পবিত্র রমজানে জামাত সিলেবাসের প্রথম অংশ
লিখেছেন লিখেছেন সত্য নির্বাক কেন ১৩ জুলাই, ২০১৩, ১০:৫৩:৪৪ সকাল
পবিত্র রমজান মাসে সম্ভব হলে পুরো কুরআন অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। কমপক্ষে আতœগঠনের এ মাসে নিম্নোক্তরুপে কুরআন হাদীস ও ইসলামী সাহিত্যগুলো পাঠ করবেন:
১। আল-কুর’আন ঃ সূরা আল বুরুজ, সূরা আনকাবূত-১ম রুকু, সূরা আসসফ, সূরা ওয়াকিয়া, সূরা তাকাসুর,
সূরা আল আসর ও সূরা আল কদর ;
২। হাদীস ঃ আখিরাত, সিয়াম ও চরিত্র গঠন সংক্রান্ত অধ্যায় ;
৩। সাহিত্য ঃ কুরআন রমযান তাকওয়া, নামায রোযার হাকীকত, জীবন্ত নামায, রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন ,
হেদায়াত ও ইসলামী আন্দোলন: সাফল্যের শর্তাবলী ;
৪। তা’লীমুল কুর’আন ঃ সহীহ তেলাওয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা করা ;
৫। আল-কুরআনের বাছাই করা আয়াত ও হাদীস মুখস্থ করা।
আল বুরুজ
ভূমিকা নামকরণ
প্রথম আয়াতে আরবী -------- শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নায়িলের সময় -কাল
এর বিষয়বস্তু থেকেই একথা সুম্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে,এ সূরাটি মক্কা মুয়ায্যমায় এমন এক সময় নাযিল হয় যখন মুশরিকদের জুলুম নিপীড়ন তুংগে উঠেছিল এবং তারা কঠিনতম শাস্তি দিয়ে মুসলমানদের ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছিল।
বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য
এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে,ঈমানদারদের ওপর কাফেররা যে জুলুম করছিল সে সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করা এবং ঈমানদারদেরকে এই মর্মে সান্ত্বনা দেয়া যে, যদি তারা এসব জুলুম -নিপীড়নের মোকাবিলায় অবিচল থাকে তাহলে তারা এর জন্য সর্বোত্তম পুরস্কার পাবে এবং আল্লাহ নিজেই জালেমদের থেকে বদলা নেবেন।
এ প্রসংগে সর্বপ্রথম আসহাবুল উখদূদের (গর্ত ওয়ালাদের )কাহিনী শুনানো হয়েছে । তারা ঈমানদারদেরকে আগুনে ভরা গর্তে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল। এ কাহিনীর মাধ্যমে মু’মিন ও কাফেরদেরকে কয়েকটি কথা বুঝানো হয়েছে । এক, গর্তওয়ালারা যেমন আল্লাহর অভিশাপ ও তাঁর শাস্তির অধিকারী হয়েছে তেমনি মক্কার মুশরিক সরদাররাও তার অধিকারী হচ্ছিল। দুই, ঈমানদাররা যেমন তখন ঈমান ত্যাগ করার পরিবর্তে আগুনে ভরা গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে জীবন দেয়াকে বেছে নিয়েছিল , ঠিক তেমনিভাবে এখনও ঈমানদারদের ঈমানের পথ থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত না হয়ে সব রকমের কঠিনতম শাস্তি ভোগ করা উচিত। তিন, যে আল্লাহকে মেনে নেবার কারণে কাফেররা বিরোধী হয়ে গেছে এবং ঈমানদাররা তাদের মেনে নেবার ওপর অবিচল রয়েছে, তিনি সবার ওপর ক্ষমতাশালী ও বিজয়ী, তিনি পৃথিবী ও আকাশের কর্তৃত্বের অধিকারী, নিজের সত্তায় তিনি নিজেই প্রশংসার অধিকারী এবং তিনি উভয় দলের অবস্থা দেখছেন। কাজেই নিশ্চিতভাবেই কাফেররা তাদের কুফরীর কারণে কেবল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে না বরং এই সংগে নিজেদের জুলুম নিপীড়নের শাস্তিও তারা ভোগ করবে আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে। অনুরূপভাবে যারা ঈমান এনে সৎকাজ করেছে তারা নিশ্চিতভাবে জান্নাতে যাবে এবং এটিই বৃহত্তম সাফল্য। তারপর কাফেরদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে , আল্লাহ অত্যন্ত শক্ত ও কঠোভাবে পাকড়াও করে থাকেন । যদি তোমরা নিজেদের বিরাট দলীয় শক্তির ওপর ভরসা করে থাকো তাহলে তোমাদের চাইতে বড় দলীয় শক্তির অধিকারী ছিল ফেরাউন ও সামুদরা। তাদের সেনাবাহিনীর পরিণাম থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহর অসীম শক্তি তোমাদেরকে চারদিকে থেকে ঘিরে আছে । এই ঘেরাও কেটে বের হবার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আর যে কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তোমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো , তার প্রত্যেকটি শব্দ অপরিবর্তনীয়। এই কুরআনের প্রতিটি শব্দ লওহে মাহফুযের গায়ে এমনভাবে খোদিত আছে যে হাজার চেষ্টা করেও কেউও তা বদলাতে পারবে না।
১) কসম মজবুত দুর্গ বিশিষ্ট আকাশের ১
১. মূলে ( আরবী -----------) বলা হয়েছে । অর্থাৎ বুর্জ বিশিষ্ট আকাশ । প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী মুফাসসিরগণের কেউ কেউ এ থেকে আকাশের বারটি বুর্জ অর্থ করেছেন। অন্যদিকে ইবনে আব্বাস (রা) , মুজাহিদ , কাতাদাহ , হাসান বসরী , যাহহাক ও সুদ্দীর মতে এর অর্থ হচ্ছে , আকাশের বিশাল গ্রহ ও তারকাসমূহ।
২) এবং সেই দিনের যার ওয়াদা করা হয়েছে ২
২. অর্থাৎ কিয়ামতের দিন।
৩) আর যে দেখে তার এবং সেই জিনিসের যা দেখা যায়৷৩
৩. যে দেখে এবং যা দেখা যায় -- এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণের বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় । কিন্তু আমার মতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতার সাথে যে কথাটি সম্পর্ক রাখে সেটি হচ্ছে , যে দেখে বলতে এখানে কিয়ামতের দিন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিকে এবং যা দেখা যায় বলতে কিয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে । কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক ঘটনাবলী সেদিন যারা দেখে তারা প্রত্যেকেই দেখবে। এটি মুজাহিদ , ইকরামা , যাহহকা , ইবনে নুজাইহ এবং অন্যান্য কাতিপয় মুফাসসিরের বক্তব্য ।
৪) মারা পড়েছে গর্তওয়ালারা যে গর্তে দাউ দাউ করে জ্বলা জ্বালানীর আগুন ছিল ,
৫) যখন তারা সেই গর্তের কিনারে বসেছিল
৬) এবং ঈমানদারদের সাথে
৭) তারা সবকিছু করছিল তা দেখছিল৷ ৪
৪. যারা বড় বড় গর্তের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং তাদের জ্বলে পুড়ে মরার বীভৎস দৃশ্য নিজেদের চোখে দেখেছিল তাদেরকে এখানে গর্তওয়ালা বলা হয়েছে। মারা পড়েছে অর্থ তাদের ওপর আল্লাহর লানত পড়েছে এবং তারা আল্লাহর আযাবের অধিকারী হয়েছে। এ বিষয়টির জন্য তিনটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে। প্রথম বুর্জ বিশিষ্ট আকাশের দ্বিতীয় কিয়ামতের দিনের , যার ওয়াদা করা হয়েছে। তৃতীয় কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক দৃশ্যাবলীর এবং সেই সমস্ত সৃষ্টির যারা এ দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করবে। প্রথম জিনিসটি সাক্ষ দিচ্ছে , যে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন মহাশক্তিধর সত্ত্বা বিশ্ব জাহানের বিশাল তারকা ও গ্রহরাজির ওপর কর্তৃত্ব করছেন তাঁর পাকড়াও থেকে এ তুচ্ছ নগণ্য মানুষ কেমন করে বাঁচতে পারে ৷ দ্বিতীয় জিনিসটির কসম এ জন্য খাওয়া হয়েছে যে , দুনিয়ায় তারা ইচ্ছামতো জুলুম করেছে কিন্তু এমন একটি দিন অবশ্যি আসবে যেদিনটি সম্পর্কে সমস্ত মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে সেদিন প্রত্যেক মজলুমের বদলা দেয়া হবে এবং প্রত্যেক জালেমকে পাকড়াও করা হবে। তৃতীয় জিনিসটির কসম খাওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে , এ জালেমরা যেভাবে ওই ঈমানদারদের জ্বলে পুড়ে মরার দৃশ্য দেখছে ঠিক তেমনি কিয়ামতের দিন এদের শাস্তি দেয়ার দৃশ্য সমগ্র সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করবে।
গর্তে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করার একাধিক ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা যায় , এ ধরনের জুলুম ও নিপীড়নমূলক ঘটনা দুনিয়ায় কয়েকবার ঘটেছে।
হযরত সুহাইব রুমী ( রা) এ ধরনের একটি ঘটনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হচ্ছে : এক বাদশার কাছে একজন যাদুকর ছিল। বৃদ্ধ বয়সে সে বাদশাকে বললো , একটি ছেলেকে আমার কাছে নিযুক্ত করো , সে আমার কাছ থেকে এ যাদু শিখে নেবে। বাদশাহ যাদু শেখার জন্য যাদুকরের কাছে একটি ছেলেকে নিযুক্ত করলো । কিন্তু সেই ছেলেটি যাদুকরের কাছে আসা যাওয়ার পথে একজন রাহেবের (যিনি সম্ভবত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দীনের অনুসারী একজন সাধক ছিলেন ) সাক্ষাত করতে লাগলো । তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে সে ঈমান আনলো । এমন কি তাঁর শিক্ষার গুণে সে অলৌকিক শক্তির অধিকারী ও হয়ে গেলো। সে অন্ধদের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে এবং কুষ্ঠরোগ নিরাময় করতে লাগলো। ছেলেটি তাওহীদের প্রতি ঈমান এনেছে , একথা জানতে পেরে বাদশাহ প্রথমে রাহেবকে হত্যা করলো তারপর ছেলেটিকে হত্যা করতে চাইলো। কিন্তু কোন অস্ত্র দিয়েই এবং কোনভাবেই তাকে হত্যা করতে পারলো না । শেষে ছেলেটি বললো , যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও তাহলে প্রকাশ্য জনসমাবেশে " বিসমি রব্বিল গুলাম " ( অর্থাৎ এই ছেলেটির রবের নামে ) বাক্য উচ্চারণ করে আমাকে তীর মারো , তাতেই আমি মারা যাবো। বাদশাহ তাই করলো । ফলে ছেলেটি মারা গেলো । এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে লোকেরা চীৎকার করে উঠলো , আমরা এই ছেলেটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। বাদশাহর সভাসদরা তাকে বললো , এখন তো তাই হয়ে গেলো যা থেকে আপনি বাঁচতে চাচ্ছিলেন। লোকেরা আপনার ধর্ম ত্যাগ করে এ ছেলেটির ধর্মগ্রহণ করেছে। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলো। সে রাস্তার পাশে গর্ত খনন করালো। তাতে আগুন জ্বালালো । যারা ঈমান ত্যাগ করতে রাজী হলো না তাদের সবাইকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করলো । ( মুসনাদে আহমাদ , মুসলিম , নাসায়ী , তিরমিযী , ইবনে জারীর , আবদুস রাজ্জাক , ইবনে আবী শাইবা , তাবারানী , আবদ ইবনে হুমাইদ )
দ্বিতীয় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বলেন , ইমানের এক বাদশাহ শরাব পান করে নিজের বোনের সাথে ব্যভিচার করে এবং উভয়ের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। কথাটি প্রকাশ হয়ে গেলে বাদশাহ জনসমক্ষে ঘোষণা করে দেয় যে , আল্লাহ বোনের সাথে বিয়ে হালাল করে দিয়েছেন। লোকেরা তার একথা মানতে প্রস্তুত হয় না। ফলে সে নানান ধরনের শাস্তি দিয়ে লোকদের একথা মানতে বাধ্য করতে থাকে। এমনকি সে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে যে ব্যক্তি তার একথা মানতে প্রস্তুত হয়নি তাকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। হযরত আলী ( রা) বলেন , সে সময় থেকেই অগ্নি উপাসকদের মধ্যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়কে বিয়ে করার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। ( ইবনে জারীর)
তৃতীয় ঘটনাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রা ) সম্ভবত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন : বেবিলনের অধিবাসীরা বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের দীন থেকে বিচ্যূত করতে বাধ্য করেছিল। এমন কি যারা তাদের কথা মানতে অস্বীকার করতো তাদেরকে জ্বলন্ত ভরা গর্তে নিক্ষেপ করতো। ( ইবনে জারীর , আবদ ইবনে হুমাইদ )
নাজরানের ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। ইবনে হিশাম , তাবারী , ইবনে খালদূন , মু'জামুল বুলদান গ্রন্থ প্রণেতা ইত্যাদি মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এর সংক্ষিপ্তসার হচেছ : হিময়ারের ( ইয়ামন ) বাদমাহ তুবান আসয়াদ আবু কারিবা একবার ইয়াসরিবে যায়। সেখানে ইহুদিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে এবং বনি কুরাইযার দু'জন ইহুদি আলেমকে সংগে করে ইয়ামনে নিয়ে যায়। সেখানে সে ব্যাপকভাবে ইহুদি ধর্মের প্রচার চালায়। তারপর তার ছেলে যু - নুওয়াস তার উত্তরাধিকারী হয়। সে দক্ষিণ আরবে ইসায়ীদের কেন্দ্রস্থল নাজরান আক্রমণ করে। সেখানে থেকে ঈসায়ী ধর্মকে উৎখাত করা এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে জোরপূর্বক ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করাই ছিল তার লক্ষ। ( ইবনে হিশাম বলেন , নাজরানবাসীরা হযরত ঈসার আসল দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।) নাজরান পৌঁছে সে লোকদেরকে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানায়। লোকেরা অস্বীকার করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে বিপুল সংখ্যক লোককে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের কুয়ায় নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেককে হত্যা করে । এভাবে মোট বিশ হাজার লোক নিহত হয়। নাজরানবাসীদের মধ্য থেকে দাউস যু সা'লাবান নামক এক ব্যক্তি কোনক্রমে প্রাণরক্ষা করে পালিয়ে যায়। এক বর্ণনা মতে , সে রোমের কায়সারের দরবারে চলে যায় এবং অন্য একটি বর্ণনা মতে সে চলে যায় হাবশার ( ইথিওপিয়া ) বাদশাহ নাজ্জাসীর দরবারে। সেখানে সে এই জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। প্রথম বর্ণনা অনুযায়ী রোমের কায়সার হাবশার বাদশাকে লেখেন এবং দ্বিতীয় বর্ণনা অনুযায়ী নাজ্জাশী কায়সারে কাছে নৌবাহিনীর জাহাজ সরবরাহের আবেদন জানান। যাহোক সবশেষে হাবশার সত্তর হাজার সৈন্য আরইয়াত নামক একজন সেনাপতির পরিচালনাধীনে ইয়ামন আক্রমণ করে। যু নুওয়াস নিহত হয়। ইহুদি রাষ্ট্রের পতন ঘটে। ইয়ামন হাবশার ঈসায়ী রাষ্ট্রের অন্তরভুক্ত হয়।
অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদি থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এ বর্ণনার কেবল সত্যতাই প্রমাণিত হয় না বরং এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত তথ্যাদিও জানা যায়। সর্বপ্রথম ৩৪০ খৃষ্টাব্দে ইয়ামন হাবশার ঈসায়ীদের দখলে আসে। ৩৭৮ খৃঃ পর্যন্ত সেখানে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে । এ সময় ঈসায়ী মিশনারীরা ইয়ামনে প্রবেশ করতে শুরু করে । এরি নিকটবর্তী সময়ে ফেমিউন( Faymiyun) নামক একজন সংসার ত্যাগী সাধক পুরুষ , কাশফ ও কারামতের অধিকারী ঈসায়ী পর্যটক নাজরানে আসেন । তিনি স্থানীয় লোকদেরকে মূর্তি পূজার গলদ বুঝাতে থাকেন। তার প্রচার গুণে নাজরানবাসীরা ঈসায়ী ধর্মের দীক্ষিত হয়। সে সময় তিনজন সরদার তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তাদের একজনকে বলা হতো সাইয়েদ । তিনি উপজাতীয় সরদারদের মতো একজন বড় সরদার ছিলেন। বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়াবলী , সন্ধি চুক্তি এবং সেনাবহিনী পরিচালনা তার দায়িত্বের অন্তরভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় জনকে বলা হতো আকেব। তিনি আভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী দেখাশুনা করতেন। তৃতীয় জনকে বলা হতো উসকুফ ( বিশপ ) । তিনি ছিলেন ধর্মীয় নেতা । দক্ষিণ আরবে নাজরান ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা । এটি ছিল একটি বৃহত্তম বানিজ্য ও শিল্প কেন্দ্র। এখানে তসর , চামড়া ও অস্ত্র নির্মাণ শিল্প উন্নতি লাভ করেছিল। প্রসিদ্ধ ইয়ামনী বর্মও এখানে নির্মিত হতো । এ কারণে নিছক ধর্মীয় কারণেই নয় বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও যু-নুওয়াস এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আক্রমণ করে। নাজরানের সাইয়েদ হারেশাকে , সুরিয়ানী ঐতিহাসিকগণ যাকে Arethas বলেছেন , হত্যা করে । তার স্ত্রী রুমার সামনে তার দুই কন্যাকে হত্যা করে এবং তাদের রক্ত পান করতে তাকে বাধ্য করে । তারপর তাকেও হত্যা করে । উসকুফ বিশপ পলের (Paul) শুকনো হাড় কবর থেকে বের করে এনে জ্বালিয়ে দেয়। আগুন ভরা গর্তসমূহে নারী, পুরুষ , শিশু, যুবা , বৃদ্ধ , পাদরী , রাহেব সবাইকে নিক্ষেপ করে । সামগ্রিকভাবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল বলা হয়। ৫২৩ খৃষ্টাব্দে এ ঘটনা ঘটে। অবশেষে ৫২৫ খৃষ্টাব্দে হাবশীরা ইয়ামন আক্রমণ করে যু - নুওয়াস ও তার হিমইয়ারী রাজত্বের পতন ঘটায়। প্রত্নতাত্বিক গবেষকগণ ইয়ামন হিসনে গুরাবের যে শিলালিপি উদ্ধার করেছেন তা থেকেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।
খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ঈসায়ী লেখকদের বিভিন্ন লেখায় গর্তওয়ালাদের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে মূল ঘটনার সময় এবং এ ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের বিবরণ সহকারে লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থের রচয়িতারা এই ঘটনার সমসাময়িক । তাদের একজন হচ্ছেন : প্রকোপিউস দ্বিতীয় জন কসমস ইনডিকোপ্লিউসটিস ( cosmos Indicopleustis) তিনি নাজ্জাশী এলিস বুয়ানের( Elesboan) নির্দেশে সে সময় বাতলিমুসের গ্রীক ভাষায় লিখিত বইগুলোর অনুবাদ করছিলেন। এ সময় তিনি হাবশার সমুদ্রোপকূলবর্তী এডোলিশ ( Adolis) শহরে অবস্থান করছিলেন। তৃতীয়জন হচ্ছেন জোহান্নাস মালালা ( Johnnes Malala)। পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক তাঁর রচনা থেকে ঘটনাটি উদ্ধৃতি করেছেন। এদের পর এফেসুসের জোহান্নাসের ( Johannes of Ephesus ) নাম করা যায়। তিনি ৫৮৫ খৃষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর গীর্জার ইতিহাস গ্রন্থে নাজরানের ঈসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর এই নিপীড়নের কাহিনী এ ঘটনার সমসাময়িক বর্ণনাকারী বিশপ শিমউনের (Simeon) একটি পত্র থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ পত্রটি লিখিত হয় জাবলা ধর্ম মন্দিরের প্রধানের( Abbot Von Gabula) নামে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্ন ইয়ামনবাসীর বর্ণনার মাধ্যমে শিমউন তাঁর এই পত্রটি তৈরি করেন। এ পত্রটি ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে রোম থেকে এবং ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে ঈসায়ী শহীদানের অবস্থা বর্ণনা প্রসংগে প্রকাশিত হয়।
ইয়াকূবী পত্রিয়ার্ক ডিউনিসিউস ( Patriarch Dionysius ) ও জাকারিয়া সিদলিনি (Zacharia of Mitylene) তাদের সুরিয়ানী ইতিহাসেও এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন। নাজরানের ঈসায়ী সমাজ সম্পর্কিত ইয়াকূব সুরুজীর গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে। আর রাহা এর বিশপ পোলাস (PULUS) নাজরানের নিহতদের উদ্দেশ্যে শোকগীতি লিখেছেন ।এটি এখনো পাওয়া যায়। সুরিয়ানী ভাষার বই " আল হিময়ারীন " এর ইংরেজী অনুবাদ ( Book of the Himyarites ) ১৯২৪ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটি মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করে। বৃটিশ মিউজিয়ামে সেই আমলের এবং তার নিকটবর্তী আমলের কিছু ইথিয়োপীয় শিলালিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো থেকেও এই ঘটনার সমর্থন পাওয়া যায়। কিলবি তাঁর Arabian Highlands নামক সফরনামায় লিখেছেন : গর্তওয়ালাদের ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সে জায়গাটি আজো নাজরানবাসীদের কাছে সুস্পষ্ট। 'উম্মু খারাক' এর কাছে এক জায়গায় পাথরের গায়ে খোদিত কিছু চিত্রও পাওয়া যায়। আর নাজরানের কাবা যেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল বর্তমান নাজরানবাসীরা সে জায়গাটিও জানে।
হাবশার ঈসায়ীরা নাজরান অধিকার করার পর সেখানে কাবার আকৃতিতে একটি ইমারত তৈরি করে। মক্কার কাবার মোকাবিলায় এই ঘরটিকে তারা কেন্দ্রীয় মর্যাদা দিতে চাচ্ছিল। এখানকার বিশপরা মাথায় পাগড়ী বাঁধতেন। এই ঘরকে তারা হারাম শরীফ গণ্য করেন। রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকেও এই কাবাঘরের জন্য আর্থিক সাহায্য পাঠানো হতো। এই নাজরানের কাবার পাদরী তাঁর সাইয়েদ , আকেব ও উসকুফের নেতৃত্বে ' মুনাযিয়া ' (বিতর্ক ) করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়েছিলেন । সেখানে যে বিখ্যাত 'মুবাহিলা 'র ঘটনা অনুষ্ঠিত হয় সূরা আলে ইমরানের ৬১ আয়াতে তা উল্লেখিত হয়েছে। ( দেখুন তাফহীমূল কুরআন , আল ইমরান ২৯ ও ৫৫ টীকা )
৮) ওই ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার এ ছাড়া আর কোন কারণ ছিল না যে তারা সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল ।
৯) যিনি মহাপরাক্রমশালী এবং নিজের সত্তায় নিজেই প্রশংসিত , যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী ৷ আর সে আল্লাহ সবকিছু দেখছেন৷৫
৫. এ আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহর এমন সব গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে তাঁর প্রতি ঈমান আনার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে এগুলোর প্রতি ঈমান আনার কারণে যারা অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ হয় তারা জালেম।
১০) যারা মু’মিন পুরুষ ও নারীদের ওপর জুলুম - নিপীড়ন চালিয়েছে , তারপর তা থেকে তওবা করেনি , নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব এবং জ্বালা - পোড়ার শাস্তি৷৬
৬. জাহান্নামের আযাব থেকে আবার আলাদাভাবে জ্বালা পোড়ার শাস্তির উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এই যে , তারা মজলুমদেরকে আগুনে ভরা গর্তে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়েছিল। সম্ভবত এটা জাহান্নামের সাধারণ আগুন থেকে ভিন্ন ধরনের এবং তার চেয়ে বেশী তীব্র কোন আগুন হবে এ বিশেষ আগুনে তাদেরকে জ্বালানো হবে।
১১) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাগান যার নিম্নদেশে প্রবাহিত হতে থাকবে ঝরণাধারা৷ এটিই বড় সাফল্য৷
১২) আসলে তোমার রবের পাকড়াও বড় শক্ত৷
১৩) তিনিই প্রথমবার সৃষ্টি করেন আবার তিনিই দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করবেন৷
১৪) তিনি ক্ষমাশীল , প্রেমময় ,
১৫) আরশের মালিক , শ্রেষ্ঠ সম্মানিত
১৬) এবং তিনি যা চান তাই করেন৷৭
৭. " তিনি ক্ষমাশীল " বলে এই মর্মে আশান্বিত করা হয়েছে যে , কোন ব্যক্তি গোনাহ করা থেকে বিরত হয়ে যদি তাওবা করে তাহলে সে আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে। " প্রেমময় " বলে একথা বলা হয়েছে যে , তিনি নিজের সৃষ্টির প্রতি কোন শত্রুতা পোষণ করেন না। অযথা তাদেরকে শাস্তি দেয়া তাঁর কাজ নয়। বরং নিজের সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন । তাকে তিনি কেবল তখনই শাস্তি দেন যখন সে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করা থেকে বিরত হয় না। " আরশের মালিক " বলে মানুষের মধ্যে এ অনুভূতি জাগানো হয়েছে যে সমগ্র বিশ্ব জাহানের রাজত্বের তিনিই একমাত্র অধিপতি । কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কেউ তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে না। " শ্রেষ্ঠ সম্মানিত " বলে এ ধরনের বিপুল মর্যাদাসম্পন্ন সত্তার প্রতি অশোভন আচরণ করার হীন মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে । তাঁর শেষ গুণটি বর্ণনা করে বলা হয়েছে , " তিনি যা চান তাই করেন। " অর্থাৎ আল্লাহ যে কাজটি করতে চান তাতে বাধা দেবার ক্ষমতা এ সমগ্র বিশ্ব জাহানের কারোর নেই।
১৭) তোমার কাছে কি পৌঁছেছে সেনাদলের খবর ?
১৮) ফেরাউন ও সামূদের সেনাদলের ?৮
৮. যারা নিজেদের দল ও জনশক্তির জোরে আল্লাহর এ যমীনে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা বুলন্দ করছে এখানে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে , তোমাদের কি জানা আছে , ইতিপূর্বে যার নিজেদের দলীয় শক্তির জোরে এ ধরনের বিদ্রোহ করেছিল তাদের পরিণাম কি হয়েছিল ৷
১৯) কিন্তু যারা কুফরী করেছে , তারা মিথ্যা আরোপ করার কাজে লেগে রয়েছে৷
২০) অথচ আল্লাহ তাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছেন৷
২১) ( তোমার মিথ্যা আরোপ করায় এ কুরআনের কিছু আসে যায় না৷)
২২) বরং এ কুরআন উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন , সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ৷৯
৯. এর অর্থ হচ্ছে , এ কুরআনের লেখা অপরিবর্তনীয় । এর বিলুপ্তি হবে না। আল্লাহর এমন সংরক্ষিত ফলকে এর লেখাগুলো খোদিত রয়েছে যেখানে এর মধ্যে কোন রদবদল করার ক্ষমতা কারোর নেই। এর মধ্যে যে কথা লেখা হয়েছে তা অবশ্যি পূর্ণ হবে । সারা দুনিয়া একজোট হয়ে তাকে বাতিল করতে চাইলে ও তাতে সফল হবে না।
চলবে.........
আল বুরুজ
ভূমিকা নামকরণ
প্রথম আয়াতে আরবী -------- শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নায়িলের সময় -কাল
এর বিষয়বস্তু থেকেই একথা সুম্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে,এ সূরাটি মক্কা মুয়ায্যমায় এমন এক সময় নাযিল হয় যখন মুশরিকদের জুলুম নিপীড়ন তুংগে উঠেছিল এবং তারা কঠিনতম শাস্তি দিয়ে মুসলমানদের ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছিল।
বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য
এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে,ঈমানদারদের ওপর কাফেররা যে জুলুম করছিল সে সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করা এবং ঈমানদারদেরকে এই মর্মে সান্ত্বনা দেয়া যে, যদি তারা এসব জুলুম -নিপীড়নের মোকাবিলায় অবিচল থাকে তাহলে তারা এর জন্য সর্বোত্তম পুরস্কার পাবে এবং আল্লাহ নিজেই জালেমদের থেকে বদলা নেবেন।
এ প্রসংগে সর্বপ্রথম আসহাবুল উখদূদের (গর্ত ওয়ালাদের )কাহিনী শুনানো হয়েছে । তারা ঈমানদারদেরকে আগুনে ভরা গর্তে ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল। এ কাহিনীর মাধ্যমে মু’মিন ও কাফেরদেরকে কয়েকটি কথা বুঝানো হয়েছে । এক, গর্তওয়ালারা যেমন আল্লাহর অভিশাপ ও তাঁর শাস্তির অধিকারী হয়েছে তেমনি মক্কার মুশরিক সরদাররাও তার অধিকারী হচ্ছিল। দুই, ঈমানদাররা যেমন তখন ঈমান ত্যাগ করার পরিবর্তে আগুনে ভরা গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে জীবন দেয়াকে বেছে নিয়েছিল , ঠিক তেমনিভাবে এখনও ঈমানদারদের ঈমানের পথ থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত না হয়ে সব রকমের কঠিনতম শাস্তি ভোগ করা উচিত। তিন, যে আল্লাহকে মেনে নেবার কারণে কাফেররা বিরোধী হয়ে গেছে এবং ঈমানদাররা তাদের মেনে নেবার ওপর অবিচল রয়েছে, তিনি সবার ওপর ক্ষমতাশালী ও বিজয়ী, তিনি পৃথিবী ও আকাশের কর্তৃত্বের অধিকারী, নিজের সত্তায় তিনি নিজেই প্রশংসার অধিকারী এবং তিনি উভয় দলের অবস্থা দেখছেন। কাজেই নিশ্চিতভাবেই কাফেররা তাদের কুফরীর কারণে কেবল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে না বরং এই সংগে নিজেদের জুলুম নিপীড়নের শাস্তিও তারা ভোগ করবে আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে। অনুরূপভাবে যারা ঈমান এনে সৎকাজ করেছে তারা নিশ্চিতভাবে জান্নাতে যাবে এবং এটিই বৃহত্তম সাফল্য। তারপর কাফেরদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে , আল্লাহ অত্যন্ত শক্ত ও কঠোভাবে পাকড়াও করে থাকেন । যদি তোমরা নিজেদের বিরাট দলীয় শক্তির ওপর ভরসা করে থাকো তাহলে তোমাদের চাইতে বড় দলীয় শক্তির অধিকারী ছিল ফেরাউন ও সামুদরা। তাদের সেনাবাহিনীর পরিণাম থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহর অসীম শক্তি তোমাদেরকে চারদিকে থেকে ঘিরে আছে । এই ঘেরাও কেটে বের হবার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আর যে কুরআনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য তোমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো , তার প্রত্যেকটি শব্দ অপরিবর্তনীয়। এই কুরআনের প্রতিটি শব্দ লওহে মাহফুযের গায়ে এমনভাবে খোদিত আছে যে হাজার চেষ্টা করেও কেউও তা বদলাতে পারবে না।
১) কসম মজবুত দুর্গ বিশিষ্ট আকাশের ১
১. মূলে ( আরবী -----------) বলা হয়েছে । অর্থাৎ বুর্জ বিশিষ্ট আকাশ । প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী মুফাসসিরগণের কেউ কেউ এ থেকে আকাশের বারটি বুর্জ অর্থ করেছেন। অন্যদিকে ইবনে আব্বাস (রা) , মুজাহিদ , কাতাদাহ , হাসান বসরী , যাহহাক ও সুদ্দীর মতে এর অর্থ হচ্ছে , আকাশের বিশাল গ্রহ ও তারকাসমূহ।
২) এবং সেই দিনের যার ওয়াদা করা হয়েছে ২
২. অর্থাৎ কিয়ামতের দিন।
৩) আর যে দেখে তার এবং সেই জিনিসের যা দেখা যায়৷৩
৩. যে দেখে এবং যা দেখা যায় -- এ ব্যাপারে মুফাসসিরগণের বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায় । কিন্তু আমার মতে বক্তব্যের ধারাবাহিকতার সাথে যে কথাটি সম্পর্ক রাখে সেটি হচ্ছে , যে দেখে বলতে এখানে কিয়ামতের দিন উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তিকে এবং যা দেখা যায় বলতে কিয়ামতকেই বুঝানো হয়েছে । কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক ঘটনাবলী সেদিন যারা দেখে তারা প্রত্যেকেই দেখবে। এটি মুজাহিদ , ইকরামা , যাহহকা , ইবনে নুজাইহ এবং অন্যান্য কাতিপয় মুফাসসিরের বক্তব্য ।
৪) মারা পড়েছে গর্তওয়ালারা যে গর্তে দাউ দাউ করে জ্বলা জ্বালানীর আগুন ছিল ,
৫) যখন তারা সেই গর্তের কিনারে বসেছিল
৬) এবং ঈমানদারদের সাথে
৭) তারা সবকিছু করছিল তা দেখছিল৷ ৪
৪. যারা বড় বড় গর্তের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল এবং তাদের জ্বলে পুড়ে মরার বীভৎস দৃশ্য নিজেদের চোখে দেখেছিল তাদেরকে এখানে গর্তওয়ালা বলা হয়েছে। মারা পড়েছে অর্থ তাদের ওপর আল্লাহর লানত পড়েছে এবং তারা আল্লাহর আযাবের অধিকারী হয়েছে। এ বিষয়টির জন্য তিনটি জিনিসের কসম খাওয়া হয়েছে। প্রথম বুর্জ বিশিষ্ট আকাশের দ্বিতীয় কিয়ামতের দিনের , যার ওয়াদা করা হয়েছে। তৃতীয় কিয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক দৃশ্যাবলীর এবং সেই সমস্ত সৃষ্টির যারা এ দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করবে। প্রথম জিনিসটি সাক্ষ দিচ্ছে , যে সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন মহাশক্তিধর সত্ত্বা বিশ্ব জাহানের বিশাল তারকা ও গ্রহরাজির ওপর কর্তৃত্ব করছেন তাঁর পাকড়াও থেকে এ তুচ্ছ নগণ্য মানুষ কেমন করে বাঁচতে পারে ৷ দ্বিতীয় জিনিসটির কসম এ জন্য খাওয়া হয়েছে যে , দুনিয়ায় তারা ইচ্ছামতো জুলুম করেছে কিন্তু এমন একটি দিন অবশ্যি আসবে যেদিনটি সম্পর্কে সমস্ত মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে সেদিন প্রত্যেক মজলুমের বদলা দেয়া হবে এবং প্রত্যেক জালেমকে পাকড়াও করা হবে। তৃতীয় জিনিসটির কসম খাওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে , এ জালেমরা যেভাবে ওই ঈমানদারদের জ্বলে পুড়ে মরার দৃশ্য দেখছে ঠিক তেমনি কিয়ামতের দিন এদের শাস্তি দেয়ার দৃশ্য সমগ্র সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করবে।
গর্তে আগুন জ্বালিয়ে ঈমানদারদেরকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করার একাধিক ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকে জানা যায় , এ ধরনের জুলুম ও নিপীড়নমূলক ঘটনা দুনিয়ায় কয়েকবার ঘটেছে।
হযরত সুহাইব রুমী ( রা) এ ধরনের একটি ঘটনা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হচ্ছে : এক বাদশার কাছে একজন যাদুকর ছিল। বৃদ্ধ বয়সে সে বাদশাকে বললো , একটি ছেলেকে আমার কাছে নিযুক্ত করো , সে আমার কাছ থেকে এ যাদু শিখে নেবে। বাদশাহ যাদু শেখার জন্য যাদুকরের কাছে একটি ছেলেকে নিযুক্ত করলো । কিন্তু সেই ছেলেটি যাদুকরের কাছে আসা যাওয়ার পথে একজন রাহেবের (যিনি সম্ভবত হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দীনের অনুসারী একজন সাধক ছিলেন ) সাক্ষাত করতে লাগলো । তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে সে ঈমান আনলো । এমন কি তাঁর শিক্ষার গুণে সে অলৌকিক শক্তির অধিকারী ও হয়ে গেলো। সে অন্ধদের দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে এবং কুষ্ঠরোগ নিরাময় করতে লাগলো। ছেলেটি তাওহীদের প্রতি ঈমান এনেছে , একথা জানতে পেরে বাদশাহ প্রথমে রাহেবকে হত্যা করলো তারপর ছেলেটিকে হত্যা করতে চাইলো। কিন্তু কোন অস্ত্র দিয়েই এবং কোনভাবেই তাকে হত্যা করতে পারলো না । শেষে ছেলেটি বললো , যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও তাহলে প্রকাশ্য জনসমাবেশে " বিসমি রব্বিল গুলাম " ( অর্থাৎ এই ছেলেটির রবের নামে ) বাক্য উচ্চারণ করে আমাকে তীর মারো , তাতেই আমি মারা যাবো। বাদশাহ তাই করলো । ফলে ছেলেটি মারা গেলো । এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে লোকেরা চীৎকার করে উঠলো , আমরা এই ছেলেটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। বাদশাহর সভাসদরা তাকে বললো , এখন তো তাই হয়ে গেলো যা থেকে আপনি বাঁচতে চাচ্ছিলেন। লোকেরা আপনার ধর্ম ত্যাগ করে এ ছেলেটির ধর্মগ্রহণ করেছে। এ অবস্থা দেখে বাদশাহ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলো। সে রাস্তার পাশে গর্ত খনন করালো। তাতে আগুন জ্বালালো । যারা ঈমান ত্যাগ করতে রাজী হলো না তাদের সবাইকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করলো । ( মুসনাদে আহমাদ , মুসলিম , নাসায়ী , তিরমিযী , ইবনে জারীর , আবদুস রাজ্জাক , ইবনে আবী শাইবা , তাবারানী , আবদ ইবনে হুমাইদ )
দ্বিতীয় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বলেন , ইমানের এক বাদশাহ শরাব পান করে নিজের বোনের সাথে ব্যভিচার করে এবং উভয়ের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। কথাটি প্রকাশ হয়ে গেলে বাদশাহ জনসমক্ষে ঘোষণা করে দেয় যে , আল্লাহ বোনের সাথে বিয়ে হালাল করে দিয়েছেন। লোকেরা তার একথা মানতে প্রস্তুত হয় না। ফলে সে নানান ধরনের শাস্তি দিয়ে লোকদের একথা মানতে বাধ্য করতে থাকে। এমনকি সে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে যে ব্যক্তি তার একথা মানতে প্রস্তুত হয়নি তাকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে থাকে। হযরত আলী ( রা) বলেন , সে সময় থেকেই অগ্নি উপাসকদের মধ্যে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়কে বিয়ে করার পদ্ধতি প্রচলিত হয়। ( ইবনে জারীর)
তৃতীয় ঘটনাটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ( রা ) সম্ভবত ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন : বেবিলনের অধিবাসীরা বনী ইসরাঈলকে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের দীন থেকে বিচ্যূত করতে বাধ্য করেছিল। এমন কি যারা তাদের কথা মানতে অস্বীকার করতো তাদেরকে জ্বলন্ত ভরা গর্তে নিক্ষেপ করতো। ( ইবনে জারীর , আবদ ইবনে হুমাইদ )
নাজরানের ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশী প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। ইবনে হিশাম , তাবারী , ইবনে খালদূন , মু'জামুল বুলদান গ্রন্থ প্রণেতা ইত্যাদি মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। এর সংক্ষিপ্তসার হচেছ : হিময়ারের ( ইয়ামন ) বাদমাহ তুবান আসয়াদ আবু কারিবা একবার ইয়াসরিবে যায়। সেখানে ইহুদিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে এবং বনি কুরাইযার দু'জন ইহুদি আলেমকে সংগে করে ইয়ামনে নিয়ে যায়। সেখানে সে ব্যাপকভাবে ইহুদি ধর্মের প্রচার চালায়। তারপর তার ছেলে যু - নুওয়াস তার উত্তরাধিকারী হয়। সে দক্ষিণ আরবে ইসায়ীদের কেন্দ্রস্থল নাজরান আক্রমণ করে। সেখানে থেকে ঈসায়ী ধর্মকে উৎখাত করা এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে জোরপূর্বক ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত করাই ছিল তার লক্ষ। ( ইবনে হিশাম বলেন , নাজরানবাসীরা হযরত ঈসার আসল দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।) নাজরান পৌঁছে সে লোকদেরকে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করার আহবান জানায়। লোকেরা অস্বীকার করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে বিপুল সংখ্যক লোককে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের কুয়ায় নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেয় এবং অনেককে হত্যা করে । এভাবে মোট বিশ হাজার লোক নিহত হয়। নাজরানবাসীদের মধ্য থেকে দাউস যু সা'লাবান নামক এক ব্যক্তি কোনক্রমে প্রাণরক্ষা করে পালিয়ে যায়। এক বর্ণনা মতে , সে রোমের কায়সারের দরবারে চলে যায় এবং অন্য একটি বর্ণনা মতে সে চলে যায় হাবশার ( ইথিওপিয়া ) বাদশাহ নাজ্জাসীর দরবারে। সেখানে সে এই জুলুমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। প্রথম বর্ণনা অনুযায়ী রোমের কায়সার হাবশার বাদশাকে লেখেন এবং দ্বিতীয় বর্ণনা অনুযায়ী নাজ্জাশী কায়সারে কাছে নৌবাহিনীর জাহাজ সরবরাহের আবেদন জানান। যাহোক সবশেষে হাবশার সত্তর হাজার সৈন্য আরইয়াত নামক একজন সেনাপতির পরিচালনাধীনে ইয়ামন আক্রমণ করে। যু নুওয়াস নিহত হয়। ইহুদি রাষ্ট্রের পতন ঘটে। ইয়ামন হাবশার ঈসায়ী রাষ্ট্রের অন্তরভুক্ত হয়।
অন্যান্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদি থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এ বর্ণনার কেবল সত্যতাই প্রমাণিত হয় না বরং এ সম্পর্কিত আরো বিস্তারিত তথ্যাদিও জানা যায়। সর্বপ্রথম ৩৪০ খৃষ্টাব্দে ইয়ামন হাবশার ঈসায়ীদের দখলে আসে। ৩৭৮ খৃঃ পর্যন্ত সেখানে তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকে । এ সময় ঈসায়ী মিশনারীরা ইয়ামনে প্রবেশ করতে শুরু করে । এরি নিকটবর্তী সময়ে ফেমিউন( Faymiyun) নামক একজন সংসার ত্যাগী সাধক পুরুষ , কাশফ ও কারামতের অধিকারী ঈসায়ী পর্যটক নাজরানে আসেন । তিনি স্থানীয় লোকদেরকে মূর্তি পূজার গলদ বুঝাতে থাকেন। তার প্রচার গুণে নাজরানবাসীরা ঈসায়ী ধর্মের দীক্ষিত হয়। সে সময় তিনজন সরদার তাদের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তাদের একজনকে বলা হতো সাইয়েদ । তিনি উপজাতীয় সরদারদের মতো একজন বড় সরদার ছিলেন। বিদেশ সংক্রান্ত বিষয়াবলী , সন্ধি চুক্তি এবং সেনাবহিনী পরিচালনা তার দায়িত্বের অন্তরভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় জনকে বলা হতো আকেব। তিনি আভ্যন্তরীণ বিষয়াবলী দেখাশুনা করতেন। তৃতীয় জনকে বলা হতো উসকুফ ( বিশপ ) । তিনি ছিলেন ধর্মীয় নেতা । দক্ষিণ আরবে নাজরান ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা । এটি ছিল একটি বৃহত্তম বানিজ্য ও শিল্প কেন্দ্র। এখানে তসর , চামড়া ও অস্ত্র নির্মাণ শিল্প উন্নতি লাভ করেছিল। প্রসিদ্ধ ইয়ামনী বর্মও এখানে নির্মিত হতো । এ কারণে নিছক ধর্মীয় কারণেই নয় বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণেও যু-নুওয়াস এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আক্রমণ করে। নাজরানের সাইয়েদ হারেশাকে , সুরিয়ানী ঐতিহাসিকগণ যাকে Arethas বলেছেন , হত্যা করে । তার স্ত্রী রুমার সামনে তার দুই কন্যাকে হত্যা করে এবং তাদের রক্ত পান করতে তাকে বাধ্য করে । তারপর তাকেও হত্যা করে । উসকুফ বিশপ পলের (Paul) শুকনো হাড় কবর থেকে বের করে এনে জ্বালিয়ে দেয়। আগুন ভরা গর্তসমূহে নারী, পুরুষ , শিশু, যুবা , বৃদ্ধ , পাদরী , রাহেব সবাইকে নিক্ষেপ করে । সামগ্রিকভাবে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল বলা হয়। ৫২৩ খৃষ্টাব্দে এ ঘটনা ঘটে। অবশেষে ৫২৫ খৃষ্টাব্দে হাবশীরা ইয়ামন আক্রমণ করে যু - নুওয়াস ও তার হিমইয়ারী রাজত্বের পতন ঘটায়। প্রত্নতাত্বিক গবেষকগণ ইয়ামন হিসনে গুরাবের যে শিলালিপি উদ্ধার করেছেন তা থেকেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।
খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে ঈসায়ী লেখকদের বিভিন্ন লেখায় গর্তওয়ালাদের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে মূল ঘটনার সময় এবং এ ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের বিবরণ সহকারে লিখিত বেশ কিছু গ্রন্থ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থের রচয়িতারা এই ঘটনার সমসাময়িক । তাদের একজন হচ্ছেন : প্রকোপিউস দ্বিতীয় জন কসমস ইনডিকোপ্লিউসটিস ( cosmos Indicopleustis) তিনি নাজ্জাশী এলিস বুয়ানের( Elesboan) নির্দেশে সে সময় বাতলিমুসের গ্রীক ভাষায় লিখিত বইগুলোর অনুবাদ করছিলেন। এ সময় তিনি হাবশার সমুদ্রোপকূলবর্তী এডোলিশ ( Adolis) শহরে অবস্থান করছিলেন। তৃতীয়জন হচ্ছেন জোহান্নাস মালালা ( Johnnes Malala)। পরবর্তী বহু ঐতিহাসিক তাঁর রচনা থেকে ঘটনাটি উদ্ধৃতি করেছেন। এদের পর এফেসুসের জোহান্নাসের ( Johannes of Ephesus ) নাম করা যায়। তিনি ৫৮৫ খৃষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর গীর্জার ইতিহাস গ্রন্থে নাজরানের ঈসায়ী সম্প্রদায়ের ওপর এই নিপীড়নের কাহিনী এ ঘটনার সমসাময়িক বর্ণনাকারী বিশপ শিমউনের (Simeon) একটি পত্র থেকে উদ্ধৃত করেছেন। এ পত্রটি লিখিত হয় জাবলা ধর্ম মন্দিরের প্রধানের( Abbot Von Gabula) নামে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্ন ইয়ামনবাসীর বর্ণনার মাধ্যমে শিমউন তাঁর এই পত্রটি তৈরি করেন। এ পত্রটি ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে রোম থেকে এবং ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে ঈসায়ী শহীদানের অবস্থা বর্ণনা প্রসংগে প্রকাশিত হয়।
ইয়াকূবী পত্রিয়ার্ক ডিউনিসিউস ( Patriarch Dionysius ) ও জাকারিয়া সিদলিনি (Zacharia of Mitylene) তাদের সুরিয়ানী ইতিহাসেও এ ঘটনাটি উদ্ধৃত করেছেন। নাজরানের ঈসায়ী সমাজ সম্পর্কিত ইয়াকূব সুরুজীর গ্রন্থেও এর উল্লেখ রয়েছে। আর রাহা এর বিশপ পোলাস (PULUS) নাজরানের নিহতদের উদ্দেশ্যে শোকগীতি লিখেছেন ।এটি এখনো পাওয়া যায়। সুরিয়ানী ভাষার বই " আল হিময়ারীন " এর ইংরেজী অনুবাদ ( Book of the Himyarites ) ১৯২৪ সালে লণ্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এ বইটি মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনার সত্যতা প্রমাণ করে। বৃটিশ মিউজিয়ামে সেই আমলের এবং তার নিকটবর্তী আমলের কিছু ইথিয়োপীয় শিলালিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো থেকেও এই ঘটনার সমর্থন পাওয়া যায়। কিলবি তাঁর Arabian Highlands নামক সফরনামায় লিখেছেন : গর্তওয়ালাদের ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়েছিল সে জায়গাটি আজো নাজরানবাসীদের কাছে সুস্পষ্ট। 'উম্মু খারাক' এর কাছে এক জায়গায় পাথরের গায়ে খোদিত কিছু চিত্রও পাওয়া যায়। আর নাজরানের কাবা যেখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল বর্তমান নাজরানবাসীরা সে জায়গাটিও জানে।
হাবশার ঈসায়ীরা নাজরান অধিকার করার পর সেখানে কাবার আকৃতিতে একটি ইমারত তৈরি করে। মক্কার কাবার মোকাবিলায় এই ঘরটিকে তারা কেন্দ্রীয় মর্যাদা দিতে চাচ্ছিল। এখানকার বিশপরা মাথায় পাগড়ী বাঁধতেন। এই ঘরকে তারা হারাম শরীফ গণ্য করেন। রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকেও এই কাবাঘরের জন্য আর্থিক সাহায্য পাঠানো হতো। এই নাজরানের কাবার পাদরী তাঁর সাইয়েদ , আকেব ও উসকুফের নেতৃত্বে ' মুনাযিয়া ' (বিতর্ক ) করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়েছিলেন । সেখানে যে বিখ্যাত 'মুবাহিলা 'র ঘটনা অনুষ্ঠিত হয় সূরা আলে ইমরানের ৬১ আয়াতে তা উল্লেখিত হয়েছে। ( দেখুন তাফহীমূল কুরআন , আল ইমরান ২৯ ও ৫৫ টীকা )
৮) ওই ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার এ ছাড়া আর কোন কারণ ছিল না যে তারা সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল
৯) যিনি মহাপরাক্রমশালী এবং নিজের সত্তায় নিজেই প্রশংসিত , যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের অধিকারী ৷ আর সে আল্লাহ সবকিছু দেখছেন৷৫
৫. এ আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহর এমন সব গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে তাঁর প্রতি ঈমান আনার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার অন্যদিকে এগুলোর প্রতি ঈমান আনার কারণে যারা অসন্তুষ্ট ও বিক্ষুব্ধ হয় তারা জালেম।
১০) যারা মু’মিন পুরুষ ও নারীদের ওপর জুলুম - নিপীড়ন চালিয়েছে , তারপর তা থেকে তওবা করেনি , নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব এবং জ্বালা - পোড়ার শাস্তি৷৬
৬. জাহান্নামের আযাব থেকে আবার আলাদাভাবে জ্বালা পোড়ার শাস্তির উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে এই যে , তারা মজলুমদেরকে আগুনে ভরা গর্তে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়েছিল। সম্ভবত এটা জাহান্নামের সাধারণ আগুন থেকে ভিন্ন ধরনের এবং তার চেয়ে বেশী তীব্র কোন আগুন হবে এ বিশেষ আগুনে তাদেরকে জ্বালানো হবে।
১১) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে নিশ্চিতভাবেই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের বাগান যার নিম্নদেশে প্রবাহিত হতে থাকবে ঝরণাধারা৷ এটিই বড় সাফল্য৷
১২) আসলে তোমার রবের পাকড়াও বড় শক্ত৷
১৩) তিনিই প্রথমবার সৃষ্টি করেন আবার তিনিই দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করবেন৷
১৪) তিনি ক্ষমাশীল , প্রেমময় ,
১৫) আরশের মালিক , শ্রেষ্ঠ সম্মানিত
১৬) এবং তিনি যা চান তাই করেন৷৭
৭. " তিনি ক্ষমাশীল " বলে এই মর্মে আশান্বিত করা হয়েছে যে , কোন ব্যক্তি গোনাহ করা থেকে বিরত হয়ে যদি তাওবা করে তাহলে সে আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে। " প্রেমময় " বলে একথা বলা হয়েছে যে , তিনি নিজের সৃষ্টির প্রতি কোন শত্রুতা পোষণ করেন না। অযথা তাদেরকে শাস্তি দেয়া তাঁর কাজ নয়। বরং নিজের সৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন । তাকে তিনি কেবল তখনই শাস্তি দেন যখন সে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করা থেকে বিরত হয় না। " আরশের মালিক " বলে মানুষের মধ্যে এ অনুভূতি জাগানো হয়েছে যে সমগ্র বিশ্ব জাহানের রাজত্বের তিনিই একমাত্র অধিপতি । কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কেউ তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে না। " শ্রেষ্ঠ সম্মানিত " বলে এ ধরনের বিপুল মর্যাদাসম্পন্ন সত্তার প্রতি অশোভন আচরণ করার হীন মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে । তাঁর শেষ গুণটি বর্ণনা করে বলা হয়েছে , " তিনি যা চান তাই করেন। " অর্থাৎ আল্লাহ যে কাজটি করতে চান তাতে বাধা দেবার ক্ষমতা এ সমগ্র বিশ্ব জাহানের কারোর নেই।
১৭) তোমার কাছে কি পৌঁছেছে সেনাদলের খবর ?
১৮) ফেরাউন ও সামূদের সেনাদলের ?৮
৮. যারা নিজেদের দল ও জনশক্তির জোরে আল্লাহর এ যমীনে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা বুলন্দ করছে এখানে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে , তোমাদের কি জানা আছে , ইতিপূর্বে যার নিজেদের দলীয় শক্তির জোরে এ ধরনের বিদ্রোহ করেছিল তাদের পরিণাম কি হয়েছিল ৷
১৯) কিন্তু যারা কুফরী করেছে , তারা মিথ্যা আরোপ করার কাজে লেগে রয়েছে৷
২০) অথচ আল্লাহ তাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছেন৷
২১) ( তোমার মিথ্যা আরোপ করায় এ কুরআনের কিছু আসে যায় না৷)
২২) বরং এ কুরআন উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন , সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ৷৯
৯. এর অর্থ হচ্ছে , এ কুরআনের লেখা অপরিবর্তনীয় । এর বিলুপ্তি হবে না। আল্লাহর এমন সংরক্ষিত ফলকে এর লেখাগুলো খোদিত রয়েছে যেখানে এর মধ্যে কোন রদবদল করার ক্ষমতা কারোর নেই। এর মধ্যে যে কথা লেখা হয়েছে তা অবশ্যি পূর্ণ হবে । সারা দুনিয়া একজোট হয়ে তাকে বাতিল করতে চাইলে ও তাতে সফল হবে না।
চলবে.........
বিষয়: বিবিধ
১৩২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন