শহিদ স্ত্রীর চোখে হামাস কমান্ডার
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:৪২:৫৫ দুপুর
‘ইসরাইলিরা তোমার তৎপরতা দেখত, তোমার চেহারা দেখত না। আর এটাই তাদের পাগল করে তুলেছিল। তোমাকে হত্যা করার তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পুরো জাতি তোমার ছায়া দেখতে আগ্রহী। আমার নায়ক, এমনকি সুদূরে থাকলেও কেবল আমিই জানি তোমার চোখের রঙ কী, তোমার চেহারার গড়ন কেমন, কতটুকু লম্বা তুমি, চায়ে কতটুকু চিনি মেশাও, আর তোমার টুথব্রাশটা কেমন।’
এই চিঠিটা লেখা হয়েছিল উইদিদ আসফুরার চোখে। লিখেছিলেন তার স্বামী হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ আল-দেইফকে উদ্দেশ করে। গাজায় সর্বশেষ যুদ্ধে ইসরাইলি বাহিনী আল-দেইফকে হত্যার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল। তাতেই আসফুরা আর তাদের ছেলে আলী নিহত হয়েছেন। চিঠিটা আসফুরা লিখেননি। তবে তিনি এমনটাই ভাবতেন। তার ভাবনাটাই কলমের আঁচড়ে তুলে ধরেছেন হাদিল আত্তালাহ।
আসফুরার মা আম ইব্রাহিম ও তার বোন ইমান আসফুরা উইদিদ আসফুরার চোখের সে ভাষা বর্ণনা করেছিলেন তার কাছে। আরবি সংবাদপত্র ফেলেস্টিন-এ তা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে মিডলইস্ট মনিটর।
মোহাম্মদ আল-দেইফ সত্যিকার অর্থেই ইসরাইলিদের মধ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বেই গাজায় ফিলিস্তিনিরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাতে করে বিশ্বে সেরা সেনাবাহিনী হিসেবে পরিচিত ইসরাইলিরা কুপোকাত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে যেখানে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে তিনটি আরব সেনাবাহিনীকে কচুকাটা করে জেরুসালেমসহ বিশাল আরব ভুখণ্ড দখল করেছিল ইসরাইল, সেখানে এবার দীর্ঘ ৫১ দিন সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করেও গাজার মতো সামান্য একটি স্থানে হামাসকে তারা হারাতে পারেনি। হামাসের শর্ত মেনে গাজা থেকে তাদের সরে যেতে হয়েছে। মোহাম্মদ আল-দেইফের করা সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের ধাঁধা আর রকেটের রহস্য তারা ভেদ করতে পারেনি। এই প্রথমবারের মতো হামাস যুদ্ধকে ইসরাইলের ভেতরে নিয়ে যেতে পেরেছে। রকেট হামলার মুখে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত তেলআবিবের প্রধান বিমানবন্দর বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
সেই মোহাম্মদ আল-দেইফের কথাই বলেছেন তার স্ত্রী। তিনি জানান, ‘আজ তোমার নামের সাথে আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তোমার সাথে আমি যতটুকু সময় ছিলাম, সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের।’
আসফুরা জানান, ‘শেষবার তুমি যখন আমার পাশে সামান্য সময়ের জন্য বসেছিল, তখন তোমার গায়ে ছিল সামরিক ইউনিফর্ম। তোমার ইউনিফর্মে তোমাকে আরো হ্যান্ডসাম লাগছিল, সাদা শার্ট আর লাল টাই পরলে তোমাকে সুদর্শন রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব মনে হয়। কিন্তু এবার তোমাকে এর চেয়েও বেশি সুন্দর মনে হচ্ছিল।’
এবার আসফুরার কথা তার মুখ থেকেই শোনা যাক-
আমার মা-ই ঘটক
আমরা ছিলাম চার বোন। বোনদের মধ্যে ইমানই ছিল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। ও ছিল আমার চেয়ে এক বছরের বড়। আর আমার ভাই ইব্রাহিমের ধর্মীয় জীবনযাপনে মুগ্ধ ছিলাম আমি। আমার মায়ের মুখটি সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমি কেবল কাসাম ব্রিগেডের সৈন্যের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’ আমার মা আমাকে অন্য বোনদের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। আমি পবিত্র কোরআন হেফজ করতে অত্যন্ত মনোযোগী ছিলাম। ছিলাম সবচেয়ে সহিষ্ণু, সবচেয়ে আগ্রহী।
আমার মা যখন মোহাম্মদ আল-দেইফের সাথে আমার বিয়ের কথা বললেন, তখন মাকে আমি আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসলাম। ছয় বছর আগে একদল নারীর সাথে বসে গল্প করছিলাম। তাদের কেউ একজন বলছিল যে এই লোকটির (মোহাম্মদ আল-দেইফ) সন্তান নেই। কিন্তু তবুও সে দ্বিতীয় বিয়ে করতে নারাজ। তবে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানায়, সে সন্তানের অভাব অনুভব করে ভীষণভাবে। তখন আমার মা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন, ‘ও যদি আমার মেয়ের পাণি প্রার্থনা করে, আমি রাজি হব। এটা হবে আমার জন্য সম্মানের।’ তিনি আমাকে লক্ষ করেই কথাটি বলেছিলেন। ঠিক পর দিনই মোহাম্মদ আল-দেইফ আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালেন।
আমার মা সবসময় প্রচলিত একটি কথা বলতেন, বিয়ে করলে আসল মানুষটিকে বিয়ে কর, যত চ্যালেঞ্জই থাকুক না কেন।
দুঃখ আর সংগ্রাম
আমার মন-প্রাণজুড়ে ছিল আল-কাসেম গ্রুপের দুই সদস্য। যেসব নারী স্বাভাবিক বা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত তারা বুঝবে না, কেমন ছিল আমার হৃদয়। এই হৃদ-মাজারের প্রথম ধমনীটির নাম ‘বিলাল কাসিয়া’। ১৬ বছর বয়সী এক মেয়ের প্রথম ভালোবাসার নাম। তার সাথে মেয়েটি তিন তিনটি বছর আনন্দময় সময় কাটিয়েছে।
বিলালের কোমলতা ঝর্ণাধারার মতো আমার হৃদয়-মন আপ্লুত করেছে। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ও আমাকে আর আমার সন্তান- বাকের ও বানানকে মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিল। একটা নতুন ওয়্যারড্রোব কিনল।
তার মৃত্যুর পর তিনটি বছর কেটেছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। আমাকে নিয়ে আমার পরিবার চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। আমি যে এর চেয়েও ভালো জীবন পাব- তা ভাবতেও পারছিলাম না। আমার জীবনে এলেন আল-দেইফ।
তুমি এতিমসহ এক বিধবা চেয়েছিলে। আর আমার একমাত্র অনুরোধ ছিল আমার একমাত্র অবশিষ্ট সন্তান আবু খালেদকে নিয়ে। আর তাই আমরা একমত হতে পেরেছিলাম। বলতে দ্বিধা নেই, তোমাকে বিয়ে করার আগে আমাকে নিজের সাথেই সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আমার ভয় হয়েছিল, তোমাকে বিয়ে করা হয়তো বিলালের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আমার এমন ভয়ও হতো, আমি আবার ট্র্যাজিডির শিকার হব, আমার নতুন সন্তানও আবার বাবা-হারা হবে। এমন শঙ্কাও জাগত, হয়তো আমিই শহিদ হব, আর তাতে বাচ্চারা মা-হারা হয়ে পড়বে। তারপর স্বপ্নে দেখা দিল বিলাল। ও-ই আমাকে বিয়ে করতে বলল।
আমার উপহার
ইসরাইলিরা তোমার তৎপরতা দেখত, তোমার চেহারা দেখত না। আর এটাই তাদের পাগল করে তুলেছিল। তোমাকে হত্যা করার তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পুরো জাতি তোমার ছায়া দেখতে আগ্রহী। আমার নায়ক, এমনকি সুদূরে থাকলেও কেবল আমিই জানি তোমার চোখের রঙ কী, তোমার চেহারার গড়ন কেমন, কতটুকু লম্বা তুমি, চায়ে কতটুকু চিনি মেশাও, আর তোমার টুথব্রাশটা কেমন। তোমার গোপন অভ্যাসগুলো যারা জানত, আমি তাদের একজন। আল্লাহই তোমার মতো কিংবদন্তির উপযোগী করে আমাকে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকেই জানত, আমি কৌতূহল প্রকাশ থেকে কতটা বিরত থাকতে পারি, নিজের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কতটা আত্মসংযমী।
আমাদের ‘ভালোবাসার কুঠির’ বিশেষ কোনো স্থানে ছিল না। আমাদের ঠিকানা নানা প্রতিবন্ধকতার ঘেরা থাকত। খুব সামান্য কয়েকজন ছাড়া কেউ জানতো না যে আমি ছিলাম মোস্ট ওয়ান্টেড মানুষটির স্ত্রী। খবরটা যখন চাউর হলো, আমরা স্বজনরা আমার মা-বাবাকে বকাঝকা করে বলেছিলেন, ‘তুমি কি এই বিয়ের দলিলে সই করে তোমার মেয়ের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করনি?’
আমাদের কাহিনী ছিল অন্য যেকোনো বীরের মতোই। আমরা কখনো হেঁটে বেড়াতে পারতাম নাম, স্বজনদের বাসায় যেতে পারতাম না। এমনকি ফোনালাপও করতে পারতাম না। এমনকি সাগরও কখনো আমাদের দেখেনি। বালুর বিচে আমরা হাত ধরে একবারও হাঁটতে পারিনি।
আমি যা ভাবতাম তা হলো কিভাবে তোমাকে সর্বোচ্চ খুশি রাখা যায়। আমি জানতাম, তুমি দেশী খাবার ভালোবাস। তোমার মা আমার সম্পর্কে যে প্রশংসা করতেন, তা আমার কানে সবসময় বাজে।
বিয়ের প্রথম দিকে তুমি আমাকে যা বলেছিলে, আমার এখনো মনে আছে : ‘উইদিদ তোমার সাথে আমার দিন হয়তো শেষ হয়ে আসছে। কিংবা আল্লাহ আমাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখবেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (মহানবি সা.-এর সাহাবা ও মহাবীর) শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু মারা গেছেন বিছানায়। তবে আমার ইচ্ছা শহিদি মৃত্যু।’
বিয়ের প্রথম দিনেই আমার জীবন বদলে গিয়েছিল। আমি ছিলাম নাইটিঙ্গেলের মতো। আমাদের মধ্যকার বয়সের পার্থক্য অনুভব না করেই আমি জীবনের গান গাইতাম। তুমি যখন বিশেষ কোনো স্থানে যাওয়ার বার্তা পাঠাতে, আমি তখন মনে হতো ভেসে যাচ্ছি। আমার জন্য উপহার অপেক্ষা করত। তুমি ছিলে সেরা উপহার। তুমি কখনো আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করনি। তুমি যদি কিছু পছন্দ না করতে, তবে অত্যন্ত প্রিয় কোনো পন্থায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। একজন নিপাট ভদ্রলোকের প্রতিকৃতি ছিলে তুমি।
প্রথমবার তারা দেখল
প্রত্যেকেই এই কাহিনীর ‘শেষ অধ্যায়টি’ জানতে আগ্রহী। যুদ্ধ যখন শুরু হলো, তখন আমরা কঠিন অবস্থায় পড়লাম।
আমার সবচেয়ে ছোট মেয়ে বাইয়ান ছিল তার দাদা-দাদির বাড়িতে। তার অন্য ভাই বাকের ও বোন বানানও ছিল সেখানে। প্রথম যুদ্ধবিরতির সময় আমার কাছে খবর এলো যে বাইয়ান কান্না করছে। তারা যখন তার কান্না কারণ জানতে চাইল, সে বলল, ‘বিমানগুলো যখন বোমা ফেলছিল, তখন আমার ভয় হচ্ছিল, বাবার মতো মা-ও হয়তো মারা যাবে।’ আমি তার কাছে ছুটে গেলাম। আমি নতুন সবুজ হিজাব পরেছিলাম। হয়তো শহিদি পোশাকই ছিল সেটা।
আমি শেষ যুদ্ধবিরতির সময় বাচ্চাদের বেশ মিস করছিলাম। আমি তাদের বলেছিলাম, ইনশাল্লাহ, ‘কাল’ তোমাদের দেখতে আসব। যুদ্ধবিরতির খবর পেয়েই ওমনটা বলেছিলাম। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলাম। কিন্তু দখলদারেরা ওয়াদার বরখেলাপ করেছিল। তারা তাদের টার্গেটে থাকা একজনকে হত্যা করতে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছিল।
চোখের পানি দিয়ে রাইফেলের ট্রিগার মোছ
ইমান, আমি জানি যে গাজার আল-দালো পরিবারের বাড়িটি হামলার শিকার হয়েছে, এমনটা শোনা তোমার জন্য কত কঠিন। তুমি জান, ওমর তার পরিচিত একজনকে খুঁজছে। কিন্তু নিরাপত্তাগত কারণে তুমি কাউকে ফোন করেও নিশ্চিত হতে পারছিলে না। তুমি মিডিয়ায় খবর প্রচারের অপেক্ষায় ছিলে।
ইমান, আমি জানি তোমার জন্য এটা দেখা কঠিন যে হালিমা মিষ্টি ফল আর বেলুন জমাচ্ছে ‘বেহেশত’ বানাতে, যে বেহেশতে তার মা গিয়েছিল। বাকের আর তার ভাইবোনদের আমি যে আর তাদের সাথে নেই- কথাটা বলা তোমার জন্য ছিল আরো কঠিন। কিন্তু তোমার চোখের পানি দেখে তারা ঠিকই বুঝে নিয়েছিল। আমি জানি বানানের মতো কোনো শিশুর জন্য আমার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহ, আমার মা-বাবাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান কর’ বলাটা কত কঠিন।
বিমানগুলো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের মুহূর্তকাল পরে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম। আমি কফি পান করতে করতে বাচ্চাদের সাথে কথা বলছিলাম, খুনসুটি করছিলাম। ওমর দৌড়ে হালিমার কাছে গেল, কিন্তু আলী, সারা আর আমার ভাগ্যের ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল।
আল-দেইফ, আমি তোমার নিষ্পাপ চোখের পানি দেখছি। আমাদের অতীত আর ঘনিষ্ঠ সময়গুলোর কথা মনে করে তোমার কপোল বেয়ে টপটপ করে ঝরছিল। তুমি নীরব ছিলে। কেবল আল্লাহই জানেন, তুমি কী বলতে চাইছিলে। কাঁদো, আল-দেইফ, কাঁদো। কান্না চেপে রেখো না। তোমার চোখের পানি দিয়ে তোমার রাইফেলের ট্রিগার মোছ। গণহত্যার কান্নায় কাউকে দুর্বল করে না, তাদের আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে, তাদের ভেতরের সুপ্ত আগুন আরো উস্কে দেয়। বিষাদ অনুভব কর। তবে খুব বেশি দিন বিষণ্ণ থেক না। আগস্ট মাসকে দোষ দিও না। যদিও এই মাসেই তাদের ক্ষেপণাস্ত্র তোমার চোখে মনি উইদিদ আর তোমার সন্তান আলী আর সারাকে কেড়ে নিয়েছে। অন্তত তুমি তো জান, আমি আগস্ট মাসকে ভালোবাসি। কারণ এই মাসেই তোমার মতো সম্মানিত মানুষের জন্ম হয়েছে ঈমানদারদের নেতৃত্ব দিতে।
http://www.dailynayadiganta.com/details.php?nayadiganta=Njc5ODg%3D&s=MjM%3D
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৩ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন