প্রত্যেক গোত্রই তার নিজ নিজ ঘাট চিনে নিয়েছিল
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ২৩ অক্টোবর, ২০১৩, ০৩:৪৫:৫৭ দুপুর
সূরা বাক্বারার এই আয়াতটি সেই ঘটনার প্রতি নির্দেশ করছে, যেখানে হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈলের জন্য পানি চেয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেনঃ
এবং (স্মরণ কর) যখন মূসা নিজ জাতির জন্য পানি চাইলো, তখন আমরা বললাম, “তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত কর পাথরের উপর।
“অতঃপর তা থেকে প্রবাহিত হল বারোটি প্রস্রবণ (ঝর্ণা)। এবং প্রত্যেক গোত্রই তার নিজ নিজ ঘাট চিনে নিয়েছিল। আল্লাহর দেওয়া রিজিক হতে খাও, পান কর আর দুনিয়ার বুকে দাংগা-হাংগামা করে বেড়িও না।” (সূরা বাক্বারা, ২: ৬০)
সে সময় সেখানে বনী ইসরাঈলের বারোটি গোত্র ছিল। আর প্রত্যেক গোত্রকেই আল্লাহ একটি করে প্রস্রবণ দিয়েছিলেন যেন কোন গোত্রকে পানির জন্য সীমালংঘন করতে না হয় কিংবা বিবাদে লিপ্ত হতে না হয়। প্রত্যেক গোত্রই নিজ নিজ ঘাট চিনে নিল এবং আল্লাহর নিয়ামতের এই সুষ্ঠু বণ্টনে তারা সবাই সন্তুষ্ট ছিল। ক্বুরআনের এমন অনেক আয়াত রয়েছে যার সবগুলোই একটি মৌলিক অর্থের ইংগিত দেয়, যদিও প্রত্যেক আয়াতের নাজিলের কারণ ভিন্ন ভিন্ন। তেমনি সূরা ইসরার একটি আয়াতঃ
“বল [হে নবী], ‘প্রত্যেকেই কাজ করে তার নিজ নিজ পন্থা অনুসারে’। “ (সূরা ইসরা, ১৭: ৮৪)
সুতরাং আল্লাহ যেভাবে বনী ইসরাঈলের প্রত্যেক গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন প্রস্রবণ দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি প্রত্যেক ব্যক্তিকেও এক একটি ভিন্ন স্বভাব ও আচার- আচরণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। বিষয়টি আরো প্রতিষ্ঠিত হয় নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারাঃ
“(ভালো কাজ) কর, কেননা প্রত্যেকের জন্য সেই কাজকে সহজ করে দেওয়া হয়েছে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।“ [১]
ক্বুরআনের আয়াতটি যেখানে প্রত্যেকের ভিন্ন প্রকৃতির স্বীকৃতি দিয়েছে সেখানে হাদিসটি তা সমর্থনের পাশাপাশি ব্যাখ্যা করে দিয়েছে কিভাবে ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত কাজকে সহজসাধ্য করে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে ক্বুরআন ও হাদিসে আরো অনেকগুলো বর্ণনা এসেছে।
শিক্ষা ও প্রতিফলনঃ
আলোচ্য আয়াত ও হাদিসগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষাগুলো পেতে পারি-
প্রথমতঃ প্রত্যেক ব্যক্তির স্বভাব, আচার- আচরণ, চিন্তাধারা তথা প্রত্যেকের প্রকৃতির একটি নিজস্বতা রয়েছে, যেটা ক্বুরআনের পবিত্র আয়াত দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা সত্য যে ক্বুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের চিন্তা অনুধাবনের জন্য বিভিন্ন মুসলিম দল ও সংগঠনের মধ্যে যে বিভেদ ও মতপার্থক্য দেখা দেয়, তা আংশিকভাবে এরই প্রতিফলন, যদিও তা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান নাও হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই দুর্বলচিত্তের। তারা একেবারেই সাদা-কালোর মত সুষ্পষ্ট বিষয়গুলো গ্রহণ করে এবং যে বিষয়গুলো কিছুটা ঘোলাটে সেখানেই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এই ধরণের লোকেরা সুষ্পষ্ট সমাধানের দিকে ঝুকে পড়ে- “অমুক মতবাদটি সঠিক এবং বাকি সব ভুলের আওতাভুক্ত” মনে করে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এখানে বিষয়গুলোতে ব্যক্তির ‘প্রকৃতি’ বিবেচ্য, কারণ কোন বিষয়ে ব্যক্তির গভীর ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ বিষয়টিতে তার নিজস্ব উপলব্ধি অনুযায়ীই হয়ে থাকে।
উদাহরণস্বরূপঃ সত্য কেবল একটাই।
ইসলাম সত্য।
সুতরাং ইসলামেরও কেবল একটি সত্যই বর্তমান।
তাত্ত্বিকভাবে বিষয়টি সত্য হলেও ইসলামী চিন্তাবিদেরা ধর্মীয় বিষয়গুলোতে এরকম মনোভাব পোষণ করেননি। অস্পষ্ট বিষয়গুলোতে তারা তাদের নিজস্ব অবস্থানের পাশাপাশি কিছুটা সংশয়- সন্দেহকেও বিবেচনার আওতায় রেখেছেন। যেমন ইমাম শাফে’য়ী রহিমাহুল্লাহ এর একটি উক্তিঃ
“আমার নিজস্ব মতামত সঠিক, তবে তা ভুলও হতে পারে। সেখানে অন্যান্যদের মতামত ভুল, কিন্তু সেগুলোও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।“
একইভাবে, ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ বলেছেনঃ
“আমরা আইনবিশ্লেষকেরা অনুভব করি যে, এটি কেবলই একটি মতামত, যদিও আমরা সর্বোচ্চ সঠিকভাবে এই মতেই উপনীত হতে পেরেছি। তবে কেউ যদি এর চেয়ে ভালো কোন মতামত খুঁজেপায়, আমরা তা গ্রহণ করব।“
এখানেই একজন চিন্তাশীল আর একজন আনাড়ি ইসলামিক ব্যক্তিত্বের মৌলিক ব্যবধান।
চিন্তা ও স্বভাবের প্রকৃতির এই ভিন্নতা সাহাবাদের ফিকহ প্রণয়নের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। ইবন আব্বাস (রাঃ) উদার মতামতের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনি বিষয়ের উদ্দেশ্যের দিকটিকে প্রধান বিবেচনা করতেন যেখানে ইবন উমার(রাঃ) এর দৃষ্টিভংগী ছিল আরো সতর্ক বিশ্লেষণ। অবশ্য এটা ভেবে নেয়া সঠিক হবেনা যে, এটি এর কারণ ছিলো কেবলই তাদের প্রকৃতিগত ভিন্নতা, বরং প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি ছিলো এর অন্যতম একটি কারণ। এই উপলব্ধিটুকুই আমাদের ধর্মীয় বিষয়গুলোতে মতবাদের ভিন্নতার কারণ অনুধাবনে সাহায্য করে। বিশেষ করে যখন আপনার থেকে ভিন্ন মতাবলম্বী কেউ বা কারা দাবি করে যে তাদের অবস্থান তথ্যের ভিত্তিতে অধিক জোরালো। এটা সত্য, তবে সেই দৃষ্টিতে যে অনুসারে তারা বিষয়টিকে বিবেচনা করছে।
সুতরাং মানুষকে তার নিজ নিজ ঘাট থেকে পানি পান করতে দিন এবং আপনি আপনার নিজ ঘাট থেকে পান করুন। অন্যদের জোর করে আপনার ঘাট থেকে পান করানোর দরকার নেই। কারণ আপনি জানেন যে, সবগুলো ঘাটেরই পানির উৎস ক্বুরআন ও সুন্নাহ নামক মহাসাগর। ফিক্বহ এর মাসয়ালা সংক্রান্ত মতভেদ এর মুখোমুখি হলে আমাদের অবস্থান এমনটাই হওয়া উচিত বলে মনে করি।
তাই কেউ যদি হানাফী মাযহাবের অনুসারী সংখ্যাগরিষ্ঠ কোন গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদেরকে রুকুর পর হাত উত্তোলনের পক্ষে সংশোধনী দিতে উদ্যত হয়, তা তার জন্য বোকামি ও অদূরদর্শীতারই পরিচায়ক হবে। এতে কেবল বিশৃংখলাই বাড়বে আর পারস্পরিক সম্প্রীতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
অবশ্যই, কিছু লোক থাকবে যারা নিজ ঘাটের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে পড়বে এবং সব ঘাট থেকে অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পানির ঘাটটি খুঁজে নেবে। কিন্তু এটি কেবলই ব্যতিক্রম, সাধারণের জন্য প্রযোজ্য নয়।
শেষতঃ আয়াতটির অনুধাবন আমাদের মধ্য থেকে ভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে নিয়োজিত মুসলিম ভাই-বোনদের কাজকে ছোট করে দেখার প্রবণতা দূর করবে। বহুবার আমি ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ভাইবোনদেরকে ইসলামী জ্ঞান অন্বেষণ ও চর্চাকারী ভাইবোনদের সম্পর্কে বলতে শুনেছি ‘তারা কিছুই করছেনা’। একইভাবে, জ্ঞান চর্চাকারীদের মধ্যেও নিজেদের গন্ডির মধ্যে আটকে থাকার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যাদের একটি উঁচু কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কিছুই নেই। এমনকি কখনো কখনো তাদের স্বর তাদের জ্ঞানের চেয়েও উঁচু হয়ে থাকে।
তাই এ বিষয়ে তর্ক এড়িয়ে আল্লাহকে খোঁজার জন্য যে বিভিন্ন পথ আছে, বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ একবার আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল আজীজ আল উমারী আল আবিদ এর কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন, যেখানে আব্দুল্লাহ মালিককে সাধারণ থেকে দূরে নির্জনে গিয়ে ইবাদত করার পরামর্শ দেন। ইমাম মালিক উত্তর দিয়েছিলেনঃ
“প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষের প্রকৃতির মতই তাদের কার্যাবলিকেও বণ্টন করে দিয়েছেন। তাই একজন মানুষ হয়ত সালাতে পারদর্শী, কিন্তু সাওমে পারদর্শী নয়। কেউ হয়ত বদান্যতায় পারদর্শী, কিন্তু তদ্রূপ সাওমে নয়। আবার কেউ জিহাদে পারদর্শী কিন্তু সালাতে নয়। জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান বিতরণ করা মানুষের উত্তম কাজগুলোর মধ্যে একটি এবং আমি আল্লাহর কাছে সন্তুষ্ট যে তিনি আমাকে এই বিষয়ে পারদর্শীতা দান করেছেন। আমি ভাবি না যে, আমি কেবল এটাই করছি কিন্তু আপনি যা (ইবাদত) করছেন তা আমি করছিনা। এবং আমি আশা করি আমরা উভয়ে উত্তম পথেই আছি। আল্লাহ যাকে যে দায়িত্বে নিযুক্ত করেন, তার উপর সন্তুষ্ট থাকাই তার দায়িত্ব। সালাম।“
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ইমাম মালিক আল্লাহকে পাওয়ার বিভিন্ন পথ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। কেবল মুহাম্মাদ(সাঃ)-ই সব বিষয়ে পুরোপুরি নির্ভুল ছিলেন এবং তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার ভিতর সবগুলো চিন্তাধারার মূর্ত প্রকাশ ঘটেছিল। আর তিনি নিজেই এ বিষয়টি শিখিয়ে গেছেন। যখন সাহাবারা প্রশ্ন করতেন ‘কোন প্রকার আমল সর্বোত্তম?’, তখন তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে তাদের প্রকৃতি ও অবস্থার ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরণের উত্তর দিতেন। এই জ্ঞানের সরাসরি প্রভাব দেখা যায় ইমাম মালিকের আচার-স্বভাবের মধ্যে যখন তিনি বলেছিলেনঃ
“এবং আমি আশা করি যে আমরা উভয়েই উত্তম পথে রয়েছি।“
তাঁরা চাইতেন বেশি বেশি মানুষকে বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করতে, সেখানে আজ অনেকেরই প্রবণতা মানুষকে বহির্ভূত করার। তাঁরা বিশ্বাসের বিশালতার স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন যেখানে আজ অনেকেই বিশ্বাসকে সরু গলি হিসেবে উপস্থাপন করার প্রয়াস পাচ্ছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের পূর্বপুরুষ ও তাদের অনুসারীদেরকে উপযুক্ত প্রতিদান দান করুন। শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক মহান নেতা ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)এর উপর।
ফুটনোটঃ
[১] সহীহ বুখারী
বিষয়: বিবিধ
১১৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন