সহিংসতা না সমঝোতা / শিবিরের অভিজ্ঞতা - এক
লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ২৫ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:১২:৫৫ দুপুর
এক.
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাইরে অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। বারান্দার আবছা আলোয় ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২টা। আবার গগন বিদারী চিৎকার কানে এলো, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘রব-জলিলের সৈনিকেরা বেরিয়ে এসো বেরিয়ে এসো।’
সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের পর কিছু কেনাকাটা ছিল। তা শেষ করে কোন রকম রাতের খাবার খেয়েছি। তারপর হলে এসে শুয়ে পড়েছি। হল মানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দি হল। রব-জলিলের সৈনিকদের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেলো। নজরে পড়লো, কে একজন জানালার পর্দা ফাঁক করে বাইরের দিকে কী যেন দেখছে। ভালো করে চেয়ে দেখলাম, সগির আহমদ। নড়াচড়া টের পেয়ে তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘রেজা ভাইয়ের ঘুম কি ভেঙে গেছে? জাসদের মিছিল যাচ্ছে। গুনে দেখলাম, মাত্র বিশ থেকে পচিশজন লোক। তবে গলায় তাদের তেজ আছে।’
স্বীকার করতে হবে, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’ শ্লোগানটি রক্ত গরম করে তোলে। ডাকাতিয়া বাঁশির মতো তরুণদের মধ্যে মাদকতা এনে দেয়, উদ্দাম করে তোলে। আমার তারুণ্যকে এ শ্লোগান বার বার মোহাবিষ্ট করেছে। এক সময় কবিতায় সে মোহকে আবদ্ধ করে রেখেছি।
‘এখন যুদ্ধের কাল.........
তুলে রাখো প্রেমপত্র অভিমানী চোখ
আমাকে পরিয়ে দাও যুদ্ধের লেবাস।
ভুলে যাও ভালোবাসা সখাদ নিখাদ
ভুলে যাও মোহময় চোখের ইশারা
তোমার প্রেমের গান যুদ্ধের সঙ্গীত
আমার হৃদয় জুড়ে অস্ত্রের পীরিত
যুবক হৃদয় গুলো চিরে খুলে দেখো
দাউ দাউ জ্বলে সেথা যুদ্ধের আগুন
প্রসাধনে ভেসে আসে বারুদের প্রাণ
অলঙ্কার মনে হয় বন্দীর শিকল।
এখন যুদ্ধের কাল..........
এ যুদ্ধের অবসান চাও?
সকল প্রার্থনা হোক প্রেমের ফসল
পৃথিবী দেখুক মুখ অজস্র যোদ্ধার।’
হ্যাঁ, লড়াই আমাকে টানলেও এর প্রকৃতি নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না। প্রার্থনা, প্রেম এবং লড়াই সেখানে পাশাপাশি বাস করেছে।
কিসের লড়াই, কার বিরুদ্ধে লড়াই, কী ভাবে লড়াই হবে, লড়াই করে কী অর্জিত হবে – তরুণদের এ সকল প্রশ্নের জবাব অন্বেষণের প্রয়োজন পড়ে না। বাঁচতে হলে লড়াই ছাড়া কি আর কোন পথ নেই, এ সব তত্ত্বকথা নিয়ে ভাবার আকাঙ্খা বা সময় কোথায়? গরম শ্লোগান শুনলেই তাদের রক্ত টগবগ করে উঠে। শ্লোগানটা জাসদের এবং জাসদ নিয়ে সাম্প্রতিক অনেক কথা বাজারে এসেছে। অধিকাংশ কথা নানা জনের পক্ষ থেকে আগেও উচ্চারিত হয়েছে। ইসলামী ঘরানার কারো কারো মুখ থেকে এর সাথে মিল রেখে ‘জেহাদ জেহাদ জেহাদ চাই’ বলে চিৎকার শুনেছি। ‘আপোস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ শ্লোগানও অনেকে দিয়েছে।
একবিংশ শতকের পৃথিবী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের চিন্তার জগতে বিবেচনা ও তর্কের অনেক নতুন বিষয় উন্মোচিত করেছে। বিশ্বায়ন যুগের পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতি নিয়ে এসেছে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ। যাদের মধ্যে মানবিকবোধ এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা আছে তাদের অবশ্যই অন্ধ ও বধির হয়ে থাকলে চলবে না। অতীতকে সঠিক ভাবে চিহ্নিত করে তাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পথ অবশ্যই অন্বেষণ করতে হবে।
জেহাদ শব্দের শাব্দিক অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা বা চূড়ান্ত চেষ্টা-সাধনা। বাংলায় এ শব্দের কাছাকাছি অর্থ সংগ্রামও হতে পারে। উনসত্তর-সত্তরে আমরা ‘সংগ্রাম সংগ্রাম, চলবে চলবে’ বলে রাজপথ গরম করেছি। অনেকের কাছে জেহাদ মানে সশস্ত্র যুদ্ধ বা লড়াই। পশ্চিমারা এর অর্থ সশস্ত্র যুদ্ধই মনে করে। কুরআনে সশস্ত্র লড়াইকে কিতাল বলা হয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধের অভিযানকে হাদিসে বলা হয়েছে গাজওয়া। জাসদের কার্যক্রম থেকে অনুমান করি, তাদের ‘লড়াই লড়াই’ শ্লোগানের অর্থ একই সাথে সংগ্রাম এবং সশস্ত্র লড়াই ছিল। তারা বলতেন, শ্রেনী সংগ্রাম তরান্বিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্যে আমরা লড়াই করছি। দেশ-বিদেশের খবর যারা রাখেন তারা জানেন, জাসদের ‘লড়াই লড়াই’ শ্লোগান উভয় অর্থে এখন ইসলামী ঘরানার অনেকের কথায় ও কর্মে সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
এক সময় কুরআনের একটা আয়াত আমার চোখে পড়ে। আয়াতটি মক্কায় নাজিল হয়েছে। সুরা ফুরকানের সে আয়াতে বলা হয়েছে, তুমি তাদের বিরুদ্ধে ‘কুরআনের সাহায্যে’ প্রবলভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাও। কুরআনের ভাষায় ‘জিহাদান কাবিরা’। কুরআনের অন্য জায়গায় মক্কার মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘কুফ্ফু আইদিয়াকুম ওয়া আক্বিমুস সালাহ’ – হাত সংযত রাখো এবং নামাজ কায়েম করো। কুরআনের সাহায্যে প্রবলভাবে লড়াইকে সশস্ত্র লড়াই বলে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই। এর অর্থ হচ্ছে নিজে কুরআন ধারণ করে কুরআনের নির্দেশ অনুসারে এর বাণী মানুষের সামনে প্রচারের জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।
মক্কায় মহানবী (স) কার্যত সে কাজই করেছেন। মক্কার ১৩ বছর মুসলমানদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন কম হয়নি। কুরাইশদের নির্যাতনে সুমাইয়া (রা) সেখানে শাহাদত লাভ করেন। তিনি ইসলামের প্রথম শহীদ। কিন্তু মুসলমানদের তখন কুরাইশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের অনুমতি দেয়া হয়নি। সশস্ত্র লড়াইয়ের অনুমতি এসেছে মদিনায় হিজরতের পর। সে সময়ও লড়াই হয়েছে মদিনার আশপাশে। মুসলামানরা মক্কায় এসে লড়াই শুরু করেননি। কুরাইশরা-ই বার বার মদিনা আক্রমণ করতে গিয়েছে।
মক্কায় কেন সশস্ত্র লড়াইয়ের অনুমতি দেয়া হয়নি? এটা কি এ কারণে যে মুসলমানরা সংখ্যায় কম ছিলেন? এটা একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। লড়াই করে মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনা যায় না। বিশ্বাস বা ঈমান জোর করে সৃষ্টি করার বিষয় নয়। ‘লা-ইকরাহা ফিদ্দিন’ বলে আল্লাহ মানুষের জন্যে ইসলাম গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। ইসলাম গ্রহণের জন্যে কাউকে বাধ্য করা ইসলামী মূলনীতির পরিপন্থী। সকল প্রকার চাপ বা বাধ্যবাধকতার উর্ধে থেকে মানুষকে বিবেচনার সুযোগ দেয়া জরুরী বিষয়।
ইসলামী দর্শন এবং আদর্শ মক্কার কায়েমী স্বার্থবাদীদের জন্যে বিপদ-ঘন্টা ছিল, এটা ঠিক। সাথে সাথে সেখানকার পুরো জনগোষ্ঠীর কাছে ছিল তা সম্পূর্ণ নতুন এবং অভিনব। নতুন আদর্শকে বুঝা এবং তা আত্মস্থ করার জন্যে মানুষকে সময় দিতে হয়। একজন বা দু জন হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে। অধিকাংশ মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব হয় না। যারা গ্রহণ করবে এবং যারা বিরোধিতা করবে, উভয় পক্ষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্যে সময়ের প্রয়োজন। সে সময় তাদের প্রদান করা হয়েছে। সব ধরণের নির্যাতন এবং উস্কানির মুকাবেলায় মহানবী (স) পাহাড়ের মতো অটল ও শান্ত থেকেছেন। আঘাতের মুকাবেলায় অঘাত করেননি, কাউকে আঘাত করার অনুমতি দেননি। ছবর করতে বলেছেন, স্বান্ত্বনা দিয়েছেন। তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করেছেন। যুদ্ধাবস্থা অথবা সহিংস পরিস্থিতি আদর্শ প্রচারের জন্যে অনুকুল নয়, তা বুঝার মতো প্রজ্ঞা তাঁর মধ্যে ছিল। মদিনায় হিজরতের পরও তিনি সেখানকার ভিন্নমতাবলম্বী জনগোষ্ঠীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অবলম্বন করেন। তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান করেন এবং তাদের নিজস্ব আইন অনুযায়ী নিজেদের বিচার-ফায়সালার সুযোগ বজায় রাখেন। এর নামও লড়াই। কিন্তু তা ছিল যুক্তি, আলোচনা এবং দৃষ্টান্তমূলক কাজের মাধ্যমে।
লড়াই সম্পর্কে আমার এ উপলব্ধি পরবর্তীতে একটি কবিতায় এ ভাবে এসেছে,
‘ঘরে ঘরে এখন যুদ্ধ চলছে
ভাতের ফেন গালতে গালতে অথবা
চায়ের সাথে চিনি মেশাতে মেশাতে
কোন কোন রমনীয় হাত বিদ্রোহ ছড়ায়
নকল খোদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে।’
বাংলাদেশে লড়াইয়ের ইতিহাস পুরানো। যতটুকু মনে পড়ে ৭৮ সালে এর শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উপলক্ষটা মনে রাখা দরকার। স্রেফ চরমপন্থা। কিছু দায়িত্বশীলের হটকারী সিদ্ধান্তের কারণে সদ্যজাত একটি সংগঠনকে প্রশ্নবোধক করে তুলে। বাংলাদেশে এর আগে মারামারিতে লাঠি আর হকি-স্টিক ব্যবহৃত হতো। এখন ব্যবহৃত হয় ছোরা, রামদা, কিরিচ, বোমা এবং নানা প্রকার আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। কার হাতে কী আছে জানি না। কতজনে কত কথা বলে। আলামত দেখে সন্দেহ হয়। বাংলাদেশে সব কিছু-ই পাওয়া যায়। মিশর শুরুতে সশস্ত্র লড়াইয়ে জড়িত হয় ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এখন অবশ্য ক্ষান্ত দিয়েছে। সিরিয়ায় শুরু হয় বাশারের বাপের আমলে। তারপর কিছু দিন বিরতি দিয়ে আবার শুরু হয়েছে। এখন সেখানে সত্যিকার চতুর্মুখি যুদ্ধ চলছে। এর প্রেক্ষাপটও ভিন্ন।
গত শতকের শেষের দিকে আমাদেরই এক আপনজন মিশরীয়দের সাবধান করেছেন। তিনি আজ নেই। আমাদের এখন কে সাবধান করবে? সহিংসতার মূল শক্তি তরুণ ছাত্ররা। ছাত্রদের রাজনীতির বলির পাঁঠা বানানো কী খুব জরুরী? ছাত্ররা আর কতদিন ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবে? তারা আর কতো জীবন দিবে, পঙ্গু হবে, মা-বাবার কপাল ভাঙবে, তাদের উপর বোঝা হবে? তাঁদের আর কতদিন ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করতে হবে? তারাই তো আমাদের ভবিষ্যত। তাদের তৈরি হতে হবে ভবিষ্যতের জন্যে। ছাত্রদের জীবন গঠনের সুযোগ না দিতে পারলে ভবিষ্যত অন্ধার। মালয়েশিয়ার ছাত্ররা, পাকিস্তানের ছাত্ররা যদি পারে, তা হলে আমরা পারি না কেন? ইউরোপের ছাত্ররা কি রাজনীতি জানে না বা করে না? তারা তো মাঠে-ময়দানে মিছিল করে না বা চোঙ্গা ফুঁকে না। আমরা কেন এ রকম নিজের পায়ে কুড়াল মারছি?
আজকের প্রধান লড়াই লাঠি বা অস্ত্র দিয়ে নয়। আজকের লড়াই মেধা ও কৌশলের। যুক্তি ও মননের লড়াই। সাংবাদিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তির লড়াই। কূটনীতি ও ডায়লগ সেখানে মুখ্য। চর্বিত চর্বণ দিয়ে এক বিংশ শতাব্দির লড়াইয়ে জেতার উপায় নেই। প্রয়োজন মৌলিক চিন্তার। মৌলিক চিন্তা কার থেকে আসবে? প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার। আগামী কাল ক্ষমতায় যাওয়ার খাহেশকে কবর দিতে হবে। আজকের ময়দান বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। স্যামুয়েল হান্টিংটন তার ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন এন্ড রিমেইকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ লিখেছেন ১৯৯৬ সালে। সেটাকে আজকের বিশ্ব পরিস্থিতির ব্লু-প্রিন্ট বলে মনে করা হয়। এর একটা উপযুক্ত কাউন্টার ন্যারেটিভ অদ্যাবধি আমরা কেউ উপস্থাপন করতে পারিনি। না কাজে, না গবেষণায়। আমাদের সম্পদের কি অভাব আছে? এ দুঃখ আমরা কার কাছে বলবো?
চলবে
বিষয়: বিবিধ
১৯১২ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বছর কয়েক আগে এমন কথা মরহুম নাজির আহম্মদের আলোচনায়ও শুনেছি।
লাঠিসোঠার সময় এখন আর নাই। মারোনাস্ত্র দিয়েও এখন যুদ্ধ জেতা যায়না।
মূল লড়াইটা হচ্ছে জ্ঞানের রাজ্য তাই জ্ঞানের অস্ত্রের মওজুদ যারা বেশী বাড়াতে পারবে আগামিদিনের ইতিহাস তাদেরকেই গ্রহণ করবে।
ধন্যবাদ।
এ কবিতাটিও আগেরটার মতই সুন্দর!!!
আপনার অন্যান্য কবিতাগুলো কোথায় পাওয়া যাবে??
এ প্রশ্নুগুলো দীর্ঘকাল পর্যন্ত উত্তরবিহীন রয়ে যাবে মনে হয়-
উদ্দীপনা না অভিমানের আত্মতুষ্টি থেকে?
বিজয়ের আকাঙ্কা নাকি পরাজয়ের হিসাব মেলানো থেকে?
জেহাদ এর অর্থ কনটেক্সট এর উপর বদলায়। আর এর সব ইন্টারপ্রিটেশনের জন্যও সব সবসময় শর্তহীনভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়। ভুজুংভাজুং এর কোনই অবকাশ নেই!
মন্তব্য করতে লগইন করুন