ভুজপুরের গল্প।

লিখেছেন লিখেছেন শান্তি চাই ২৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৪৬:১০ বিকাল

টিকছড়িতে সরকার ও আওয়ামী লীগ লুকোচ্ছে প্রকৃত ঘটনা

শতশত মোটরসাইকেল ও গাড়ির সশস্ত্র শোডাউন ও মুসল্লিদের ওপর হামলায় আতঙ্কিত মানুষ প্রতিরোধে এগিয়ে আসে

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : শোডাউনের সন্ত্রাস করতে গিয়ে দলীয় প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়েছে ফটিকছড়ির আ’লীগ নেতা পেয়ারুল ইসলাম বাহিনী। সেদিন শতশত মোটরসাইকেল ও গাড়ির সশস্ত্র শোডাউন-মুসল্লিদের ওপর হামলায় আতঙ্কিত মানুষ প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। আগের দিন শোডাউন করা দলীয় প্রতিপক্ষ ফখরুল আনোয়ারকে উদ্দেশ্য করে শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়েই মূলত এ ঘটনা ঘটে। তাদের দলীয় কোন্দল এতটাই চরম আকার ধারণ করে যে এই ঘটনার প্রতিবাদে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করতে তাদের এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কঠোর নির্দেশের পরই সবাই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকে। এছাড়া সাংবাদিক সম্মেলন থেকে আ’লীগই ঘটনার তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছে। এতে সমর্থন দিয়েছে বিরোধী দলও। কিন্তু সরকার তা না করে তাদের মতো করে তদন্ত করছে। আর বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের গণগ্রেফতার করছে। এই থেকেই বোঝা যায়, সরকারের উদ্দেশ্য আসল রহস্য উদঘাটন নয়। বিরোধী দলকে দমন এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাওয়া। যাতে করে একঢিলে দুই পাখি মারা যায়। একদিকে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রামশূন্য করা যাবে। অন্যদিকে এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ পাবে তারা। প্রকৃত ঘটনা যাতে জানাজানি না হয় সেজন্য তাতক্ষণিকভাবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও প্রত্যাহার করা হয়। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এখানে গুলী করা হয়েছে অভিয়োগ করা হলেও পুলিশ বলছে আহতদের কেউ গুলীবিদ্ধ ছিলেন না। এমনকি কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। এতসব ঘটনার পরও সরকার ও তার উচ্ছিষ্টভোগী কথিত বুদ্ধিজীবীরা এই ঘটনার জন্য বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে উস্কানিদাতা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে গিয়ে এখন ঘটনার আসল রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দেশের প্রভাবশালী পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, এই ঘটনার মাধ্যমে জনগণের প্রতিরোধ এবং শাসক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণার মাত্রাই প্রকাশিত হয়েছে।

১১ এপ্রিল ফটিকছড়িতে কি ঘটেছিল তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে একের পর এক বেরিয়ে আসছে ঘটনার মূল রহস্য। এ পর্যন্ত যা কিছু মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে তাতে এটি অন্তত পরিষ্কার যে, এই গণবিস্ফোরণের সাথে বিএনপি-জামায়াতের নূন্যতম কোনো সম্পর্ক নেই। আ’লীগের দুই গ্রুপের মধ্যকার চলমান সন্ত্রাস, দখল, চাঁদাবাজি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে নমিনেশনকে কেন্দ্র করে জনগণের মাঝে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল এই ঘটনা তারই প্রতিফলন বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। ঘটনার দিন ও তার আগের দিন এই দুই গ্রুপ এলাকায় যে সশস্ত্র শোডাউন করেছিল এতে আতঙ্কিত হয়েই এই গণবিস্ফোরণের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন এখানকার মানুষ অত্যাচারিত হয়ে আসছিল, হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে, অসংখ্য মানুষ বাড়িছাড়া।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এই শোডাউনে কারো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে যাকে পেয়েছে তাকে মেরেছে। মাদরাসার ছাত্র মনে করে মসজিদের মুসল্লিদের ওপর পেয়ারুলের লোকেরা হামলা চালিয়েছে। তারপরই নিজেদের বাঁচার তাগিদে এলাকার নারী-পুরুষ সবাই বিশাল এই সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। শোডাউন দেখে আতঙ্কিত ও ভীত হয়ে এই বিস্ফোরণের জন্ম দেয়। এখানে কোন দলীয় ব্যানার নিয়ে প্রতিহত করা হয়নি। সর্বস্তরের মানুষের প্রতিরোধ এত শক্তিশালী ছিল যে, সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র এমনকি একে-৪৭ রাইফেল থাকার পরও তারা রোষানলের শিকার হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঘটনার দিন শোডাউনের নেতৃত্বদানকারী পেয়ারুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা জামায়াত-শিবির অধ্যূষিত এলাকা দিয়ে মিছিল করে অনেক দূর পর্যন্ত এসেছি। সেখানে আমাদের ওপর হামলা হয়নি। কিন্তু কাজিরহাটে আমাদের ওপর চারদিক থেকে হামলা হয়েছে। আমরা মনে করি হেফাজতের পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াত এই হামলা চালিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের আগের দিন আওয়ামী লীগের আরেকটি অংশ মিছিল বের করেছে। আমরা সেখানে ছিলাম কি ছিলাম না সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। বা তারা আমাদের মিছিলে ছিল কিনা সেটিও বিষয় নয়। যে কেউই মিছিল-সমাবেশ করবে এতে অসুবিধা কোথায়? এটি মিছিল না দলীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তির মহড়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা ছিল হরতালের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ মিছিল। আমাদের লোকজন কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়নি। আমাদের সাথে স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনী ছিল। হামলাকারীরাই আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর গুলী করেছে।

হামলার পেছনে তৃতীয় কোনো শক্তি ছিল কি না, যারা আপনার আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাচ্ছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি এমপি না হয়েও এলাকায় অনেক কাজ করেছি। আমার ব্যাপক জনপ্রিয়তা আছে। তৃতীয় শক্তির ইন্ধন আছে বলে আমি মনে করি না। তবে আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ এ হামলায় অংশ নিতে পারে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রচলিত নিয়মেই তদন্ত দাবি করেছি। তবে এতে যদি কাজ না হয় তাহলে বিচার বিভাগীয় তদন্তের কথা বলেছি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফটিকছড়ি বিএনপির সভাপতি মোঃ সালাউদ্দিন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ফটিকছড়ির ঘটনাটির পেছনে তাদের অন্তঃকোন্দল অন্যতম বিষয়। এখানে বিএনপি বা জামায়াত কিছু করেনি। আপামর নারী-পুরুষ সবাই আতঙ্কিত হয়ে নিজেদের রক্ষায় রাস্তায় নেমে এসেছিল। এই ঘটনায় স্থানীয় আ’লীগ বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছিল। আমরাও সেটিকে সমর্থন জানিয়েছি। বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে। কিন্ত সরকার সেটি না করে একতরফাভাবে বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করছে। এখন পুরো ফটিকছড়িতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

এদিকে আ’লীগের করা অভিযোগের সাথে মিল নেই চট্টগ্রাম পুলিশের। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোঃ ফরিদ উদ্দিন দৈনিক ফটিকছড়ির খবরকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে এলাকার ধর্মপ্রাণ বিশাল জনগোষ্ঠীকে কজে লাগিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছিল। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ভুজপুরের ওসি সামুদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে । জানা গেছে, প্রকৃত ঘটনা জানাজানি হবার ভয়েই তাকে তড়িঘড়ি করে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আ’লীগের পক্ষে গুলী করার অভিযোগ আনা হলেও এই কর্মকর্তা বলেন, হামলায় যারা আহত হয়েছে এদের কেউ গুলীবিদ্ধ নয়। দেশীয় দা-চুরি-কিরিছ হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া অভিযানকালে এযাবৎ কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এ থেকেই প্রমাণ হয়, এটি পূর্বপরিকল্পিত হামলা নয়। এটি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ।

এছাড়া ভুজপুরের গণবিস্ফোরণের একসপ্তাহ পর আ’লীগের আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, দলীয় কোন্দলের কারণেই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতে দেরি হয়েছে। হাই কমান্ডের কড়া নির্দেশের পরই প্রতিপক্ষ ফখরুল আনোয়ারকে সাংবাদিক সম্মেলনে দেখা গেছে বলে মনে করেন অনেকেই। এছাড়া যে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে সাংবাদিক সম্মেলনটি এলাকায় না করে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে করা হয়েছেও বলে অনেকেই জানান। এতে লিখিত বক্তব্যে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি আফতাব উদ্দিন বলনে, যুদ্ধাপরাধীদরে বাঁচানোর জন্য তালেবানি কায়দায় এ নগ্ন হামলা চালানো হয়। আওয়ামী লীগের শান্তির্পূণ মিছিলের ওপর হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত, একতরফা। বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে ১১ এপ্রিলের নৃশংস ও নারকীয় তা-বের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থের যোগানদাতা ও উস্কানিদাতাদের চিহ্নিত করে দেশবাসীর সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। এ তদন্তের মাধ্যমে ঐদিনের হামলার ঘটনায় প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বের হয়ে আসবে। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসন বলেনে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কারাবন্দী হলেও তার পরিবারের সদস্যরা এ তা-বের ঘটনায় অর্থের যোগান দিয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, গত সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই পেয়ারুল ইসলামের সাথে প্রতিপক্ষের দ্বন্ধ চরম আকার ধারণ করে। গত নির্বাচনে এই এলাকা থেকে বারবার সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী থাকা রফিকুল আনোয়ারকে বাদ দিয়ে পেয়ারুলকে প্রার্থী করায় এই দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তারা একসাথে কোনো কর্মসূচি পালন করতেন না বলে এলাকাবাসী জানান। কয়েক মাস আগে এই আসনের সাবেক এমপি প্রার্থী রফিকুল আনোয়ার মারা যান। এরপর তার হাল ধরেন ভাই ফখরুল আনোয়ার ও তার মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থী বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অবর্তমানে এই আসন থেকে এমপি প্রার্থী হতে দুই গ্রুপই মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে এদের মাঝে দলীয় কোন্দল অনেকটা প্রকাশ্য রূপ নেয়। যার ফলশ্রুতেই গত ১০ এপ্রিল বিশাল শোডাউন করে আগামী নির্বাচনের প্রার্থীতার কথা জানান দেয় ফখরুল আনোয়ার। তার পরের দিনই আরো বড় ধরনের শোডাউন করে নিজের আধিপত্যের কথা জানিয়ে দেয় পেয়ারুল ইসলামও। এতেই মানুষ আতঙ্কিত হয়ে তাদের হামলা চালায়।

গত ১১ এপ্রিল ঘটনার দিন দেশের প্রায় সব কটি মিডিয়ায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার কাজিরহাট এলাকায় গ্রামবাসী ও আওয়ামী লীগ, পুলিশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুইজন নিহত এবং গ্রামবাসী, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মচারীসহ শতাধিক লোকজন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সময় উত্তেজিত গ্রামবাসীরা প্রায় শতাধিক মোটরসাইকেল, চারটি মিনি ট্রাক, তিনটি প্রাইভেট কার, একটি মাইক্রোবাস, ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনার পরপরই বিকেল ৪টা থেকে ফটিকছড়ির ভূজপুর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। কেউই সেদিন বলেনি এটি বিএনপি বা জামায়াত ঘটিয়েছে। কিন্তু এটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই রাজনৈতিক রং দেয়া হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঘটনার দিন আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে একটি হরতালবিরোধী মিছিল শুরু হয়। এর আগেও এখানে হরতালবিরোধী মিছিল হয়েছিল। কিন্তু এমন শোডাউন হয়নি। এদিনে আজাদী বাজার থেকে। প্রায় দেড় হাজার মোটরসাইকেল ও বেশ কয়েকটি জিপ, ট্রাক, পিকআপ নিয়ে মিছিল বের করে। মিছিলটি নানুপুর, মাইজভা-ার শরীফ, নাজিরহাট, বিবিরহাট অতিক্রম করে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাজীরহাট বাজারে পৌঁছে দুপুর দেড়টার সময়। অনেকটা যুদ্ধাংদেহী পরিবেশ সৃষ্টি করে তারা। হঠাৎ করে সশস্ত্র অবস্থায় এতো মানুষের উপস্থিত স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা কাজিরহাট এলাকায় গিয়ে সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে বক্তারা দলীয় প্রতিপক্ষসহ স্থানীয় মাদরাসার ছাত্রদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার উত্তেজিত বক্তব্য প্রদান করতে থাকলে স্থানীয় লোকজন, গ্রামবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে গ্রামবাসীদের সাথে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময় অনেকেই স্থানীয় মসজিদ থেকে নামায শেষে বের হচ্ছিল। শোডাউনকারীরা এদেরকে মাদরাসার ছাত্র মনে করে হামলা চালালে এলাকার শত শত নারী-পুরুষ দা-ছোরা ও লাঠি নিয়ে হামলা শুরু করে। হামলায় মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আওয়ামী লীগের মিছিল। দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশও হামলার শিকার হয়। এ সময় পুলিশ গ্রামবাসীকে লক্ষ করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলীবর্ষণ করে। এ সময় উত্তেজিত লোকজন শতাধিক মোটরসাইকেল, চারটি মিনি ট্রাক, তিনটি প্রাইভেটকার, একটি মাইক্রোবাস, ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি পুড়িযে দেয়। এতে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী, গ্রামবাসী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের কর্মচারীসহ শতাধিক আহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এক্ষেত্রে দলীয় প্রতিপক্ষ গ্রুপও সুযোগ নিয়েছে।

গণবিস্ফোরণের পর পরই ফটিকছড়ির ভূজপুরে শুরু দমন-পীড়ন। মামলা হয় অজ্ঞাত ৫/৬ হাজারের বিরুদ্ধে। ঘটনার ১০ দিন পরও সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো গ্রাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চিরুনি অভিযানে কারা এ হামলার সাথে জড়িত তাদের চিহ্নিত না করেই চলছে গণগ্রেফতার। তবে গ্রেফতারকৃতরা অধিকাংশই বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থক। গত জুমার নামাযের সময়ও মসজিদগুলো ছিল প্রায় মুসল্লীশূন্য। যারা সেদিন এলাকায় ছিলেন না তারাও ভয়ে আসছে না।

এদিকে বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হামলা, মামলা এবং চাঁদাবাজির কারণে দেশের কোথাও না কোথাও এই সরকারের দলীয় লোকজন সাধারণ মানুষের প্রতরোধের মুখে পড়ছে। সাপ্তাহিক হলি ডে পত্রিকাও এটি শিরোনাম করেছে। তারা বলেছে, ফটিকছড়ির ঘটনা তারই অংশ হতে পারে। তারা বলেছে, বাংলাদেশের একাধিক জেলা এবং গ্রাম বা পল্লী এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ক্যাডার বাহিনীর সাথে বিরোধী দলীয় কর্মীবৃন্দ এবং এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হচ্ছে। সরকার সমর্থক ও ভিন্নমতাবলম্বী পত্রিকাতেও সেগুলো প্রচার হচ্ছে। তেমনি একটি পত্রিকা হলো ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’। পাকিস্তান আমল থেকে এ পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। সেই হলিডে পত্রিকাতে গত শুক্রবার ১৯ এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম হলো ‘সরকার পল্লী এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বিষয়টি ক্রমাগত পরিষ্কার হচ্ছে যে, গ্রামবাসীদের সামষ্টিক প্রতিরোধ থেকে এমনটি হচ্ছে। গ্রামবাসী প্রতিরোধ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। বানোয়াট অভিযোগে পুলিশ যখন গভীর রাতে গ্রামে-গঞ্জে আসামী ধরতে হানা দিচ্ছে তখন এই সম্মিলিত প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে বলেছে, দলীয় ও পুলিশের এই ধরনের হামলা জনগণের মাঝে কেমন পাল্টা সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে। এই ঘটনায় অনেকেই হতাহত হয়েছেন। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেক গাড়ি। এতে বলা হয়, জনতা ভূজপুর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসে এবং আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পিয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে আসা সরকারি ক্যাডারদের জিম্মি করে ফেলে। অথচ আওয়ামী লীগ নেতা পিয়ারুল ইসলাম একটি বিশাল বহিনী নিয়ে ঐ গ্রামে পুলিশের সাথে মিলে অভিযান চালিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে ভয় দেখানো। কারণ এলাকার প্রায় সব মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। হলিডের এই রিপোর্ট থেকেই বুঝা যাচ্ছে, এখানে হামলা সাথে বিএনপি বা জামায়াতের কেউ জড়িত নয়। এই শোডাউনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো। সেটি স্থানীয় জনগণকে হতে পারে। হতে পারে দলীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও শক্তির মহড়া প্রদর্শন করা।

দৈনিক ইত্তেফাকের খবরের বরাত দিয়ে হলিডের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, গ্রামগঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ লাঠি এবং বল্লম নিয়ে বের হয়। পুলিশ এবং আওয়ামী ক্যাডারদের সম্মিলিত বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য গ্রামে মহিলারাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, এই ঘটনার মাধ্যমে জনগণের প্রতিরোধ এবং শাসক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণার মাত্রাই প্রকাশিত হয়েছে। জনগণের এই দুঃসাহসিক প্রতিরোধ দেখে হানাদাররা দ্রুত পালিয়ে যায়। তাদের অনেকেই নিরাপত্তার জন্য নিকটবর্তী পুকুর অথবা কাদামাটির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে বাঁচার জন্য অপরিচিত বাড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু তাদেরকেও গৃহবাসীরা বেদম প্রহার করে। হলিডের ঐ রিপোর্ট মোতাবেক স্পষ্টই প্রমাণিত যে, উত্তেজিত জনতার গণপিটুনিতে সেদিন সরকারদলীয়রা হতাহত হয়েছিলেন।

দৈনিক ‘কালের কণ্ঠের’ বরাত দিয়ে হলিডের ঐ রিপোর্টে বলা হয়, মোটরসাইকেলের একটি বহর পুলিশের সাথে এই অভিযানে অংশ নেয়। মোটরসাইকেলের এই বহরে ছিল আবু তৈয়ব, আব্দুল কাইয়ুম, মহিউদ্দিন চুন্নু প্রমুখ ভয়ঙ্কর অপরাধী। আবু তৈয়বের বিরুদ্ধে ২৮টি ফৌজদারী মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো হত্যাকা-ের মামলা। আবু তৈয়বকে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার জামিনে মুক্তি দিয়েছে। আব্দুল কাইয়ূমের বিরুদ্ধেও হত্যাকা-সহ ডজন খানিক মামলা রয়েছে। তাকেও রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমা করে দেয়া হয়। এসব অপরাধী যেসব ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র সাথে নিয়ে অভিযানে যায় তার মধ্যে রয়েছে একে-৪৭, এম-১৬, জি-৩ রাইফেল। কিন্তু জনতার প্রতিরোধ ছিল এতই তীব্র যে তারা এসব ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র থেকে গুলীবর্ষণের সাহস পায়নি। হলিডের এই রিপোর্টের মতে বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় দৈনিক সরকারপন্থী। তারা এই ঘটনার জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের ওপর দোষারোপ করেছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে যে এই ফটিকছড়ি হলো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা। এখান থেকে তিনি বিগত নির্বাচনসহ বিগত পাঁচটি নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। স্থানীয়রা জানান, তিনি এখানে ব্যাপক জনপ্রিয়। এছাড়া এই সরকারের সন্ত্রাসের কারণে প্রতিটি ঘরে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এই গণবিস্ফোরণ কোনো দলীয় ব্যানারে হয়নি।

ফটিকছড়ি থেকে প্রকাশিত দৈনিক ফটিকছড়ির খবর পত্রিকায় বলা হয়, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়-সকাল দশটায় আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের ব্যানারে একটি হরতালবিরোধী মিছিল শুরু হয় আজাদী বাজার থেকে। প্রায় পাঁচশ’ মোটরসাইকেল ও কয়েকটি জিপ নিয়ে মিছিলটি নানুপুর, মাইজভা-ার শরীফ, নাজিরহাট, বিবিরহাট অতিক্রম করে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাজীরহাট বাজারে পৌঁছে দুপুর দেড়টার সময়। একটু অগ্রসর হতেই হেফাজতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় কাজীরহাট বড় মাদরাসার ছাত্ররা হামলা শুরু করে। ইতোমধ্যে মাদরাসা ও বাজার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, দক্ষিণ ফটিকছড়ির ছাত্রলীগ ক্যাডাররা মাদরাসা ও এলাকার মসজিদে হামলা করবে এবং ওই মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা জুনায়েদেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে মিছিলকারীরা। ঘোষণার সঙ্গে এলাকার শত শত নারী-পুরুষ দা-ছোরা ও লাঠি নিয়ে মিছিলকারীদের চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে। হামলায় মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আওয়ামী লীগের মিছিল। আওয়ামী লীগ নেতা হাসান সরওয়ার জানান, কাজীরহাট এলাকাটি হেফাজত অধ্যুষিত। কাজীরহাট বড় মাদরাসা উত্তর ফটিকছড়িতে হেফাজতের প্রধান ঘাঁটি। সে কারণে মাইকে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে স্থানীয় এলাকাবাসীও যোগ দেয়।

বিষয়: বিবিধ

১২৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File