যে অন্ধত্ব চোখের নয়
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৩৪:৪৫ সকাল
কয়েক বছর আগের কথা। তখনও খুব একটা ‘প্র্যাক্টিসিং’ মুসলিম হইনি। অন্য সময় নামাজের ঠিক-ঠিকানা না থাকলেও শবে ক্বদরের মতো ‘স্পেশাল নাইট’ গুলোর বড় একটা অংশ ম
সজিদে কাটাতাম। অনেকটা জিটিভির (বাংলা নয়, হিন্দি চ্যানেলটার কথা বলছি) বিখ্যাত উইকেন্ড শো এর মত – ‘আজ কি রাত, তাহাজ্জুদ কি সাথ’ (শো অনুযায়ী তাহাজ্জুদ নয়, অমিতাভের সাথে রাত কাটানোর কথা)।
যাই হোক, সেরকম এক রাতে নামাজের মাঝে জিরিয়ে নিতে নিতে আঙ্গুল গুনে গুনে কিছু একটা পড়ছিলাম। এক আঙ্কেল এসে ঢুকলেন মসজিদে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘুম থেকে কোনমতে উঠে এসেছেন। রাত তিনটার মত বাজে, মানুষ আস্তে আস্তে বাসায় যাওয়া শুরু করেছে। মসজিদ তাই অনেকটাই ফাঁকা। আঙ্কেল ডাক্তার মানুষ, জীবনের একটা বড় সময় বিদেশে কাটিয়ে এসেছেন। চলাফেরাতে খানিকটা আভিজাত্যের ছাপ। আমার সামনে গিয়ে দাড়ালেন নামাজ পড়ার জন্য। হাত উঠাচ্ছেন কি উঠাননি, এমন সময় খেয়াল করলাম তার প্যান্ট টাখনু অতিক্রম করে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
মুহূর্তেই মাথার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল… বলব কি বলব না… বললে আবার কি না কি মনে করেন… না বললে উনি জানবেন কিভাবে… আমি তো আর জেনেশুনে তাকে এমন ভুল করতে দিতে পারি না! অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাড়ালাম। যতটা সম্ভব নম্র ভাষায় তার সাথে কথা বলা শুরু করলাম।
“আঙ্কেল…”, পিঠে আলতো করে হাত রেখে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম (আমার ধারণা ছিল পিঠে আলতো করে হাত রেখে কারো সাথে কথা বলা কোমলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়)।
আঙ্কেল ঘুরে তাকালেন।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আপনি সম্ভবত প্যান্ট বটতে ভুলে গেছেন”। নিজেকে অনেকটা মিনা কার্টুনের কূপ থেকে বের হওয়া দৈত্যের মত লাগল – “এই যে, ছোট্ট বন্ধু! তুমি মনে হয় সাবান দিয়ে হাত ধুতে ভুলে গেছ!”
আঙ্কেল যে রক্তচক্ষু দেখালেন, তাতে হিতাকাঙ্ক্ষী দৈত্য থেকে আবার একজন সাদামাটা মানুষ হয়ে গেলাম। “মানে? ”
সর্বোচ্চ রকমের ভদ্রতা দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, “না মানে আপনার প্যান্ট তো টাখনুর নিচে চলে গেছে। আপনি মনে হয় খেয়াল করেননি… হয়তো সবসময়ই দেখেন, আজ দেখেননি…”
“এই ছেলে, তুমি নিজেকে কি মনে কর, হ্যাঁ?”
“আমি তো শুধু…”
“তুমি জানো আমি সঊদী আরবে পাঁচ বছর ছিলাম?”
“জী জানি, কিন্তু…”
“কিন্তু কি? বেয়াদবি তো ভালই শিখসো দেখি”
“আমি তো বেয়াদবি করতে চাই নাই…”
“Five years, do you understand? Five years! ”
“ইয়েস, সরি।”
“নিজেকে কি মনে কর…?”
“সরি, সরি। আর বলব না…” রাগ, ক্ষোভ ও অপমানে মাথা হেঁট করে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলাম।
সাধারণত বাসায় কিছু বলি না, কিন্তু সেদিন আর সহ্য করতে পারলাম না। বাসায় বাবাকে বললাম। তার নির্বিকার চিত্ত দেখে মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। মাকে বললাম, বোনকে বললাম, কেউই পাত্তা দিল না। শেষমেষ এক বন্ধুকে বললাম ঘটনাটা। যা খুঁজছিলাম, ঠিক তাই পেলাম – সহমর্মিতা।
“মানে? উনি নিজেকে কি মনে করে?”
“সেটা আমি কেমনে বলব? কথাগুলা তো আরো ভালভাবেও বলা যাইত।”
“উনার কি এমনে বলার right আসে নাকি?” বন্ধুর কথায় আমার নিজেরই রক্ত গরম হয়ে ওঠার উপক্রম।
“আরে বুঝো না? ইগো, ইগো। বয়সে ছোট কারো থেকে কিছু জানলে তো যেন জাত চলে যাবে!”
“লোকটার তো বংশের নামই ‘কোরাইশী’। মক্কার কুরাইশদের মত ইগো তার থাকবে না তো থাকবেটা কার?”
“নিজের ছেলে তো ব্যান্ড আর গান-বাজনা নিয়ে থেকে পড়ে থাকে। আর আমারে বলে বেয়াদব…”
দুজন দুজনের কথায় সম্মতি জানাতে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালাম।
এর প্রায় বছরখানেক পর ধর্ম-কর্ম শেখার ব্যাপারে আগ্রহ জন্মালো। বিভিন্ন কোর্স আর লেকচারে আসা-যাওয়া শুরু করলাম। গত বছর করলাম নামাজ নিয়ে একটা কোর্স। নামাজের রুকন (অবিচ্ছেদ্য অংশ – যা ছাড়া নামাজ হবে না) ও ওয়াজিব (অবশ্যই করনীয়) ব্যাপারগুলোর লিস্ট শিখলাম। আরো শিখলাম যে এর বাইরে সবই ঐচ্ছিক, অর্থাৎ সেগুলোর জন্য নামাজের বৈধতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠবে না। মনে মনে চিন্তা করে দেখলাম, ওই আঙ্কেলের নামাজ তো তার মানে ঠিকই ছিল। চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
এরও কিছুদিন পর জানলাম যে, কিছু ‘আলেমের মত অনুযায়ী টাখনুর নিচে কাপড় যাওয়াটা কোন সমস্যা না, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটা দাম্ভিকতার পরিচায়ক না হয়। আমি মানি আর না মানি, অন্যরা যদি পড়াশোনা করে বুঝে-শুনে কোন ‘আলেমকে দলীলের ভিত্তিতে মানে, সেখানে আমি মাথা ঘামানোর কে? আঙ্কেলের ঘটনাটা নিয়ে আরেকটু ‘কেমন যেন’ লেগে উঠল। বিনা কারণে কতগুলা কথা শুনলাম!
আমার denial এর কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল শাইখ ইবন তাইমিয়্যার একটি উক্তিঃ
“কেউ যখন আমাকে অপমান করে, আমি সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি উপহার মনে করি। তিনি আমাকে এর মাধ্যমে নম্রতা শেখাচ্ছেন।”
চিন্তা করে দেখলাম, ওই আঙ্কেলের ইগো প্রব্লেম আছে কিনা তা তো আল্লাহই ভালো জানেন। কিন্তু আমার যে ইগো কন্ট্রোল করতে শেখা প্রয়োজন, এ ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই! তিনি যদি আমাকে অপমান করেও থাকেন, আমি নিজেও কি খুব ভালো কিছু করেছি? বন্ধুর কাছে তার ব্যাপারে কটুক্তি করা, সেটা কি গীবতের১ মত মারাত্মক কবিরা গুনাহের মধ্যে পড়ে না? তার ছেলেকে নিয়ে যে বিনা কারণে নাক সিঁটকালাম, এর জন্য কি হাশরের ময়দানে আমাকে জবাবদিহি২ করতে হবে না?
গত মাস থেকে ব্যাপারটা আরো বেশি অস্বস্তিকর হয়ে উঠল, যখন দেখলাম আঙ্কেলের সেই ছেলেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করছে। গান-বাজনা তো ছেড়ে দিয়েছেই, এখন আরো উল্টো মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার মহান কাজ করছে। যে বন্ধুর সাথে একসাথে দাঁড়িয়ে কটুক্তি করলাম, সে তো দেখে পুরোই অবাক। দুজনই প্রচন্ড খুশি হলাম ছেলেটির এই পরিবর্তন দেখে, কিন্তু আমার বুকের বাঁ পাশটিতে যে ব্যাথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করলো, তা নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখলাম।
এই অশান্তি নিয়েই দিন কাটতে লাগল। আঙ্কেলের সাথে প্রায়ই দেখা হয়, সালাম দেই। তিনিও জবাব দেন। হয়তো সেদিনের সেই কথোপকথনের কথা ভুলেই গেছেন। কিন্তু আমার মন থেকে তো তা এত সহজে মুছে যাবার নয়। মনে মনে ছক কষলামঃ
ঠিক ছিল – সঠিক উদ্দেশ্য নিয়েই আঙ্কেলকে শুধরাতে চেয়েছিলাম। যথাসম্ভব নম্র ব্যবহার করেছিলাম। (অনেক চেষ্টা করেও আর কোন পজিটিভ দিক খুঁজে পেলাম না)
ভুল ছিল – ভাল মত না জেনেই, কোন পড়াশোনা ছাড়াই একটা ব্যাপার বোঝাতে গিয়েছিলাম। তার আচরণ মনে যে আঁচড় কেটেছিল, তা দিয়ে নিজেকে বারবার বিনা কারণে ক্ষত-বিক্ষত করেছি। শুধু একটু সহমর্মিতার জন্য মানুষের কাছে ঘটনাটি বলে বেড়িয়েছি। যখন সহানুভূতিশীল কাউকে পেলাম, তখনই সব খারাপ মন্তব্য করা শুরু করলাম – দাম্ভিকতার অভিযোগ করলাম, যে ছেলের সাথে আমার কখনো কোন সমস্যাই ছিল না, তাকে নিয়েই কটুক্তি করলাম। যেন একটু নামাজ পড়ে আমি নিজে খোদাভীরুতার একজন জ্বলন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছি। অথচ সেই ছেলেকেই এখন মসজিদের প্রথম কাতারে পাওয়া যায়, আর সেখানে আমার ডেডিকেশনের ব্যাপারে কিছুই না-ই বলি।
নিজেই ঘটনাটার একটা পোস্ট-মরটেম করলাম। রিপোর্ট থেকে উপলব্ধি করলাম, অন্যের কাপড়ের প্রতীয়মান ময়লা নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে নিজের ভেতরটাই যে কতটা কলুষিত হয়ে গেছে, তা নিয়ে কোন ধারণাই ছিল না। নিজের দাম্ভিকতার ব্যাপারেই ছিলাম অন্ধ ।
ফুটনোটঃ
১। http://www.quraneralo.com/gibot/
২। আল্লাহর নবী ﷺ তাঁর সাহাবীদের একবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জানো দেউলিয়া কারা? তারা বললেন, দেউলিয়া হলো তারা যাদের কোন প্রকার অর্থ কিংবা মালামাল নেই। রসুলুল্লাহ ﷺ তখন বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে দেউলিয়া হলো তারা, যারা কিয়ামতের দিন নামায, রোজা ও যাকাত নিয়ে আসবে কিন্তু তারা হয়তো কাউকে অপমান করেছিল, কাউকে অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ লুট করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল বা কাউকে মেরেছিল। যাদের উপর এরূপ জুলুম করা হয়েছিল, তাদেরকে জালেমদের ভালো কাজগুলো দিয়ে দেয়া হবে। সবকিছু মিটমাট হওয়ার আগেই যদি জালেমদের ভালো কাজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে নির্যাতিতদের খারাপ কাজগুলো জালেমদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তারপর তাদের জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।
- সহীহ মুসলিম, ৪৬৭৮ [ইংরেজী অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত; ওপরে ভাবার্থটি লেখা হয়েছে]
বিষয়: বিবিধ
২০৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন