শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভায়ের শেষ চিঠি ও মেয়ে আমাতুল্লাহ শারমীন।
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:২৭:৩৯ রাত
- ----------------- ---------- ---------------------- ------
আব্বু, সালাম আপনাকে। কেমন আছেন? সবাই বলছে আপনি নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয়, এখনি এসে বলবেন, শারু আম্মু চা দাও তোঁ , বলবেন আমার মায়েরা কই ?
আর আম্মু বলবে মেয়ে যেন আর কারো নেই ? অথবা বলবেন, আব্বা জানি আর আমাদেরও ছিলো না? আপনার সাথে লাস্ট ডেইটের আগের দিন সাক্ষাতে আমি বলেছিলাম আপনাকে গাজী হিসাবে দেখতে চাই। তারপর যখন নিউজ আসলো ১০ টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে তখন ভাবলাম আমার দোয়া কবুল হয়ছে। কিন্তু না, আপনিই জয়ী হলেন।
স্বার্থপরের মত আমি আপনাকে আমাদের আব্বু বানিয়া রাখতে চেয়ে ছিলাম . কিন্তু এখন দেখি আপনাকে আল্লাহ এমন মর্যাদা দিলেন যা আমরা কল্পনাও করিনি। আজকে মনে হচ্ছে শাহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা শুধু আমাদের asset না সারা পৃথিবীর ইসলামী আন্দোলনেরও অমূল্য সম্পদ ।আমরা গর্বিত সান্তান। আপনি ভাল থাকেন আল্লাহর আরশের ছায়ায়, জান্নাতের পাখি হয়ে। দোয়া করেন যেনো খুব তাড়াতাড়ি দেখা হয় জান্নাতে।
কারণটাও স্বার্থপরের মত বলছি আমরা আপনার সান্নিধ্য চাই, আমি আমার বাবার বুকে মাথা রাখতে চাঁই, আমার আব্বুর শরীরের সুবাস নিতে চাই। সেই সুবাস যা আমাকে নেশা ধরিয়ে দিতো,এখনও চারদিকে সেই সুবাস অনুভব করি। সবাই বাসায় এসে যখন বলে, তোমরা কত ভাগ্যবান , তখন শান্তনা পাই। কিন্তু তা ও মেয়ের মনতো মানে না। আমাদের দোয়া করেন যেন সবর করতে পারি।
আপনার শারু মনি।
আমাতুল্লাহ শারমীন ।
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম। প্রিয়তমা জীবন সাথী পেয়ারী, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আজ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর খুব সম্ভব আগামী রাত বা আগামীকাল জেলগেটে আদেশ পৌছানোর পরই ফাঁসির সেলে আমাকে নিয়ে যেতে পারে। এটাই নিয়ম। সরকারের সম্ভবত শেষ সময়। তাই শেষ সময়ে তারা এই জঘন্য কাজটি দ্রুত করে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। আমার মনে হচ্ছে তারা রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করবে না। যদি করেও তাহলে তাদের রায়ের কোন পরিবর্তন হওয়ার দুনিয়ার দৃষ্টিতে কোন সম্ভাবনা নেই। মহান আল্লাহ যদি নিজেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন, তাহলে ভিন্ন কথা। অথচ আল্লাহর চিরন্তন নিয়মানুযায়ী সব সময় এমনটা করেন না। অনেক নবীকেও তো অন্যায়ভাবে কাফেররা হত্যা করেছে। রাসূলে করীম (স এর সাহাবায়ে কেরাম এমনকি মহিলা সাহাবীকেও অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। আল্লাহ অবশ্য ঐ সমস্ত শাহাদাতের বিনিময়ে সত্য বা ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে ব্যবহার করেছেন। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কি করবেন তা তো জানার উপায় নেই। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে আওয়ামী লীগকে শুধু সাহসই দেন নাই, হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদকে চাপও দিয়েছেন। এবং সতর্ক করার জন্য জামায়াত শিবিরের ক্ষমতায় আসার ভয়ও দেখিয়েছেন। এতে বুঝা যায় যে জামায়াত এবং শিবির ভীতি এবং বিদ্বেষ ভারতের প্রতি রক্তকনায় কিভাবে সঞ্চারিত। আমি তো গোড়া থেকেই বলে আসছি, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এটার সবটা ছকই ভারতের অঙ্কন করা। আওয়ামী লীগ চাইলে এখান থেকে পেছাতে পারবে না। কারণ তারা ভারতের কাছে আত্মসমর্পনের বিনিময়েই এবার ক্ষমতায় পেয়েছে। অনেকেই নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে কথা বলেন, আমাকে সহ জামায়াতের সকলকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে যে কায়দায় জড়ানো হয়েছে এবং আমাদের দেশের প্রেসের প্রায় সবগুলোই সরকারকে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করছে, তাতে সরকারের পক্ষে নীতি নৈতিকতার আর দরকার কি? বিচারকরাই স্বয়ং যেখানে জল্লাদের ভূমিকায় অত্যন্ত আগ্রহভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার নেশায় মেতে উঠেছে তাতে স্বাভাবিক ন্যায় বিচারের আশা অন্তত এদের কাছ থেকে করা কোনক্রমেই সমীচিন নয়। তবে একটি আফসোস, যে আমাদেরকে বিশেষ করে আমাকে যে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়েছে, তা জাতির সামনে বলে যেতে পারলাম না। গণমাধ্যম বৈরী থাকায় এটা পুরাপুরি সম্ভবও নয়। তবে জাতি পৃথিবীর ন্যায়পন্থী মানুষ অবশ্যই জানবে এবং আমার মৃত্যু এই জালেম সরকারের পতনের কারণ হয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক দূর এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কালই সূরা আত-তাওবার ১৭ থেকে ২৪ আয়াত আবার পড়লাম। ১৯ নং আয়াতে পবিত্র কাবা ঘরের খেদমত এবং হাজীদের পানি পান করানোর চাইতে মাল ও জান দিয়ে জেহাদকারীদের মর্যাদা অনেক বেশি বলা হয়েছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর চাইতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর দেয়া ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জেহাদে মৃত্যুবরণকারীদের আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ মর্যাদার কথা আল্লাহ স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ নিজেই যদি আমাকে জান্নাতের মর্যাদার আসনে বসাতে চান তাহলে আমার এমন মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ জালেমের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু তো জান্নাতের কনফার্ম টিকেট। সম্ভবতঃ ১৯৬৬ সালে মিসরের জালেম শাসক কর্নেল নামের সাইয়্যেদ কুতুব, আব্দুল কাদের আওদাসহ অনেককে ফাঁসি দিয়েছিলেন। “ইসলামী আন্দোলনের অগ্নি পরীক্ষা” নামক বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষা শিবিরে বক্তব্য শুনেছি। একাধিক বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বাম হাতটা গলার কাছে নিয়ে প্রায়ই বলতেন, ‘ঐ রশি তো এই গলায়ও পড়তে পারে’। আমারও হাত কয়েকবার গলার কাছে গিয়েছে। এবার আল্লাহ যদি তার সিদ্ধান্ত আমার এবং ইসলামের অগ্রগতির সাথে সাথে জালেমের পতনের জন্য কার্যকর করেন, তাহলে ক্ষতি কি? শহীদের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে রাসূলে করিম (সঃ) বারবার জীবিত হয়ে বারবার শহীদ হওয়ার কামনা ব্যক্ত করেছেন। যারা শহীদ হবেন, জান্নাতে গিয়ে তারাও আবার জীবন এবং শাহাদাত কামনা করবেন। আল্লাহর কথা সত্য, মুহাম্মদ (সঃ) এর কথা সত্য। এ ব্যাপারে সন্দেহ করলে ঈমান থাকে না। এরা যদি সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ফেলে তাহলে ঢাকায় আমার জানাযার কোন সুযোগ নাও দিতে পারে। যদি সম্ভব হয় তাহলে মহল্লার মসজিদে এবং বাড়িতে জানাযার ব্যবস্থা করবে। পদ্মার ওপারের জেলাগুলোর লোকেরা যদি জানাযায় শরীক হতে চায়, তাহলে আমাদের বাড়ীর এলাকায়ই যেন আসে। তাদেরকে অবশ্যই খবর দেয়া দরকার। কবরের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি আমার মায়ের পায়ের কাছে। কোন জৌলুষপূর্ণ অনুষ্ঠান বা কবরের বাধানোর মত বেদআত যেন না করা হয়। সাধ্যানুযায়ী ইয়াতিম খানায় কিছু দান খয়রাত করবে। ইসলামী আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। বিশেষ করে আমার গ্রেফতার এবং রায়ের কারণে যারা শহীদ হয়েছে, অভাবগ্রস্থ হলে ঐসব পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। হাসান মওদূদের পড়াশুনা এবং তা শেষ হলে অতি দ্রুত বিবাহ শাদীর ব্যবস্থা করবে। নাজনীনের ব্যাপারেও একই কথা। পেয়ারী, হে পেয়ারী, তোমাদের এবং ছেলেমেয়ের অনেক হকই আদায় করতে পারিনি। আল্লাহর কাছে পুরষ্কারের আশায় আমাকে মাফ করে দিও। তোমার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেছি যদি সন্তান-সন্ততি এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আল্লাহ যেন আমার সাথে তোমার মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। এখন তুমি দোয়া করো, যাতে আমাকে দুনিয়ার সমস্ত মায়া-মহব্বত আল্লাহ আমার মন থেকে নিয়ে শুধু আল্লাহ এবং রাসূলে করীম (সঃ) এর মহব্বত দিয়ে আমার সমস্ত বুকটা ভরে দেন। ইনশাআল্লাহ, জান্নাতের সিড়িতে দেখা হবে। সন্তানদেরকে সবসময় হালাল খাওয়ার পরামর্শ দিবে। ফরজ, ওয়াজিব, বিশেষ করে নামাজের ব্যাপারে বিশেষভাবে সকলেই যত্মবান হবে। আত্মীয়-স্বজনদেরকেও অনুরূপ পরামর্শ দিবে। আব্বা যদি ততদিন জীবিত থাকেন তাকে সান্তনা দিবে। তোমাদেরই প্রিয় আব্দুল কাদের মোল্লা ।
বিষয়: বিবিধ
৪৩২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন