ভাই, পৃথিবি সৃস্টির গল্পটা কি বলবেন ???????
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ৩০ জুলাই, ২০১৩, ১২:৫৯:১১ দুপুর
ভাই, পৃথিবি সৃস্টির গল্পটা কি বলবেন ১৷ কুরআনের আলোকে ২৷ বিজ্ঞানের আলোকে৷ এবং আমরা কোনটা সত্যি? কোনটা মানব?
বেশ বড়সড় একটা প্রশ্ন করে ফেলেছেন বন্ধু। সংক্ষেপে একটু ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করি।
প্রথমেই বলি- কুর’আন কিন্তু ভাই ধর্মের বই, বিজ্ঞানের বই নয়। জানি কথাটা এর আগে অনেকবার শুনেছেন, কিন্তু এর তাৎপর্য অনেক। যেকোন text- তা ধর্মীয় হোক বা না হোক- ব্যাখ্যা করতে গেলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস মাথায় রাখতে হয়, সেটা হচ্ছে তার সাহিত্যিক ধরণ বা literary genre. যেমন মনে করুন- রবিঠাকুর বুকের পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে মশাল জ্বেলে নিতে বলেছেন। এখন এই কবিতা পড়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে- আচ্ছা হাড় ভেঙ্গে আগুন জ্বালানো ব্যাপারটা কি খুব সায়েন্টিফিক? হাড়ে কি আগুন ভালমত ধরবে? পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গেলে মানুষ কি বাঁচতে পারে? তাহলে সে নেহায়েত বেআক্বেল। একইভাবে, কুর’আন যেহেতু ধর্মের বই, কাজেই এতে বৈজ্ঞানিক বিবরণ আশা করলে আপনাকে একটু আশাভঙ্গ হতেই হবে। ধর্মের বাণী সর্বসাধারণের বোধগম্য হতে হয়- কাজেই আপনি দেখবেন কুর’আনে সৃষ্টিতত্ত্ব, মায়ের পেটে বাচ্চার ডেভেলাপমেন্ট, পাহাড়-পর্বত-নদী-নালার বর্ণনা ইত্যাদি এসেছে সহজ সরল বোধগম্য ভাষায়, বৈজ্ঞানিক বর্ণনা আকারে নয়। এর কারণটা খুব সহজ- বিজ্ঞান শেখাতে কুর’আন আসেনি, কুর’আন এসেছে ধর্মশিক্ষা দিতে। তবে সেই ধর্মশিক্ষা দিতে গিয়ে কুর’আন প্রায়ই প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেছে, তাও নিতান্ত সহজ সাধারণ ভাষায়। অন্যভাবে বলতে গেলে- প্রকৃতি নিয়ে কথাবার্তা কুর’আনে এসেছে যাকে বলে incidental details হিসেবে, মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নয়। আপনার প্রশ্নের সাথে এই কথাগুলোর একদম সরাসরি রেলেভ্যান্স নেই, কিন্তু কুর’আনে “বৈজ্ঞানিক সত্য” অনুসন্ধানের আগে (তা যাই হোক না কেন) এই বেসিক কথাগুলো মাথায় রাখতে হবে।
যাইহোক, “কুর’আনের আলোকে পৃথিবী কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে?”
প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব সহজ নয়, কারণ ওপরে যেমনটা বললাম, কুর’আন ঠিক বিজ্ঞানের বই নয়, কাজেই সৃষ্টিতত্ত্ব সঙ্ক্রান্ত কথাবার্তা এখানে অতটা ডিটেইলে স্থান পায়নি। যেমন কুর’আনে সূরা আম্বিয়ায় এসেছে- আকাশ-পৃথিবী উভয়েই একসাথে ছিল, পরে এদেরকে পৃথক করে দেওয়া হল। আবার সূরা যারিআতে আল্লাহ বলেছেন- আমিই (আকাশের) সম্প্রসারণকারী। অন্যদিকে সূরা দুখানে আল্লাহ বলেছেন- আকাশ আর পৃথিবী সৃষ্টির শুরুতে ধোঁয়া হিসেবে ছিল (প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আক্ষরিক অনুবাদ না দিয়ে ভাবার্থটা দেওয়া হচ্ছে শুধু). আল্লাহ মহাবিশ্বকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন- এ ব্যাপারটা কুর’আনে একাধিকবার এসেছে।
দেখতেই পাচ্ছেন- সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাপারটা কুর’আনে খুব একটা সিস্টেম্যাটিকেলি আসেনি, এখানে ওখানে বিভিন্ন কনটেক্সটে, ধর্মশিক্ষা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো-টাকরা ইনফর্মেশান এসেছে।
বিজ্ঞানের আলোকে কীভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল? এর উত্তর নির্ভর করে আপনি “সৃষ্টি” বলতে কী বোঝাচ্ছেন তার ওপর। আপনার প্রশ্ন যদি এরকম হয়ঃ “শূন্য থেকে কীভাবে সবকিছু তৈরি হল?” এর উত্তর বিজ্ঞান জানে না। বিজ্ঞানের আওতা শুধু ম্যাটার আর এনার্জি পর্যন্ত, “শূন্য” বা nothingness এর ওপর বিজ্ঞানের আওতা নেই। কাজেই শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি- দার্শনিকরা যেটাকে বলেন creatio ex nihilo- এ ব্যাপারে বিজ্ঞানের কাছে প্রশ্ন করা যা, রাজনীতির কাছে প্রশ্ন করাও একই।
যাই হোক, শেষে আপনি বলেছেন, “কোনটাকে আমরা বিশ্বাস করব?” প্রশ্নটা শুনে মনে হচ্ছে আপনি একটাকে ছেড়ে একটাকে বিশ্বাস করতে চান- হয় ধর্ম নয় বিজ্ঞান। কিন্তু সেটার দরকার তখনই হবে যদি ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে আদৌ কোন কনফ্লিক্ট থাকে। কুর’আনে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার সাথে বিজ্ঞানের কোন কনফ্লিক্ট আমি দেখছি না।
ইন ফ্যাক্ট একদিন থেকে দেখলে দু’টোর মধ্যে মিল দেখতে পাওয়া যায়- কুর’আন বলছে আকাশ-পৃথিবী মিশে ছিল, বিজ্ঞানও বলে এই মহাবিশ্বে একসময় চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা কিছুই পৃথকভাবে ছিল না, বরং খুবই উত্তপ্ত আর ঘনসন্নিবিষ্ট অবস্থায় মিশে ছিল। পরে আস্তে আস্তে এর সম্প্রসারণ ঘটে, মহাবিশ্ব আরো শীতল হতে থাকে, গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি তৈরি হয়, আর তারই একটা গ্রহ আমাদের পৃথিবী। কুর’আন বলছে আল্লাহ আকাশের সম্প্রসারণকারী- এটা আল্লাহ পাস্ট টেন্সে বলেছেন না প্রেজেন্ট টেন্সে বলেছেন আমি বলতে পারছি না- কিন্তু বিগ ব্যাং থিওরীর মতে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল (কুর’আনের ভাষায় “আকাশ” মানে পৃথিবী ছাড়া ঐ চাঁদ-তারা-নক্ষত্রওয়ালা যা আছে তাই). কুর’আন বলে আকাশ-পৃথিবী একসময় ধোঁয়া ছিল, বিজ্ঞানের মতে মহাবিশ্বের একদম গোড়ার দিকে সকল পদার্থ একটা প্ল্যাজমা অবস্থায় ছিল- যেটা হচ্ছে গ্যাসের আয়নিত রূপ। আর ছয়দিনে বিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারটাও সহজেই অন্যভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়- কুর’আনে ব্যবহৃত “দিন” বা ইয়াওম কথাটার অর্থ ২৪-ঘন্টার দিন নাও হতে পারে। কাজেই কুর’আনের সৃষ্টিতত্ত্ব আর বিজ্ঞানের মধ্যে সেরকম কোন সংঘর্ষ দেখছি না।
উপসংহারে বিজ্ঞান-ধর্মের টেনশান নিয়ে দু’একটা কথা যোগ করতে চাই। খুব জেনারেলি বলতে গেলে- বিজ্ঞান কথাটার মানে হচ্ছে আরো ভালভাবে দেখা।
সৃষ্টি জিনিসটাকে আমাদের ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার একটা পদ্ধতির নাম বিজ্ঞান। আমাদের ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি-বিবেচনা কে দিয়েছেন জানেন তো? যে আল্লাহ কুর’আন পাঠিয়েছেন, তিনিই। কুর’আন আর বিজ্ঞান- দু’টোই আল্লাহর দান, কাজেই ইসলাম আর বিজ্ঞান- যদি তা সঠিকভাবে করা হয়- এ দু’টোর মধ্যে কনফ্লিক্ট বাঁধবে না কখনোই। যখনই দেখবেন ধর্মীয় কোন সত্য বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বা এরকম কিছু, তার মানে হয় বিজ্ঞানের ঐ তথ্যটা ঠিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই যথার্থ নয়, অথবা ইসলামের যেভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে সেটা ভুল। কাজেই কখনো ভাববেন না বিজ্ঞান ঠিক আর ইসলাম ভুল, বা ইসলাম ঠিক আর বিজ্ঞান ভুল। দু’টোই মানুষের কাছে আল্লাহর উপহার, আর দু’টোই ঠিক। এদের সম্পর্ক সম্পূরক বা complimentary- সাংঘর্ষিক বা contradictory নয়। আশা করি সংক্ষেপের মধ্যে গুছিয়ে বলতে পেরেছি। কি বলেন? না না না!!!!!!!!!
বিষয়: বিবিধ
২৪৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন