আমার বায়না ও মায়ের চেষ্টা

লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২০ মার্চ, ২০১৩, ০৫:২৩:৪৭ বিকাল

বয়স কত মনে নেই। তবে বাড়ি-ঘরের ছোট-খাটো বক্স-পেটরা নিয়ে আমার বেশ কৌতূহল। এই বক্সগুলোতে আমার খেলনাগুলো সাজিয়ে রাখি। বাজার থেকে যে-নতুন বক্সটা আসবে, সেটাই আমার চাই। কারণ, হাতে তৈরি আমার নতুন খেলনার জন্য নিত্যনতুন বক্স না হলে হয় না। নিজের হাতে কাগজ দিয়ে নৌকা, ফুল, চড়কি ইত্যাদি বানাতে পারি। এই কর্মকারিতায় সবাই অবাক। ছোটরা তো অবশ্যই, সমবয়সী বা ঊর্ধ্ববয়সীরাও এগুলো বানিয়ে দেওয়ার আবদার জানায়। বীরদর্পে বানিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করি।

পাশের বাড়িতে আমার এক ভাইয়ের বিয়ে হবে। ভাই সেনাবাহিনীর লোক। ভীষণ বদমেজাজি। শোনা যায়, তার বুট নাকি দারুণ শক্ত। এ দিয়ে মানুষকে তিনি মারেন। যে-কোনো মানুষ তার লাথিতে চিৎপটাং। তিনি আমাকে কাছে ডাকার চেষ্টা করেন। আমি এড়িয়ে চলি। এ-কিরে বাবা, যে-লোকটা শুধু শক্ত বুট পরে, এই বুট দিয়ে মানুষকে আঘাত করে তার কাছে যাওয়ার কোনো মানে হল? তো তার বিয়ে উপলক্ষ্যে আমাদের বাড়িতে-ঘরে ভীষণ আনন্দ। আমরা বিশেষ আমন্ত্রিত গোষ্ঠীর আওতাভুক্ত। কারণ, আমার পুঁচকে বড় ভাইকে সেই সেনা-ভাইয়া দোস্ত বলে ডাকে। গ্রামে বিয়েতে দোস্তের আলাদা কদর।

এই বিয়ের উপহারের জন্য চমৎকার একটি ফ্লাস্ক আনা হল। বিয়ে বাড়িতে পাঠানোর আগেই অনেকে দেখে-শুনে এর প্রশংসা করলেন। বিয়ে-বাড়ির দু-এক আপু প্রশংসা শুনে অগ্রিম দেখে গেছেন। তারাও খুশি। কিন্তু আমার মনটা ভীষণ ভার। কেউ আমার এই মন ভারের খবর নেয় নি, সময়ও পায় নি হয়ত। সবাই তো বিয়ের আনন্দ নিয়েই ব্যস্ত। আম্মা শুধু দেখলেন, আমি কেমন যেন মনমরা। তিনি জিজ্ঞেস করলে আমি এড়িয়ে যাই। পরক্ষণে ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, বিয়ে-বাড়ির জন্য যে প্যাকেটটা আনা হয়েছে, সেই বস্তুটা তাদের দিয়ে প্যাকেটটা রেখে দেওয়া যায় কি-না। আম্মা একটু দমে গেলেন, তিনি এতক্ষণে বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেনে। আমাকে বললেন, এটা উপহারের জিনিশ। প্যাকেট ছাড়া তা দেওয়া যাবে না।

বোধহয়, আম্মা আব্বার কাছে কথাটা বলেছেন। আব্বা উপহারটা আমাদের আলমারিতে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আম্মা বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বলে আসলেন, ‘আমি এ নিয়ে একটু খেলা করতে চাই। আমার খেলার শখ মিটলেই তা দিয়ে আসবেন।’ প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠি আর আলমারিতে রাখা প্যাকেটটা দেখি। আহা! যদি এই প্যাকেটটা হত, তাহলে আমার নতুন খেলনাগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা যেত। কী অদ্ভূত প্যাকেট! কত খাঁজ কাটা! আর কতদিক দিয়ে যে খোলা যায়। খুলে দেখার আবদার করলে আম্মা বলেন, আলমারিতে যেহেতু আছে, এ নিয়ে এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমার জন্যই তা আছে এবং থাকবে।

একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি, সেটা আলমারিতে নেই। হাউমাউ করে কান্না শুরু করি। একবারে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার দিচ্ছি। আমার বিনম্র মা অসহায় ভঙ্গিতে করুণ নয়নে তাকিযে আছেন। দাদি বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এটা-ওটা হাতে দিচ্ছেন। সবই ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। আমার মায়ের দ্বিধাটা হল, উপহারের জন্য আনা বস্তুটা তো ফিরিয়ে আনা যায় না। আর তাছাড়া প্যাকেট ছাড়া দেওয়াটা তো অশোভন। আম্মা নিরূপায় হয়ে দাঁড়িয়েই আছেন। হঠাৎ দেখি তিনি আমার চোখের সামনে নেই। আমার কান্না না থামলেও এটা কেমন যেন মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, কেউ তো আর প্রবোধ দিচ্ছে না। দুঃখে-বিষাদে মাটিতে শুয়েই হিক্কা তুলছি। কান্না তো আর আসছে না। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। কিন্তু এমন সুন্দর প্যাকেটটা আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে তা মানতেও পারছি না। তাই মাটিতে পড়েই আছি। হঠাৎ দেখি মা হাসতে হাসতে সেই প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত। আমার সকল বিষাদ তিরোহিত।

পরে শুনেছি, নতুন ভাবীর সঙ্গে ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ভাব জমিয়ে সন্তানের দুরন্তপনার বিষয়আশয় খোলাসা করে তিনি নির্লজ্জের মতো প্রদত্ত উপহারের খোলস তথা প্যাকেটটা চেয়ে বসেন। জ্যাঠি-মাও এ-ব্যাপারে নতুন ভাবীকে সুপারিশ করেন। মা তখন আমার বেয়াড়াপনায় কেঁদেছিলেন কি-না জানি না। দীর্ঘ দিন রোগে ভোগে পরপারে পাড়ি জমান আমার দুরন্তপনার বয়সেই। এখন যখন মনে পড়ে খুব কান্না পায়। একরোখা ছেলের সামনে অসহায়ভঙ্গির করুণ চাহনির চিত্র আমাকে উতলা করে শুধু।

বিষয়: Contest_mother

১৭৪৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File