চির উন্নত মম শিরঃ আগষ্ট বিপ্লব প্রসঙ্গ

লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ১১ আগস্ট, ২০১৪, ১০:১২:৫৪ সকাল



এমন একটি সেনাবাহিনী কল্পনা করুন, যারা সদ্য একটি যুদ্ধ শেষ করে ব্যারাকে ফিরেছে । তাদের ফায়ার আর্মস বা মিলিটারী টেকনোলজি বেশ প্রাচীন আমলের । কিন্তু সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার মতো জ্ঞান, সাহস এবং দৃঢ়তা তাদের আছে । আবার কল্পনা করুন এমন একটি সেনাবাহিনী যারা জীবনে কখনো যুদ্ধই দেখেনি । প্রতিসপ্তাহে কমপক্ষে তিনটা করে পার্টিতে অ্যাটেন্ড করে, আনুষ্ঠানিকতায় দেশের মধ্যে শীর্ষে তাদের অবস্থান, সবার কাছে স্যার-স্যার শুনতে থাকে প্রতিনিয়ত । অবশ্য তাদের প্রশিক্ষণ আছে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার বিষয়ে । আপনাকে যদি বলা হয় দুটি সেনাবাহিনীর মধ্যে দায়িত্বশীলতার তুলনা করতে, আপনি অবশ্যই প্রথম দলকে এগিয়ে রাখবেন যদি সত্যিকার অর্থে সেনাবাহিনীর মূল্যায়ন করার মতো শিক্ষা আপনার থাকে ।

১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে কারো অজানা নয় । এ বিষয়ে যথেষ্ট ইতিহাস লেখালেখি হয়েছে, কলাম পড়া হয়েছে, ডকুমেন্টারি দেখা হয়েছে, ফেসবুকে নোট/স্ট্যাটাস পড়া হয়েছে । আমিও এটা নিয়ে লিখতে যাচ্ছি না । এতোবড় ঘটনার নিখুঁত বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা যেমন আমার নেই, তেমনি সস্তা মকারি করে রম্য লেখারও উদ্দেশ্য নেই । বরং আমি এখনো আগস্ট বিপ্লবের প্রকৃত তাৎপর্য এবং সাফল্যের শিক্ষণীয় দিকটি শিখতে চেষ্টা করি । যতোবার আগস্টের গল্প শুনি বা আগস্ট মাসে শোক প্রকাশের কালো পতাকা দেখি, আমার মনে একটা অদ্ভুত রকমের ডিলেমা তৈরি হয় । সেটা শেয়ার করাই এবারের নোট লেখার মূল প্রেরণা ।



বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরণের অচলাবস্থা চলছে এটা সত্য । সম্ভবত ৭৫ সালেও প্রায় একই অচলাবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছিলো । যেহেতু বাংলাদেশের কোন নিরপেক্ষ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি, আমরা কোন এক বা একাধিক লেখকের বই পড়ে বা কয়েকটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখে অথবা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সত্যিকার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হবো- এটা ভাবাই বাতুলতা । তাহলে আমরা যারা এই প্রজন্মে বড় হয়েছি, তাদের সামনে একটিমাত্র পথ খোলা থাকে । সেটা হলো নিজেদের স্বশিক্ষিত বিচারবোধ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের প্রিম্যাচিউর বার্থ থেকে শুরু করে ৭৫ সালের দিনগুলো পর্যন্ত বুঝে বুঝে ১৫ আগস্টের মূল্যায়ন করা । আপাতত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সময় নষ্ট না করে প্রথমেই দেখে নেয়া যাক আগস্ট বিপ্লবের চারটি লক্ষ্য মূলত কি ছিলোঃ

১। রুশ-ভারতের নাগপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা ।

২। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ।

৩। ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ নামে বাকশাল ও মুজিব সরকারের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা ।

৪। কৌশলগত কারণে স্বল্প সময়ের জন্য সংসদকে বলবৎ রেখে সাংবিধানিকভাবে একটি দেশপ্রেমিক (সর্বদলীয়/র্নিদলীয়) অস্থায়ী সরকার গঠন করা ।

চলুন দেখে নিই অস্থায়ী সরকারের কাজগুলো কেমন হবার কথা ছিলোঃ



১। বাকশাল প্রণোদিত শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা আইন, রক্ষীবাহিনী আইন, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আইনের পরিপন্থী শ্রমিক আইন ও অন্যান্য কালা-কানুন বাতিল করা ।

২। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে দেশে অবিলম্বে প্রকাশ্য রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ।

৩। সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া ।

৪। সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা ।

৫। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলা করার জন্য 'জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ' গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলা ।

৬। সমাজতন্ত্রের নামে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ, স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্ব ও সরকারি সহযোগিতায় জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, চোরাচালান ও অবাধ দুর্নীতির ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটিয়ে বিপর্যস্ত দেউলিয়া অর্থনীতির পূর্ণবিন্যাসের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ।

৭। জাতীয় জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিচার বিভাগের পুর্ণ স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন করা ।

৮। প্রশাসন কাঠামোকে দুর্নীতিমুক্ত করা ।

৯। রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহে বাংলাদেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জীবনাদর্শের প্রতিফলন নিশ্চিত করার সাথে সাথে সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা ।

১০। ভারতের সাথে পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা ।

আরেকবার এক থেকে দশ পর্যন্ত পড়ে দেখুন । বর্তমানকালের সাথে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার এই নির্দেশিকায় কি খুব একটা পার্থক্য ধরা পড়ছে ? বর্তমান আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে যেসকল শক্তি আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, তারা কি ঠিক একই অভিযোগ এবং অভিপ্রায় প্রদর্শন করছে না ? তাহলে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পার করে আগষ্ট বিপ্লবের ফায়দা কি দাঁড়ালো ! তখনকার আওয়ামী গডফাদার গাজী গোলাম মোস্তফা যেভাবে লেডিস ক্লাব থেকে মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রী নিম্মীকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করতে পারতো, এখনকার জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমানরা কি এমন দুঃসাহস দেখাচ্ছেনা ? ১৯৭৩ সালে যেভাবে শেখ কামাল পুলিশের গুলি খেয়েছিলো ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে, এখনকার ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করার জন্য কি একই গ্রুপ কাজ করছেনা ? তাহলে বিপ্লব কিভাবে বলি ১৫ আগস্ট কে ! এটাই আমার কাছে প্যারাডক্স ।

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা প্রথমেই যে ভুলটা করি তা হলো- এটাকে নিছক একটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হিসেবে চিন্তা করি । যা সম্পূর্ণরুপে একটা সিভিলিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি । অথচ সম্পূর্ণ সামরিক সিদ্ধান্তে, সেনাকর্মকর্তাদের দ্বারা এই ফেইট আকমপ্লি সংঘটিত হয়েছে । আমরা আওয়ামী বিরোধী মহল কথায় কথায় শেখ মুজিবকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করি- যেনো হত্যাকান্ডের পক্ষে একটা ধর্মীয় আবহ তৈরী হয় । তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যারা মুজিব হত্যার পর রাতারাতি চেহারা পাল্টে জানরক্ষায় নিয়োজিত হয়েছিলো- তাদের কর্মকান্ডকে বার্ডেন অব প্রুফ ধরে আমরা ১৫ আগস্টের আলোচনা করি । একারণে বিষয়টির গভীরে আমরা যেতে পারিনা এবং প্রতিবছর শোক দিবসের একপেশে বিরোধিতা করতে থাকি ।

আরেকটি সমস্যা হলো দেশের অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীকে দেবজ্ঞান করে এড়িয়ে চলা । একারণে টকশোতে যেমন বুদ্ধিজীবিরা সেনাসদর/আইএসপিআর নিয়ে কোন সমালোচনা করতে বিব্রতবোধ করেন, আমজনতাও সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডকে স্বর্গীয় নজরে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলস্বরুপ সেনাবাহিনী একটা পুতুল নাচের মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । তারা রাজনীতির মাঠে নিষ্কৃয়তার প্রমাণ দিতে গিয়ে বিদেশী আগ্রাসনের মুখেও মুখ খুলতে পারেনা । ভারতের সেনাপ্রধান দলবীর সিং যতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাকিস্তানী সেনাপ্রধান রাহিল শরীফ কে হুমকি দিতে পারেন, ইরানী কমান্ডো চীফ কাসেম সোলায়মানি যেভাবে প্রকাশ্যে গাজা হত্যাকান্ডের জন্য ইসরাঈলের নিন্দা জানাতে পারেন, বাংলাদেশী সেনাপ্রধান ততোটা জোর গলায় নিজদেশের পাহাড়ি জঙ্গিগোষ্ঠি জেএসএস বা ইউপিডিএফ কেও ধমক পর্যন্ত দিতে পারেন না । বিজিপি বা বিএসএফের বিরুদ্ধে মুখ খোলা তো অলীক কল্পনা !

অথচ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিলো অনেক বেশি স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ । মানুষের হৃদয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি একটা গভীর সহানুভূতি কাজ করতো । তাদের সাহসিকতা এবং প্রতিশোধ পরায়নতার ওপর মানুষ এতোটাই আস্থা রাখতো যে, রক্ষীবাহিনীর সমস্ত অপরাধের খবারখবর সাধারণ মানুষ নিজ থেকেই সেনাবাহিনীকে অবহিত করতো । কোন সেনাকর্মকর্তার সাথে বা সেনা পরিবারের সাথে সংঘটিত অপরাধের জন্য স্বয়ং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে ক্ষমা চাইতে হতো । আর এযুগে পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন বলে কখনো শুনিনি । আমাদের যুগে এমনও ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কথা শোনা যায় যিনি তার মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন । শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের লম্পট শিক্ষক যখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বসে ছাত্রীদের পর্ণো ভিডিও বের করে তখনো পুলিশের আশায় বসে থাকা ছাড়া সেনাবাহিনীর করার কিছু থাকেনা । অপরদিকে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাড়াটে খুনী হওয়ার বিষয়টি না হয় এড়িয়েই গেলাম । অথচ যে সেনাবাহিনী আগস্ট বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নেবার মতো দৃঢ়তা এবং সাহস দেখিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে তাদের এমন অসহায়ত্ব শুধুুমাত্র শোক দিবসকে তাচ্ছিল্য করেই বোঝা সম্ভব নয় ।

আমাদের দেশে যখনই সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা সম্পৃক্তি নিয়ে কথা হয়, বড় বড় দলগুলো সবসময় এটিকে টালবাহানা করে এড়িয়ে যায় । ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, রাজনৈতিক নেতারা যতোবার ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, ততোই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্ররাজনীতি জেঁকে বসেছে । দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য যতোবার ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠান গুলোকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার বুলি সম্প্রচার হয়েছে, ততোই যেনো ব্যাবসা-বাণিজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরন তীব্রতর হয়েছে । তেমনিভাবে সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যতোই মধুর বাণী বর্ষন করা হোক না কেনো, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক কাঠামোর উত্থান-পতনে (একাত্তর থেকে এক-এগারো পর্যন্ত) সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা । এমনকি পিলখানা হত্যাকান্ডের পর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাকুঞ্জে গেলেন স্বান্তনা সভায়, তখনো সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক মেরুকরণের ভয়াবহতা উঠে এসেছে । অথচ সম্পূর্ণ বিষয়টিকে স্পর্শকাতরতার চাদর পড়িয়ে বদহজম বাড়ানোর নীতি কোন পক্ষই ছাড়তে পারেনি ।

মোটাদাগে যদি আগষ্ট বিপ্লবের দুটি পক্ষ ধরা হয়, একটি হবে আওয়ামী লীগ- যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দ্বারা সর্বদা নিয়ন্ত্রিত, আরেকটি হবে সেনাবাহিনী- যাদের প্রতি মানুষ বরাবরই বিশ্বাস রাখতে পছন্দ করে । বর্তমানে দুটি পক্ষের কার্যক্রম তুলনা করলেই বিগত চল্লিশ বছরে আগষ্ট বিপ্লবের সাফল্য/ব্যর্থতা বোঝা সহজ হয়ে যায় । এক মুজিবের লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে তৈরি না হলেও প্রতিটি পাড়ায়/মহল্লায় অন্তত একটি করে মুজিবের অনুসারী গডফাদার তৈরি হয়ে গিয়েছে এতোদিনে । মানুষজন বিপদে পড়লে যেমন তাদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়, ইফতার মাহফিলে যেমন তাদেরকে প্রধান অতিথি রাখতে হয়, মসজিদ কমিটিতে পর্যন্ত তাদের আইনে মানুষ চলে । শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলেই দায় এড়াবেন কিভাবে ! দেশের রাষ্ট্রপতি কে বিদায় করেও আগষ্ট বিপ্লবের নায়কেরা দেশের একনায়কতান্ত্রিক অনাচার এবং ভারতমাতার দাসত্ব রুখতে পারেনি । এদিক থেকে দেখলে সহজেই বোঝা যায়- রাষ্ট্রপতি মুজিব শেষপর্যন্ত মরণোত্তর বিজয়ী হয়েছেন । আমরা যতোই ভাঁড়ামো/চটুলতার আশ্রয় নিই, বাস্তবতা এড়াতে পারবোনা । অপরদিকে সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখুন । জেনারেল জিয়ার মতো এমন সেনাপ্রধান আর পায়নি বাংলাদেশ । আ ল ম ফজলুর রহমানের মতো বিডিআর প্রধানও পায়নি । সেনাবাহিনীর মান নিয়েও তৈরি হয়েছে যথেষ্ট প্রশ্ন । রেশমা নাটকের হোতা সারওয়ার্দিরা উঠে যায় আকাশে । আব্দুল্লাহ আযমীদের বরখাস্ত হতে হয় অযথা । গুলজারদের মৃত্যু হয় প্রতিশোধবিহীন । একটা উদাহরণ দেই- দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যদি সার্ভে করা হয়, ক্লোজ আপ ওয়ান তারকা এবং লাক্স সুপার স্টারদের মাস কিভাবে চলে, দেখা যাবে প্রতিদিন ক্যান্টনমেন্টগুলোতে কোন না কোন উপলক্ষে গানের কনসার্ট চলছেই, দেশের প্রায় সবগুলো এলিট ক্লাবে সেনাকর্মকর্তা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা চালানো হয়, ইসরাঈলী আইডিএফ কেও এতোটা আনন্দঘন পরিবেশে রাখা হয় কিনা জানিনা । শেখ হাসিনার দলীয় অনুষ্ঠানেও অনেক সময় বাহিনী প্রধানদের হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । ডিওএইচএস এর মালিকানা নিয়ে দরদাম চলছেই, বৈষয়িক হিসাব নিকাশে ভীষণ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে ডিফেন্স ফোর্স । তাহলে সেভেনটি ফাইভ এর সেনাবাহিনী আজকের যুগে কিভাবে আশা করেন ! 'তৃতীয় শক্তি' নামের কাগুজে বাঘ হিসেবে শুধু পত্রিকার কলাম আর টিভি টকশোতেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতার আভাস দেয়া হয় । একজন সামান্য প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কোন চাপ অনুভব করেন বলে মনে হয়না । 'চির উন্নত মম শির' চেতনার পরিস্ফুটন ইদানিংকালের সেনাবাহিনী খুব একটা দেখাতে পেরেছে বলেও প্রমাণ নেই । অর্থাৎ আগস্ট বিপ্লবের দ্বিতীয় পক্ষ, অথবা বিজয়ী পক্ষ বলেও যাদেরকে ধরা হয়- তাদের নৈতিক অস্তিত্ব আজ ভীষণ সংকটে ।

আমি বলছিনা যে, সেনাবাহিনীতে ভোটাভুটি চালু করাই এ সংকটের সমাধান । সেনাবাহিনীকে দলীয় ভাগাভাগির ব্যালেন্স অব পাওয়ার বানানোর কথাও বলছিনা আমি । বরং গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনীর সমরনৈতিক অবস্থানটি সুস্পষ্ট এবং প্রকাশিত রাখার পক্ষেই আমি অভিমত দিচ্ছি । আপনারা কি বলতে পারেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিলেবাসে এখন কি কি বিষয় পড়ানো হয় ? যে সেনাবাহিনী আফ্রিকার মাটিতে ভয়ংকর অপরাধীদের সাথেও শান্তিরক্ষীর আচরণ করতে পারে, তারা দেশীয় জনগণকে 'ব্লাডি সিভিলিয়ান' হিসেবে পরিত্যাজ্য মনে করার সাইকোলজি কেনো ধারণ করে এটা নিয়ে কি কোন গবেষণা হয়েছে ? বিএমএ কমিশন্ড অফিসার হিসেবে আগামী লং কোর্স থেকে দুই বছরের স্থলে চার বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ চালু হচ্ছে এই কথা কি সবাই জানতেন ? এখন থেকে সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট নয়, সরাসরি ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম হচ্ছে, এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেটা নিয়ে কি আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেছে কেউ ? এমনিতেই সেনাবাহিনী অনেকটা যুদ্ধবিমুখ হয়ে পড়েছে, তার উপরে যদি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই তাদেরকে বই-পুস্তক গিলিয়ে বিদ্যাবাগীশ করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়, তবে সেটা আমাদের ভূরাজনৈতিক প্রক্ষাপটকে কিভাবে প্রভাবিত করবে তার রিপোর্ট কি দেশের নেতানেত্রীদের কাছে আছে ? গত দশ বছরের মধ্যে লেঃ কর্ণেল বা মেজর পদবি ধারণ করেই বিপুল সংখ্যক প্রতিভাবান সেনাকর্মকর্তা স্বেচ্ছা অবসরে চলে গিয়েছে কেনো, তা নিয়ে কোন গবেষণাপত্র কি জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে ? হাসান সারোয়ার্দিরাই কেনো জেনারেল হয় সেটা বুঝতে হলে কি এ ব্যাপারে আরো তীক্ষ্ন নজর রাখার প্রয়োজন ছিলো না ? আমাদের ছেলেমেয়েরা অষ্টম শ্রেণির বইয়ে "নিজেকে জানো" শিরোনামে মূলত কি শিখছে সেটা জানা এবং লক্ষ্য রাখার অধিকার যেমন জনগণের আছে, তেমনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ভাইবোনেরা সমরনীতি চর্চায় কোন কোন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধান পাচ্ছে সেটা লক্ষ্য রাখার অধিকার কি জনগণের নেই ? আমার মনে হয় ১৫ আগস্টকে বোঝার জন্য সেনাবাহিনীর তখনকার অবস্থান এবং এখনকার অবস্থানের তুলনাটাই মুখ্য বিষয় । তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো- একনায়ক শেখ মুজিব নিহত হওয়াতে যতটুকু বিজয় আমরা অনুভব করেছি, তলে তলে আরো বেশি হেরে গিয়েছি ।

অনেকে ধারণা করতে পারেন- আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারলেই এ সংকটের সমাধান হয়ে যাবে । সততার সাথে একবার ভেবে দেখুনতো- বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল গুলো কি জন্মদিন পালন করা ছাড়া ১৫ আগষ্টের আর কোন মূল্যায়ন করেছে কখনো ? যদি আবারো বিশ দলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় আসে তবে হয়তো দিবসটিকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে হিসাব করে ১৫ আগষ্টের দিন এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করতে পারে যেনো সেদিনের শিরোনামটি উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা দখল করে নেয় । কিন্তু এর বেশি কিছুই তারা করতে পারবেনা । কারণ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের চাইতে- ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ যে আরো ক্ষতিকর এবং ভয়ংকর এটা সেনাবাহিনী যেমন জানে, বিরোধী দলগুলোও জানে । অতএব আগস্ট বিপ্লব নিয়ে অতো আয়োজন করে বিভ্রান্ত হবার প্রয়োজন নেই ।

তাহলে করণীয় কি হতে পারে ! হ্যাঁ, করণীয় অত্যন্ত স্পষ্ট । প্রথমেই আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে ১৫ আগস্ট ছিলো বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের পক্ষে একটি যথার্থ বিপ্লব । ঝড়ে বক মরবে আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবো আমরা, এমন মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে । সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের পক্ষে সুবিধা করে দেবে আর আমরা সবটুকু সুখভোগের পর তাদেরকে বিপথগামী নাগরিক খেতাব দিয়ে নিজেদের খোলসে আবার হারিয়ে যাবো, এমন লুকোচুরি বন্ধ করতে হবে । নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢেকে ঢেকে সামরিক অভ্যুত্থানের আশায় ঈদের পর ঈদ গুনতে থাকার প্রবৃত্তিও বাদ দিতে হবে । আগস্ট বিপ্লবের যথাযথ স্বীকার্য প্রদানের পর দেখতে হবে আগস্ট বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলো কি কি ! বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলা করার জন্য 'জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ' গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার ছিলো তা পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে । এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে । রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে "র‌্যাব বিলুপ্তির আহবান", "উপজেলা ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি", "নাগরিক অধিকার আদায় কমিটি", "সম্প্রচার নীতিমালা স্থগিত করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার কমিটি", "একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধ কমিটি" এসব হাজারটা শিশুসুলভ আন্দোলন-আন্দোলন খেলা বাদ দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় 'জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ' গঠনই সময়ের দাবি । সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদের 'দেয়াল' এমন একটি নিরাপত্তা সূচক দেয়ালের অভাব অনুভব করেই লেখা । সম্ভবত কারারুদ্ধ মাহমুদুর রহমান এটা চিন্তা করেই 'আমার দেশ' অফিসে পাঠচক্রের আয়োজন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । যদি এতোদিনে একটি সত্যিকার নিরাপত্তা পরিষদ আমাদের থাকতো- হয়তো ফেলানীদেরকে মরতে হতোনা, পিলখানা ট্রাজেডী এড়ানো যেতো, একতরফা নির্বাচন কেন্দ্রিক কোটি কোটি টাকার লুটপাট থেকে জাতি রক্ষা পেতো । রানা প্লাজা ধ্বস, পিনাক লঞ্চডুবি, ডেসটিনির অর্থচুরির বিষয়ে অভিযোগ করার মতো মানুষের আরো একটি আশার জায়গা থাকতো ।

অনেক কথা বলা হলো । তবু কিছুই হবেনা এটা প্রায় নিশ্চিত । তারপরেও দিন বদলায়- মানুষ বদলায় । আশা ধরে রাখতেই হয় । শাপলা চত্বর থেকে শাহবাগ চত্বর পর্যন্ত দেখার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের তরুণদের হয়েছে । সাগর-রুনি হত্যাকান্ড দেখার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের হয়েছে । আমিনুল হত্যা থেকে দেলোয়ার খালাস পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখা হয়েছে এ প্রজন্মের শ্রমিক ভাইবোনদের । আমাদের প্রজন্মের মাঝে এতোদিনে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদঘাটনের একটা দৃঢ় প্রত্যয় এসেছে বলেও মনে হয় । হপ-স্টেপ নেবার পর এখন শুধুই জাম্প দেবার অপেক্ষা । যদি সে দীর্ঘ অপেক্ষার পালা নিকট ভবিষ্যতে সমাপ্ত হয়, তবেই আগষ্ট বিপ্লবের সাফল্য তার চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছাবে বলে বিশ্বাস করি ।

পরিশেষে- দীর্ঘসময় নিয়ে কষ্ট করে যারা এই নোট পড়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ । Happy-মুজতাহিদ বাপ্পী

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

253137
১১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:২২
হতভাগা লিখেছেন : আরে ! এই লেখা তো একবার পড়ছি ! কে জানি দিছে ....।
১১ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০১:৪২
197285
সত্য নির্বাক কেন লিখেছেন : -মুজতাহিদ বাপ্পী
১১ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০১:৪৪
197286
সত্য নির্বাক কেন লিখেছেন : এটি স্টিকি করে নাই মডুরা তাই আমি স্টি করে রাখলাম.....
253140
১১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০:২৮
কাহাফ লিখেছেন : আমিও................।
১১ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০১:৪৪
197287
সত্য নির্বাক কেন লিখেছেন : এটি স্টিকি করে নাই মডুরা তাই আমি স্টি করে রাখলাম.....
253443
১২ আগস্ট ২০১৪ রাত ০১:৫৩
চির উন্নত মম শির লিখেছেন : সচেতনমূলক পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
১৩ আগস্ট ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৬
197784
সত্য নির্বাক কেন লিখেছেন : আপনাকে ও মোবারকবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File