ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রাসূল (সা.) এবং সাহাবীদের কর্মনীতি।
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০২:২১:২১ দুপুর
আগে পারসিকরা বিশ্বাস করত যে, একজন পারসিক সৈন্য দশজন আরবের সমান। তারা অবজ্ঞা করে আরবদের ডাকত ভিুকের জাত বলে। এ বিশ্বাস এক তরফা ছিল না। আরবরাও একজন পারসিক সৈন্যকে দশজন আরবির সমান মনে করত। দক্ষিণ আরবের ইয়ামেন পারসিকরা শাসন করত একজন গভর্নরের অধীনে মাত্র কিছু সংখ্যক সৈন্য দিয়ে।
অভ্যন্তরীণ আরব এত নিঃস্ব ছিল যে, ওখানে গভর্নর বা সৈন্য রাখার মতো কোনো আকর্ষণ আছে বলে তারা মনে করত না। ওদিকটায় কোনো বিশেষ ঘটনা বা গোলযোগ হলে ইয়ামেনের গভর্নর দু’একটা পুলিশ পাঠিয়ে দেয়াই যথেষ্ট মনে করত। বিশ্বনবী যখন পৃথিবীর শাসকদের ইসলামী জীবনব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানালেন, তাঁর আহ্বান পেয়ে তখন পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ অপমান বোধ করে তার ইয়ামেনের গভর্নর বাযানকে আদেশ দিলেন মুহাম্মদ (সা.) নামের আরবটাকে ধৃষ্টতার জন্য গ্রেফতার করে তার কাছে রাজধানীতে পাঠিয়ে দিতে। সম্রাটের আদেশ পেয়ে গভর্নর বা’যান কি করলেন তা ভেবে দেখার বিষয়। তিনি রাসূল (সা.)কে গ্রেফতার করার জন্য মদীনায় দু’জন পুলিশ পাঠিয়ে দিলেন। (তথ্য সূত্র : মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক, তাবারি, ইয়াজিদ বিশ আবু হাবিব)।
এখানে চিন্তা করার বিষয় এই যে, ইয়ামন আরব উপদ্বীপেই অবস্থিত এবং মক্কা মদিনা থেকে খুব দূরে নয়। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখন বিশ্বনবী (সা.)কে নিয়ে আরবময় হুলুস্থূল অবস্থা। বদর ও ওহোদ যুদ্ধ ছাড়াও ছোট খাটো অনেক সংঘর্ষ হয়ে গেছে। মহানবী (সা.) তখন মদীনায় সর্বেসর্বা। গভর্নর হিসেবে এসব খবর বাযানের জানা না থাকা অসম্ভব। তা সত্ত্বেও মহানবী (সা.)কে গ্রেফতার করার জন্য দু’জন পুলিশ পাঠানো থেকে বোঝা যায়, পারসিক শক্তি আরবদের কতখানি দুর্বল মনে করে অবজ্ঞার চোখে দেখত।
তারপর মাত্র তেইশ বছরের সাধনায় বিশ্বনবী (সা.) ঐ দরিদ্র বিচ্ছিন্ন অশিক্ষিত আরবকেই রূপান্তরিত করলেন এমন একটি শক্তিশালী জাতিতে, যে জাতি ঐ পারসিকদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে তুলোর মতো উড়িয়ে দিল। (এখানে আরো একটু মনে রাখা দরকার মহানবী (সা.) নবুয়তি জীবনের তেইশ বছরের প্রথম কয়েক বছর যখন মক্কায় ছিলেন তখন যে অল্পসংখ্যক লোক মুসলমান হয়েছিলেন কোরাইশ কাফেরদের বিরোধিতায় তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেবার পুরোপুরি সুযোগই পাননি। সুযোগটা পেয়েছিলেন মদিনার দশ বছরে।)
তখন দেখা গেল একজন মুসলিম মুজাহিদ দশজন পারসিক সৈন্যের সমান। অর্থাৎ একদম সম্পূর্ণ উল্টো। চিন্তা করে দেখার বিষয় এক পুরুষের জীবনের তফাত নয়, মাত্র কয়েকটা বছর এবং সেই মানুষগুলোই যারা নিজেরাই স্বীকার করত যে, একজন পারসিক সৈন্য দশজন আরবের সমান। তারাই যখন ইসলাম গ্রহণ করে সেই পারসিকদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন তখন দেখা গেল, এবার তারাই একজন, দশজন পারসিক সৈন্যের সমান।
এই তফাত কেমনে হলো? কিসে আনলো? কিসের বলে আরবের হতদরিদ্র অশিক্ষিত বিচ্ছিন্ন উচ্ছৃঙ্খল, যাদেরকে কিছুদিন পূর্বে বলা হতো ভিুকের জাত সেই লোকগুলো এমন শক্তিশালী হয়ে ওঠলেন? নিঃসন্দেহে ইসলাম- ইসলাম আল্লাহর দেয়া এমন জীবন ব্যবস্থা আর মহানবী (সা.) এর প্রশিক্ষণে তারা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অপরাজেয় জাতি হিসেবে গড়ে উঠলেন।
ইসলাম ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করলে নিজ থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি জাতি দুর্ধর্ষ যোদ্ধায় পরিণত হতে বাধ্য। এমনি করেই আল্লাহ তাঁর জীবনব্যবস্থা তৈরি করেছেন। এ জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করলে দুর্বলেরা আর দুর্বল থাকে না। বিচ্ছিন্নরা আর বিচ্ছিন্ন থাকে না, ঐক্যবদ্ধ হয়। মূর্খরা আর মুর্খ থাকে না, সুশিক্ষিত সুসভ্য হয়। ক্ষমতাহীনরা আর ক্ষমতাশূন্য থাকে না। ভীরুরা আর ভীরু থাকে না। তারা হয়ে ওঠে সাহসী শক্তিশালী দুর্বার এবং অসাদারণ তেজদীপ্ত। তাদের হাতে আসে সকল কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব পদমর্যাদা এবং সকল অর্থসম্পদ তাদের পায়ের নিচে গড়াগড়ি করে।
এই যোদ্ধাদের জন্য আল্লাহ শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও সম্মান রেখেছেন। কারণ, পরম দয়াময় জ্ঞানী আল্লাহ জানেন যে, ভালো ও সত্য কথা যতই প্রচার করা হোক, যতই বক্তৃতা দেয়া হোক, যতই তাবলিগ করা হোক শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া দ্বীন ইসলাম পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
রাসূল (সা.) এর মতো ভালো মানুষ ভালো প্রচারক আর কে আছেন? তাঁর মতো সুন্দর করে কথা আর কে বলতে পারেন? তিনি যে হেকমতের তরিকায় ইসলামের কথা বলেছেন, ইসলাম প্রচার করেছেন, তার মতো উত্তম ব্যক্তি ও প্রচারক দুনিয়াতে আর কি কেউ আছেন?
তিনি ছিলেন সকল দেশের সকল যুগের সকল মানুষের জন্য রহমত, সবার কল্যাণকামী, শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সাহাবিদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। তিনি সাহাবীদের যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তা আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা-প্রশিক্ষণ।
নবী করিম (সা.) এর ওফাতের পর সাহাবি ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে আরব থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। মহানবী (সা.) যদি সাহাবিদের এ শিক্ষা না দিতেন তবে তাঁর সময়ে শুধু আরবে যে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাহাবী তাতেই খুশি হয়ে মহাউৎসাহে বর্তমানের মুসলমানদের মতো নামাজ রোজা হজ জাকাত তসবিহ তাহলিল ও জেকের আসকারে মশগুল হয়ে পড়তেন।
কিন্তু সাহাবী তা করেননি। আখেরি নবী (সা.) তাঁদের উপর যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা জানতেন যতদিন সম্পূর্ণ মানবজাতির উপর ইসলামী জীবন বিধান জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন মানব জাতি আজকের মতোই অন্যায় অনাচার অবিচার জোরজুলুম যুদ্ধ বিগ্রহ খুন গুম অশান্তির মধ্য পতিত থাকবে। অন্য কোনো জীবন বিধানে মানুষের মধ্যে শান্তি আসবে না এবং মুসলিম উম্মার উপর আল্লাহর রাসূলের (সা.) দেয়া দায়িত্বপূর্ণ হবে না।
প্রত্যেক নবীই তাঁর উপর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন তাঁর অনুসারীদের সাহায্যে। কোনো নবীই একা একা তাঁর কাজ-কর্তব্য সম্পাদন করেননি বা করতে পারেননি। কারণ নবুয়তি কাজ একা একা ঘরে বসে পালন করার মতো নয়। এ কাজ হলো সমাজের মানুষ নিয়ে, দেশ ও জাতি নিয়ে। এ কাজ ব্যক্তিগত নয়, এ কাজ পাহাড়ের গুহায়, নির্জনে বা হুজরাখানায় বসে করা যায় না। আমাদের নবী (সা.) এর পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। নবুয়ত পাবার মুহূর্ত থেকে ওফাত পর্যন্ত পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষটির জীবন কেটেছে মানুষের মধ্যে, জনকোলাহলে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামে, সশস্ত্র সংগ্রামে এ ইতিহাস সবারই জানা। নবুয়তের জীবন বহির্মুখী। যে দ্বীন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করে আমাদের দিলেন তার চরিত্র হলো বহির্মুখী-সংগ্রামী। আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যে তাঁর উম্মার উপর ন্যস্ত করে গিয়েছিলেন তা তাঁর উম্মাহ পূর্ণভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার প্রমাণ উম্মাহহ পরবর্তী কার্যক্রমের ইতিহাস। কারণ বিশ্বনবী (সা.)-এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উম্মাহ বাড়িঘর, স্ত্রীপুত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছু ত্যাগ করে তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার অর্পিত কাজ করার জন্য দেশ থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। মানুষের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর নেই যে, একটি সম্পূর্ণ জাতি এক মহান আদর্শ পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠার জন্য পার্থিব সুখ-সুবিধে, আরাম সব ত্যাগ করে দেশ থেকে বের হয়ে পড়েছে এবং সে মহান আদর্শ হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে এমন একটা জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেটা মানুষের সমষ্ঠিগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে পূর্ণ শান্তি আনবে। অর্থাৎ এই জাতি তাদের নেতা আল্লাহর শেষ নবী (সা.) যেমন করে মানুষের কল্যাণের জন্য নিজকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। ঠিক তেমনি করে পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লেন। তাঁদের নেতা বিশ্বনবী (সা.) বলেছিলেন, ‘আমাকে অনুসরণ করো, আমার সুন্নাহ পালন করো, যে আমার সুন্নাহ ত্যাগ করবে সে আমার কেউ নয়। বিশ্বনবীর (সা.) সুন্নাহ কি?
আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)কে জানিয়ে দিয়েছেন পৃথিবীতে যত জীবন বিধান আছে সে সবের উপর তোমার কাছে অবতীর্ণ এই জীবন বিধানকে প্রতিষ্ঠা কর : ‘তিনি সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহকারে যেনো সকল ধর্মের উপর এ দ্বীন জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।’ (সূরা আল ফাতাহ-২৮, সূরা আততাওবা-৩৩, সূরা আসসাফ-৯)।
আল্লাহ পাক আরো বলেছেন, তোমরা সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। (সূরা ইমরান-১০৪)।
যারা এ কর্তব্য পালন করে তাদের সর্বোত্তম জাতি বলে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন : তোমরাই সর্বোত্তম উম্মত, মানব জাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উত্থান হয়েছে’। (সূরা ইমরান-১০)।
রাসূল (সা.)-এর নিজের প্রতি আল্লাহর আদেশ এবং মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর আদেশকে একত্র করলে যা হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি (আল্লাহ কর্তৃক) সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না পৃথিবীর মানুষ আল্লাহকে একমাত্র প্রভু এবং আমাকে তাঁর রাসূল বলে স্বীকার করে নেয়, সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও জাকাত দেয়।’
এ জেহাদ কার্যত মুসলিম জাতির জন্য ফরজ হয়ে গেল। নিজ আত্মার কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে থেকে শুরু করে কথা বলে যুক্তি দিয়ে লিখে মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা জেহাদ তো আছেই। উক্ত সশস্ত্র সংগ্রামে ‘জেহাদ’শব্দ ব্যবহার করা হয়নি, ব্যবহার করা হয়েছে ‘কিতাল’ শব্দ, যার অর্থ সশস্ত্র সংগ্রাম। অন্যদিকে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত না করার। আল্লাহ তার নবী (সা.) ও উম্মাহকে আদেশ দিয়েছেন সশস্ত্র সংগ্রাম করে পৃথিবীর মানুষকে ইসলামের মধ্যে নিয়ে আসতে। আপাততঃ দৃষ্টিতে এ অসামঞ্জস্যপূর্ণ আদেশকে শেষ নবী (সা.) পরিষ্কার করে দিয়েছেন অনেকবার।
মহানবী (সা.) যখনি মুজাহিদদের কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে পাঠিয়েছেন প্রত্যেকবার তিনি তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, প্রত্যেক সংঘর্ষের আগে বিরোধীদের তিনটি শর্ত দেবে।
প্রথমত. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব তাওহিদ ও বিশ্বনবী (সা.)কে স্বীকার করে নিয়ে শেষ জীবনব্যবস্থা ইসলাম গ্রহণ কর, তা হলে তোমরা আমাদের ভাই হয়ে যাবে এবং আমাদের সঙ্গে একত্র হয়ে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের সহযোগী হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত. তাতে যদি সম্মত না হও তবে রাষ্ট্রশক্তি ও শাসনভার আমাদের হাতে ছেড়ে দাও। আমরা ইসলামের নীতি অনুসারে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবো। তোমরা ব্যক্তিগতভাবে যার যে ধর্মে আছো তাই থাকবে। আমরা বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করব না। এমনকি তোমাদের এক জোড়া ছেঁড়া জুতোও নেব না। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা আমরা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করবে না (শুধু যুদ্ধক্ষম লোক) তারা মাথা পিছু একটা কর দেবে।
তৃতীয়. যদি এটাও স্বীকার না কর তবে যুদ্ধ ছাড়া আর পথ নেই। কারণ, এই জীবনব্যবস্থা ইসলাম পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে বিশ্বনবী (সা.) এর উপর স্রষ্টার অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ করে পৃথিবীতে শান্তি সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে, ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করতে আমরা পার্থিব সব কিছু বিসর্জন দিয়ে এখন প্রাণটুকু বিসর্জন দিতে এসেছি। তবে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়ে যদি আমাদের তোমাদের ওপর এই জীবনব্যবস্থা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলেও তোমাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করব না। তবে তোমাদের যোদ্ধাদের বন্দী করব’
বিশ্বনবী (সা.) ও উম্মাহর এই প্রচেষ্টা-জেহাদ বহুভাবে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে। অমুসলিমরা তো বটেই এমন কি মুসলিম নামধারী কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুশরেক ও কাফিররাও এই সংগ্রামকে জোর করে মানুষকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এ ছাড়াও এক শ্রেণীর বিশ্বাসী মুসলিম আছেন যারা ইসলামের যুদ্ধকেও শুধুমাত্র আত্মরক্ষামূলক বলে মনে করেন। এরা প্রমাণ হিসেবে কুরআনের সূরা বাকারার ঊনিশ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন, যেখানে আল্লাহ যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছেন শুধু তাদের বিরুদ্ধে যারা মুসলমানদের আক্রমণ করে এবং ঐ সূরার দুশ ছাপান্ন নম্বর আয়াত উল্লেখ করেন যেখানে আল্লাহ বলেছেন: ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগ করে কাউকে ধর্মান্তরিত করা নিষেধ করে দিয়েছেন। তাদের মতে, এক কথায় মুসলমানদের শুধু আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধেরই অনুমতি দেয়া হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত ঐ আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামের অতি প্রথমদিকে যখন বিশ্বাসীদের সংখ্যা ছিল খুবই অল্প।
সমস্যা তখন প্রধানত আত্মরক্ষার। যখন এই অবস্থা কেটে যেয়ে বিশ্বনবী ও সাহাবারা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠলে তা তখন ঐ আদেশ বদলে দিয়ে নিজেরা অগ্রসর হয়ে বিরোধী অবিশ্বাসীদের আক্রমণ করে পরাজিত করার আদেশ দিলেন। তখন আদেশ এলো সশস্ত্র সংগ্রাম করো যতক্ষণ না অন্যায় অশান্তি পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়ে সেখানে আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা আনফাল-৩৯)।
আল্লাহ আরো পরিষ্কার করে মুসলমানদের বললেন, ‘আর (হে মুমিনরা) তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে লড়াই করছো না সেই সব দুর্বল পুরুষ, অসহায় নারী এবং শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এই অত্যাচারী জনপদ থেকে উদ্ধার করো। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের (পক্ষ অবলম্বনকারী) অভিভাবক বানিয়ে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী ঠিক করে দাও। আর ঈমানদার তো তারাই যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে। আর অপর পক্ষে যারা কাফের তারা লড়াই করে তাগুতের পক্ষে। অতএব, তোমরা জিহাদ করতে থাকো শয়তানের পক্ষ অবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে (দেখবে) শয়তানের চক্রান্ত অত্যন্ত দুর্বল (সূরা নিসা-৭৫-৭৬)
এখানেও সেই একই কথা। মানুষের ভুলে ভরা জীবনব্যবস্থার ফলে মানুষ যে অন্যায় অবিচার আর অত্যাচারের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে তা থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মদিকে আদেশ করেছেন সশস্ত্র সংগ্রাম করতে।
আল্লাহ যখন মহানবী (সা.)কে যথেষ্ট শক্তিশালী করলেন, তখন তিনি আরবের বিভিন্ন দিকে সামরিক অভিযান চালিয়ে সমগ্র আরবকে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের অধীনে নিয়ে আসলেন। ঐসব অভিযানের সেনাপতিদের সবাইকে তিনি নির্দেশ দিয়ে দিতেন সেই তিনটি শর্ত তাদের দিতে। প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত গ্রহণ না করলে যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের ইসলামের শাসনব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসাই ছিল মহানবী (স.া)-এর নির্দেশ।
যারা এই দ্বীনের আকিদা স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে শিক্ষা করেছিলেন তাদের একজন হজরত আবু বকর (রা.) জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘হে মুসলিম জাতি, তোমরা কখনো জেহাদ ছেড়ো না, জেহাদ ছাড়লে আল্লাহ তোমাদের অপমান অপদস্ত না করে ছাড়বেন না।’ আজকের এই মুসলিম জাতির আকিদা আবু বকর (রা.)-এর আকিদার সম্পূর্ণ বিপরীত। জেহাদ এই জাতির আকিদা থেকে মুছে গেছে। তাই তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবরূপে প্রতিফলিত হয়েছে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের ওপর।
বদরযুদ্ধের আগেই মহানবী (সা.) মোট সাতটি সশস্ত্র অভিযান শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন। প্রথম অভিযান উবাইদা বিন হারেস (রা.)-এর অধীনে ৬০ থেকে ৮০ জন অশ্বরোহী ও উষ্ট্রারোহী দলকে ওয়াদ্দান নামক স্থানে পাঠানো হয়। সেখানে সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) মুশরেকদের প্রথম সাক্ষাতেই আক্রমণের অপেক্ষা না করেই তীর নিক্ষেপ করেন। এ ঘটনা থেকে বলতে হবে যে, আক্রান্ত না হলে আক্রমণ করবে না এ নীতি নিশ্চয়ই মুসলমানদের ছিল না। তা ছাড়া নীতি আত্মরক্ষামূলক হলে মহানবী (সা.) অশ্বরোহীদের প্রথম আক্রমণ নিষেধ করে দিতেন। এবং সাদ (রা.) আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করে বিনা প্ররোচনায় কখনো প্রথম তীর ছুঁড়তেন না।
রাসূল (সা.) আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রা.)কে আটজন উষ্ট্রারোহী দলের নেতৃত্ব দিয়ে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে পাঠান। এখানে তারা মক্কার কুরাইশদের একটি কাফেলার দেখা পান। দিনটি ছিল রজব মাসের শেষ দিন। আরবদের মধ্যে চারটি মাস হারাম। এই চার মাসে যুদ্ধ মারামারি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মহা শত্রুকে হাতের কাছে পেয়েও কেউ তাকে আঘাত করত না। জাহশ এবং তাঁর সাথীরা মহাসমস্যায় পড়ে গেলেন। এখন কী করা যায়। আক্রমণ করলে নিষিদ্ধ মাস লংঘন করা হয়। আবার না করলে শত্রু কাফেলা হাত ছাড়া হয়ে যায়। সাহাবারা (রা.) নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে আক্রমণ করাই স্থির করলেন। সাহাবারা তখন মাত্র ছয়জন। উট হারিয়ে যাওয়ায় দু’জন উট খুঁজতে পেছনে পড়ে গিয়েছিল। ঐ ছয়জনের আক্রমণেই মুশরেকদের কাফেলার একজন তীরের আঘাতে নিহত হলো। দু’জন আত্মসমর্পণ করল। আর বাকীগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল। কাফেলার মালপত্র ও ঐ দু’জন বন্দী নয়ে সাহাবীরা মদীনায় ফিরে এলেন। নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ ও মানুষ হত্যা করা হয়েছে বলে মহানবী (সা.) ইতস্তত করতে লাগলেন। বন্দী ও গনিমতের মাল গ্রহণ না করে অমীমাংসিত অবস্থায় রেখেছিলেন। আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায়।
যথাসময়ই আল্লাহর নির্দেশ এল। আল্লাহ নবী (সা.)কে জানালেন :
‘তারা তোমাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধের ব্যাপারে প্রশ্ন করে! ঐ মাসে যুদ্ধ (অবশ্যই) একটি গুরুতর বিষয়। কিন্তু মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখা, তাঁকে অস্বীকার করা, পবিত্র মসজিদে (মানুষের গমনাগমন) বাধা দেয়া এবং সেখান থেকে সেখানের লোকজন বহিষ্কার করা আল্লাহর কাছে তার চেয়েও গুরুতর বিষয়। (সূরা আল বাকারা-২১৭)।
এই পরিষ্কার নির্দেশ পাওয়ার পর মহানবী (সা.) বন্দী ও গনিমতের মাল যথারীতি গ্রহণ করলেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আক্রমণাত্মক যুদ্ধ তো ঠিক আছে। এমনকি নিষিদ্ধ মাসেও আক্রমণাত্মক যুদ্ধও ঠিক আছে।
দশ হাজার সাহাবী মুজাহিদ নিয়ে স্বয়ং মহানবী (সা.) যখন মক্কা অধিকারের জন্য রওনা হলেন তখন মক্কার অধিবাসীদের মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ তো দূরের কথা কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তিছিল না, যে কারণে মক্কা বিনা যুদ্ধে জয় হয়েছিল। এটা তো সবার জানা সুস্পষ্ট ইতিহাস। আক্রমণাত্মক যুদ্ধ যদি আল্লাহর আদেশের পরিপন্থী হয়ে থাকে, তবে রাসূল (সা.) কি আল্লাহর আদেশ ভঙ্গ করে ছিলেন? (নাউযুবিল্লাহ)।
আসল কথা হচ্ছে, আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.)কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যেনো তিনি পৃথিবেিত প্রচলিত সব রকম জীবনব্যবস্থা, মানুষের গড়া আইন-কানুন মতবাদ পূর্ববর্তী বিকৃত ধর্ম সব নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে একমাত্র আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেন।
এই কাজটি দেশের শাসন ক্ষমতা নিজের অধিকারে না এনে সম্ভব নয়। মুসলিম মুজাহিদরা তাই একেক দেশ দখল করে তার শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন, অন্যান্য ধর্মের মানুষ যার যার ধর্মে স্বাধীন থাকত। রাষ্ট্রীয় আইন চলত ইসলামী অমুসলিমরা ইসলামকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখে মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে, এই নতুন জীবন বিধান কেমন করে সব অন্যায় অনাচার অবিচার ও জুলুম দূর করে পরিপূর্ণ শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে তা তারা বুঝে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
যদি মুজাহিদরা অস্ত্র হাতে তাদের সম্মুখীন না হতেন, যদি যুদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিকার না করতেন তবে তারা ইসলামকে জানার সুযোগ পেত না।, দূরে থেকে নানা ভুল যুক্তি ও প্রচারণার শিকার হয়ে আজীবনই তারা এ্ নতুন জীবন বিধান ইসলামকে অস্বীকার করতে থাকত।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন