মুহিব খান: আশা-নিরাশার দোলাচল

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ১৯ অক্টোবর, ২০১৭, ০৮:১৪:৫৭ সকাল



তখন বেশ ছোট, গুরুজনদের কাছে মাতৃভাষায় দক্ষ যে কয়জন আলেম-ওলামার নাম শুনি, তাঁদের মাঝে মাওলানা আতাউর রহমান খান অন্যতম। তাঁকে চর্ম চোখে দেখার সুযোগ হয় নি কখনো। এক সময় মাওলানা আতহার আলীর জীবন-সম্পর্কিত ছোট্ট একটি পুস্তিকা হাতে আসে। এর লেখক মাওলানা আতাউর রহমান খান। বইটি এক বন্ধুকে নিয়ে যৌথভাবে পড়ি, আর এর শব্দবন্ধ-বাক্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আওড়ে আওড়ে শেষ করি। দু-জনেই বিষয়-বিন্যাস ও ভাষিক মাধুর্যে আপ্লুত। না, এরপর তাঁর কোনো লেখা পড়া হয় নি।

ততদিনে উপন্যাসে মুখ গুঁজে রাখার প্রবণতা তৈরি হয়ে গেছে। সৈয়দ হক, শওকত, মিলন-হুমায়ুন নয়, সুদূর গ্রামে তাদের আওয়াজ খুব একটা পৌঁছয় না। প্রথম আকর্ষণ রোমেনা আফাজের বনহুর সিরিজ, পরবর্তী ধাপ মাসুদ রানা। তবে মাঝে-মধ্যে ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’ বাজাই বা ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ও ঘুরে আসি। ইতিহাসপাঠও উপভোগ্য। দূর সম্পর্কের এক মাওলানা ভাই হান্টারের লেখা পড়তে বলেন। তিনি আবার বিভিন্ন ধর্মীয় মাসিক পত্রিকায় লেখালেখি করেন। এ জন্য আমার উৎসাহ বাঁধ মানে না। মনের গভীরে লেখক হবার ব্যর্থ তাড়না। সে ভাই প্রায়ই আমার পড়াশোনার খোঁজ-খবর নেন। কখনো-সখনো আমার সংগ্রহ থেকে দু-একটি বই ধার চেয়ে নেন। এভাবেই দিন গড়ায়।

এক সময় পড়াশোনার স্বার্থে ঢাকায় আসার উপলক্ষ্য তৈরি হয়, যদিও তা আর হয়ে ওঠে নি; মফস্বলেই থিতু হই। তবে সে ভাই বলেন, উবাইদুর রহমান খান নাসিম নামে তাঁর এক বন্ধু ঢাকায় থাকেন। তিনি যে খান সাহেবের ছেলে, তাও উল্লেখ করতে ভুলেন না। আফগানিস্তানে আমি আল্লাহকে দেখেছি- বইটি হাতে পড়েছে কি-না, মনে নেই। তবে, ভেতরে ভেতরে দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক মিল্লাত মার্কা লেখার প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা। কারণ, এগুলোর ভাষা জলো-জলো মনে হয়। আর তাই নাসিম সাহেবের বই পড়া হয় নি আজও। তখনই এক বন্ধুকে নিয়ে দেওয়ালে সাঁটানো নিয়মিত আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, বাংলাবাজার ইত্যাদি পড়ি, বিশেষত এগুলোর সাহিত্য-সাময়িকী। মুসলিম জাহান, বিক্রম, পালাবদল, বিচিত্রা, বিচিন্তা, যায়যায়দিন ইত্যাদি স্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। এভাবেই জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতাবোধ তৈরি হয়। সাহিত্য পত্রিকার মাঝে প্রাধনত দেশ ও শৈলীই অধিক প্রিয়। কেন জানি না, মনে মনে তখনই কিংবদন্তিপ্রতীম মেধা নাসিম সাহেবের বিপুল অপচয়ের গন্ধ পেতে থাকি। নিশ্চিত হতে থাকি, তিনি যে জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়ছেন, এর কচুরিপানার ঘনপিনদ্ধভাব কোনো ঢেউ তুলতে দেয় নি, দেবেও না। সেই কওমি-অঙ্গনের বদ্ধ জলাশয়ই তাঁর একান্ত স্বপ্নভূমি ও নির্বিরোধ কর্মক্ষেত্র। তাই তাঁর লেখনি-তৎপরতায়, তিনি কতটা সফল, আজও আমার প্রশ্ন!

নাসিম সাহেব ইনকিলাবের নিরাপদ বেষ্টনীতে জীবন পার করে দিলেন, কিন্তু অপার সম্ভাবনার কর্ষণভূমি ধর্মীয় বা কওমি-অঙ্গনে চেতনার জাগরণ হল না: না বিষয়ে, না ভাষায়। ধর্মীয় সাহিত্যের তরীকে পাড়ে ভিড়ানোর জন্য এখনো কেউ তৈরি হয় নি। কেন হয় নি, এর উত্তর কার কাছে চাইবো, জানা নেই। যাদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মাঝে মাঝে, তাদের সংখ্যা কত, তাদের অভিজ্ঞতাই-বা কেমন? তারা সত্যি কি নাসিম সাহেবদের চিন্তার মূলসূত্র ধরতে পেরেছেন? জানার বড় সাধ।

কবি জামাল উদ্দিন আরিফ নামের এক মাওলানাকে জানি, এখন তিনি বিগত, কওমি-অঙ্গন থেকে উঠে আসা তুখোড় মেধাবী ও পরিশ্রমী ব্যক্তি। মেধা ও সাধনায় তার তুলনা মেলা ভার। তার আফসোস ছিল, যাদের জন্য সাহিত্য-সাধনা, তারা সাহিত্য বোঝে না! আমার জানা মতে, তিনি একটু অস্থিরমতি ছিলেন। সাহিত্যের সমঝদার গোষ্ঠী তৈরি করার মতো গঠনমূলক কোনো কাজ তিনি করতে পারেন নি। কিন্তু নাসিম সাহেবদের, যাদের পারিবারিক ঐতিহ্য গঠনমূলক নানা প্রণোদনার সঙ্গে জড়িয়ে, সেই কাজকর্ম কই? হয়ত আছে, দৃশ্যমান নয়, অন্তত আমার চোখে। কিন্তু কী সেই কর্মসূচি, যা ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে? যদি থেকে থাকে, তাহলে দৃশ্যমান হচ্ছে না কেন? তা হতে কত দিন লাগবে? আর যদি এমন কোনো কার্যক্রমের উদ্যোগ না থাকে, তাহলে আমি বলবো, এ হল নাসিম সাহেবদের ‘ইচ্ছা-মৃত্যু’র নীরব ঘণ্টা! বাংলা ভাষার চর্চায় শামসুল হক ফরিদপুরী, নুর মুহাম্মদ আজমী, আবদুর রহিম, ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, মহিউদ্দিন খান, আবু তাহের মেসবাহ, জয়নুল আবেদীন প্রমুখদের পরবর্তী স্রোত কই? যদি সে স্রোত না থাকে, থাকলেও যদি তা সাহিত্যের সাগর পর্যন্ত না পৌঁছাতে না পারে; বরং এঁদো পুকুর, বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়, তাহলে এনিয়ে বেশি উল্লাস-উচ্ছ্বাসের কোনো যুক্তি নেই। কারণ, নদীর কলকল বা সাগরের উত্তাল ধ্বনি এতে আশা করা বাতুলতা মাত্র।

ইতিহাস-পাঠে জানা যায়, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের একেবারে শেষ পর্যায়ে, আধুনিক সাহিত্যের সূচনায় এক ধরনের সাহিত্য পদবাচ্য বস্তুর চর্চা হত খুব, একে বলা হত কবিগান, এর স্রষ্টাগণকে কবিয়াল। সাহিত্যের আলোচনায় এর উপস্থিতি একান্ত প্রান্তে। কারো কারো মতে, তা সাহিত্য পদবাচ্য নাম ধারন করতে পারে নি। কিন্তু সে সময়ের কবিগানের পাঠক বা শ্রোতার সংখ্যা কম ছিল, তা বলা যাবে না। ইতিহাসে কান পাতলে আজও এর হুল্লোড়-ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা তৈরি হয় নি। কেন হয় নি বা কেনই-বা তা কোনো স্রোতের তৈরি করতে পারে নি, তা বিশ্লেষণসহ ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।

বটতলার সাহিত্য নামেও এক ধরনের সাহিত্য চর্চিত হত। সেই সাহিত্যের চিহ্ন বা নিদর্শনগুলো আমাদের হাতে সেভাবে পৌঁছয় নি। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে তা বর্তমানে রক্ষিত অভিজাত সাহিত্যের চেয়ে কোনোভাবইে কম ছিল না। সেই বটতলার পাঠকের সংখ্যাও কিন্তু কম ছিল না। কিন্তু কই সেই সাহিত্য? এগুলো এখন শুধু ইতিহাসের অংশ।

কওমি-অঙ্গনে সাহিত্য হয় না বা হয় নি, ব্যাপারটা তা না। কওমি-অঙ্গনে মেধাবী নেই, তাও বলা যাবে না। তথাকথিত অতি আভিজাত্যপ্রবণদের মতে, কওমিকে যদি গবেটদের আখড়া মেনে নেওয়া হয়, তাহলে গোবরেও যে পদ্মফুল ফুটে, তা কি তারা অস্বীকার করবেন? কিন্তু সেই মেধাবী পদ্মফুল কীভাবে নিজের শাণিত বুদ্ধি-বিবেক, স্বরূপ-সচেতনতা নিয়ে বেঁচে-বর্তে থাকার- শুধু সমকালে নয়, দূরস্থিত ভবিষ্যতের গর্বে- কোনো চেষ্টা আছে কি? যদি না থাকে এর জন্য প্রস্তুতি কে নেবে? এর দায় তো প্রতিদ্বন্দ্বী বা তথাকথিত প্রতিপক্ষের কেউ নেবেন না। নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিজেদের টিকে থাকার সকল উপায়-উদ্যোগ নিজেদেরই করতে হবে এবং সফলভাবে। এ বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য দু-একটি প্রসঙ্গ টেনে আনছি। এক. তমদ্দুন মজলিশ কিন্তু বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চার তুমুল একটি অধ্যায়। কিন্তু আজ এর উপস্থিতি নেই। কেন এবং কীভাবে তা দুর্বল হলো, এ প্রশ্ন কেউ তুলে না, উত্তর খুঁজে না; পাছে নিজেদের অদক্ষতা-অযোগ্যতা প্রকাশ পায় এ শঙ্কায়। দুই. জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের ভাই সৈয়দ আলী আশরাফ আস্তিক্যবাদী কবিতা-চর্চার একটি প্লাটফর্ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কিছু চর্চা-টর্চাও হয়েছিল। কিন্তু এর ধারাবহিকতা থাকলো না। আলী আহসানের মতো ধীমান প-িত এর পক্ষে থাকার পরও কেন তা রুদ্ধ হল, এর উত্তর কি কারো জানা আছে? তিন. ফররুখ আহমদকে রেনেসাঁর কবি বলা হয়। যারা বলেন, তারাই কিন্তু বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের জাগরণ বিষয়ে নানা প্রশ্ন তুলতে কসুর করেন না। তারা কিন্তু নিজেদের রেনেসাঁর কবির জাগরণমূলক সামগ্রিক কাজের তথ্য-তালাশ নেন না। কলকাতার আবহে ফররুখ আহমদের সমকালীন এক ঝাঁক কবির আবির্ভাব হয়েছিল। ইসলামি ঐতিহ্য-চেতনা তাদের কাব্যচর্চার অংশ ছিল। সেই এক ঝাঁক কবির মাঝে এখনও বেঁচে-বর্তে আছেন একমাত্র ফররুখ আহমদ: কাব্য ও ব্যক্তিত্ব চর্চার নিরিখে। আর বাকি সবাই ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কেন? চার. ইসমাইল হোসেন সিরাজী মুসলিম স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার বিপুল উচ্চারণ। তার ‘অনল-প্রবাহ’ সত্যি সত্যি তৎকালীন মুসলিম চেতনায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এখনকার মতো এতো দ্বিধা-বিভাজন ছিল না। গদ্য ও পদ্যচর্চায় তিনি প্রবল বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ কোথায় তার সেই সাহিত্য? কেন তা মূলধারার সাহিত্য হিসাবে গণ্য হতে পারে নি? সে প্রশ্ন কি আমাদের মাথায় কাজ করে?

দীর্ঘ এ ভূমিকায় যা বলা হল, তা মুহিব খান সম্পর্কে সামান্য একটি উপসংহার টানার জন্য। আমার প্রশ্ন মুহিব খান কি সে ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন? এ সব বিষয়ে তার প্রস্তুতি কেমন বা কতটুকু? নাকি পতঙ্গের মতো সন্ধ্যাবেলায় উদিত হয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই মিলিয়ে যাওয়ার পায়তারা?

যেহেতু কওমি-অঙ্গনটা একেবারে শূন্য, তাই ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার যে প্রবাদ আছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। কবি ফরুরখ আহমদের মতে, সুফিয়া কামালও মেধাবী ছিলেন। কিন্তু সংবর্ধনার তোড়ে সুফিয়া কামাল নিজের মেধা-চর্চার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েন। যে মৃগনাভি নিয়ে তার জন্ম হল, সভা-সেমিনার তা ভুলিয়ে দিল। কবিতার কাজ যে চর্চা ও চর্যার ভিতর দিয়ে এগোনোর কথা, তার ফুরসত হল না। পরিণামে যা হবার তাই হল।

পৃথিবীর যে কোনো সাহিত্য নির্দিষ্ট একটি ধারা মেনে চলে। কালে কালে যুগে যুগে এর প্রবণতার একটু আধটু সংযোজন-বিয়োজন ও গ্রহণ-বর্জন চলে। কিন্তু মূল চেতনা এক ও অভিন্ন। ভিক্টোরিয়ান যুগের কবির সঙ্গে রোমান্টিক যুগের, রোমান্টিক যুগের কবির সঙ্গে মডার্ন যুগের এবং মডার্ন যুগের কবির সঙ্গে তথাকথিত পোস্ট মডার্ন যুগের কবির সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ও অন্তর্গত চেতনার প্রবাহ আছেই। তেমনি, জাহেলি যুগের কবির সঙ্গে উমাইয়া-আব্বাসি, উসমানি বা পতনযুগের কবিতার সঙ্গে আধুনিক আরবি কবিতার মিল-অমিল সবই আছে। কবি আদোনিসের আলোচনায় এর সাক্ষাৎ মেলে ঢের। ইংরেজি কবিতায় ইসলামধর্মীয় আবহের প্রশ্ন আসে না। সেখানে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে অনেক পরে। কিন্তু খোদ ইসলামের আঁতুরঘর মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি সাহিত্যের অবস্থানটা কোথায়? সেই উমাইয়াদের থেকে শুরু করে কয়জন চেতনাধারী মুসলিম কবির নাম উল্লেখ করা যায়? প্রশ্নটা এখানেই। বাংলা সাহিত্যেও ইসলামি চেতনাধারী একাধিক কবির নাম উল্লেখ করা যায় না। কিন্তু কেন? সমস্যাটা কোথায়? এর উত্তর চিহ্নিত করতে হবে ধর্মের মূল আবেদন ও সমাজ বাস্তবতার নিরিখে। কওমিরা ভীষণ আবেগী; এরা তিলকে তাল করতে যেমন দ্বিধা করে না। তেমনই রশিকে সূতা হিসাবে ভাবতেও দেরি করে না। তাই এদের বাহবা নিয়ে কাব্যচর্চা করলে আখেরে নিজেরেই পতন, অন্তত এটুকু বোধ মুহিব খানকে ধারনে করতে হবে।

মুহিব খান যদি কওমির চেতনা নিয়ে কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ করতে চান, তার জন্য এর দরোজা অবশ্যই উন্মুক্ত, যেমন খেলার মাঠ সকল খেলোয়াড়দের জন্য। কিন্তু কাব্যচর্চা আর ওয়াজ-মাহফিল এক জিনিশ নয়। কবিতা হল কবির নিবিষ্ট চর্চার ঐশিক প্রকাশ। এখানে সাধনা হবে সন্ন্যাসীর নিবিষ্ট নিবেদনের মতো। নিজের গহীনে, ইতিহাসের বিস্তারে ডুবুরির মতো ডুব দিতে হবেভ। বাইরের অওয়াজ ও কোলাহল তার কানে ঠিকই প্রবেশ করবে, কিন্তু এতে ধ্যানভঙ্গ হলে হবে না। আর তখনই ভাব ও ভাষার অপূর্ব যোজনায় ফুটে উঠবে মগ্নচৈতন্যের অমোঘ উচ্চারণ। বাংলা সাহিত্যের সুদীর্ঘ পথ বেয়ে খুঁজবেন নানা মণি-মানিক্য, যা তুলে আনবেন পাঠকের চোখে-মুখের সামনে। পাঠক নিজের রুচি মতো গ্রহণ করবেন। এভাবেই তৈরি হবে নিজস্ব কাব্যভূবন।

সুনির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর জীবনধারা নিয়ে বৈশ্বিক পরিম-লের সাহিত্য রচনা করতে গেলে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। আমাদের হরিসংকর জলদাস এর জীবন্ত প্রমাণ। মহাশ্বেতাদেবী মুণ্ডা উপজাতিদের নিয়ে পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন। বাউল-বৈষ্ণবদের নিয়েও সাহিত্য রচিত হয়েছে। সে হিসাবে কওমি তো বেশ সজীব ও সক্রিয় জনগোষ্ঠী। তাই কওমির গান গাইতে হলে, বিশ্বসভায় এর আবেদন তৈরি করতে হলে, বৈশ্বিক রীতি অনুসারেই শব্দ-সন্ধান ও সুর-যোজনা করতে হবে।

মুহিব খানের জন্ম নির্জলা-নিস্ফলা এক ভূমিতে। তাই তার প্রতি কওমি-অঙ্গনের প্রত্যাশা অনেক। সে প্রত্যাশার ভার তাকে নিতে হবে। নিজের শেকড় ও ঐতিহ্যকে চেতনায় ধারন করা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু এর জন্য বা তা জনসমক্ষে প্রকাশের জন্য প্রচলিত কাব্যভাষা ও রীতিকে আত্মস্থ করতে হবে। কওমপ্রথা-নির্ভর কওমির শ্লোগানধর্মী ভাষা সর্বত্র আবেদন তৈরি করতে পারবে না। তাই বৃহত্তর জনতার ভাষা, সাহিত্যের ভাষা, যা চর্যাপদ-মঙ্গলকাব্য-বৈষ্ণবকাব্য হয়ে আধুনিক ধারায় মিলিত হয়েছে, তা আপন করে নিতে হবে। ভাব-প্রকাশের ও চর্চার যে ধারা-পরম্পরা, তা আরো পরিশীলিত ও কাব্যনিষ্ঠ হতে হবে।

আবার তার সামনে প্রচুর বাধা। কারণ, তিনি ধর্মীয় অঙ্গনের ফসল বলে, সংরক্ষণশীল পরিবারের সদস্য বলে, তার উপর আনুশাসনিক নিগড় চাপিয়ে দিতে চাইছেন কেউ কেউ। কবি হিসাবে এগুলোর প্রতি চোখ রাখলে বা হেলায় ভরে ফেলে দিলে ভুল করবেন। এতেও প্রজ্ঞা ও ধীরতার পরিচয় দিতে হবে। ইসলামে শিল্প ও সাহিত্যচর্চার যে উদার জমিন আছে, তাকে সে জমিন উদ্ধার করতে হবে। সে জমিনে পা রাখতে হবে শক্তভাবে। এবং যারা সেই জমিনের খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত রাখতে হবে, যেন ধর্মীয় আবহ থেকে উত্থাপিত অভিযোগ তাকে কলুষিত করতে না পারে। তার চারপাশে যারা আছেন, তারা ধর্মের উদার সেই জমিনের ব্যাপারে কতটা সচেতন, তা একমাত্র তিনিই জানেন।

কওমি অঙ্গন সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে বালখিল্যতার সীমানা অতিক্রম করতে পারে নি, অতি শীঘ্র তা পারবে, এমন আশা করা ভুল। কারণ, সাহিত্যের সুদীর্ঘ রাস্তার ব্যাপারে তাদের জানাশোনা একান্ত সীমিত। তাই সম্মাননা-অনুষ্ঠানে অতিথিদের প্রত্যাশা ও জবাবে কবির বক্তব্য কেমন হল, এনিয়ে কবির দায়বদ্ধতার চিত্র কতটুকু ফুটে উঠলো, সে আলোচনা নেই। অথচ বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মীয় সাহিত্য-চর্চা, ঠিক ইসলামি ফিকহ-চর্চার মতোই, নিয়ে নানা তথ্য-তত্ত্বের যে উতোর-চাপান চলছে, তার খোঁজ-খবর রাখলেও কিন্তু আলোচনায় বালকত্বের প্রভাব ফুটে উঠতো। তা তাদের জানা নেই বলেই সম্মাননা-অনুষ্ঠানের পর কাঁচা কাঁচা কথার বুদ্বুদ উঠতে শুরু করেছে। যেমন: সম্মাননায় জন্মবার্ষিকীর উল্লেখ কেন? অনুষ্ঠানে করতালি হল কেন? পুরুষদের মাঝে নারীদের উপস্থিতি কেন, তাও আবার বেপর্দা অবস্থায়?

অন্তর্জালে চোখ রাখলে হাসি পায় খুব! বুঝতে পারি, মুক্ত তথ্য-প্রবাহের সুবাদে বিশেষত ধর্মীয় পরিসরে বায়স-ফিঙ্গের আজ বাড়-বাড়ন্ত। তাদের কা-কা-রবে অন্তর্জালে বসা দায়। আহা, আজ টেড হিউজ বেঁচে নেই। ব্রিটেনের এই রাজকবি বায়সপ্রজাতিকে নিয়ে এন্তার কাব্য রচনা করেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে এবং আমাদের ডানাহীন-পাখাহীন দু-পেয়ে বায়সপ্রজাতি দেখলে আমোদ পেতেন অবশ্য। হয়ত গুটিকয় কবিতাও প্রসব করতেন এনিয়ে। সে যাক গে, কিন্তু কবিকে কোকিলের মতো সুরের সাধনা করতে হয়। বেসুরো কোনো আওয়াজ কবির জন্য বে-মানান।

সব শেষে হিন্দু পুরাণ থেকে একটি উদাহরণ টানছি। অসুরদের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে দেবতারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়। অমৃতলাভ বা স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য তারা সমুদ্র-মন্থনের অনুমতি পায়। সে সমুদ্র-মন্থনে কত সমস্যা, কত বাধা-বিঘ্ন! শেষপর্যন্ত মন্থন হলেও এর ক্ষিরটুকু কে নেবে, এনিয়ে কূটচালের শেষ নেই। এখানেই কথা, ধর্ম-সমাজ মন্থন করে সাহিত্যের ক্ষির তৈরি হবে, সে কি সামান্য কাজ! এ ক্ষেত্রে দেবাসুরের বিভাজন যদি থাকে, সেখানে মুহিব খানকে, তার অনুসারীদেরকে কৌশলী ও শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে হবে।

তাই মুহিব খানকে অবশ্যই চরিত্রের শুদ্ধতায়, বিশ্বাসের দৃঢ়তায়, আচরণের উদারতায়, কাব্যবোধের গভীরতায়, সাধনার নিবিড়তায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এটাই হল মূল কথা। আমরা তার সার্বিক উন্নতি কামনা করি। আমিন।

বিষয়: বিবিধ

৯৫৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

384248
২১ অক্টোবর ২০১৭ দুপুর ১২:৫২
কাহাফ লিখেছেন : :কওমিরা ভীষণ আবেগী; এরা তিলকে তাল করতে যেমন দ্বিধা করে না। তেমনই রশিকে সূতা হিসাবে ভাবতেও দেরি করে না। তাই এদের বাহবা নিয়ে কাব্যচর্চা করলে আখেরে নিজেরেই পতন, অন্তত এটুকু বোধ মুহিব খানকে ধারনে করতে হবে"
অসাধারণ আলোচনা!জাযাকাল্লাহ মুহতারাম!
২১ অক্টোবর ২০১৭ সন্ধ্যা ০৭:১২
316966
রওশন জমির লিখেছেন :
ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File