গ্রানাডা ট্রাজেডি : বাংলাদেশ ও বিশ্ব
লিখেছেন লিখেছেন আগুনের ফুলকি ২৯ মার্চ, ২০১৩, ০৬:৫৬:০৫ সন্ধ্যা
মায়ানমারে মুসলমানদের উপর পাশবিক নির্যাতনের আজ একটি ভিডিও দেখে চোখের পানি কোথায় যেন শুকিয়ে গেছে। মনে পড়ে গেল এখন থেকে ৫২০ বছর পূর্বের ইতিহাস। যা ঘটেছিল গ্রানাডায়। সেই ইতিহাসের সাথে বর্তমান মুসলিম দুনিয়ার কিছু চিত্র আমার চিন্তায় ভেসে উঠল। আমার সেই চিন্তা আপনাদের সাথে শেয়ার করব। জানিনা আমার উপস্থাপনায় আপনাদের হৃদয় গহিনে প্রবেশ করাতে পারব কিনা?
৯২ হিজরী মোতাবেক ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলমানরা স্পেন বিজয় করে। এবং সেই থেকে স্পেনে মুসলিম শাসন শুরু হয়। দীর্ঘ ৮০০ বছরের শাসনামলে মুসলমান স্পেনকে পরিণত করেছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের এক স্বর্গ রাজ্যে। স্পেনের গ্রানাডায় বর্তমান যে লাইব্রেরীটি আমরা চিনি এই লাইব্রেরীর প্রায় ৬ লক্ষেরও অধিক বই সংগ্রহ করেছিল মুসলমানেরা। মুসলমান শাসন আমলে স্পেনের নাগরিকরা পেয়েছিল একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র, যেখানে নারীরা তাদের অধিকারের জন্য কোন আন্দোলন করতে হতোনা, নিন্মভিত্তরা খাবারের অভাবে ধুকে ধুকে মরতে হতোনা, ধনি-গরীবের কোন তারতম্য ছিলনা, জোড় করে ধর্মান্তরিত করণ নামক শব্দের সাথে কেউ পরিচিত ছিলনা, ন্যায় বিচারের জন্য বিচারকের দ্বারে দ্বারে কোন মানুষকে দৌড়াতে হতোনা, শিশু,নারী,বৃদ্ধদের অধিকার বিষয়ে কাউকে কথা বলতে হতো না। সর্বোপরি বিরাজ করছিল একটি শান্তি এবং সুশাসন। স্পেনের সুশাসনের প্রভাব যখন বাইরের রাষ্ট্রগুলোতে পড়তে লাগলো, ইয়োরোপীয় নাগরিকরা যখন ইসলামকে জানার সুযোগ পেল তখন টনক নড়ে উঠল কট্টরপন্থী খ্রিষ্টানদের। মহাচিন্তায় পড়ে তারা ভাবতে লাগলো কিভাবে মুসলমানদের ধ্বংস করা যায়। খ্রিষ্টান পাদ্রীরা রাজা ফার্ডিনেন্ডকে পরামর্শ দিল যে, মুসলমানদের ভিতর থেকে এমন খিছু মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে যারা পার্থিব বিষয়ে খুবই চিন্তাশীল। রাজা ফার্ডিনেন্ড তাই করল, সারা স্পেন থেকে কিছু মুসলিমকে খুঁজে বের করল যেখানে অনেক আলেমও ছিল। রাজা এই সকল মুসলমানদের কিনে নিল। এবং এই সংখ্যাটাকে আরো ভারী করার প্রয়াস অব্যাহত লাগল। রাজা দেখল তার আরো একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী দরকার। তাই পাশ্ববর্তী রাজ্যের রাণী ইসাবেলাকে বিয়ে করে তার শক্তি বৃদ্ধি করল। যে সকল মুসলমানদেরকে তারা কিনে নিয়েছে তাদেরকে উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের কাজ ছিল মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করার জন্য কিছু ধর্মীয় কাজ সৃষ্টি করা। এবং বাদশাহ আবুল হাসানের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা। সেই সাথে তারা করত বিচক্ষণ মুসলিম আলেমদের অপহরণ করে হত্যা করত। ফার্ডিনেন্ডের পাতা ফাঁদে না বুঝেই পা ফেলল স্বয়ং বাদশাহ আবুল হাসানের পুত্র আবদুল্লাহ এবং ছোট রাণী তথা আবদুল্ল্যাহর মা।ফার্ডিনেন্ডের গুপ্তচরেরা বাদশার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করল। এভাবে দেশ ব্যাপী প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে চলা ষড়যন্ত্রে স্পেনের মুসলমাদের ঈমান বিনষ্ট হয়ে গেল। স্পেনের সর্বশেষ নেতৃত্ব বাদশাহর ভাতিজা মুসা বিন আবি গাসসানকে গুম করে হত্যা করা হল। তারপরও কিছু মধ্যম সারির আলেমরা যাদের ঈমান মজবুত ছিল তারা জণগনকে বুঝাতে চাইলেও ফার্ডিনেন্ডের ষড়যন্ত্র এত বেশী বিস্তৃত ছিলো যে সকলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যায়ে এসে নিরীহ মুসলমানদের সাতে প্রতারণা খেলায় মেতে উঠলো ফার্ডিনেন্ড ও ইসাবেলা। তারা মুসলমানদেরকে মসজিদে আশ্রয় নিতে কিংবা মরোক্কো যেতে চাইলে খৃষ্টান জাহাজে উঠতে বলল। কিছু সংখ্যক মুসলমান আগেই মরক্কো সফর করেছিল। সরল মনা মুসলমানেরা যখন মসজিদে এবং জাহাজে আশ্রয় গ্রহণ করলো তখন মসজিদের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে এবং জাহাজকে সমুদ্রে ভাসিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। স্পেনের মুসলমানেরা সবশেষে এসে আগুনে পুড়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের নাম মুছে ফেলা হলো। নতুন করে যোগ হলো এক খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের।
মুসলমানেরা তাদের ইতিহাস ভুলে গেলেও খ্রিষ্টানরা তাদের রচিত প্রতারণাকে স্মরণ করে রাখতে সেই দিনটিকে আজো স্মরণ ঝমিয়ে তুলছে। ’এপ্রিল ফুল’ নাম দিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সারা বিশ্বে। আর মুসলিম তরুণরা বিশ্ব বোকা দিবস হিসেবে এই দিনে লোকুচুরির মতো পরস্পরকে ধোঁকা দিয়ে মজা লুটে। সত্যি সেলুকাস।
৮৯৮হিজরী তথা ১৪৯৩ সালের ১ এপ্রিল মুসলমানদেরকে যেভাবে ধোঁকা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল ঠিক তেমনি আজো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। ১৯৯৩ সালের ১লা এপ্রিল খ্রিষ্টানরা গ্রানাডা ট্রাজেডির ৫০০ বছর ফুর্তি উপলক্ষ্যে হোল্ড মেরি ফান্ড বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্বের কোথাও মুসলমানদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিবে না। এবং সেই কর্মসূচী বাস্তবায়নের কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরছি।
১৯৯৩ সালে তারা এই কর্মসূচী ঘোষণা করলেও তার বাস্তবায়ন শুরু হয় অনেক আগ থেকে। তারা মুসলমানদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে মুসলমান নামধারী কিছু ব্যক্তি তৈরী করেছে। যেমন: ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার হু ম এরশাদ এর শাসন চলছিল। ভারতের দুই নাগরিক পদ্মমল চোপড়া ও শীতল সিং ভারতের পদ্মখাস্তগিরের আদালতে কুরআনের কয়েকটি সূরার বিরুদ্ধে আপিল করলে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। বাংলাদেশের মুসলমানরা এর প্রতিবাদ করলে মুখের দাবীতে মুসলমান এরশাদ তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে বাংলার মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে। কিছুদিন আগেও এই প্রতারক জিহাদের কথা বলেন। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি একজন নারী বিলাসী তার মুখ দিয়ে জিহাদের ডাক মানেই হলো
প্রতারণার শ্রেষ্ঠ কৌশল।
১৯৯২-১৯৯৫ সময়ে তৎকালীন বি.এন.পি সরকার বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসা ছাত্রদের উপর নির্যাতন চালায় এবং অনেককে হত্যা করে। তবে এক্ষেত্রে পুলিশের ভুমিকা উল্যেখযোগ্য ভূমিকা না থাকলেও দলীয় ক্যাডার বাহিনীর ভূমিকাই ছিল মুখ্য। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার সারাদেশে ৫০০টিরও অধিক মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়। হত্যা করা হয় অসংখ্য কোরআন প্রেমী যুবককে। নির্যাতনের নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে দেশব্যাপী চালানো হয় নির্যাতনের স্টীম রোলার। কুকুর মাথায় দাড়ি টুপি লাগিয়ে অবমাননা করা হয় ইসলামের ইউনিফরমকে। এবং ২০০১ সালেই প্রথম বুট পায়ে দিয়ে পুলিশ মসজিদের প্রবেশ করে। যা বর্তমানে অহরহ ঘটছে। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে দাড়ি-টুপি পরিহিত কাউকে দেখলেই রাজাকার বলার প্রচলন করা হয়। ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত ইসলামের উপর কোন রকমের আক্রমণ না হলেও ২০০৪ সালে সারাদেশে ইহুদী চক্রে পা দিয়ে জঙ্গীবাদরে সাথে জড়িয়ে পড়ে গ্রানাডার দালালদের মত কিছু মুসলমানেরা। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মুসলমানদের উপর চলছে নানা মুখী নির্যাতন। সারাদেশে দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে সাথে নিয়ে মুসলমান নির্মূলের ইহুদী পায়তারা চলছে। এক্ষেত্রে কিছু ভাড়াটিয়া আলেমকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে শাহবাগের মোড়ে গণজাগরন মঞ্চ নামক ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিদের মাথাছাড়া দিয়ে উঠা, রাণী ইসাবেলার মত আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও শুরু করেছেন মুসলমানদের প্রতারণা দেয়ার নানা কৌশল। একটু যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন, সরকার একদিকে যেমন ইসলামী শক্তিকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে অপরদিকে দেখেন ইসলামের ইউনিফরমদারী কিছু আলেমকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। যে সরকার কোরআন বিরুধী সংবিধান রচনা করে সে সরকার যখন কোন ইসলামী দলের সমাবেশ কিংবা মোটর সাইকেল বহরে পুলিশি নিরাপত্তা দেন তখনি মুসলমানদের বুঝা উচিত শুধুমাত্র ফরিদ উদ্দিন মাসউদ নয় বাংলাদেশে ইসলামের স্বপক্ষে বিচরণ করে পীরবাদি আরো কিছু সংগঠন আছে যারা ইসলামী আনুষ্ঠানিক ইবাদাত রুপদানের ভিতরে সীমাবদ্ধ করে। এমনকি তারা সরকারের বিপক্ষে হাজারো কথা বললেও সরকার যেন তখন বধির থাকে।
এবার আসি মায়ানমার প্রসঙ্গে, মায়ানমারে যে গণহত্যা চলছে তা নতুন কিছু নয়। আমরা জেনেছি যে, গ্রানাডায় মুসলমানদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। মায়ানমারে ঠিক তাই হচ্ছে। হয়তো আরাকান হতে চলেছে নতুন কোন স্পেন। শুধু মায়ানমার নয় হত্যাজঙ্গ চলছে ফিলিস্তিন, বসনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মীর সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে মিসর, ইরান, তিউনিসিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সকল দেশে। প্রশ্ন আসতে পারে ষড়যন্ত্র কিভাবে। উত্তরে আমি শুধু বলব ব্রিটিশ কলোনাইজের সাবেক মন্ত্রী গ্লাগস্টোন এর একটি বক্তব্য। গ্লাডস্টোন বলেছিলেন,
”মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার দুইটি প্রক্রিয়া রয়েছে। ১. তাদের কাছ থেকে কোরআনকে কেড়ে নিতে হবে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। ২. তারা যেন কোরআনের প্রতি ভালবাসা হারিয়ে ফেলে সেই কাজ করতে হবে কৌশলে, আর তা হবে বেশী কার্যকরী।”
আমরা দেখতে পাই যে, বর্তমানে দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় মারাত্মক ভাব কাজ চলছে। বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে কোরআনের অবমাননা করা হচ্ছে কিন্তু আমাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। আমি সকল মুসলিম তরুণদের আহবান জানাব, কোন রাষ্ট্র বা সরকার আমাদের শত্রু নয়। আমরা কাউকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করব না। যারা কোরআনের বিপক্ষে বলে তাদেরকে অবুঝ হিসেবে ধরে নিয়ে আমরা ঈমানের দাওয়াত দিয়ে যাব। মানুষদেরকে ডেকে যাব আল-কোরআনের সুমহান ছায়াতলে। এমন একটি রাষ্ট্র বা সমাজ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব যেমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ)।আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক উপলদ্ধির মাধ্যমে ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন