়ত মূর্খ, নয়তো জ্ঞানপাপী। দায়িত্বশীল আদর্শ গৃহীনিরা বরং অতিরিক্ত গার্হস্থ শ্রম সম্পাদন করে অবসর সময় না পাওয়ার অভিযোগ করে থাকেন। এমনকি কোন নারীর যদি গৃহভ্যন্তরে অতিরিক্ত সময় থাকেও, সে তা গঠনমূলক কোন কাজ, যেমন, সেলাই ইত্যাদিতে ব্যয় করতে পারে । ঘরের মধ্যে বসেও সে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ করতে পারে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। পারে তার সমাজ ও সমজাতীয় নারীদের সাহায্য সহযোগিতা করতে। পারে দারিদ্র্য, মূর্খতা, রোগ-বালাই , অসামাজিকতার প্রতিকারে অবদান রাখতে। নিজ গৃহে সন্তান-সন্ততির লালন-পালন, সুরক্ষা-পরিচর্যার দায়িত্বভার অনাত্মীয়, কাজের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে আপন স্বন্ধে যে নারী সমাজ স্বার্থের বোঝা তুলে নেয়, সে মূলত একই সাথে সমাজ ও নিজের ধ্বংস সাধন করে।
সাত. এ কথা স¦তঃসিদ্ধ যে, শুধুমাত্র অর্থ দিয়েই পরিবারের সুখ-শান্তি ক্রয় করা যায় না। তদূপরি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, নারীর অর্জিত অর্থের সিংহ ভাগই বরং পুরোটাই ব্যয়িত হয় তার সৌন্দর্য চর্চা ও প্রসাধনী সামগ্রি কিনতে। ঘরের বাহিরে পুরুষকে দেখানোর জন্য মূল্যবান বিলাস বসনের আয়োজন করতে। অন্য কথায়, পোশাক প্রদর্শনী, সৌন্দর্যের কৃত্রিম প্রকাশ আর মডেলিংয়ের পেছনে। বিনিময়ে পরিবারকে হারাতে হয় অকৃত্রিম আনন্দ, প্রশান্তি ও হৃয়াবেগ। যা একজন নিবেদিত নারীই শুধু দিতে পারে। পক্ষান্তরে, কর্মজীবি মা সে কি দিবে পরিবারকে? সে তো নিজেই ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরে। তার পরিচর্যার জন্যই বরং আরেকজন দরকার। কথায় বলে, যার কাছে যা নাই, সেকি তা দিতে পারে?
আট. সহজাত স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নারীকে পুরুষ শ্রমে বাধ্য করায় নারীত্বের কোন স্বার্থকতা নেই। তাকে আল্লাহ সৃষ্টিই করেছেন নারী রূপে। তাই শ্রমের দোহাই দিয়ে পুরুষের সমারোহে নারীর বিচরণ তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়, এ কথা বিবেকপ্রসূত হতে পারে না। এটি বাস্তবতা বিবর্জিত, মিথ্যা কথা। এ জাতীয় নারী ক্রমান্বয়ে তার নারীত্বই হারিয়ে ফেলে। নারীর মূল ভুষণ লজ্জাশীলতা ও আচার-আচরণের কোমলতা- ইত্যাদি হয়ে যায় দুষ্প্রাপ্য। এ কারণেই কোন কোন ইউরোপীয় গবেষক এদেরকে পুং ও স্ত্রী লিঙ্গের মধ্যবর্তী ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইউরোপের অনেক সৎসাহসী নারীও এ সত্য অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, নারীবাদীরা ব্যক্তিত্ব বিকাশের কথা না বলে যদি বলতেন, এতে নারী ধর্ষণের হার আশংকাজনক হারে বেড়ে যায়, তাহলেই বরং তা হতো বাস্তবসম্মত। আজকের বাংলাদেশই এর উজ্জল প্রমাণ।
নয়. গৃহ বহির্ভুত শ্রমলদ্ধ অর্থ নারীর বিপদের বন্ধু। কঠিন প্রতিকূলতায় এটি হতে পারে তার আত্মরক্ষার উপায়। এ কথা পাশ্চাত্যবাসীদের জন্য সঠিক হলেও মুসলিম দেশে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ইসলামের শিক্ষায় নারী সর্বদা ভরণ-পোষণপ্রাপ্ত। বাবা, স্বামী, সন্তান, ভাই, নিকটাত্মীয় অথবা রক্তসম্পকীয় কেউ না কেউ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নারীর ভরণ-পোষণ দিতে শরীয়তে আদিষ্ট।
অবশ্য পাশ্চাত্য সভ্যতার কুপ্রভাবে এখন আমাদের সমাজের অনেকেই আত্মস্বার্থ অন্ধ হয়ে ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসী বলে। অধীনস্থ ও নিকটাত্মীয়দের দায়িত্বভার থেকে অনেককে এখন সড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। পরিণামে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার কাছে আমাদের ধার্মিকতা যদি এভাবে পরাজিত হতে থাকে, তবে ধ্বংস যে আমাদের অনিবার্য তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পুরুষ শ্রমের প্রতি বিনা প্রয়োজনে নারীদের অতিমাত্রিক ঝুঁকে পড়ার ক্ষতিসমূহ:
পূর্বেই বলেছি, বিশেষ প্রয়োজনে শর্তসাপেক্ষে পুরুষ শ্রমে নারীর আত্মনিয়োগে কোন বাধা নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজনে নারীর অতিমাত্রিক ঝোঁক ও লাগামহীনতা ভয়াবহ ক্ষতি ও ধ্বংসাত্মক পরিণাম ডেকে আনতে পারে। এ সবের মধ্যে রয়েছে:
এক. নারীর নিজের ক্ষতি: এতে তার নারীত্ব ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সমূহ হারিয়ে যায়। নারী বঞ্চিত হয় তার ঘর ও ছেলে-সন্তানের সান্নিধ্য থেকে। পরিণামে অনেক নারীকে বন্ধ্যাত্বেরও শিকার হতে হয়। এদেরকে অনেকে ‘তৃতীয় প্রজাতি’ বলেও অভিহিত করেছেন। যারা না পুরুষ, না নারী।
দুই. স্বামীর ক্ষতি: স্বামী হারায় তার প্রিয়তম স্ত্রীর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অনুরাগের ফল্গুধারা। ঝগড়া-বিবাদ ও ভুল বোঝাবুঝিতে সুখের সংসারে জ্বলে অশান্তির দাবানল। কখনো কখনো আত্মনির্ভরশীলতার অহংকারে স্ত্রীর মুখাপেক্ষহীনতার মনোভাব স্বামীর প্রতি যথার্থ মর্যাদাদান ও তার অভিভাবকত্বের অধিকারে আঘাত হানে। বরং বহুক্ষেত্রে স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর অবস্থান ও বেতন অপেক্ষাকৃত উচ্চতর হওয়ায় এক ধরণের হীনমন্যতা, ক্ষোভ ও পরশ্রীকাতরতায় ভুগতে থাকে সে।
তিন. ছেলে-সন্তানদের ক্ষতি: কর্মক্লান্ত মা সন্তান প্রতিপালনে ব্যর্থ। মাতৃস্নেহ ও পরিচর্যা বঞ্চিত প্রজন্ম অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। কারণ পৃথিবীতে মায়ের কোন বিকল্প নেই। না কোন প্রতিষ্ঠান, না কোন ব্যক্তি।
চার. পুরুষ জাতির ক্ষতি: নারী শ্রমিক যখন বিনা প্রয়োজনে পুরুষ শ্রমিকের স্থান দখল করে নেয়, তখন বেকারত্ব অভিশাপ হয়ে নেমে আসে পুরুষের জীবনে। অতএব, যতদিন সমাজে বেকার পুরুষ থাকবে, ততদিন নারী শ্রম তাদের ক্ষতিই করতে থাকবে।
পাঁচ. শ্রমের ক্ষতি: নারীকে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যগত কারণেই বাধ্য হয়েই অনেক সময় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে হয়। ফলে শ্রম ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
ছয়. নৈতিকতা ও চারিত্রিক মূল্যবোধের ক্ষতি: পুরুষের সাথে অতিমাত্রিক মাখামাখির কারণে নারীর লজ্জাশীলতা হারিয়ে যায়। পুরুষ হারিয়ে ফেলে তার আত্মমর্যাদাবোধ। আর প্রজন্ম তথা সন্তান হারায় শ্রেষ্ঠ সম্পদ, মা-বাবার ছত্রছায়ায় উত্তম শিক্ষা ও প্রতিপালন। কারণ মা-বাবার মন-মগজ জুড়ে আছে শুধু অর্থলিপ্সা ও আয়-উপার্জন বৃদ্ধির চিন্তা। লজ্জা, আত্মমর্যাদাবোধ ও উত্তম প্রতিপালন হারিয়ে গেলে নৈতিকতা ও চরিত্র বলতে কি আর কিছু থাকে পরিবারে?
(চলবে)
প্রবন্ধকার: সহযোগী অধ্যাপক ও পরিচালক, ইউনিভার্সিটি রিকোয়ারমেন্ট কোর্সেস, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। খতীব, চট্টগ্রাম কলেজ মসজিদ
http://ctgtimes.com/archives/38603
বিষয়: বিবিধ
২৯৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন