বাংলাদেশের মধ্যে বিভিন্ন ইসলামী দল আর ইসলামিস্টদের ভিতরকার কথা
লিখেছেন লিখেছেন Proযুক্তি ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৪:৫২:৫৫ রাত
ইদানিং খুব বেশি মাতা মাতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক এক সংগঠনের ভিডিও বার্তা নিয়ে। যদিও ভিডিওটি অনেক আগের দেওয়া ঠিক এই সময় কেন এটি মিডিয়া হাইলাইট করল এটি ভাবনার বিষয়। অনেকে বলছেন সম্প্রতি ভারতের সাথে তেল গ্যাস নিয়ে বিতর্কিত চুক্তিটি আড়াল করার জন্য এনেছে যেন ঢাকা পরে যায় ব্যাপারটি। আল্লাহ্ ভাল জানেন।
আমার আজকের বিষয় এটি নয়, আমি যেটি লক্ষ করছি সাধারণ জনগন জামায়াত, আল কায়েদা, হেফাযত সহ সব ইসলামপন্থীদের একাকার করে মিলিয়ে ফেলেছে। যেন মনে হয় পার্থক্যই নেই এদের মাঝে। দীর্ঘ সময় ব্লগে থাকা আর বিভিন্ন ধরণের ইসলামী দলের ব্লগে লিখা, ফেসবুক,সাইট পড়ার অভিজ্ঞতাটা সবার মাঝে শেয়ার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি এখন। আমি একটি একটি করে যাব বিভিন্ন ইসলামী দল নিয়ে। এরপর বিভিন্ন দলের মধ্যকার সম্পর্ক কি আর কি ভাবে একদল অপর দল সম্পর্কে। মোট কথা একেবারে ভিতরকার খবর যা সাধারণের যাদের এই ব্যাপারে আগ্রহ কম জানার কথা নয়। আমার কিছু ভুল হয়তেই পারে। বিজ্ঞ পাঠকেরা কমেন্টে তা এডরেস করবেন আশা করি।
প্রথমেই আসি, হেফাযত নিয়ে। হেফাযত নতুন সংগঠন হলেও এর পিছনের ব্যাক্তিরা অনেক আগেরই। মূলত হাটহাজারী মাদ্রাসা আর কওমী মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকেরা এর সাথে জড়িত। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা মুলত এর আসল গোড়া। কাওমী মাদ্রাসা থেকে কেউ উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে ভারতের দেওবন্দে যান। সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীদের "নদভী" উপাধী দেওয়া হয়। অনেক বিখ্যাত আলেম এই দেওবন্দ থেকে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন সাইয়্যেদ আলী হাসান নাদভী (রহঃ ))।
দেশে এই মাদ্রাসা ভিত্তিক অনেক দল আছে। এর মধ্যে যেমন ইসলামী ঐক্যজোট (যা কয়েকটি ভাবে বিভক্ত), খতমে নবুওয়াত, তাবলীগ, হেফাযত। হ্যাঁ অবাক হওয়ার কিছু নেই তাবলীগ ও এই মাদ্রাসা ভিত্তিক একটি দাওয়াতী সংগঠন। দেওবন্দের আলেম মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ )) এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। গত ৫ই মের শাপলা চত্বরে তাবলীগরাও অংশগ্রহন করে। হেফাযত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নিজেদের মধ্যে অনেক দলে বিভক্ত হওয়া দল ঐক্যবদ্ধ হয়। এরাই হচ্ছে মুলত দেওবন্দী ভিত্তিক ইসলামী দল দেশে।
এর পর আসি জামায়াত নিয়ে। জামায়াত নিয়ে যে পাব্লিক পার্সেপ্টশন আছে তা নিয়ে এখানে বলবনা। শুধু এই সংগঠনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিব। তার্কির ওটমান খিলাফত পতনের পর ইসলামের খিলাফত পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৎকালীন বিশ্বে যে কয়েকটি সংগঠনের উদ্ভব হয়েছিল এর মধ্যে জামায়াত অন্যতম। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মাওদূদী (রহঃ )।, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় বিশ্বে তিনি দা'ইয়ী (যে দাওয়াত দেয়) হিসেবে সুপরিচিত আলেমের চেয়ে। সারা বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাই এর মুল লক্ষ্য। গনতান্ত্রিক ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা এই সংগঠনের পদ্ধতি। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে এদের আদর্শগত অনেক মিল আছে।
এখন আসি আহলে হাদীস আন্দোলন । একদেরকে অনেকেই সালাফী বলে। সলফে সালেহীন বলা হয় রাসূল (সঃ) এর পর তিনিটি জেনেরেশন অর্থাৎ সাহাবী, তাবেয়ী আর তবে-তাবেয়ীদের। এদেরকে যারা অনুসরন করে তারাই সালাফী। আধুনিক সময়ের এর মূল ভিত্তি করেছেন ইবনুল ওহহাব (রহঃ )। - তৎকালীন আরবে (ওটমানদের শাসন আমলে) মাযার পূজা ব্যাপক আকার ধারণ করে। ইবনুল ওহহাব (রহঃ ) প্রিন্স সৌদ এর সহায়তায় এই শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ইসলামের তাওহীদের উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং তিনি সক্ষম হন মাযার পূজা দূর করে আরবকে শিরক মুক্ত করতে। এই আন্দোলন মুসলিমদের মাযহাব ভিত্তিক অনুসরণের থেকে বের করে মুল কুরআন আর হাদীসকে অনুসরণের আহবান জানায় আর তাওহীদ ভিত্তিক জীবন যাপনের উৎসাহ দেয়।
সালাফীরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। তাদের মতে শাসক গোষ্ঠিকে নামিয়ে ফেলা ইসলাম সম্মত নয় বরং শাসকদেরকে উপদেশ দিতে হবে। গনতন্ত্রকে সাধারণভাবে হারাম বলেন তারা। তারাও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান কিন্তু তা দাওয়াতের মাধ্যমে। পিস টিভি আলোচক মতিউর রাহমান মাদানী এর উদাহরণ।
এই উপরের তিনটি দল আগে থেকেই দেশে ছিল। এখন আসি নতুন কিছু দল নিয়ে।
প্রথমেই আসি হিজবুত তাহরীর নিয়ে। এই দলটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের অফসুট তাকী উদ্দীন আন নাবাহানী(রহঃ ) এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। সারাবিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাও এই দলের লক্ষ্য। প্রচন্ড রকম গনতন্ত্রবিরোধী। বিপ্লব আর নুসরা (সাহায্য) এর মাধ্যমে এরা ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী নয় তারা।
এর পর হল জসিম উদ্দিন রহমানী এর দল। গতবছর গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। তার দলের কোন অফিসিয়াল নাম নেই। নিজেদের মুসলিম বলেই পরিচয় দেন। কিন্তু অনলাইন জগতে তারা 'জিহাদী' নামে পরিচিত। আল কায়দা, তালেবান সহ সশস্ত্র আন্দোলন তাদের আদর্শ। দেশে তার অনুসারীদের বিরাট অংশ সরকারী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক। তারা প্রচন্ডরকম একটিভ থাকে বিভিন্ন সোসাল মিডিয়াতে।
এ হল বিভিন্ন দলের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। বাংলাদেশে ইসলামিস্টরা নিজেদের মধ্যে কিছু আদর্শিক দ্বন্দে লিপ্ত। এখন এই দল একে অপরকে কিভাবে দেখে বা এদের মধ্যে সম্পর্ক কি একটু দেখি।
হেজাযত তথা দেওবন্দীদের সাথে জামায়াতের দ্বন্দের সুচনা দ্বি-জাতি তত্ত্ব নিয়ে। অখন্ড ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে আলাদা দেশ হবে এই হচ্ছে এই তত্ত্বের মুল কথা। মুসলিম লীগ এই তত্ত্বের পক্ষে ছিল আর কংগ্রেস ছিল এর বিপক্ষে। আর দেওবন্দীরা ছিল কংগ্রেসের পক্ষে এই ইস্যুতে। আর মাওলানা মওদূদী ছিল উভয়ের বিপক্ষে। তিনি বলেছিলেন মুসলিম লীগ ধোকা দিচ্ছে কারণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে যে ইসলামী দেশের কথা বলা হচ্ছে তা মোটেও ইসলামী দেশ হবে না কারণ এই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যারা আছে তারা কেউ নিজের জীবনে ইসলাম প্রেক্টিস করে না। আর কংগ্রেসের বিপক্ষ নিয়েছেন এই কারণে যে মুসলিমরা এই অখন্ডভারতের অধীনে থাকলে আরও নির্যাতিত হবে। তাই তিনি দেওবন্দী আলেমদের সমালোচনা করেন। এখান থেকেই মুলত জামায়াত আর দেওবন্দীদের মধ্যে বিবাদের সুত্রাপাত। দেওবন্দ থেকে ফাতয়ার পর ফাতয়া আসতে থাকে মাওলানা মওদূদীর বিপক্ষে। তার বই সমুহের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়। এই নিয়ে উভয় পক্ষের তাত্ত্বিক লড়াই চলতেই থাকে।
দেশের ইসলামিস্টদের মধ্যে মতপার্থক্যের আরেকটি বড় একটি ইস্যু হল গনতন্ত্র। হিজবুত তাহরীর, সালাফী, জিহাদী এরা হল গনতন্ত্র বিরোধী। জামায়াত,হেফাযত এরা গনতন্ত্র পন্থী। দেশের সাধারণ কেউ যখন হিজবুত তাহরীর, সালাফী বা জিহাদী তে অংশগ্রহন করে যখন জামায়াত কে সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করে।আগে জামায়াত সম্পর্কে যুদ্ধপরাধের ইস্যুটি গৌণ হয়ে যায় আর মুখ্য হয়ে যায় তাদের গনতন্ত্রের ইস্যুটি। তখন জামায়াত বিরোধীর মুল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এই গনতন্ত্র।
সালাফী, জিহাদী আর জামায়াত এর মধ্যে আকীদাগত মতপার্থক্য কম। এদের সাথে হেফাযতের সুক্ষ আকীদাগত মতপার্থক্য আছে। দেওবন্দী আলেমদেরকে সালাফীরা 'ওহতাতুল উজুদ' নামক এক আকীদায় দোষী সাব্যস্ত করে। সংক্ষেপে এই আকীদার মুল কথা হল আল্লাহ সব জায়গায় আছেন এই তত্ত্বে বিশ্বাস করা। সালাফীরা আরো দাবী করে দেওবন্দীরা মাযহাব গত ভাবে হানাফী আর আকীদায় তারা মাতুরিদিবিশ্বাসী।
আকীদার দিক থেকে সালাফী আর জিহাদী একদম কাছাকাছি কিন্তু এদের মধ্যে মুল মতপার্থক্য হল জিহাদের ইস্যুটা। সালাফীরা বলে জিহাদ ডাকার জন্য একটা রাষ্ট্র দরকার আর জিহাদ একজন রাষ্ট্রের প্রধানই ডাকতে পারে। এই মতের সাথে ব্যাপক দ্বিমত পোষন করে জিহাদীরা। আর সালাফীরা জিহাদীদের খারেজী বলে থাকে।
আজকে এতটুকুই থাক। বিভিন্ন দল সম্পর্কে জানার স্টার্টিং পয়েন্ট হতে পারে এই লিখা। মুল ব্যাপারটি হল দেশের ইসলামিস্টদের এককাতারে ফেলার কোন সুযোগ নেই।
বিষয়: বিবিধ
৩২২৩ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চুক চুক
এটা 'আল কায়েদার' কাম নয়
এটা হল 'বাল কায়েদার' (BAL) কাম।
ভালো লাগলো আপনাকে ধ
ন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন