বিবিসি কে দেয়া সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী কি আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন
লিখেছেন লিখেছেন আগুনের ফুলকি ১০ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:১৫:৫৫ বিকাল
বিবিসি: ইসলামপন্থীদের দাবি অনুযায়ী আপনারা কি ব্লাসফেমি আইন করছেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: এটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই প্রতিটি ধর্মের মানুষেরই অবাধে ও নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম করার অধিকার এখানে রয়েছে। কিন্তু অন্যের ধর্মানুভূতিকে আঘাত করা ঠিক নয়। আমরা সব ধরনের ধর্মীয় অনুভূতিকে রক্ষার চেষ্টা করি। আপনি জানেন, বিশ্বের অনেক দেশেই ব্লাসফেমি আইন চালু আছে। কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের দেশে এ ধরনের আইন প্রণয়নের দরকার নেই। কারণ, প্রচলিত আইনেই আমরা জনগণের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করতে পারি। তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতি সমুন্নত রাখতে পারি। এ ক্ষেত্রে সিআরপিসি, স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (বিশেষ ক্ষমতা আইন) ও সম্প্রতি আইসিটি ‘ল’ (তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন) আছে, এগুলোই যথেষ্ট।
আমার প্রশ্ন: যে আইন ধর্মকে স্বীকার করে না, সে আইনে কিভাবে ধর্মানুভুতিতে আঘাতের বিচার করা হবে? আপনার দলীয় লেজুড় ভিত্তি যেখানে তুঙ্গে অবস্থান করছে, যেখানে স্বয়ং স্পীকার এমনকি ইফা ডিজি সহ বেশীর ভাগ মন্ত্রী এম.পি ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানছে সেখানে কিভাবে ধর্মীয় অনুভুতি সমুন্নত রাখছেন? নাকি এক্ষেত্রে মুসলমানরা নিগৃহীত হবে?
বিবিসি: আপনারা কি ইসলামপন্থীদের দাবি মেনে নিচ্ছেন?
শেখ হাসিনা: এটি মেনে নেওয়া না-নেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। আমি বলেছি, এ মুহূর্তে আমাদের এ ধরনের আইন প্রণয়নের দরকার নেই।
আমার প্রশ্ন: আইন ছাড়া কি বেআইনি কাজের বিচার সম্ভব?
বিবিসি: ইসলামপন্থীদের অন্য দাবিগুলো সম্পর্কে কী বলবেন?
শেখ হাসিনা: আমরা সব কটি দাবি খতিয়ে দেখব। কোনো দাবি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলে তা পূরণ করা হবে। আর যেগুলো আমাদের দেশের জন্য, জনগণের জন্য উপযুক্ত মনে হবে না, সেগুলো মানা হবে না। কিন্তু কোনো দাবি যদি দেশ কিংবা জনগণের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলে মনে হয়, তাহলে তা পূরণ করা হবে।
আমার প্রশ্ন: বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমাবেশ ঘটল গত ৬ এপ্রিল, যা দ্বারা প্রমাণিত হয় এই দাবী গুলো অধিকাংশ জনগণেরই। তাহলে কি আপনি সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণের কল্যাণের কথা ভাবছেন না?
বিবিসি: আপনার সমালোচনাকারীদের অভিযোগ, ইসলামপন্থীদের চাপের মুখে আপনি আপস করছেন। আপনি বলছেন, এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এর ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য রয়েছে, কিন্তু সম্প্রতি কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইসলামপন্থীদের দাবির মুখেই কি তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে?
শেখ হাসিনা: না, না, মোটেও তা নয়। আমি আপনাকে বলেছি, যদি কেউ কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে কিংবা কোনো ধর্মীয় নেতাকে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে প্রচলিত আইনে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমরা ইতিমধ্যে একটি কমিটি গঠন করেছি। ওই কমিটি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্লগ বা ফেসবুকের নানা লেখালেখি খতিয়ে দেখছে। যদি কারও বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা এমন কিছু লিখেছে, যা আইনের পরিপন্থী।
আমার প্রশ্ন: প্রমাণ ছাড়া যখন কাউকে গ্রেফতার করা হবেনা বলছেন, তাহলে শুধুমাত্র যুদ্ধপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে কেন গ্রেফতার করা হয়েছে? তাহলে কি বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে নাম মাত্র স্বাধীন?
বিবিসি: কিন্তু তাঁদের তো কয়েক মাস আগেও গ্রেপ্তার করা যেতে পারত। তা করা হয়নি। ইসলামপন্থীরা বিক্ষোভ শুরুর পরই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলো।
শেখ হাসিনা: আমরা একটা কমিটি গঠন করেছি। কমিটি নানা বিষয় খতিয়ে দেখেছে।...দেখুন, কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে কিছু প্রমাণ থাকা প্রয়োজন। আর প্রমাণ সংগ্রহে কিছু সময়েরও দরকার পড়ে।
আমার প্রশ্ন: পূর্বের প্রশ্ন আবারই, তাহলে ট্রাইবুন্যাল শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করেছে?
বিবিসি: বাংলাদেশ কি তার ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য থেকে সরে আসছে?
শেখ হাসিনা: অবশ্যই না। আমরা আমাদের সংবিধানে সংশোধনী এনেছি, যেকোনো মানুষের ধর্ম চর্চার অধিকার নিশ্চিত করেছি। আমার দল, আওয়ামী লীগ সব সময়ই বিশ্বাস ও সমর্থন করে, প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। আমরা তা-ই নিশ্চিত করি।
আমার প্রশ্ন: ঐতিহ্য কি? যা কয়েক বছর স্থায়ী থাকে তাই, নাকি যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তা? বাংলাদেশের স্বাধীণতা যুদ্ধে যেখানে অস্থায়ী সরকার গঠনের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত হয়, যেখানে স্বাধীনতার স্লোগান ছিল ”বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিষ্টান আমরা সবাই বাঙালী।” সেখানে ধর্ম নিরপেক্ষ ঐতিহ্য আপনি কোথায় পেলেন?
বিবিসি: কিন্তু সম্প্রতি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কয়েক সপ্তাহ ধরে হামলা চালানো হয়েছে। আমি বেশ কয়েকজন হিন্দু নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা এসব ঘটনায় ভীতসন্ত্রস্ত। তাঁদের অভিযোগ, এ ধরনের হামলা প্রতিরোধে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি।
শেখ হাসিনা: এ অভিযোগ সত্য নয়।
আমার প্রশ্ন: যেখানে দৈনিক পত্রিকা সহ অধিকাংশ মিডিয়ায় রিপোর্ট এসেছে যে, আপনার দলীয় লোকেরাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির পুড়ারো সহ সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাথে জড়িত, এই জন্যই কি অভিযোগ সত্য নয়?
বিবিসি: তাঁদের মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। এখনো তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন।
শেখ হাসিনা: দেখুন, জামায়াতের নেতা-কর্মীরা শুধু হিন্দুদের মন্দিরই ভাঙেনি, তারা বৌদ্ধমন্দির, খ্রিষ্টানদের উপাসনালয়, এমনকি মসজিদেও হামলা চালিয়েছে। আপনি জানেন, আমাদের জাতীয় মসজিদের ভেতরেও আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। আর সরকার এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পরও যদি বলেন, সরকার কিছুই করছে না, এটা সত্য নয়। যেখানে যেকোনো ধরনের ঘটনা ঘটানো হোক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে যায়। প্রতিরোধের চেষ্টা করে। আমরা এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আপনি কাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, আমি তা জানি না। তবে আমরা এ বিষয়ে খুবই সতর্ক। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
আমার প্রশ্ন: শুধু মিডিয়া নয় স্বয়ং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বলছে আপনার দলীয় লোকেরাই এসব করছে এবং জামায়াত-শিবির মন্দির পাহারা দিচ্ছে এবং আপনি বলছেন, কোন অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা হয়না সেখানে প্রমাণ ছাড়া আপনি একটি দলের নেতাকর্মীদেরকে দায়ী করছেন কিসের ভিত্তিতে?
বিবিসি: দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামী হরতাল দিচ্ছে। হরতাল করছে দেশটির প্রধান বিরোধী দলও। এখন ইসলামপন্থীরাও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। তাহলে বাংলাদেশ কি এখন সন্ধিক্ষণ (ক্রসরোড) পার করছে?
শেখ হাসিনা: অবশ্যই না। হরতাল খুবই মামুলি কর্মসূচি। আর এটা তো একটা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ। যে কেউ চাইলে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারে। আমরা কাউকে থামিয়ে দিই না। সব সময়ই তাদের সুযোগ দিই। কারণ, কর্মসূচি পালনের অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু আমরা শুধু জনগণের জানমাল রক্ষার চেষ্টা করি। জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখতে চাই। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আমার প্রশ্ন: হরতাল যদি মামুলি ব্যাপার হয় এবং এটা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার হয় তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং আপনার দলীয় বাহিনী দিয়ে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ হত্যা করা হলো কেন?
বিবিসি: আশঙ্কা করা হচ্ছে, সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারে।
শেখ হাসিনা: কেন আমি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে যাব? জনগণকে রক্ষায় আমাদের আইনের তো আর অভাব নেই। তবে হ্যাঁ, কিছু লোক আছে, যারা নানা ধরনের গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছে।
আমার প্রশ্ন: তাহলে বিজিবি মোতায়েন এবং বগুড়ায় সেনা বাহিনী নামানো হলো কেন?
বিবিসি: বাংলাদেশে সম্প্রতি অনেক বিক্ষোভ করা হয়েছে। বেশির ভাগ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে জামায়াত। এ ছাড়া প্রধান বিরোধী দলও এতে অংশ নিয়েছে। গত কয়েক মাসে বিক্ষোভ চলাকালে সংঘর্ষে ৮০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করছে।
শেখ হাসিনা: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। আপনি জানেন, কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও নিহত হয়েছেন। জামায়াত ও বিরোধী দলের লোকেরা এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। আপনি যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ দেশের ইতিহাসের দিকে নজর দেন, তাহলে দেখতে পাবেন, বহু জঙ্গি হামলা চালানো হয়েছে। কেবল আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গত চার বছরে আমরা শক্ত হাতে সব ধরনের জঙ্গি তৎপরতা প্রতিহত করেছি। আমরা হত্যাসহ সব ধরনের জঙ্গি তৎপরতা দমন করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আন্দোলনের নামে এখন তারা জনগণের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ওরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করছে। আমাদের দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করছে। জনগণের জানমাল রক্ষা করাই তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব।
আমার প্রশ্ন: যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা কি জনগণের বাইরের কেউ? আপনি জঙ্গীবাদের কথা বলছেন, তাহলে শোলাকিয়ার ইমাম যেখানে সরাসরি ২০০৪ সালের সিরিজ বোমা হামলার সাথে জড়িত তাকে কেন আপনার ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছেন?
বিবিসি: কিন্তু বেশির ভাগ লোকই তো নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে।
শেখ হাসিনা: আচ্ছা, আপনিই বলুন, পুলিশের ওপর যদি কেউ নৃশংস হামলা চালায়, তখন পুলিশ করবেটা কী? আপনি কি সেই সব দৃশ্য দেখেছেন? কী ভয়ানকভাবেই না পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। নৃশংসভাবে পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কী করতে পারে পুলিশ! কাজেই আপনি তাদের দায়ী করতে পারবেন না।
আমার প্রশ্ন: কিন্তু ভিডিও ফুটেজেতো দেখা যায় পুলিশের হামলা থেকে আত্ম রক্ষার জন্য ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হলেও যে সকল পুলিশ নিহত হয়েছে তাদেরকে গুলি করেছে পুলিশ কর্মকর্তা কারণ তারা জনগণের উপর গুলি করতে অস্বীকার করেছে?
বিবিসি: প্রধান বিরোধী দল ও জামায়াতের অভিযোগ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে বিচার চলছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বেশির ভাগ আসামিই বিরোধী দলের নেতা। এর মধ্য দিয়ে আপনি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন।
শেখ হাসিনা: দেখুন, আপনি জানেন, আমার বাবা জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচার যখন শুরু হয়, তখনো এ ধরনের কথা রটানো হয়েছিল। কারা এসব ছড়ায়? এরাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অপরাধ করেছে। আমাদের জনগণকে হত্যা করেছে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। হানাদার বাহিনী আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে। আর তাদের দোসর ওই লোকগুলোই তখন হানাদারদের হাতে নারীদের তুলে দিয়েছিল। এরাই যুদ্ধাপরাধ করেছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর বহু দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
আমার প্রশ্ন: আপনার পিতার হত্যাকারীরা নিজেরাই হত্যার জন্য দম্বসহকারে কথা বলত কিন্তু মানবতা বিরোধী অভিযোগে যাদের বিচার করছেন তাদেরতো আমার বয়সে কোন মানবতা বিরোধী অপরাধ করতে দেখিনি এবং শুধুমাত্র অভিযোগ এনে তাদেরকে প্রমাণছাড়া বিচার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী যেখানে আসামীর পক্ষে কথা বলেছেন সেখানে তাদেরকে অপহরণ করা হয়েছে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে আপনি এই বিচার কাজ সম্পন্ন করছেন নাকি প্রহসনের রাজনীতিই আপনার মুলনীতি?
বিবিসি: কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে, তাতে মানুষ মনে করছে যে, আপনি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছেন।
শেখ হাসিনা: অবশ্যই না। কিন্তু বিরোধী দল যদি মনে করে, তারা যুদ্ধাপরাধের অংশ, তাহলে এ বিষয়ে আমাদের কিছু করার নেই। তবে এটা সত্য যে, যেসব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং যাঁদের বিচার চলছে, তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। তবে আমার প্রশ্ন, বিরোধী দল কেন এসব যুদ্ধাপরাধীকে রক্ষা করতে চাইছে?
এ দেশকে স্বাধীন করতে বহু মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটা জনগণের দাবি যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। ১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল? গণহত্যা ঘটানো হয়েছিল। কাজেই আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করব এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার-প্রক্রিয়া চলছে, তা সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে ও দেশের আইন অনুসারেই করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিচারে আপিলের বিধানও রাখা হয়েছে। যদিও অনেক ট্রাইব্যুনালেই এ ধরনের সুযোগ নেই। আমরা আপিলের সুযোগ রেখেছি; কারণ, কোনো পক্ষ যদি বিচারে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে তারা হাইকোর্টে আপিল করতে পারবে। কাজেই এটা কীভাবে বলা সম্ভব যে, এখানে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়নি।
আমার প্রশ্ন: বিবিসির প্রশ্নছিল মানুষ বলছে আর আপনি উত্তরে চলে গেছেন বিরোধী দলের দিকে, তাহলে কি দেশে কোন মানষ নেই? যে বিচার প্রক্রিয়ায় কোন বিদেশী কোন আইনজীবী আসতে চাইলেই বাঁধা দেয়া হয় সেই বিচার প্রক্রিয়া কিভাবে আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রাখছে?
বিবিসি: কিন্তু দেশটা বিভক্ত হয়ে গেছে। মানুষ বিচারের প্রতিবাদ করছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষ রাস্তায় ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে...জাতি তো স্পষ্ট বিভক্ত হয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা: কোনোভাবেই দেশ বিভক্ত হয়নি। খুবই কমসংখ্যক মানুষ, একটি ছোট গোষ্ঠী এটা করছে। সমগ্র জাতি এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে না, বরং আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কথা ছিল এবং জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে। কাজেই এটা জনগণের দাবি এবং খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ এ ধরনের কথা বলতে পারে। কাজেই পুরো জাতি এর বিরোধিতা করছে না। বরং আমাদের জাতি চায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হোক এবং এটা হলেই দেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে।
আমার প্রশ্ন: শুধুমাত্র কমসংখ্যক মানুষ যদি এই বিচারের বিরোধীতা করত তাহলে জনগণই তাদের বিরোধীতা করত কিন্তু আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাই জনমত জরিপে আপনার কথার বিরোধীতা বেশী হয়, কেন? আর আপনি শুধু ইশতেহারের একটা মাত্র অঙ্গিকারের কথা বললেন বাকী গুলোর কি অবস্থা?
বিবিসি: ...প্রধান বিরোধী দল বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না—এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন।
শেখ হাসিনা: এখন বিরোধী দল এ কথা বলছে। কিন্তু আপনি যদি দেখেন, ২০০৮ সালে তারা কী বলেছে; দেখবেন, সেটা একেবারেই ভিন্ন জিনিস। মূল বিষয়টা হলো যে, আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। কিন্তু নির্বাচন কী? জনগণের সাংবিধানিক অধিকার থাকবে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে। কাজেই তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার চর্চার সুযোগ থাকতে হবে। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করার অধিকার জনগণের থাকতে হবে এবং নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে।
আমার প্রশ্ন: কোন দলীয় সরকার কি কখনো নিরপেক্ষতার উর্ধ্বে উঠতে পারে?
বিবিসি: কিন্তু তারা যে বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
শেখ হাসিনা: ঠিক আছে। কিন্তু এটা তো তাদের প্রমাণ করতে হবে। গত চার বছরে নির্বাচন কমিশন পাঁচ হাজার ৫৫৪টি নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার ও মেয়র নির্বাচনসহ ১৫টি উপনির্বাচনও রয়েছে। অনেক নির্বাচনেই বিরোধী দলের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন যদি অবাধ ও নিরপেক্ষ না হতো, তাহলে বিরোধী দলের প্রার্থী কীভাবে জয়ী হলো? আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আর জনগণ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। কাজেই প্রার্থীটা কে? প্রার্থী কোন দলের সেটা কোনো বিষয় নয়। কাজেই আমরা দেখব যে, জনগণ অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারছে কি না।
আমার প্রশ্ন: স্থানীয় নির্বাচনে ব্যক্তির ইমেজ কাজ করে এবং জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ইমেজ কাজ করে, অপরদিকে স্থানীয় এবং উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সন্ত্রাসীরা প্রভাব খাটিয়ে বিজয়ী হয়েছেন অনেকে জায়গায় এই অভিযোগ করেছেন? বিষয়টি আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বিবিসি: ...কিন্তু যে যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, তারা তো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনে অংশ নেবে না।
শেখ হাসিনা: তাহলে আপনি বিরোধী দলকে জিজ্ঞেস করেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে আমাদের সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাদের প্রার্থী জয়ী হলো কীভাবে? তারা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে, সেটা সব সময়ই আমাদের ২০০৭-২০০৮ সালের পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমার প্রশ্ন: আপনি তখন বলেছিলেন, ঐ সরকার আপনাদের আন্দোলনের ফসল, আর এখন বলছেন সে সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, অর্থাৎ সময়টা খুব খারাপ ছিল। তার মানে কি ২০০৬ সালে আপনারা যে আন্দোলন করেছেন তা সম্পুর্ণ ভূল করেছেন?
বিবিসি: কিন্তু সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অনেক গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। কারণ, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের অনেক ঘাটতি রয়েছে।
শেখ হাসিনা: প্রত্যেক দেশেই প্রধান রাজনৈতিক দল মূলত দুটি বা তিনটি। সেখানে অন্যান্য দলও থাকে যারা নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু মূল প্রশ্নটা হলো, নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী কি না। আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে। আর নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে তিনি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং সব ধরনের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। প্রধান বিরোধী দলও ওই আলোচনায় অংশ নিয়েছে। তারাও তাদের পরামর্শ দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সবার মতামত ও পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। আর সেই কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে। এই নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। আমরা এ নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করেছি, যাতে তারা অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারে। আর আমি সারা জীবন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করেছি। কারণ, নির্বাচনে কীভাবে কারচুপি করা হয়, তা আমি দেখেছি। নির্বাচনকালীন সহিংসতাও আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু আমাদের সরকারের আমলে পাঁচ হাজার ৫৫৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কোথাও সহিংসতা হয়নি।
আমার প্রশ্ন: রাষ্ট্রপতি কি দলীয় নয়? যদি দলীয় হয় তাহলে তিনি যে কমিশন গঠন করুন না কেন তা কখনো দলীয় সংকীর্ণীতার উর্ধ্বে উঠতে পারে কি? আপনি বলেছেন নির্বাচনে কিভাবে কারচুপি হয় আপনি দেখেছেন তার মানে কি আপনি কারচুপি করে এসেছেন? বা কারচুপির কথা ভাবছেন?
বিবিসি: দুই প্রধান দল তো এখনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে কথা বলছে না। কাজেই আপনি কীভাবে ভাবতে পারেন, প্রধান বিরোধী দল তাদের মূল দাবি পূরণ ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেবে?
শেখ হাসিনা: তারা যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, রাজনৈতিক দল হিসেবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমার প্রশ্ন: ক্ষতির ধরণটা একটু জানাবেন?
বিবিসি: তাহলে সেই নির্বাচন কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?
শেখ হাসিনা: জনগণ অংশ নেবে। আমি আশা করি, তারাও অংশ নেবে। তারা যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তারা আসন হারাবে। কারণ, তাদের অনেক নিশ্চিত আসন রয়েছে।
আমার প্রশ্ন: নিশ্চিত আসন বলতে কি বুঝাতে চান? তার মানে কি আপনারা সে সকল এলাকায় কোন উন্নয়ন মুলক কাজ করেননি যে আপনার দল ঐ সকল এলাকায় বিজয়ী হবে?
বিবিসি: তাহলে বিরোধী দল অংশ না নিলেও আপনি কি নির্বাচন করবেন?
শেখ হাসিনা: এটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। আমি এ ক্ষেত্রে কী করতে পারি? পার্লামেন্টে আমার যথেষ্ট শক্তি আছে। সংবিধানে আমি যেকোনো ধরনের পরিবর্তন আনতে পারি। কিন্তু আমি তো সেটা করতে যাচ্ছি না। এ দেশে আপনি যদি আমাদের ইতিহাস দেখেন, তাহলে দেখবেন, শুধু একবারই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। শুধু সেই সময়েই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর হয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় কী ঘটেছিল? সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ভোটার তালিকা ছিল ভুলে ভরা। তালিকায় প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে সময়ে নির্বাচন কমিশনও গঠন করেছিল সরকার এবং প্রতিষ্ঠানটি ছিল একেবারেই দুর্বল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো তখন ছিল। অথচ তারা নির্বাচন করতে পারেনি। তারা নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। সাধারণত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা সময়মতো নির্বাচন করতে পারেনি। কাজেই সুশীল সমাজের যেসব প্রতিনিধি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, তাঁরা পদত্যাগ করেন। সেই ঘটনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে।
আর সে সময় কী ঘটেছিল? তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের দুজনকেই কারাগারে পাঠায় এবং আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়। কাজেই আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী সেই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি চাইছেন কি না, আমি তা জানি না।
আমার প্রশ্ন: আপনি কি এবার শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইছেন না যে কারণে বিরোধী দল বিহীন নির্বাচন করতে চাইছেন? আপনি আবার সেনা সমর্থিত সরকার আসার আশংকা করছেন?
বিবিসি: বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেছেন, সেনাবাহিনী নীরব বসে থাকতে পারে না। আর আপনি বলেছেন, সেনাবাহিনীর সংবিধান রক্ষা করা উচিত। কাজেই আপনারা দুজনই কি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন? দুজনেই সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কথা বলছেন?
শেখ হাসিনা: না, আমি সেনা হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছি না, বরং আমি কখনোই সেনা-সমর্থিত বা সেনাবাহিনীর শাসনকে সমর্থন দিইনি। আমি শৈশব থেকেই সেনাশাসনের বিরোধিতা করছি। অর্থাৎ, আইয়ুব খানের সময় থেকেই আমি এর বিরোধিতা করে আসছি।
আমার প্রশ্ন: আপনি সেনা শাসনের বিরোধীতা করেন, তাহলে বিগত নির্বাচনে আপনি সাবেক সেনা শাসককে নিয়ে নির্বাচন করেছেন কেন?
বিবিসি: বিরোধীদলীয় নেত্রী সামরিক শাসন সম্পর্কে বলছেন...
শেখ হাসিনা: তিনি সেনাশাসন সম্পর্কে বলতেই পারেন। কারণ, তাঁর দল গঠিত হয়েছিল সামরিক স্বৈরশাসকের মাধ্যমে। তাঁর স্বামী সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এমনকি তিনি সামরিক আইন লঙ্ঘন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আমার প্রশ্ন: তার দল যখন গঠিত হয় তখন আপনি এর প্রতিবাদ করেননি কেন? অর্থাৎ সেনা সরকারের প্রতিবাদ করেননি কেন? তাঁর স্বামীই তো আপনাকে দেশে নিয়ে এসেছেন আপনি কি কৃতজ্ঞতাও জানাবেন না?
বিবিসি: সেনা-সমর্থিত আরেকটি সরকার আসার কোনো সুযোগ আছে কি?
শেখ হাসিনা: না, না, আমাকে শেষ করতে দিন। যেহেতু তাঁর দল গঠিত হয়েছিল একজন সামরিক স্বৈরশাসকের হাত দিয়ে; তাই তিনি সম্ভবত মনে করেন, সেনাবাহিনী আসবে এবং তাঁকে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে। কিন্তু এ দেশে, বর্তমান বিশ্বে এটা সম্ভব নয়। আমাদের জনগণের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা সব সময় জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করি এবং আমরা সংবিধান সমুন্নত রাখব। এই দেশ সংবিধান অনুসরণ করে চলবে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে আপনি জানেন, হাইকোর্টের রায় রয়েছে। তাই তিনি কীভাবে (খালেদা) এ রকম বলতে পারেন?
আমার প্রশ্ন: আপনি বলেছেন আপনি আইন করে সব কিছু করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে কি এ রায় আপনার তৈরী?
বিবিসি: কিন্তু একই রায়ে এটাও তো বলা হয়েছে যে, দেশে আগামী দুই দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে। আদালতের রায়ে সেই পরামর্শ রয়েছে।
শেখ হাসিনা: পরামর্শ দিয়েছেন এবং শুধু তা-ই নয়, বিষয়টি নির্ধারণের দায়িত্ব সংসদের। যদি সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে কীভাবে সেটা সম্ভব? এবং কেন আমরা এই দেশকে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাব? আমাদের বিরোধী দল যদি গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করে, তাহলে তাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত। যদি তারা বিশ্বাস করে, তাদের পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে; যদি তারা মনে করে, এই সরকার ব্যর্থ হচ্ছে; তাহলে তাদের সামনে তো সব সুযোগই রয়েছে। এবং আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু এবং জনগণ সেখানে ভোট দেবে। তাই তারা (বিরোধী দল) যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাদের ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ থাকবে। তাহলে কেন তারা ভয় পাচ্ছে? কেন তারা নির্বাচনে আসতে চাইছে না?
আমার প্রশ্ন: আপনিতো সরকার প্রধান, আপনি চাইলেই সংসদ তা কার্যকর করে? তাহলে আমরা বলব আপনি সংসদের দোহায় দিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছেন?
বিবিসি: বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে প্রায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মুখ দেখে আসছে। কিন্তু এখন বহির্বিশ্ব, পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বেগের সঙ্গে দেখছে, পাঁচ-ছয় মাস ধরে বাংলাদেশে কী হচ্ছে? সবকিছু নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে দ্বিধা করছে। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে পোশাকশিল্পে উদ্বেগ রয়েছে। তাই বাংলাদেশে যা হচ্ছে, সে ব্যাপারে বহির্বিশ্বকে আপনি কী বলবেন?
শেখ হাসিনা: দেখুন, আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হবে না। এটা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। এটি চলবে এবং এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমরা জানি, কীভাবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। এটা নতুন কিছু নয়।
আমার প্রশ্ন: আপনি এ জানেন যে কিভাবে এ জাতীয় পরিস্থিতি তৈরী করে বিরোধী দলকে চাপে রাখতে হয়?
বিবিসি: কিন্তু রপ্তানিকারকেরা তো সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারছেন না। ফলে কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বলছেন, দেশের অর্থনীতি কোটি কোটি মার্কিন ডলার হারাচ্ছে। কিন্তু প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনা: রপ্তানিকারকদের পণ্য সময়মতো পাঠানোর জন্য আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিয়েছি। এতে কোনো সমস্যা হবে না, আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম ভালোভাবেই চলছে এবং এটা সচল থাকবে। আর আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেবল ঢাকা শহরভিত্তিক নয়। আমাদের দেশটি বড়, তাই এটা চলবে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। হ্যাঁ, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে হয়তো অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তবে আমি বেশ আত্মবিশ্বাসী।
আমার প্রশ্ন: যেখানে সপ্তাহে সাতদিনে ৬দিনই অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে সেখানে আপনার আত্মবিশ্বাস দেখে কি অবাক হব?
বিবিসি: বিশেষ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ের পরপরই শত শত তরুণ ব্লগার ও অনলাইনকর্মী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে শাহবাগে বিক্ষোভ শুরু করেন। ফাঁসির রায়ের দাবিতে তাঁদের সেই বিক্ষোভ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে। সেই একই আন্দোলনকারীরা এখন মনে করছেন, আপনি ও আপনার সরকার তাঁদের দমন করছেন। কারণ, আপনারা ব্লগারদের গ্রেপ্তার করছেন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিচ্ছেন।
শেখ হাসিনা: হ্যাঁ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু আপনি কারও ব্যক্তিগত অনুভূতিতে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারেন না অথবা আপনি কোনো ধর্ম বা কোনো ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে এ রকম কিছু লিখতে পারেন না। যদি সেটা করে থাকেন, তাহলে আপনাকে পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। তাই এ ব্যাপারে খতিয়ে দেখার জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। যদি তারা কাউকে দোষী হিসেবে শনাক্ত করে, তাহলে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন, হ্যাঁ, তারা দাবি জানাচ্ছে। আর এটা স্বাধীন দেশ। আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। আর সে জন্যই তারা বিক্ষোভ আয়োজন করতে পারে, নিজেদের দাবি জানাতে পারে। তাই আপনি বলতে পারেন না যে, এ দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই।
আমার প্রশ্ন: আপনি আবারও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বললেন, তাহলে চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করলেন কেন? আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক সহ এক সাংবাদিককে ৯ মাস কারাগারে রাখলেন কেন?
বিবিসি: আপনার জোট সরকারের শরিক দলগুলোর কয়েকজন নেতা, বামপন্থী নেতা, অনলাইনকর্মীদের গ্রেপ্তার করায় আপনার সমালোচনা করছেন।
শেখ হাসিনা: আমি সব সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমরা নিশ্চিত করে বলছি। কিন্তু এখন আমাকে এই দেশটা চালাতে হবে, তাই না? আমাকে জনগণের জন্য কাজ করতে হবে। এ দেশে সবাই স্বাধীন। সব গণমাধ্যম স্বাধীন। তারা যা ইচ্ছে বলতে পারে। কিন্তু আমি জানি কী করতে হবে, কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে। তারা দাবি করতে পারে। এখন একটি দল এক ধরনের দাবি নিয়ে আসছে। অন্য দল অন্য কোনো দাবি জানাচ্ছে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার এবং সেটাই তারা করছে। আর আমাকে কাজ করতে হবে আমাদের আইন ও সংবিধান অনুযায়ী। এবং এটি একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারও কোনো অধিকার নেই। প্রত্যেকটি ধর্মকেই আমাদের রক্ষা করতে হবে।
আমার প্রশ্ন: এত কিছুই যখন করতে হবে, তাহলে দেশকে শুধু শুধু ধর্মনিরপেক্ষ বানিয়ে সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কি দরকার ছিল?
বিবিসি: সরকারের নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করার ব্যাপারে আপনি কি আত্মবিশ্বাসী?
শেখ হাসিনা: অবশ্যই। কেন নয়? কয় মাস বাকি আছে?
আমার প্রশ্ন: এত আত্মবিশ্বাসের শক্তি কি একটু জানাবেন?
বিবিসি: আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য বর্তমান সরকারের আছে?
শেখ হাসিনা: অবশ্যই আছে।
আমার প্রশ্ন: কিভাবে?
বিবিসি: প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আপনার আলোচনায় বসার কোনো সুযোগ আছে কি?
শেখ হাসিনা: আমার দরজা খোলা রয়েছে। আর আলোচনার জন্য আমরা ইতিমধ্যে তাদের প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের কাছ থেকে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয়, তারা প্রত্যাখ্যান করে।
আমার প্রশ্ন: আপনার যুগ্ম মহাসচিব তো এখনো বলে কোন সংলাপ হবে না?
বিবিসি: তারা অভিযোগ করছে, সরকার অর্থবহ কোনো প্রস্তাব দিচ্ছে না।
শেখ হাসিনা: কীভাবে এটি অর্থবহ হবে, আমি জানি না। তাদের এটি ব্যাখ্যা করা উচিত।
আমার প্রশ্ন: আপনার দলের একেক জন মন্ত্রী একেক কথা বলেন, তাহলে তারা কিভাবে এটাকে অর্থবহ মনে করবে?
বিবিসি: আদালতের পক্ষ থেকে প্রধান দুই নেতাকে আলোচনায় বসতে বলা হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন না যে, এটা বহির্বিশ্বের দৃষ্টিতে অদ্ভুত মনে হতে পারে?
শেখ হাসিনা: এ রকম হওয়াটাও আসলে অদ্ভুত। কারণ, এটা আদালতের কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু কেউ একজন আদালতে গেছেন। আদালত কী করতে পারেন? তাঁরা নির্দেশ দেবেন? সেটা কীভাবে? তাই এটা বেশ হাস্যকর ব্যাপার, এটা সত্যি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি বেশি মন্তব্য করতে পারি না। কারণ, বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে আমি মন্তব্য করব।
আমার প্রশ্ন: বিচার প্রক্রিয়া কবে শেষ হবে? আমরা কবে মন্তব্য শুনতে পারব?
সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ নেয়া হয়েছে গতকালের প্রথম আলো থেকে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন