গভীর রাতে একটি মেয়ের কাছে একটি ছেলের ফোন কল?
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ২৮ জুলাই, ২০১৩, ০৯:৩৯:৫৯ সকাল
রাত একটা বাজে। চোখে ঘুম নেই। উপন্যাস পড়ছি, মিসির আলির চশমা।
হঠাৎ সেলফোন বেজে উঠলো। তুলে দেখি অচেনা নম্বর। অচেনা নম্বর থেকে ফোন মানেই ভাঁওতাবাজি হবার একটা বিরাট সম্ভাবনা, বিশেষ করে সেই ফোন যদি আসে রাত বিরাতে। কলেজে ওঠার পর থেকেই এই ফোন ব্যবহার করছি, এখন তো গ্র্যাজুয়েশানও শেষ। এতদিনে নানা রকম বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, শিক্ষাও হয়েছে অনেক। যেমন একবার এক অপরিচিত কল ধরলাম। হ্যাঁ, আমি জানি, অপরিচিত ফোন ধরার থেকে বুড়িগঙ্গার নোংরা পানিতে ডুবে মরাটা বেশি আকাঙ্খিত, কিন্তু সেটা বোঝার জন্যই হয়ত ওই অভিজ্ঞতাটার প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, অপর দিক থেকে তখন কর্কশ গলা শুনা গেলো -
“তোমায় দেখলে মনে হয়।”
মুহূর্তেই মেজাজ গেলো চড়ে।
“হাজার বছর তোমার সাথে ছিল পরিচয় –”
“থাবড় চিনস?”
কী আর বলব, এই অপমানেরও সাধ্য নেই সেই মহান গীতিকারকে দমাবে। মিসকলের জ্বালায় ফোন সারাদিন চার্জে রাখতে হল। রাতে ভাইয়া এসে হেভি বিরক্ত চেহারা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী রে, সারাটা দিন তোকে ফোন করে পাওয়া যায়না কেন?”
“আর বোলো না ভাইয়া, এক বেকুব তখন থেকে মিসকল দিয়ে যাচ্ছে।“
শুনেই ভাইয়ার মুখ টকটকে লাল, মনে হচ্ছে এখনই ফেটে পড়বে। আমার উপর না ফাটলেই হয়।
“ফোনটা আমাকে দে, আর কানে আঙ্গুল দে।”
“কেন?”
“দে বললাম!”
কথা না বাড়িয়ে তাই করলাম, তারপর হাঁ করে ভাইয়ার সাউন্ডলেস বিস্ফোরণ দেখে গেলাম, প্রথম যুগের বাক্যহীন চলচ্চিত্রের মতো।
যাই হোক। তো এতো আজগুবি অভিজ্ঞতার পরও কেন জানি সেদিন রাত একটায় সেই ফোনটা ধরলাম।
“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে কেমন যেন একটা শব্দ আসছে। কিছুটা কুকুরের কান্নার শব্দের মতো। আমি আবার বললাম,
“হ্যালো?”
কয়েক সেকেন্ড পর একটি ছেলে ওপাশ থেকে জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিলো, “প্লিজ…”
কেন যেন বুক কেঁপে উঠলো। একটা শব্দের মধ্যে দিয়ে যে এতো অনুভূতি প্রকাশ পেতে পারে, আগে কখনও বুঝিনি।
“প্লিজ, ফোন রাখবেন না…দয়া করে…”
আবার কুকুরের কান্নার মতো শব্দ। বুঝলাম সেই শব্দ ছেলেটির মুখ থেকে বের হচ্ছে।
“আমি আপনাকে… আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। আমাকে একটু সময় দিন। আপনি আমাকে চেনেন না, আমিও আপনাকে চিনি না। চিনিনা দেখেই আপনাকে বলতে চাচ্ছি… I want to… I want to kill myself… আমি আর বাঁচতে চাই না, বাঁচতে চাই না!”
মেয়েদের মন নরম হয় সেটা সবাই জানে, আর তাই সেটার সুযোগ নিতেও ফোনি (phoney) রা নানাভাবে চেষ্টা করে। এসব বিবেচনা করলাম। কিন্তু আমি স্বভাবতই বিবেচনার থেকে বেশি প্রাধান্য অন্য একটা জিনিসকে দেই – ইনটিউশান।
“হুম। বাঁচতে চান না?”
“না।”
“ভুল। আপনি বাঁচতে চান। এই যে আপনি আমাকে ফোন দিয়েছেন, এতেই বোঝা যায় আপনি বাঁচতে চান। হয়তো অনেক কষ্ট হচ্ছে বাঁচতে, আর পারছেন না। স্রোতে ভেসে যাচ্ছেন। তাই মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু একটা খুঁজছেন।“
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছেলেটি বলল, “হয়তো ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপু, আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বেঁচে থাকতে? আর সহ্য হচ্ছে না, মনে হচ্ছে কেউ আমার বুকে ছুরি দিয়ে খোঁচাচ্ছে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন! আমি বাড়িয়ে বলছি না, ঠিক সেরকমই লাগছে।“
কান্নার শব্দ শুনলেই কেমন যেন লাগে। বিশেষ করে ছেলেদের হাউমাউ করে কাঁদতে শুনলে খুব বড় রকমের ধাক্কা লাগে, মনে হয় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি।
“আমি আছি এখানে, যখন ইচ্ছা হয় আমাকে বলতে পারেন, কী হয়েছে।“
মিনিট পাঁচেক পর কান্না থামল।
“আমার অনেক দিন ধরেই এরকম হচ্ছে। প্রায় ছোটবেলা থেকে। কখনও কাউকে বলতে পারিনি। কিন্তু আজকে কেন যেন মনে হচ্ছে আর নিতে পারছি না, মনে হচ্ছে বুকটা ফেটে যাবে …
আজকে আম্মু আব্বুর বিয়ের বার্ষিকী ছিল, আব্বু আম্মুকে স্পেশাল ট্রিট দিয়েছে, দুপুরে বাইরে খেতে নিয়ে গেছে, গিফট দিয়েছে। তারপর রাতে বাসায় পার্টি হয়েছে। এগুলোর জন্যই আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। …
কি পাগলের মতো কথা তাই না? এতো খুশির দিনে আমি এভাবে ডুকরে কাঁদছি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আসলে অসুস্থ, পাগল।”
“কেন কান্না পাচ্ছে?” আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি জানি না আপু। ওদেরকে খুশি দেখলে আমার খুব কষ্ট লাগে। কেন জানো? এসব কথা আমি আগে কাউকে বলিনি। জানো আপু, আমার কোন বন্ধু নেই, এমন কেউ নেই যাকে মন খুলে মনের কষ্টগুলো দেখাতে পারবো। আমি খুবই একা আপু, সারাজীবন একা ছিলাম, একা থাকবো। কারণ আমাকে কেউ বুঝবে না আপু। জানো, সব মানুষ কেমন স্বার্থপর, সব্বাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তার পাশে যে একটা মানুষ ভিতরে ভিতরে পচে যাচ্ছে সেটা দেখার চোখ কারো নেই… আমাকে অনেকেই বন্ধু ডাকে, অনেকেই আমার সাথে মিশে, তাও আমি এতো একা কেন? জানো আপু, যত মানুষ আমার সাথে মিশে, আমার ততই একা লাগে। কোন পার্টি বা অনুষ্ঠান হলে, সেদিন আমি ঘরে লুকিয়ে কাঁদি, মুখে বালিশ চেপে, যাতে কেউ না শুনতে পায়…
আর তখনই আমার মনে পড়ে সেই বীভৎস স্মৃতি গুলো। সেই – ”
Call Disconnected.
বুঝলাম না কী হল। হয়তো আবার ফোন দেবে সে, সেই ভেবে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
আধ ঘণ্টা চলে গেছে, খুব অস্থির লাগছে। কী হল ছেলেটার? কিছু করে বসল না তো? না না! হতে পারে ওর টাকা শেষ। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিলাম। ডায়াল করে কানে ধরলাম।
চিৎকারের শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে তার বুক চিরে বের হচ্ছে এই অমানুষিক কান্না।
“ভাইয়া, আপনি শান্ত হন, আমি আছি এখানে। কোথাও যাব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি এসব কথা বলতে থাকলাম। আমার কথা শুনে আস্তে আস্তে সে শান্ত হল।
“থ্যাঙ্ক ইউ… থ্যাঙ্ক ইউ… আমি সত্যিই মরে যেতাম। মনে হচ্ছিলো কী জানেন? আল্লাহ চায় যে আমি মরে যাই, তাই ফোনটা ওভাবে কেটে গেলো। আর মনে হচ্ছিলো আমি আমার মায়ের চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, যেভাবে ছোটবেলায় শুনতাম। আমার বাবা অ্যালকোহলিক ছিল। প্রতিদিন রাতে লাইব্রেরিতে বসে ড্রিঙ্ক করত, তখন সে ঘরে কেউ যেতে ভয় পেত, কারণ মাতাল হলে তার মাথা ঠিক থাকত না। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে সেই সময়গুলোতে ঝগড়া হতো। খুব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে। হয়তো সেদিন সকালে মা তার ফোন ধরেনি। এই অপরাধটার কথা তখন মদ খেতে গিয়ে তার মনে পড়ত, আর তারপর মাকে এটা নিয়ে জেরা শুরু করত। আর তারপরই মারধরের আওয়াজ। আমি আমার ঘরে খাটের নিচে লুকিয়ে কানে হাত দিয়ে থাকতাম। তাও শোনা যেত… মায়ের চিৎকার… উফ!! আল্লাহ!! আমি মরে যেতে চাই! মরে যেতে চাই!!”
আমি স্তম্ভিত। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। শুধু যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, ছোট্ট একটা বাচ্চা, খাটের নিচে লুকিয়ে, কানে হাত দিয়ে থরথর করে কাঁপছে।
“কেউ জানে না, মা-ও না, আমার তখন কেমন লাগতো। মা কে কক্ষনো বলিনি। যখন মা একা একা ওই অবস্থাতেই বসে কাঁদত, তখন আমি কখনও তাঁর সামনে যাইনি। আমি অভিনয় করতাম, যে আমি কিছুই জানি না। মা এসে দেখত আমি ঘুমুচ্ছি।“
“এতোকিছু কী করে চেপে রাখতে পারে একটা মানুষ, ভাবতে পারছি না। এভাবে একা একা এতদূর কীভাবে এসেছেন? আশ্চর্য শক্তি আপনার।“
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। “আমি কখনও এভাবে ভাবিনি, আমি তো নিজেকে অনেক দুর্বল মনে করি। দুর্বলরাই তো এভাবে ভেঙ্গে পড়ে, এভাবে কাঁদে, তাই না?”
“কান্না দুর্বলতার পরিচয়, এই কথাটা ভুল। সব মানুষের বোঝা নিতে পারার একটা লিমিট আছে। আপনার লিমিটটা সাধারণ মানুষদের থেকে অনেক বেশি। কিন্তু তাও, এক জায়গায় এসে আপনি থমকে দাঁড়িয়েছেন। আর নিতে পারছেন না। এই অবস্থায় কান্না করাটা দুর্বলতা না, বরং এই কান্নাই প্রমাণ করে যে আপনি অনেক কাল ধরে প্রবল শক্তির পরিচয় দিয়ে চলেছেন।”
কথাগুলোকে সে খুঁটিয়ে দেখছে বুঝতে পারলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“আপনার কথা শুনে মনে হল অনেকটুকু বোঝা মন থেকে সরে গেছে। আমি জানি না কীভাবে এতকিছু আপনাকে বললাম, কেন যেন আপনাকে খুব আপন লাগছে। জানেন, আমি কখনও ভাবতে পারিনি আমাকে কেউ এভাবে বুঝবে। এই কথাটা চিন্তা করেই মনটা হালকা হয়ে যাচ্ছে।”
“আপনার ভাষায় বলি, হয়তো আল্লাহ চান যে আপনি বেঁচে থাকেন, তাই আমার নম্বরটা এভাবে লেগে গেলো।”
“আল্লাহ যদি তাই চান, তাহলে ওই ছোট্ট বয়স থেকে কেন এতো ব্যথা দিয়ে আসছেন আল্লাহ আমাকে? কেন আমার জীবনে এতো কষ্ট দিয়ে ভরে রেখেছেন? আমি কী অপরাধ করেছি?”
“আপনার জীবনে এতো কষ্ট কেন দিয়েছেন সেটা আমি কী করে জানবো? সেটা তো আপনার জানার কথা। তবে আমার জীবনে কেন আল্লাহ এতো কষ্ট দিয়েছেন, সেটা মনে হয় আমি কিছুটা জানি।“
“আপনারও কষ্ট… কেন দিয়েছেন?”
“হয়তো… আপনার জীবনটা বাঁচানোর জন্য?”
“মানে?”
“আমিও ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। আপনার মতো আমারও কোন বন্ধু ছিল না, কষ্টগুলোকে তাই অনেক তীব্রভাবে অনুভব করতাম। ওই প্রবাদটা জানেন তো? What doesn’t kill you only makes you stronger. আল্লাহ চান আমাকে শক্তিশালী করতে। এসবের কারণে আমি মানুষকে দরকারের সময় সাপোর্ট দিতে পারি। আমি মানুষের কষ্টগুলো খুব সহজে বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি। অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। এটা পারতাম না যদি আমি নিজে এতো কষ্টভোগ না করতাম। আপনি অন্যকে ততদূরই পথ দেখাতে পারবেন যতদূর আপনি নিজে হেঁটে এসেছেন।”
“আপু, আপনার মতো মানুষ আমি কোথাও দেখিনি।”
“আমি দেখেছি। আমার মতো একজন মানুষ এখন আমার সাথে ফোনে কথা বলছে।”
“… আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।”
“আপনি খুব শক্তিশালী। জীবনের এতো কষ্ট আপনাকে ভাঙতে পারেনি, বরং আরও শক্তিশালী করেছে। এই ব্যাপারটা আপনি হয়তো এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে যে এই কষ্টগুলোর আপনার জীবনে দরকার আছে। আপনি যাতে আল্লাহকে চেনার চেষ্টা করেন, সেই জন্যই আল্লাহ আপনাকে কষ্ট দিচ্ছেন।
আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন, তাদেরকেই কষ্ট দেন।১ যার মর্যাদা যত বেশি, তাঁর কষ্টও তত বেশি, আর তাই নবী রসূলদের জীবনী পড়লেই দেখবেন, তাঁরাই সবচাইতে বেশি কষ্ট করেছেন। ইউসুফকে ছোটবেলায় তাঁর নিজেরই ভাইয়েরা কুয়াতে ফেলে দেয়। তারপর অনেক বছর তাঁকে প্রথমে ক্রীতদাস হিসেবে, তারপর বিনা অপরাধে জেলের কয়েদি হিসেবে জীবন কাটাতে হয়। ইব্রাহিমকে তাঁর বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেন। তাঁদের সকলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
মুহাম্মদ ﷺ এতিম হয়ে বড় হন। নবুয়্যাতের পরে তাঁর নিজের আত্মীয় স্বজনরাই তাঁকে তিরস্কার, অপমান করেন, এমনকি তাঁর ছোট্ট শিশু মারা যাবার খুশিতে তাঁর নিজেরই চাচা ও প্রতিবেশী আবু জাহল উল্লাসে মেতে উঠে। একইভাবে ঈসাকে তাঁর নিজের লোকেরা অনেক যন্ত্রণা দেন, শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলার চেষ্টা করেন।
এনারা সবাই অনেক দুঃখ সহ্য করেছেন, কিন্তু কখনও অভিযোগ করেননি, কারণ তাঁরা জানতেন যে এই কষ্টই আসলে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। এই কষ্ট আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পৃথিবীটা আসলে জান্নাত নয়, বরং জান্নাতে পৌঁছানর উপায় মাত্র। পৃথিবীতে আমরা ক্ষণিকের পথিক, আর এই ক্ষণিকের মধ্যেই আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে আমরা জান্নাত পাবার উপযোগী । সেইজন্য ওই কষ্টগুলো খুব দরকারি।
আরেকটা ব্যাপার কী জানেন? এই কষ্টগুলোই আমাদেরকে শেখায় সুখকে তৃপ্তি নিয়ে উপলব্ধি করা, কেননা শুধুমাত্র সে-ই পানির আসল স্বাদ বুঝবে যে তৃষ্ণার্ত।”
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার (আল্লাহ সবকিছুর ঊর্ধ্বে…)
চুপ করে ফজরের আজান শুনলাম দু’জনে। মনটা অন্যরকম এক প্রশান্তিতে ভরে গেলো। ঝড়ের পরে প্রকৃতিতে যেরকম প্রশান্তি আসে ঠিক সেরকম।
“আমার মনে হচ্ছে, বৃষ্টি শেষ হয়ে আমার মনের আকাশে রোদ উঠেছে। সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার, স্পষ্ট, সুরভিত, শীতল… আপু, আমি এখন রাখছি। আমি ঠিক করেছি ফোন রেখেই আপনার নম্বরটা ডিলিট করে দিবো।”
নামহীন সেই ছেলেটি আবার কাঁদছে। কিন্তু এবারের কান্নাটা অন্য রকম। এই কান্না অসহ্য কষ্টের কান্না নয়, বরং কৃতজ্ঞতার, পরিতৃপ্তির, কিছুটা গৃহীত বেদনার কান্না।
“আপু, তোমাকে আমি কোনদিনও ভুলতে পারবনা… ভালো থেকো।”
ফজরের নামাজের পর জায়নামাজে বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছি। অন্ধকারের সাথে আলোর যুদ্ধ। চারিদিকে পাখিরা জেগে উঠছে। অদ্ভুত সুন্দর, শান্তিপূর্ণ, এবং একই সাথে দ্রুত রূপান্তরের সময়। নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, এবং রাত ও দিনের সংঘর্ষে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল মানুষের জন্যে।২
মনটা কেমন উদাসীন হয়ে আছে। নাম না জানা ছেলেটির কথা খুব মনে পড়ছে। সেই সাথে মনে পড়ছে বিশ্বনবীর ﷺএকটি উক্তি –
যেই ব্যক্তি তাঁর (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন পূ্রণ করবে, আল্লাহ তাঁর প্রয়োজন পূরণ করবেন। এবং যে একজন মুসলিমের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাঁর কষ্ট দূর করবেন।৩
“ইয়া রাব্বি, হে আমার প্রভু, আমি তোমাকে খুশি করার জন্যে তোমার এক বান্দার কষ্ট দূর করেছি। তুমি আমার এই ইবাদতটি কবুল করে নাও।“
যদি কেউ একজনের প্রাণ রা করে তবে সে যেন গোটা মানব জাতিকেই বাঁচিয়ে দিলো…৪
***
উপসংহার
সাগর বাসার কলিং বেল চাপল। ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, আজ ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। বাবা এসে দরজা খুলে দিলেন, তারপর নিজের ঘরে ফিরে যেতে লাগলেন। সাগর ডাক দিলো, “আব্বু।”
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না শফিক সাহেব। কয়েক বছর হয়ে গেছে সাগর তাঁর সাথে কথা তো দূরের কথা, তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না। এর কারণও তিনি জানেন। তাঁর অতীতের কিছু ভুল অভিশাপ হয়ে তাঁকে এভাবেই ধাওয়া করছে। তিনি চেষ্টা করেছেন সেগুলোর প্রায়শ্চিত্ত করার, ক্ষমা চাওয়ার। তাঁর স্ত্রী তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু সাগর…
“আব্বু, একটু শুনবে? একটা সুখবর আছে, আমি চাকরি পেয়েছি!” বলে হেসে বাবার কাছে গেলো সাগর।
“ইয়ে… খুব ভালো কথা বাবা।” শফিক সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন, বুঝতে পারছেন না কী করবেন। সাগরও বাবার অবস্থা বুঝতে পারছে। খুব নরম করে সে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করবে না বাবা?”
ছেলের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন শফিক সাহেব। দু’ ফোটা পানি আস্তে করে গড়িয়ে পড়লো গাল দিয়ে। তারপর কান্নার স্রোত ঝরঝর ঝরতে লাগলো।
বাবাকে বুকে জড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ কেঁদেছে সাগর। কাল রাত থেকেই ওর কান্নার পালা চলছে, কিন্তু এক এক বার কান্নার স্বাদটা ছিল একেক রকম।
আপু, তোমাকে আমি কোনদিন ভুলবো না।
ফুটনোটঃ
১/ The Prophet ﷺ said, “When Allah loves a servant, He tests him,” [Tirmidhi]
২/ সুরাহ আলি ইমরান ৩:১৯০
৩/ বুখারি ও মুসলিম উভয় হতে বর্ণিত।
৪/ সুরাহ মা’ইদা ৫:৩২
Suicide prevention resource: http://www.shuni.org/
এখানে ছেলে মেয়ে ফোনে কথা বলা দিয়ে কিছু পয়েন্ট হাইলাইট করা হয়েছে, যেমনঃ
১/ একজন অপরিচিত ছেলে আর মেয়ের মধ্যে ফোনে যে শুধু অশ্লীল সম্পর্কই হতে পারে এই ব্যাপারটাকে রিফিউট করা হয়েছে। এই গল্পে অত্যন্ত শালীনভাবে দুজন কথা বলেছে। ফোনে কথা বলা পর্দার আড়ালে কথা বলার মতো, কারণ এখানে একটা barrier কাজ করে। এবং তারা কোন খেজুরে আলাপ করেনি, তারা শুধু দরকারী কথা বলেছে, কথা শেষ হবার পর ছেলেটা মেয়েটার নম্বর ডিলিট করে দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আর কথা না হয়। এর পরেও কি কোন “normal” মানুষ এখান থেকে ভুল মেসেজ পাবেন?
২/ ছেলে আর মেয়ে একজন অপরজনের আওলিয়া, মানে helper। এটা আমি বলিনি, আল্লাহ বলেছেনঃ The believing men and believing women are allies of one another. They enjoin what is right and forbid what is wrong and establish prayer and give zakah and obey Allah and His Messenger. Those – Allah will have mercy upon them. [সুরা তাওবা, আয়াত# ৭১]
৩/ ফ্রি মিক্সিং জিনিসটা অনেক খারাপ এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু তার মানে কখনো এই না যে একজন ছেলেকে আমি মারা যেতে দেখব অথচ তাকে বাঁচাতে যাব না, শুধুমাত্র আমার পর্দা নষ্ট হবে এই ভয়ে। আমরা হলাম middle nation, আমরা কোন extreme এ যাই না, সবসময় মধ্য পথ বেছে নেই। এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন। http://www.suhaibwebb.com/relationships/gender-relations/co-ed-love-for-the-sake-of-allah/
এই আর্টিকেলে আমি কি মেসেজ দিতে চেয়েছি আশা করি এখন বোঝা গেছে। জাযাকুমুল্লাহু খাইরান।
ফোনে কথা বলাকে সরাসরি খালওয়া (seclusion) হিসাবে ঘোষণা দেয়া যাবে না, কারণ এর সাথে অনেক fiqh ruling জড়িত। অবশ্য কারণ ছাড়া মধ্যরাতে কথা বলা শোভনীয় না সেটা সবাই মানবে। শেখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ, যিনি freemixing এর ব্যাপারে অনেক কড়া, ওনার একটি ফাতওয়াতে বলেছেনঃ “There is no reason why a woman should not work if she is with other women like her, or she is alone and answers calls from customers or calls them to offer the company’s products, so long as she observes proper etiquette when speaking and does not speak in an alluring tone to men” http://islamqa.info/en/ref/60221/phone%20men%20women
ফোনে কথা বলা যদি খালওয়া হতো তাহলে আমাদের জীবন অনেকটা কঠিন হয়ে যেত। কোন nonmahram পুরুষকেই ফোন করতে পারতাম না, স্যারের কাছে ক্লাসের সময় জানতে পারতাম না, pizza order দিতে পারতাম না। অথবা এসব করার সময় সব সময় ভাই বাবা কাউকে সামরে বসিয়ে রাখতে হতো। তাই না?
বিষয়: বিবিধ
১১৪৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন