"শতাব্দীর সাহসী উচ্চারণ"
লিখেছেন লিখেছেন পথিক মুসাফির ২৮ অক্টোবর, ২০১৩, ০৭:৪৯:৫৮ সকাল
এই লেখাটি পড়লে আপনি বা আপনারা বা বিশেষ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মনোভাবী ব্যক্তিদের পরম তৃপ্তি দান করবে বলে আমি আশা রাখি ।
মনসুর আহমদ : পৃথিবীর মঞ্চশালা থেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ কত লোক চলে যায় যারা পশ্চাতে কিছু রেখে যায় না। যদিও তাদের মাঝ থেকে দু’একজন কিছু রেখে যায়, তা সহ¯্র চরণ তলে অবিশ্রাম দলিত হয়ে কিছুক্ষণেই তা ধূলিতে মিশে একাকার হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো মহাজনের পুণ্যস্তূপের মধ্য হতে এমন সকল অমর বীজ পড়ে যায় যা ধূলিতে পড়ে অঙ্কুরিত ও বর্ধিত হয়ে স্থায়ী রূপে বিরাজ করে নতুন পথিকদেরকে ছায়াদান করে। এমনিভাবে পৃথিবীতে অনেক মহাজন সত্যের পথে ন্যায়ের পথে লড়তে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন বাণী উচ্চারণ করেছেন যা শাহাদতের নতুন পথিকদেরকে অনন্ত জীবনের পথে পা বাড়াতে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। শাহাদতের পথে অনুপ্রাণিত এমন এক সিংহ পুরুষ আব্দুল কাদের মোল্লা। কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর তাকে ফাঁসির দ-াদেশ দেয়া হয়েছে। দ-াদেশ মাথায় নিয়ে তিনি নির্ভীক চিত্তে জনতার আদালতে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে শত সহ¯্র শহীদের বজ্র নির্ঘোষ কণ্ঠস্বর।
ফাঁসির মঞ্চে কাদের মোল্লা জীবনের জয়গান প্রথমেই স্মরণ করিয়ে দেয় জ্ঞান গুরু সক্রেটিসকে। আজ থেকে প্রায় চব্বিশ শ’ বছর আগে জ্ঞান জগতের প্রথম গুরু সক্রেটিসকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস, জ্ঞান জগতে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নতুন করে বিনির্মাণের প্রয়াসে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। তৎকালীন সুশীল সমাজ ও নগর রাষ্ট্র তার এ প্রচেষ্টাকে সুনজরে দেখেনি। তার বিরুদ্ধে এথেন্সের প্রচলিত দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে নতুন একক অদ্বৈত প্রভুর অস্তিত্ব প্রবর্তনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। সেই সাথে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও প্রচলিত আইন পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশের যুব সমাজকে বিপথে পরিচালনা করার অভিযোগও যুক্ত হয়েছিল।
ম্যালেতুস, লাইকন, আনীতুসের আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে ৫০১ জন বিচারকের দ্বারা গঠিত প্রহসনমূলক বিচারালয়ে তাকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়। তার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল তার সাক্ষী পরবর্তী কাল। মৃত্যুর সময় তার উচ্চারিত উক্তি জগৎ আজও স্মরণ করে। তিনি বলেছিলেন, আমার দ-িত হওয়ার কারণ, বিচার কক্ষে আমার কাছ থেকে মুক্তির যে আর্ত আবেদন, যে বিলাপ এবং ক্রন্দন আপনারা শুনতে চেয়েছিলেন এবং যে আর্ত আবেদন এবং বিলাপ শুনতেই আপনারা অভ্যস্ত সে আর্তবিলাপ আমার কাছ থেকে আপনারা পাননি। সাহস, ঔদ্ধত্য, অনিচ্ছা যে নামই আপনারা দিন না কেন, আপনাদের কাছ থেকে মুক্তি আদায়ের জন্য আর্ত-আবেদন কিংবা বিলাপ করতে আমি সম্মত নই। আমি এখনও মনে করি আমার পক্ষে এরূপ ব্যবহার প্রদর্শন অসঙ্গত। এই বিচারের শুরুতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিপদকালে অতি নগণ্য কিংবা নিচ কোন ব্যবহার যেন আমি না করি। এখনও আমি আমার প্রদত্ত কৈফিয়তের জন্য অনুতপ্ত নই। যে কথা আমি বলেছি সেজন্য যদি মৃত্যুবরণ করি সেও আমার শ্রেয়: তবু যেন না আমি আপনার অভিপ্রেত ভঙ্গিতে নিজেকে ছোট করে ক্ষমা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করি। কেননা, যুদ্ধ ক্ষেত্রে কিংবা আইনের সম্মুখে মৃত্যুকে পরিহারের জন্য ক্ষুদ্রতার আশ্রয় কারও নেয়া উচিত নয়।
সক্রেটিসের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এ শতাব্দীর অন্যতম নর শার্দুল আব্দুল কাদের মোল্লা সাহসী উচ্চারণ করেছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরকে নির্দেশনা প্রদান করতে গিয়ে বলেন, আমি যদি মহান আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হই, সেটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওনা। সুতরাং মৃত্যুদ-ের ভয়ে আমি ভীত নই। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন না। আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা যাক বা না যাক- এটাই তার সিদ্ধান্ত। তিনি আত্মীয় স্বজন ও দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমার অনুরূপ চিন্তা করতেও নিষেধ করেছেন। জামায়াতের এই সিংহ পুরুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে শুনলাম জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা আদি পুরুষ মাওলানা মওদুদীর কণ্ঠে উচ্চারিত একই কথা।
‘কাদিয়ানী সমস্যা’ পুস্তিকার মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে বিদ্বেষ প্রচার এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অভিযোগের ভিত্তিতে সামরিক আদালত ৮ মে মাওলানা মওদূদীকে ফাঁসির হুকুম প্রদান করে। কি এক অদ্ভূত বিচার, যে পুস্তিকা লেখার অভিযোগে মওলানাকে ফাঁসির হুকুম দেয়া হল সে গ্রন্থখানিকে বাজেয়াপ্ত করার মতো তাতে কোনো উপাদান পাওয়া গেল না। এমন কি সামরিক আদালতে বিচার চলাকালে লাহোর শহরে উক্ত পুস্তিকা শত শত কপি বিক্রি হয়েছিল। যে বই লেখার ওপর ভিত্তি করে মাওলানাকে ফাঁসির হুকুম দেয়া হলো তার মধ্যে এমন একটি ছত্রও নেই যে জন্য লেখকের ন্যূনতম শাস্তি হতে পারে।
আসলে ইসলাম ও ইসলামী শাসনতন্ত্র বিরোধীরা চেয়েছিল ছলে বলে কৌশলে ইসলামী আন্দোলনের এ বীর সেনানীকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে চিরতরে বিদায় করে দিতে। ফাঁসির আদেশে মাওলানা মওদূদীর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সমগ্র মুসলিম জগতে তার জনপ্রিয়তা এবং আল্লাহর পথে জান কুরবানীর যে মহান ও মহিমাময় নিদর্শন পাওয়া গেছে তা ইসলামের ইতিহাসে এক অক্ষয় কীর্তি হয়ে থাকবে।
৮ মে বাদ মাগরিব জেলখানার কর্মচারী সরকারি ফরমান শুনিয়ে গেলÑ ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ পুস্তক প্রণয়নের জন্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর মৃত্যুদ- এবং তার মুদ্রাকর সাইয়েদ নকী আলীর ৯ বছর সশ্রম কারাদ-। সাইয়েদ নকী আলী বলেন, ‘মাওলানার মৃত্যুদ- ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। তবু কারও মুখে ছিল না কোনো উদ্বেগ। আমরা সকলে তাকালাম মাওলানার দিকে। দেখলাম তার ধীর প্রশান্ত মূর্তি। দৃষ্টিতে বিরাট গভীরতাÑ যেন গহীন সমুদ্রের অসীম গভীরতা। জেল কর্মচারী মাওলানার হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে বলেনÑ মাওলানা, আপনি ইচ্ছা করলে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে পারেন।
মাওলানা নীরবে মৃদু হাস্যসহকারে, কাগজটুকু হাতে নিলেন। তিনি ধীর ও গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আপনারা মনে রাখবেন যে আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমি তাদের কাছে কিছুতেই প্রাণ ভিক্ষা চাইবো না। এমন কি আমার পক্ষ থেকে অন্য কেউ যেন প্রাণ ভিক্ষা না চায়Ñ না আমার মা, না আমার ভাই, না আমার স্ত্রীÑ পুত্র-পরিজন। জামায়াতের লোকদের কাছে আমার এই নিবেদন।” মাওলানার সীমাহীন খোদাপ্রেম এবং খোদার পথে প্রাণ উৎসর্গ করার আকুল আগ্রহ জগতকে করলো স্তম্ভিত। মাওলানা মওদূদী (রহঃ)Ñএর উচ্চারণের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আবদুল কাদের মোল্লার সাহসী উচ্চারণ যুগ যুগ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সাহস যোগাবে সন্দেহ নেই।
যতোদিন মানুষ সভ্যতা ও বিচারব্যবস্থা থাকবে ততো দিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে সক্রেটিসের শেষ কথা। তার শেষ উক্তিÑ বিদায় মুহূর্ত সমাগত! আসুন আমরা আপন আপন পথে অগ্রসর হই। আমি অগ্রসর হই মৃত্যুর পথে। আপনারা অগ্রসর হউন জীবনের পথে। কোন পথ মহত্তর? জীবনের কিংবা মৃত্যুর? বিশ্বনিয়ন্তাই তার জবাব দেবেন। সক্রেটিসের এ কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আবদুল কাদের মোল্লার কথায়। তিনি বলেছেন, “আমি কোনো অপরাধ করিনি। মহান আল্লাহ গোপন, প্রকাশ্য সকল খবর রাখেন। কোনো ব্যক্তিই আল্লাহর চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। যারা আমাকে মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করতে চায়, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের ময়দানে তাদের বিচার করবেন। আমার জন্য আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট।”
আল্লাহর পথে শাহাদাতবরণকারী সাইয়েদ কুতুব শহীদের উচ্চারিত বাণী ধ্বনিত হয়েছে মোল্লা আবদুল কাদেরের কণ্ঠে। সাইয়েদ কুতুব নির্মম নির্যাতনের ফলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৫৫ সালের ২ মে তাকে সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঐ বছরের ১৩ জুলাই মহকুমাতুস সাব অর্থাৎ জাতীয় আদালতে তাকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করে। পরে এ দ- বাতিল করে তাকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়। ১ বছর কারা ভোগের পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে, তিনি যদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে ক্ষমার আবেদন করেন তাহলে তাঁকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে।
এ প্রস্তাবের জওয়াবে মর্দে মুমিন বলেন, “আমি এ প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি যে, মজলুমকে জালিমার নিকট ক্ষমার আবেদন জানাতে বলা হচ্ছে। খোদার কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাঁসি থেকেও রেহাই দিতে পারে তবু আমি এরূপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাজি নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।”
পরবর্তীকালে যতবারই তাকে ক্ষমা প্রার্থনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে ততবারই তিনি এই বলে জওয়াব দিয়েছেন, “যদি আমাকে যথার্থই অপরাধের জন্য কারারুদ্ধ করা হয়ে থাকে তাহলে আমি এতে সন্তুষ্ট আছি। আর যদি বাতিল শক্তি আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে থাকে তাহলে আমি কিছুতেই বাতিলের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবো না।” এই একই কথা উচ্চারিত হলো আব্দুল কাদের মোল্লার কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, ‘মিথ্যা’ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তিনি দ- মওকুফের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করবেন না।
এক সময় সাইয়েদ কুতুবকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়। তাঁর দ-াদেশ শোনার পর আদালত সংশ্লিষ্ট লোকজন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অথচ সাইয়েদ রায় শোনার পর খুশি মনে বলে উঠলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “আমার কাছে এটা কোন বিষয় নয় যে আমি কোথায় মরতে যাচ্ছি এবং কিভাবে যালিমরা আমার মৃত্যুদ- দেবে। আমি তো এতেই সন্তুষ্ট যে আমি আল্লাহর একজন অনুগত বান্দা হিসেবে শাহাদতের পেয়ালা পান করতে যাচ্ছি।”
এর পরের দৃশ্য বড়ই করুণ। জয়নাব আল গাজ্জালী লিখেছেন, মৃত্যুদ-াদেশ দেয়ার পাঁচ দিন পর সাইয়েদ কুতুব কারাগারে আটক ছোট বোন হামিদা কুতুবকে দেখতে তার কক্ষে যান। ছোট বোন তাঁকে দেখে বলেন, “ধন্যবাদ, প্রিয় ভাই সাইয়েদ। এটা আমার জন্য এক দুর্লভ মুহূর্ত। আপনি আমার পাশে একটু বসুন।”
সাইয়েদ কুতুব বসলেন বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আলোচনা হলো। তিনি সবাইকে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিলেন। হামিদা কুতুব মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ভাইকে দেখে বিষণœ হয়ে পড়েন। কিন্তু সাইয়েদ কুতুবের সাথে কিছু কথা বলার পর হামিদা কুতুবের বিষণœ বদনেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
২৮ আগস্ট রাতে সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর দুই সাথীকে ফাঁসির সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৯ আগস্ট ভোর রাত। সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর দুই সঙ্গীকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। ইতোমধ্যে ফাঁসির সকল আয়োজন শেষ। সাইয়েদ অত্যন্ত আনন্দিত। নির্ভীক চিত্তে সামনে পা বাড়াচ্ছেন, তাঁর মুখে তৃপ্তির হাসি। সুবহে সাদিকের আলো ঝলমল ধরণী যেন আজ গভীর বেদনাপ্লুত। সাইয়েদ কুতুব হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন। চারদিকে ভেসে উঠল ফজরের আযান। এমনি এক পবিত্র পরিবেশে কার্যকর করা হলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম আয়োজন, সাইয়েদ কুতুব ও তার সঙ্গীদের ফাঁসি। সারা বিশ্বের অগণিত মানুষকে কাঁদিয়ে সাইয়েদ কুতুব পৌঁছে গেলেন তার পরম প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে।
প্রধানমন্ত্রী জামাল নাসেরকে হত্যা করে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বিপ্লবী সরকারের পতন ঘটানোর পরিকল্পনা করছে ইখওয়ানÑ এই মিথ্যা অভিযোগ আনা হলো ইখওয়ানের বিরুদ্ধে। প্রহসনমূলক বিচারের জন্য সামরিক কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক একটি সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলো। এই ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জামাল সলিম, সদস্য ছিলেন আনোয়াস সায়াদাত ও হোসাইন আশশফী। এ তিনজনই ছিলেন জামাল নাসেরের সহকর্মী এবং বিপ্লবী পরিষদের সদস্য।
এই প্রহসনমূলক বিচারে সাতজনকে ফাঁসির হুকুম দেয়া হলো। ডিসেম্বরের নয় তারিখ ছয়জন আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দাহকে মিসরের জালেম সরকার ফাঁসিতে ঝুলাল। এই ছয়জন হলেন, মাহমুদ আব্দুল লতীফ, হিন্দাবী দাবীর, ইবরাহীম আততাইয়ের, ইউসূফ তালায়াত, শেখ মুহম্মদ ফারগালী এবং আব্দুল কাদের আওদাহ। “এই লোকেরা ফাঁসি কার্যকর করার মুহূর্তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছিলেনÑ যিনি তাদেরকে শাহাদতের মর্যাদা দান করেন।” একে একে পাঁচজনকে ফাঁসিতে ঝুলান হলো। সব শেষে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় আব্দুল কাদের আওদাহকে। এসময় তার চোখে ছিল মুচকি হাসির উজ্জ্বলতা। গম্ভীর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন তিনি। এ সময় আব্দুল কাদের আওদাহ বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, তিনি আমাকে শহীদ হবার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি যেন আমার রক্তকে বিপ্লবের নেতাদের জন্য অভিশাপে পরিণত করে।” ফাঁসির আসামীর পোশাক পরিধান করে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, “আমি কোন অপরাধ করিনি। আমার রক্ত অভিশাপ হয়ে চেপে বসবে আমার হত্যাকারীদের উপর।” অতঃপর তিনি হযরত খোবায়েব (রা)-এর মতো মৃত্যুঞ্জয়ী কবিতা-‘আমি যদি আল্লাহর পথে জীবন দিতে পারি, তবে আমার কোনো কিছুর পরওয়া নেই’ বলতে বলতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন।
আজ ঐ একই বিদ্রোহী সুর বেজে উঠেছে আব্দুল কাদের আওদার উত্তর সূরী ফাঁসির জন্য অপেক্ষমাণ আব্দুল কাদের মোল্লার কণ্ঠে। তিনি বলেছেন, ‘নবুওতের পথ বন্ধ হলেও খোলা রয়েছে শাহাদতের দরজা। আমি শাহাদত হিসেবেই দেখি এ ধরনের মৃত্যুকে। তাই ভয় পাই না মৃত্যুদ-কে। তবে মিথ্যা অভিযোগে যারা আমাকে হত্যা করবে, তাদের বিচার হবে কিয়ামতের ময়দানে।’
বালাকোটের শাহাদতের পরে আযাদী আন্দোলনের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতার উপরে মোকদ্দমা চলে, যার মধ্যে মাওলানা ইয়াহইয়া আলী আজীমাবাদী, মাওলানা আহমদ উল্লাহ আজীমাবাদী, মাওলানা জাফর থানেশ্বরী ও মাওলানা আব্দুর রহীম সাদিকপুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব মর্দে মুজাহিদকে শুনান হয়েছিল মৃত্যুদ-াদেশ। মৃত্যুদ-াদেশ শোনার পর জজকে লক্ষ্য করে জাফর থানেশ্বরী বলেছিলেন, “সমগ্র মানবম-লীর জীবন আল্লাহর হাতে। তিনিই মারেন এবং তিনিই জীবন দান করেন। মোতার হাতে না জীবন দেবার ক্ষমতা আছে, না আছে মৃত্যুর। এর পরে তিনি কবিতা আওড়াতে ছিলেন : “আলহামদুলিল্লাহ! যে বস্তু আমার অন্তর কামনা করছিলো, অবশেষে তা তকদীরের ও পর্দার অন্তরাল থেকে প্রকাশিত হলো।”
জেলের জল্লাদেরা তাদের সামনে ফাঁসির মঞ্চ ও রশি তৈরি করতো আর এর বিরুদ্বেগ ও তৃপ্তির সাথে সামান্যতম ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে সে দৃশ্য দেখতেন। মাওলানা ইয়াহইয়া আলী একাগ্রতার সাথে সেই কবিতা পড়তেন যা হযরত খুবাইব (রা.) শূল দ-ের উপর পড়েছিলেন : ‘যদি আমি এই অবস্থায় নিহত হই যে আমি মুসলামন- তবে আমি পরোয়া করি না কোন পার্শ্বে আমাকে হত্যা করা হলো। আর এ সব তো আল্লাহর পথে। যদি তিনি চান তবে শরীরের কর্তিত ও বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকেও জীবন ও বরকত দান করতে পারেন।”
ও সব মর্দে মুজাহিদের কণ্ঠে উচ্চারিত বাণীর মতো একই ধরনের বাণী উচ্চারিত হয়েছে মোল্লা আব্দুল কাদেরের কণ্ঠে। যা না মানবার তা তিনি শেষ পর্যন্ত মানবেন না। তাই তিনি বলেন : “এই রায় বিম্ময়কর হলেও আমি এতে হতবাক হইনি। কারণ আমি ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কারণেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। দুনিয়ায় যারা ইসলামী আন্দোলন করেছেন তাদের সবাইকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করার নানামুখী ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এমনকি নবী রসূলদের ওপরেও চালান হয়েছিল জুলুম ও নির্যাতন। তাই ইসলামী আন্দোলনের পথ হচ্ছে রক্ত পিচ্ছিল ও কণ্টকাকীর্ণ।... আমি যদি মহান আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই, সেটাই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওনা। সুতরাং মৃত্যুদ-ের ভয়ে আমি ভীত নই।” অতীতে আল্লাহর পথে শাহাদত বরণকারীদের খুন আমাদের স্থূল দৃষ্টিতে বিভিন্ন জমিন শুষে নিয়েছে, সেই খুন যার পরিণতিতে এখনও কোন সা¤্রাজ্য কায়েম হয়নি তথাপি সেই খুনের কতিপয় কাত্্রা আদল ও ইনসাফের দাঁড়ি-পাল্লায় বিশাল সা¤্রাজ্য থেকেও অধিকতর ওজন রাখে। অতীত বর্তমান সমস্ত শহীদের সমষ্টিগত পয়গাম এটাই যে, আমরা এমন একটি ভূখ- লাভের জন্য চেষ্টা ও সাধনা করতে থাকি যেখানে আমরা আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জিমাফিক এবং ইসলামের আইন-কানুন মোতাবিক ইসলামী জিন্দেগী পালন করতে পারবো এবং যেখানে প্রবৃত্তি ও শয়তান, শাসক সুলতান এবং রসম রেওয়াজের পরিবর্তে খালেস আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৮৯৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন