সহিংসতা না সমঝোতাঃ শিবিরের অভিজ্ঞতা
লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ৩১ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:৩৬:৩১ দুপুর
চট্টগ্রামের কাছে আমার অনেক ঋণ, এর সাথে অনেক গভীর প্রেম। চট্টগামের মানুষের মেধা, সাহস এবং ভালোবাসা এখনো আমাকে টানে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদের কথা তো আছে-ই।
শেষবারের মতো সেখানে গিয়েছি চট্টগ্রাম শহরের নির্বাচন করতে। আমার ঘাড়ে তখন অবিভক্ত ঢাকা শহর এবং চট্টগ্রাম শহরের দায়িত্ব। দু রাত সেখানে থেকে চট্টগ্রাম শহরের দায়িত্ব সে সময়ের সেক্রেটারী নুরুল আমিন চৌধুরীর মাথায় তুলে দিয়ে চলে আসি।
আমি ঢাকায় এসেছি। চট্টগ্রাম থেকে বার্তা পেলাম, তারা একটা স্মারক বের করবেন। এর জন্যে কবিতা দিতে হবে। কিশোর বয়স থেকে কবিতার সাথে আমার প্রেম। এ প্রেম বাপ-দাদা থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত। আমার জন্যে তা একই সাথে শখ ও অলৌকিক আনন্দের সামগ্রী। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে কবিতার সাথে আড়ি চলছে। কবি-বন্ধু রাগিব হোসেন চৌধুরী কারণটা ঠিক মতই চিহ্নিত করেছেন। বিভিন্ন সময় আলাপচারিতার সময় এবং বার কয়েক লিখিতভাবে তিনি তা অনুযোগ আকারে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘ছাত্র রাজনীতির কারণে রেজা ভাই কবিতা পাড়ায় স্থায়ী আবাস গড়তে পারেননি।’
তাঁর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু কোন কথায় যুক্তি থাকলেই যে তা সঠিক বা সত্য তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কার মেধা বা যোগ্যতা কখন কোন ময়দানের জন্যে উপযোগী কেউ জানে না। সে নিজেও বলতে পারে না। ষাটোর্ধ জীবনের বর্তমান সময়ে তা নিয়ে ভাবার মন বা অবসর কোনটা-ই নেই। স্রোতের টানে জীবন কাটছে, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। আদি কোথায়, অন্ত কোথায় কেউ জানে না। কী করলাম তা বড় কথা নয়। বড় কথা, এখন বা এ মুহুর্তে যা করছি, তা কি তৃপ্তি ও আনন্দের সাথে করছি? আমি কি নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট? নিজের কাছে আমি কতটুকু বিশ্বস্ত? প্রভূর সাথে আমার প্রেমে কি কোন খাদ আছে? আমার চারপাশে যারা আছে তাদের প্রতি কি আমার ভালবাসা বা হৃদ্যতা আছে? বিশ্বস্ততা আছে? এ প্রেম এবং এ বিশ্বস্ততা-ই আমার সম্পদ।
আসলে অন্যদের মতো আমি চট করে কবিতা লিখতে পারি না। অনেকে প্রত্যহ একটা দুটা কবিতা লিখতে পারেন। আমার একটি কবিতা শেষ করতে কয়েকদিন, কোন কোন সময় মাস লেগে যায়। চট্টগ্রামের অনুরোধ এবং তাগিদে নানা ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে কোন রকম একটা কবিতা দাঁড় করালাম। এর শিরোনাম ছিল কুরআনের সুরা কাহাফ থেকে নেয়া। ইন্নাহুম ফিতইয়াতুন, ‘ওরা একদল যুবক’।
জীবনের সুবর্ণ অধ্যায়গুলো কথা বলে শাতিল গঙ্গায়
একদিন চারাগাছ বড় হবে ঠিক
ফলেফুলে সুশোভিত হবে
ভরত পাখির গানে মুখরিত হবে এই অপয়া পৃথিবী
লিখে রাখো অঙ্গীকার সাহসী কলম।
লাশের পাহাড় দিয়ে একদল সতেজ জোয়ান
রাখতে চায় স্বাধীনতা
রাখতে চায় স্বদেশের নিহত সম্মান
রক্ত দিয়ে লিখে যায় - বার বার লিখে
আমানত শাহের নাম.................
শাহ জালাল নিসার আলী তোমাদের নাম......
প্রতিটি রক্তকণা ড্রাগনের দাঁত
অজস্র জীবন্তপ্রাণ জন্ম দেয় মুহূর্তে মুহূর্তে।
পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাস ঢেউ তুলে পতেঙ্গা বন্দরে
অযুত কোরবানী বুকে সুনীল সাগর আজো জীবন্ত উদ্দাম
আহত আত্মার মুখে বিশ্বাসের গান
আমাকে দিয়েছে এক অগ্নিঝরা অঙ্গীকার
চট্টলার সমুদ্র সৈকত
বাকলিয়া........ আল-করন.......... শুলক বহর।
কবিতায় যে কথা আকারে ইঙ্গিতে বলা হয়, তা গদ্যে বললে স্পষ্ট হয়ে উঠে। আমি কী চাই, কী ভাবে চাই তা বার বার কবিতায় বলার চেষ্টা করেছি। কাছের বন্ধুদের কেউ বুঝে এবং অনেকে না বুঝে আমাকে বাহবা দিয়েছেন। এখনো তারা তাই করেন। চট্টগ্রামকে নিয়ে লেখা কবিতায় চট্টলার প্রশংসা করার সাথে সাথে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সুপরিচিত তিনটি প্রতীকি নাম সেখানে এসেছে। শাহ জালাল, শাহ আমানত এবং নিসার আলী বা তিতুমীর।
তাদের সকলের প্রতি আমাদের অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ আছে, কিন্তু আমরা খুব কমই তাদের পাঠ করি। অথচ বাংলার মাটি অত্যন্ত গভীর ও বলিষ্ঠ ভাবে তাদের উত্তরাধিকার ধারণ করে আছে। সে উত্তরাধিকারে অনেক সম্পদ আছে, আছে একই সাথে লড়াই এবং আপোসের সোনালী ঐতিহ্য। আছে পরাজয়ের শিক্ষা এবং বিজয়ের বিস্ময়কর ইতিহাস।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কাফির-মুশরিক নয়, ইহুদি-খৃস্টান নয়। তারা মুসলমান। তবে জন্মগত মুসলমান। তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন শাহ জালাল, শাহ আমানত, শাহ মখদুম, খান জাহান আলী প্রমুখ সুফি-দরবেশের নিকট থেকে। খিলজি-মোগলদের নিকট থেকে নয়। তাদের মাইন্ড-সেট আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, লড়াই করে মানুষের মন জয় করা যায় না, ভালোবাসা ও উদারতা দিয়ে করতে হয়। ‘তোমার প্রভু ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সকল মানুষ ঈমানদার হয়ে যেতো। তবে কি তুমি মানুষকে ঈমান আনার জন্যে জবরদস্তি করবে?’ (ইউনুস ১০: ৯৯) জোর করে বা আইন করে হেদায়াত বা সংশোধন – কোনটাই হয় না। দেহ নয়, মনকে জয় করতে হবে। শরীর নয়, ক্বলবের সাথে কথা বলতে হবে।
ইবনে কাইয়িম আল-যাওজিয়া বলেন, ‘ইসলাম ক্ষমাশীলতার নাম। এর পরিবর্তে নিষ্ঠুরতা দেখলে বুঝতে হবে এর নাম ইসলাম নয়। ইসলাম হলো বিচক্ষণতা। যদি সেখানে মূঢ়তা এবং বোকামী থাকে তা হলে এর নাম ইসলাম নয়। ইসলাম ন্যায়পরায়ণতার নাম। যদি দেখা যায় নিপীড়ন হচ্ছে তা হলে এটা ইসলাম নয়।’
আমরা আপোস চাই না, লড়াই চাই। মহানবী(স)’র কাছে ওহি আসতো। এর পরও বহু রাজনৈতিক, সামাজিক ও যুদ্ধনীতির বিষয়ে তিনি সাহাবাদের অভিমত গ্রহণ করে নিয়েছেন। অনেক সাহাবা নানা বিষয়ে তাঁর সাথে মতপার্থক্য করেছেন। সাহাবারাও পরস্পর মতপার্থক্য ও বিতর্ক করেছেন। এ কারণে তারা একে অপরের চরিত্র হনন করেননি বা কাউকে জাহান্নামে পাঠাননি। আমাদের সাথে কেউ দ্বিমত করলে তাকে আমরা চট করে মুনাফেক অভিধায় ভূষিত করি। আমাদের দল ত্যাগ করে কেউ চলে গেলে দলত্যাগীকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেই। আমাদের মতো করে অথবা আমাদের নিজের তৈরি ইসলামী আন্দোলনের সংজ্ঞা অনুযায়ী কেউ কাজ না করলে সেটাকে ইসলামী আন্দালনই মনে করি না। অথচ আমরা কেউ নিজেদের আল-জামাত বলার অধিকার রাখি না। মুসলমানদের মুশরিক, মুনাফিক বা কাফের ফতোয়া দিয়ে বিভক্ত করি। ইসলামের মৌলিক বিষয়ে যাদের কোন ধারণা নেই তাদের রাজনীতি বুঝাই। তাদের কাছে রাজনৈতিক ফতোয়া ব্যাখ্যা করি। তারপর বাক-বিতন্ডা এবং লড়াই করি। দাবি, লড়াইটা হচ্ছে ইসলাম এবং কুফরের মধ্যে। আম-জনতা হা করে তাকিয়ে থাকে। দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে। তারা কিংকর্তব্য বিমূঢ়।
মহানবী (স) মুশরিক ও ইহুদিদের সাথে সহাবস্থানের সুযোগ তালাশ করেছেন, অনেক বড় বড় এবং জটিলতর বিষয়ে। আমরা মুসলমানদের সাথে-ই সহাবস্থানের ফর্মুলা খুঁজে বের করতে পারি না। কেন? আমরা কি ইসলামের একক ইজারাদার? ইসলাম বা জাতির জন্যে যা অপ্রয়োজনীয় বা কম-গুরুত্ববহ সে বিষয়ে পর্যন্ত ছাড় দিতে আমরা রাজি নই। হোদায়বিয়ার সন্ধির কথা আমরা জানি। মহানবী (স) সেখানে শান্তির প্রয়োজনে অসম-শর্তে সন্ধি করেছেন, অনেক বেশি ছাড় দিয়েছেন। ছাড় দেয়ার কারণে বিনা লড়াইয়ে, নিরাপদে আরবের সকল মানুষের কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করেছেন। আমরা হলে কী করতাম? বলতাম, ‘আপোস না সংগ্রাম – সংগ্রাম সংগ্রাম’। অথবা বলতাম, ‘লড়াই লড়াই - লড়াই চাই।’
কুরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল ইবনে আমর হোদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লিখতে আপত্তি করে বলেছে, ‘রহমান’ কে? তাকে আমরা চিনি না। লিখুন ‘বি-ইসমিকা আল্লাহুম্মা’, তোমার নামে হে আল্লাহ। আরবে তখন এর প্রচলন ছিল। মহানবী (স) মেনে নিয়েছেন। মুহাম্মাদুর ‘রাসুলুল্লাহ’ লিখতে আপত্তি তুলেছে। বলেছে, লিখুন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। আপনাকে রাসুল মানলে আমরা আপনার সাথে লড়াই করতাম না। সাহাবারা কষ্ট পেয়েছেন, ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মহানবী (স) মেনে নিয়েছেন। বৃহত্তর স্বার্থে আল্লাহর ‘রহমান’ নাম এবং নবী (স)’র আসল পরিচয় ‘রাসুলুল্লাহ’ বাদ দিয়েছেন। কারণ লক্ষ্য ছিল ইসলামের বিজয়।
আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কী ইসলামের বিজয় চাই? না কি বিশেষ কোন দল, গোষ্ঠী বা কোন মহান ব্যক্তির বিজয় চাই? না শুধু ক্ষমতা-ই আমাদের প্রধান লক্ষ্য?
লন্ডন, ২৩ অক্টোবর ২০১৫
বিষয়: বিবিধ
১৫৫২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখাটি ভালো লাগলো, কবিতাটির মধ্যে রয়েছে লক্ষ্য জয়ের উদ্দেশ্যে গভীর অনুভূতির বাসনা!
সাহিত্য, তথ্য ও ইতিহাসের সমন্বয়ে চমৎকার অভিব্যক্তির জন্য আন্তরিক শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন