মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং আমাদের দায়

লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:৩০:২৪ রাত

বাংলাদেশে মেয়েদের অধিকার সীমিত হলেও বিজ্ঞাপন এবং সংবাদ শিরোনামে তাদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। আমাদের নিত্যদিনের নিন্দা-বাহবা এবং আলোচনা-সমালোচনায়ও মেয়েদের প্রসঙ্গ সর্বাগ্রে আসে। যারা বিজ্ঞাপনে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মেয়েদের পণ্যদ্রব্যের মতো ব্যবহার করে তাদের আমরা সবাই নিন্দা করি। এ নিন্দাবাদ কেউ করেন বাহবা কুড়ানোর জন্যে, কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে এবং কেউ সত্যিকার আন্তরিকতার সাথে। আন্তরিক ভাবে নিন্দাবাদের অনিবার্য দাবি হচ্ছে, এ জন্যে ইতিবাচক কিছু কাজ করা। কিন্তু আমরা কি তা করছি?

নারী-অধিকার এবং নারীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে যারা সোচ্চার তাদের অভিযোগ, ইসলাম নারীদের অধিকার দেয়নি। প্রমাণ হিসেবে তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা তুলে ধরেন। কিছুদিন আগে তাদের একজন কুরআন সংশোধনের দাবি করেছিলেন। এখন তিনি প্রবাসে দুঃখে-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তার মতের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন এমন লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়। মাঝে মাঝে তাদের ক্ষীণ কন্ঠ আমরা শুনতে পাই। দিনে দিনে তাদের কন্ঠ বলিষ্ঠ হবে। যারা অভিযোগ উত্থাপন করেন, তারা কুরআন-হাদীস পাঠ করেন না। করলেও একটি দুটি আয়াত বা হাদীসের মধ্যেই তাদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ। ইসলামের বিশাল চিত্র বা ‘বিগ পিকচার’ তাদের সামনে নেই। বাংলাদেশের শ্রমজীবী এবং অধিকার বঞ্চিত নারীদের চিত্র তাদের সামনে। বাংলাদেশে মেয়েদের অবস্থা বিবেচনা করলে আমরা কি তাদের অভিযোগ অস্বীকার করতে পারি? ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে বাংলাদেশের নারীরা কি সে অধিকার ভোগ করছে? ইসলাম যারা কঠোরভাবে মেনে চলেন তাদের অনেকে কি ইসলামের দোহাই দিয়ে নারীদের অনেক অধিকার হরণ করছেন না?

আমরা যখন ওয়াজ-নসীহত করি, আমরা বলি রাসুল (স)-এর সুন্নাত মেনে চলতে হবে। সুন্নাত বলতে এখানে রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণ Ñ সবকিছুই অন্তর্ভূক্ত। মহিলাদের সাথে আচার-আচরণের ক্ষেত্রে রাসুল (স)-এর সুন্নাত কি ছিল তা কি আমরা জানি? তা নিয়ে কি আমরা আলোচনা করি? একজন স্ত্রী তার স্বামীকে কি ভাবে আনুগত্য করবে, আমাদের ওয়াজ-নসীহতকে আমরা সেখানে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। মায়ের প্রতি আচরণের কথা অবশ্য আমরা বলি। কিন্তু স্ত্রী বা অন্যান্য মহিলাদের সাথে কি রকম আচরণ করতে হবে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে ভুলে যাই।

রাসুল (স)-এর যুগে মহিলারা যে সম্মান, স্বাধীনতা এবং মর্যাদা ভোগ করেছেন সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই। দৃষ্টান্ত হিসেবে মসজিদে নববীর কথা আমরা বলতে পারি। রাসুল (স)-এর যুগে মসজিদে নববী ছিল মহিলাদের জন্যে উন্মুক্ত। মহিলারা যখন ইচ্ছা তখনই সেখানে যেতে পারতেন। সেখানে গিয়ে তারা মহানবী (স)-এর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতেন। বুখারী-মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। তারা সেখানে গিয়ে রাসুল (স)-এর পেছনে নামাজ পড়তেন। মধ্যখানে কোন দেয়াল বা পর্দা ছিল না। পুরুষদের কাতারের পেছনে মহিলারা নামাজে দাঁড়াতেন। নামাজের পর রাসুল (স)-এর কথা তারা সরাসরি শুনতেন, তাঁকে দেখতেন। শুধু মসজিদে নববীতে নয়, সে সময় মদীনা বা পার্শ্ববর্তী এলাকার যে সকল স্থানে জামাতে নামাজ পড়া হতো সর্বত্র একই রকম ব্যবস্থা ছিল। মদীনার মসজিদে মহিলারা অন্যান্য কারণেও যেতেন। মহিলাদের সামাজিক যোগযোগের কেন্দ্র ছিল মসজিদ। যুদ্ধাহত সৈনিকদের সেবার জন্যেও রাসুল (স)-এর যুগে মহিলারা মসজিদে যেতেন।

মহানবী (স)-এর ইন্তেকালের পর খলিফাদের সময়ও মহিলারা স্বাধীনভাবে মসজিদে যেতেন। কারণ, মহানবী (স)-এর নির্দেশ ছিল, তোমরা মহিলাদের মসজিদে যেতে বাঁধা দিবে না। মসজিদে নববীতে খলিফা ওমর (রা)-এর সাথে এক মহিলার কথাবার্তার কথা আমরা জানি। খলিফা তাঁর এক খুতবায় মহিলাদের সমালোচনা করে বলেন, আজকাল মহিলারা অতিরিক্ত মোহরানা দাবি করছে। খলিফা মিম্বর থেকে নামার পর এক মহিলা বলেন, হে আমীরুল মুমিনিন, আল্লাহ যেখানে মোহরানা হিসেবে অনেক সম্পদ দাবি করার অধিকার দিয়েছেন সেখানে আপনার তা সীমিত করার কোন অধিকার নেই। মহিলার কথা শুনে খলিফা রাগ না করে আবার মিম্বরে ফিরে এসে ঘোষণা দেন, ‘ওমর যা বলেছে তা ঠিক নয়, ওই মহিলাই ঠিক।’ আল্লাহর কালামের রেফারেন্স শোনামাত্র খলিফা তা মেনে নিয়েছেন। রাগ বা অহঙ্কার প্রদর্শন না করে মিম্বরে দাঁড়িয়ে নিজের ভুলের স্বীকৃতি দিয়েছেন। খলিফা বা ইমামের কথার প্রতিবাদ করার কারণে উপস্থিত মুসাল্লিরা আপত্তি উত্থাপনকারী মহিলাকে কিছু বলেছেন বলে আমরা খবর পাইনি। খলিফাদের শাসনামলে মদীনার মহিলারা পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করেছেন। খলিফা ওমর (রা) শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ নামক এক মহিলাকে মদীনার ব্যবসা-বানিজ্য দেখাশোনার দায়িত্ব প্রদান করে আমাদের জন্যে অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু এ সব কথা এখন ইতিহাস, আমাদের সোনালী যুগের ইতিহাস। মানুষ ইতিহাস পাঠ করে সন্তুষ্ট হয় না, বাস্তব জীবনে এর নমুনা দেখতে চায়।

এ রকম কোন ঘটনার কথা বাংলাদেশের বা মুসলিম বিশ্বের কোন মসজিদে কি কল্পণা করা যায়? বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে মহিলারা যেতেই পারেন না, ইমামের কথার প্রতিবাদ করা তো অনেক দূরের বিষয়। কোন মহিলা এ রকম সাহস দেখালে সবাই মিলে তাকে অপমান করে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন বায়তুল মোকাররম মসজিদ ছাড়া আর কোন মসজিদে মহিলাদের যাওয়ার সুযোগ ছিল না। বিলাতে বাঙালি এবং গুজরাটিদের দ্বারা পরিচালিত অধিকাংশ মসজিদেও মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই। এখন বাংলাদেশের কয়টি মসজিদে মহিলারা যেতে পারেন তা আমার জানা নেই। তবে অনুমান করে বলতে পারি, এখনো সেখানে অধিকাংশ মসজিদ মহিলাদের জন্যে নিষিদ্ধ এলাকা।

আল্লাহর ঘর মসজিদে যদি মহিলাদের অধিকার স্বীকৃত না থাকে তা হলে আমাদের পারিবারিক পরিবেশে মহিলাদের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে তা ভাবা যায় না। ইসলাম সকলের অধিকার দিয়েছে, ইসলাম শুধু পুরুষের জন্যে নয়। বাংলাদেশের ইসলামী ঘরানার লোকদের তৎপরতা দেখে যে কেউ ভাবতে পারেন, ইসলাম শুধু পুরুষের ধর্ম, মেয়েদের ব্যাপার সেখানে গৌণ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মেয়ে বা মহিলা। আমরা জানি, তাদের উপেক্ষা বা অবহেলা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু ইসলামী ঘরাণার লোকেরা কি তা মানেন? মেয়েদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের জন্যে তাদের কি কোন কর্মসূচী আছে? তারা প্রায়ই চিৎকার করে বলেন, এনজিও বা বিদেশী মিশনারীরা আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি ধ্বংস করে ফেলছে। এনজিও এবং মিশনারীরা ক্ষুধার্ত এবং নিরক্ষর মানুষের কাছে শিক্ষা ও খাদ্য নিয়ে যুগ যুগ ধরে সেখানে কাজ করছে। আপনারা এ ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর জন্যে কি করছেন? বাংলাদেশে লাখ লাখ মহিলা আছেন যারা শ্রমজীবী। তারা মানুষের বাসা-বাড়ি, খেত-খামার, গার্মেন্টস ফেক্টরী, কারখানা এবং চা-বাগানে কাজ করেন। তারা কি মানুষ নয়? ইসলামের পতাকাবাহী হিসেবে তাদের জন্যে কি আপনাদের কোন করনীয় নেই? কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু সস্ত্রীক বৃটেনে বেড়াতে আসেন। তাঁর স্ত্রী বাংলাদেশের ইসলামী ঘরানার সাথে জড়িত। শ্রমজীবী মহিলাদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে তিনি একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। তিনি আমাকে দুঃখ করে বললেন, যে সংগঠনের সাথে তিনি আছেন তাদের ফান্ডে টাকা-পয়সার তেমন অভাব নেই। কিন্তু কর্মকর্তারা শ্রমজীবী দুঃস্থ মহিলাদের জন্যে অর্থ ব্যয় করতে রাজি নয়। এটাই আসলে বাংলাদেশের ইসলামী ঘরানার স্বাভাবিক চিত্র।

এক সময় বাংলাদেশের ইসলামী ঘরানার লোকেরা শুধু মসজিদ এবং মাদ্রাসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাও শুধু পুরুষদের জন্যে। দেশের পত্রপত্রিকা থেকে ধারণা করি, বর্তমানে তারা সবাই রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। কেউ সরকারের পক্ষে এবং কেউ সরকারের বিপক্ষে। রাজনৈতিক মিছিল এবং সমাবেশের জন্যে তাদের হাতে সময় এবং অর্থ দুটোই আছে। কিন্তু সামাজিক কাজ করার জন্যে তাদের কোনটাই নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইখতিয়ার উদ্দীনের রাজনৈতিক বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলাম প্রসারিত হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে শাহ জালাল, খান জাহান আলী, শাহ আমানত প্রমুখ সুফি-দরবেশের নিকট থেকে। সুফি দরবেশেরা মানুষের খেদমত করে মানুষের সামনে ইসলামের সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের বাণী তুলে ধরেন। সুফি-দরবেশরা তাদের কাজের মাধ্যমে বাংলার মাটিকে ইসলামের জন্যে উর্বর করেছিলেন বলেই ইখতিয়ার উদ্দীন এত সহজে বাংলাদেশ দখল করে নিতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের ইসলামী ঘরানার লোকেরা এখন ইসলামের মূল শিক্ষা এবং সমাজসেবার কথা ভুলে গিয়ে রাজনীতি নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। এটা মোটেই শুভ-লক্ষণ নয়।

আমাদের মতে তরুণদের জাগরণ এবং ক্ষমতায়নের উপর বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। এ তরুণদের মধ্যে মহিলারা সংখ্যা গরিষ্ঠ। বিশ্বায়নের জোয়ার এবং ভারতীয় টেলিভিশনের ধাক্কা বাংলাদেশের সামাজিক ভিত্তিকে অস্থির করে তুলেছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের চিত্র। এর পাশাপাশি অসংখ্য মত ও পথের লোকেরা সেখানে মহিলাদের মধ্যে কাজ করছে। রাজপথে ম্লোগান দিয়ে এ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। বাস্তব কাজের মাধ্যমে মহিলাদের ব্যাপারে ইসলামের সঠিক বক্তব্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হলে এর দায় ইসলামী ঘরানার লোকদেরই বহন করতে হবে।

লন্ডন, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৩

বিষয়: বিবিধ

১৬০৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File