দেশের জন্যে প্রয়োজন নির্দলীয় চৌকস রাষ্ট্রপতি

লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ২৯ মার্চ, ২০১৩, ১১:৩৫:১৬ রাত

হরতাল ও সংঘাতে আক্রান্ত বিভক্ত বাংলাদেশে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। রাজনৈতিক সংকটও জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রাজনৈতিক সহনশীলতা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শালীনতাবোধ অন্তর্হিত। বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের নিম্নস্বরে উচ্চারিত সাবধান-বানীর প্রতি কেউ কর্ণপাত করছে না। দেশের ভবিষ্যত চিন্তা করে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। কিন্তু রাজনীতিকরা নির্বিকার। রাজনৈতিক বিভাজন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সবার মনে প্রশ্ন, এর শেষ কোথায়

সরকারী দল এবং বিরোধী দল পুরানো ব্লেইম গেইম নিয়ে ব্যস্ত। অথচ সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আর মাত্র নয় মাস বাকি আছে। বিএনপি বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না। সরকার তা নিয়ে কোন আলোচনা করতে রাজি নয়। প্রধান মন্ত্রী বিরোধী দলের নেত্রীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ভাষা ব্যবহার করে পাকিস্তান চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। এর জবাবে বিনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বরং বিদেশ যাবার অভ্যাস আছে। তিনি হয়তো বিগত সেনাশাসনের সময় প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকায় চলে যাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন। এ দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রেহিতার অভিযোগও এনেছেন। বেগম জিয়ার অপরাধ, তিনি বগুড়ায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করতে গিয়ে এমন কথা বলেছেন যা ‘আপত্তিকর’। এ নিয়ে রাজনৈতিক কলামিস্টরাও গেল গেল বলে চিৎকার করছেন। ২৫ মার্চ মানব জমিনে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে আমরা দেখতে পাই, ‘বগুড়ায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের সমবেদনা জানাতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন সেনাবাহিনী এসেছিল। প্রতিবাদী মানুষকে লক্ষ্য করে তারা গুলি চালায়নি। এজন্য তাদের ধন্যবাদ। তারা শান্তি মিশনে গিয়ে অন্য দেশের মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করে। আর নিজের দেশের মানুষকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য তারা চেয়ে চেয়ে দেখতে পারে না। প্রয়োজনের সময় তারাও দায়িত্ব পালন করবে। গতকাল বগুড়ার মাটিডালি বিমান মোড়ে শোকসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ’ খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা কি না তা দেশবাসী বিচার করবে। আমাদের মতে বিরোধী দলীয় নেত্রী ‘প্রয়োজনের সময় তারাও দায়িত্ব পালন করবে’ না বলে তিনি বলতে পারতেন, ‘প্রয়োজনের সময় তারা সঠিক ভুমিকা পালন করেছে’। তা হলে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ থাকতো না।

এ সকল ফালতু বিতর্ক বাদ দিয়ে দেশের প্রয়োজনে সরকারকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনই সমাধান করতে হবে। দেশের একজন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সমাধান করা এ মুহুর্তে সরকারের প্রধান দায়িত্ব। আইন বা সংবিধান অনুযায়ী সরকারী দলই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করবে। জাতীয় সংসদে সরকারী দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী। তাই আইনতঃ রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ব্যাপারে বিরোধী দলের সাথে তাদের পরামর্শের কোন প্রয়োজন নেই। এর পরও নানা দিক বিবেচনায় এনে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ব্যাপারে কথা বলছেন।

আওয়ামী লীগের দাবি হচ্ছে, মরহুম জিল্লুর রহমান দলীয় লোক ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দেশের সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে তাতে বোঝা গেছে দলীয় লোক হলেও তিনি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এটা ঠিক, তাঁর মৃত্যুতে আমরা সবাই শোক প্রকাশ করেছি এবং তাঁর মহৎ গুণাবলীর প্রশংসা করেছি। মরহুম জিল্লুর রহমানের ভদ্র ব্যবহার, শালীনতাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা বাংলাদেশের রাজনীতিকদের জন্যে অবশ্যই অনুসরণযোগ্য। কিন্তু মৃত্যু-পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে কোন ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করা যায় না। মরহুম জিল্লুর রহমানের অনেক মহৎ গুণ ছিল। তবে একজন রাষ্ট্রপতির নিকট দেশবাসীর আরো অনেক প্রত্যাশা ছিল যা তিনি পূরণ করতে পারেননি। একজন নিবেদিতপ্রাণ গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ রোধ-কল্পে তাঁর কোন ভূমিকা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেনি। তাঁর চোখের সামনে সরকার বিরোধীদলের সভা-সমাবেশের উপর নগ্নভাবে হামলা চালিয়েছে। সরকারবিরোধী বিভিন্ন দলের সমাবেশে পুলিশ বাহিনীকে এমন ভাবে লেলিয়ে দিয়েছে যে তারা রাজপথে দাঁড়াতেই পারেনি। সরকার পুলিশকে অবারিত লাইসেন্স দিয়েছে এবং পুলিশ পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। রাষ্ট্রপতি কঠোর হলে সরকারকে এ ব্যপারে সংযত করতে পারতেন।

শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপতির সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতা বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত রয়েছে। সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি কোন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর সাজা মওকুফ করে দেবার ক্ষমতা রাখেন। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যে কোন দণ্ড স্থগিত, হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট ২১ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ মওকুফ করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট ২৫ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছেন এর মধ্যে ১৯৮৭ সালে ১ জন, ২০০৫ সালে ২জন, ২০০৮ সালে ১ জন, ২০০৯ সালে ১জন, ২০১০ সালে ১৮ জন এবং ২০১১ সালে ২জন । এর অর্থ হচ্ছে ক্ষমাপ্রাপ্ত ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান-ই মাফ করে দিয়েছেন। এটা কি তার মহানুভবতা, না কি দলীয় আনুগত্য? যে দলীয় আনুগত্য ২১ জন দন্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামীকে মাফ করে দিতে বাধ্য করে সেটা কি মহত্ত্ব না দুর্বলতা?

রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশের বর্তমান অবস্থায় এমন একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দরকার, যিনি সরকারী দল এবং বিরোধী দল - উভয়ের আস্থাভাজন হবেন। সাথে সাথে তিনি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবেন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবেন। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে খুব বেশি ক্ষমতা দেয়া না হলেও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে নেপথ্যে থেকে তিনি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান একই রাজনৈতিক মতাদর্শের হলে সেখানে জবাবদিহিতার সুযোগ কম থাকে। সরকার যারা পরিচালনা করেন তারা তাদের ৯০ ভাগ সময় ব্যয় করেন নিজেদের গুণকীর্তন করে। বাকি সময় অপচয় করেন বিরোধী দলের সমালোচনায়। কোন দলীয় রাষ্ট্রপতির সে কোরাসে যোগ দেয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।বর্তমান সময়ে যিনি রাষ্ট্রপতি হবেন, তাকে দেশের সংকট মুহুর্তে অলিখিত ভাবে আরো কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে মানুষের অনেক অভিযোগ আছে। টেন্ডারবাজী, প্রশাসন দলীয় করন এবং লুটপাটের যে কালচার দেশে গড়ে উঠেছে তা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। আগামী রাষ্ট্রপতিকে এ সকল ব্যাপারে সরকারকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতি যাতে দায়মুক্তি না পায়, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃত অর্থে জনগণ যাতে ক্ষমতার উৎস হতে পারে, সে বিষয়ে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো একজন রাষ্ট্রপ্রধান আমাদের দরকার। কোন দলীয় রাষ্ট্রপতি এ সকল দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

তাই, আমাদের বিবেচনায়, এ মুহূর্তে নির্দলীয় কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করতে হবে। দলীয়ভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করলে বিরোধী দল তা মানবে না। তারা বর্তমানে যেসব কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত রাখবে। সে ক্ষেত্রে সংলাপ হবে না। আর সংলাপ না হলে নির্বাচনও হবে না। এতে দেশের অবস্থা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সুতরাং সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংকট এড়াতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্দলীয় ব্যক্তিই উত্তম। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই পাওয়া যাবে, যাঁর কোনো বদনাম নেই, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই এবং বিশেষ কোনো দলের প্রতি যাঁর কোনো অনুরাগ বা বিরাগ নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে যে কোন নির্বাচনে সরকারি দলের ভূমিকা যতটুকু, বিরোধী দলের ভূমিকাও ঠিক ততটুকু-ই থাকে। যিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন, তাঁকে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করতে হবে। এমনও হতে পারে, আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারে। সে সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হবে বর্তমানে নিযুক্ত রাষ্ট্রপতিকে। নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলকে জড়িত করা না গেলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। তাই সরকারের উচিত, বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে আবদুল হামিদ, সাজেদা চৌধুরী, এ কে খন্দকার, মতিয়া চৌধুরী, বিচারপতি খায়রুল হক, আনিসুজ্জামান ও শেখ রেহানার নাম উল্লেখযোগ্য। প্রধানমন্ত্রীর নামও কেউ কেউ উচ্চারণ করছেন। আসলে ক্ষমতাসীন দল চায় দলীয় অন্ধ আনুগত্যের রাষ্ট্রপতি যাতে দল যা বলবে তিনি তা অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। এ জন্যেই এ সকল নাম আলোচনায় আসছে। একজন নিরপেক্ষ, উদার ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি চিন্তা হয়তো তারা করতে পারছেনা। হতে পারে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দৃষ্টান্ত তাদের সামনে রয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ব্যাপারে বিএনপির তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু সে তিক্ত অভিজ্ঞতার দায় কি শুধু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর? এ দায় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নয় কেন? তা ছাড়া অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে কি আমরা ইতিবাচক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি না? আওয়ামী লীগের বোঝা উচিত, অন্ধ দলীয় আনুগত্য রাষ্ট্রপতির মর্যাদা ও পদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং বর্তমান সংকটে তিনি কোন ভূমিকা রাখতে পারবেন না। বাংলাদেশের জনগণ এমন একজন রাষ্ট্রপতি কামনা করে যিনি দেশকে বর্তমান বহুমুখি সংকট থেকে উদ্ধার করে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

সমগ্র দেশ এখন ক্ষত-বিক্ষত এবং বিভক্ত। এ বিভক্তি শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়। সাংবাদিক, টিভি চ্যানেল, পত্রপত্রিকা, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনজীবী, শিক্ষক সমাজ - সর্বত্র এ বিভক্তি সুস্পষ্ট। এ পরিস্থিতিতে দেশের প্রতিটি মানুষ অত্যন্ত উদ্বেগ এবং উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। একজন চৌকস, সাহসী, বিজ্ঞ এবং নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলে তিনিই পারবেন দেশবাসীকে এ সংকট থেকে উদ্ধার করতে।

আওয়ামী লীগ কি অতীতের মতো ঐতিহাসিক এ দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে আসতে পারবে, না কি দলীয় স্বার্থের আবর্তে ঘুরপাক খাবে?

লন্ডন, ২৮ মার্চ ২০১৩

বিষয়: বিবিধ

৯২০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File