এ তান্ডব আর হত্যাযজ্ঞ কতদিন চলবে?

লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ০৮ মার্চ, ২০১৩, ০১:০১:৪১ দুপুর

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণে বিলাতের বাংলাদেশী জনগণ অত্যন্ত উদ্বেগ এবং উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। প্রবাসে বাংলাদেশী রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ় অবস্থান থাকলেও বিলাতের বাংলাদেশী কমিউনিটির একটা বৃহৎ অংশ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশী রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে কোন বড় ঘটনা ঘটলে স্বাভাবিক ভাবেই বিলাতে এর উত্তাপ প্রতিফলিত হয়। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিলাত প্রবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীকে প্রবল ভাবে আলোড়িত ও আন্দোলিত করছে। এটা সবার নিকট পরিস্কার যে দেশের মতো বিলাতের বাংলাদেশী কমিউনিটি সুস্পষ্ট দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মোটা দাগে বললে এক পক্ষ আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপকে চোখ বন্ধ করে সমর্থন দিচ্ছেন। অপর পক্ষ বিএনপি-জামাত জোটের দাবি নিয়ে মাঠ গরম করছেন। রাজনৈতিক কর্মীরা বাংলাদেশী কমিউনিটির এ বিভক্তিকে উচ্ছ্বাসের সাথে দেখলেও নিরব সংখ্যগরিষ্ঠ অংশের কাছে তা মোটেই স্বস্থিকর নয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিয়ে বাংলাদেশের সহিংস চিত্র পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনে দেখে তারা উৎকন্ঠিত। তারা একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করছেন, দ্রুত বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। তারা এ দোয়াও করছেন, এ দেশের সকল পক্ষ যেন শালীনতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রেখে একে অপরের সমালোচনা করেন এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে।

এ দেশে প্রবাসীরা সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সুসম্পর্ক দেখে তারা অভ্যস্থ। তারা দেখেন, বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করছে এবং সরকারী দল সে সমালোচনার সুন্দর ভাবে জবাব দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দিচ্ছেনা। তারা কামনা করেন, বাংলাদেশেও সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে এ ধরণের ওয়ার্কিং সম্পর্ক থাকবে। কারণ তারা সবাই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এবং পরমতসহিষ্ণুতার কথা বলেন। প্রবাসীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন যখন তারা দেখেন, বাংলাদেশের সরকারী দল এবং বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। আমাদের মনে আছে, কিছু দিন আগে লন্ডনে পুলিশের গুলিতে মার্ক ডুগান নামক এক ব্যক্তি নিহত হয়। বিলাতের এমন কোন রাজনৈতিক দল নেই যে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করেনি। সরকার নিজেও এর সমালোচনা করে এবং স্বাধীন পুলিশ কমপ্লেইন কমিশনের মাধ্যমে দোষী পুলিশকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানায়।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে সরকারী পুলিশ এবং র‌্যাব হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিরোধী মতাবলম্বী শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। এ নিয়ে দেশে এবং বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে এ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন বিবৃতি বা প্রেসনোট পর্যন্ত ইস্যু করা হয়নি। ভাবটা এমন যে যারা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে তারা মানুষ নয়। বাক্যবাগীশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানুষের হত্যার দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। নিহতরা কি তা হলে রাষ্ট্রের নাগরিক নন? জামায়াত শিবির হলেই কি গুলি করে মারা যায়? রাষ্ট্র বা সরকার কি এভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারে? কেউ নাস্তিক-মুরতাদ হলে পুলিশ তাকে হত্যা করতে পারেনা। সন্ত্রাসী হলেও রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা বৈধ নয়। জামাত-শিবির আইন হাতে তুলে নিবে, পুলিশকে আক্রমণ করবে, তান্ডব চালাবে - তা কখনো সমর্থন করা যায় না। তাদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও সরকারের উপর বর্তায়। জামাত-শিবির সন্ত্রাসী হলে তাদের গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেন। প্রয়োজন হলে তাদের নিষিদ্ধ করুন। সভা-সমাবেশ করা বা প্রতিবাদ জানানো মানুষের মৌলিক অধিকার। মিছিল-সমাবেশ বা হরতাল করার কারণে কাউকে গুলি করে হত্যা করা যায় না। জংলি আইনে তা বৈধ হতে পারে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা চলতে পারেনা। আমরা কি তা হলে মধ্যযুগের দিকে ফিরে যাচ্ছি? যারা ক্ষমতায় আছেন তারা কি মধ্যযুগের কোন রাজা-বাদশাহ?

বাংলাদেশে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্যে আরেকটি জঘন্য কার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে এবং তা হচ্ছে সংখ্যালঘু কার্ড। দেশের কয়েকটি এলাকায় হিন্দু ও বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সরকার এবং সরকার সমর্থক মিডিয়ার মতে সংখ্যালঘুদের ওপর জামাত-শিবির আক্রমণ করছে। অপরদিকে বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া হিন্দুদের বাড়িঘরে চলমান আক্রমণের জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করেছেন। জামায়াতে ইসলামী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে তারা এর সাথে জড়িত নয় এবং যে কোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। আমাদের দেখতে হবে, হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে থাকলে কাদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা?

জামায়াতে ইসলামীকে এমনিতেই ‘সাম্প্রদায়িক দল বলা হয়। দলের শীর্ষ নেতারা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাবন্দী আছেন। এ পরিস্থিতিতে যদি হিন্দুদের বাড়ি বা মন্দির ভাঙতে গিয়ে কোথাও জামাত-শিবিরের একজন সদস্যও ধরা পড়ে, তবে দলটিকে ভীষণ বেকায়দায় পড়তে হবে। তাই জামাত হিন্দুদের বাড়িতে চড়াও হবে, তা কল্পণা করা যায়না। তবে এর দায় বিএনপি ও জামাতের ওপর চাপাতে পারলে মহাজোট সরকার এর ফায়দা লুটবে। আমাদের প্রশ্ন হলো, হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে ক্রমাগত হামলার পর আমাদের অতিদক্ষ পুলিশ বা র‌্যাব তা প্রতিহত করতে বা দোষীদের কেন তাদের ধরতে পারছে না? তবে বগুড়ার শেরপুরে শহীদ মিনার ভাঙতে গিয়ে জনতার হাতে হাতে ধরা পড়েছে এক যুবলীগ নেতা। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কার্যালয়ে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে আওয়ামী লীগের এক কর্মী নিহত ও চারজন আহত হয়েছে। এ সকল ঘটনা থেকে আমরা এর পেছনে কে আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

আমাদের দাবি, সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও উপাসনালয়ে হামলা চালানোর সকল ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, দোষীদের শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত প্রদান করা হোক। আমরা সবাই জানি যে, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এদেশে কখনো-কখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে তার পেছনে সক্রিয় থাকে হীন রাজনৈতিক কৌশল। আমাদের বিশ্বাস সচেতন দেশবাসী অবশ্যই এ ধরণের হীন রাজনৈতিক কৌশলকে প্রতিহত করবে। গতকাল বিএনপির সমাবেশকে পুলিশ কি ভাবে ভন্ডুল করে দিয়েছে তা প্রবাসীরা টেলিভশনে দেখেছেন। দফায় দফায় সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ ও পুলিশের গুলিতে পণ্ড হয়ে গেছে রাজধানীতে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ। গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামসহ অন্তত ১৫০ নেতাকর্মী। ৫ জন গণমাধ্যমকর্মীও আহত হন। যারা আহত হয়েছেন তাদেরসহ অজ্ঞাতনামা আরো কয়েক শ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে। সমাবেশ পন্ড হলো, পুলিশের হাতে নির্যাতিত হতে হলো এবং এখন মামলার পেছনে মাসের পর মাস দৌড়াতে হবে। এধরণের ঘটনা যে শুধু গতকাল ঘটেছে তাই নয়, ‍বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ভেঙে দেয়ার ঘটনা সেখানে গত চার বছর যাবৎ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মাসখানেক ধরে বাংলাদেশে সহিংস বিক্ষোভে নারী ও শিশুসহ শতাধিক মানুষ নিহতের ঘটনায় বৃটেন-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আজ (৭ মার্চ ২০১৩) বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সবচেয়ে বড় ফোরাম ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ) বাংলাদেশের সকল দল এবং কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে রাজনৈতিক সংলাপে বসার ওপর জোর দিয়ে বলেছে, নিজ নিজ সমর্থকদের কোন ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতায় কিংবা রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ক্ষতিকর প্রচারকাজে লিপ্ত না হতে যেনো দলগুলো আহ্বান জানায়। সংস্থাটির সভাপতি শোয়াইর বিল হাসান আরো বলেন, যে কোন পরিস্থিতিতে এফআইডিএইচ মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে আসছে। তারপর এই ট্রাইব্যুনালে সরকারের হস্তক্ষেপের সাক্ষ্যপ্রমাণ, স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায় এবং রায় হয়ে যাবার পর বেশি সাজা দিতে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনে ঘটনাক্রম এমন পর্যায়ে গেছে যে অবিলম্বে মৃত্যুদণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশ দরকার। ফোরামটি বলে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত ঘৃণ্য অপরাধের বিচার চাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে অভিযুক্তদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার এবং সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দেয়া উচিত। আমরা জানি, যুদ্ধাপরাধ একটা জঘন্য অপরাধ। যুদ্ধাপরাধ পৃথিবীর যেখানে হোক না কেন এর বিচার হওয়া ন্যায় বিচারের দাবি। কোন বিবেক সম্পন্ন মানুষ এর বিপক্ষে থাকতে পারেনা। এটা সুস্পষ্ট যে যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ না হয় তা হলে তা শুধু অভিযুক্ত দল বা ব্যক্তিবর্গ নয়, বাংলাদেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবেনা। তখন যুদ্ধাপরাধের বিচার সরকারের জন্যে বুমেরাং হয়ে দেখা দিবে। শুধু ন্যায়-বিচার করার মধ্যেই বিচার-কার্যের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না, ন্যায়-বিচার হচ্ছে বলে মানুষের কাছে দৃশ্যমান হতে হবে। আদালত রাজনৈতিক বিবেচনার উর্ধে উঠে বিচার-কার্যে ন্যায়-বিচার সম্পন্ন করার পরও ন্যায়-বিচার দৃশ্যমান না হলে ইতিহাসের বিচারে সরকার ও আদালত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

বিশ্বসম্প্রদায় এবং নাগরিক সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে আজ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিরোধী দলের সাথে সংলাপের কথা শোনে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। গত কয়েকদিনে এত জন মানুষ বিনাবিচারে নিহত হবার পরও আজ তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সংঘাত চাই না। তবে তারা (বিএনপি-জামায়াত) মার দেবে, আমরা বসে বসে দেখব, এত দুর্বল হইনি। যারা তাণ্ডব চালাচ্ছে, তাদেরও ঘরবাড়ি, ব্যবসা আছে। মানুষ যদি ক্ষেপে গিয়ে হামলা করে, তাহলে তারা কোথায় যাবে?’ (০৭ মার্চ ২০১৩, প্রথম আলো) প্রধান মন্ত্রীর এ ঘোষণা শোনার পর কল্পণায় এর পরিণতি ভেবে আমরা শিউরে উঠছি। এর আগে শাহবাগ চত্বর থেকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ার কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামলার শিকার হয়েছে। এখন পুলিশের ছত্রছায়ায় হবে মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা। প্রধানমন্ত্রীর আজকের ঘোষণা দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে তা ভাবে আমরা খুবই শঙ্কিত। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দেশের সকল মানুষের জান-মাল হেফাজতের দায়িত্ব তার উপর বর্তায়। একজন প্রধানমন্ত্রী কোন অবস্থায়ই এ ধরণের ঘোষণা দিতে পারেন না। এর পরিণতিতে এখন দেশে যত হামলা এবং লুটপাট হবে এর সকল দায় তাঁকেই বহন করতে হবে।

লন্ডন ৭ মার্চ ২০১৩

বিষয়: বিবিধ

১১৬৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File