“ভূতের বাচ্চা সোলায়মান” ও কওমি-পড়ুয়া কতিপয় তরুণ
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৪:১১:২৫ বিকাল
ইন্টারনেটের সুবাদে যখন-তখন আপন প্রতিক্রিয়া প্রকাশে কারো কোনো বাধা নেই। তাই ইন্টারনেট-ব্যবহারকারী নিজস্ব সাইটে ভালো বিষয়ের যেমন প্রশংসা করতে পারেন, তেমনই মন্দ জিনিশের নিন্দাও করতে পারেন। ব্যক্তিভেদে ভালো-মন্দ নির্ধারণের মাপকাঠি বিভিন্ন রকমের হতে বাধ্য। তবে যে বিষয়ের নিন্দা-মন্দ হচ্ছে, তাকে সামগ্রিকভাবে না হোক, অন্তত যে-কোনো এক বা একাধিক যুক্তির নিরিখে মন্দ হতে হবে অবশ্যই। তা না হলে এ সব নিন্দা-মন্দ একান্ত পাগলের প্রলাপ বলে গণ্য হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’-এর নিন্দা-মন্দের শুরু, বইটি তখনো আমার চোখে পড়ে নি। কারণ, বইমেলায় যাবার সুযোগ নেই। আবার শিশু-কিশোরদের বই আমাকে তেমন টানে না। কিন্তু নিন্দা-মন্দের তোড়জোর শুরু হওয়ার পর মনটা স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তখন ঘেঁটে ঘেঁটে এর নিন্দার কারণগুলো খুঁজতে থাকি। মনে হল, প্রথম কারণ এর নামকরণের মাঝে নিহিত। সোলায়মান একজন সম্মানিত নবীর নাম। তাও যেন-তেন নবী নন, ইসলামি/ সেমেটিক ইতিহাসে তিনি বেশ ক্ষমতাধর নবী। মানব-সমাজ তো অবশ্যই, জিন জাতিও তার সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল। তাই কোনো কোনো অভিযোগকারীর বক্তব্য হল, সেই দিকে ইঙ্গিত করেই নবী সোলায়মানের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে! দ্বিতীয় অভিযোগ হল, জিন জাতির বিশ্বাস অন্তত সুন্নি ইসলামের অংশ। তা বিশ্বাস না করলে, বা এ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করলে ইমান থাকে না। তাদের বিশ্বাসমতে, লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ধর্মদ্রোহী (?) মানুষ! তিনি এ-বিশ্বাসে আঘাত করার জন্যই এ বিষয়ে বই লিখেছেন। তৃতীয় অভিযোগ হল, জুব্বাপরা একটি লোকের ছবি প্রচ্ছদে ব্যবহার করে ইসলামি পোশাককে হেয়-প্রতিপন্ন করার চেষ্টা আছে এতে। এ ছবি ব্যবহার না করে, তিনি অন্য যে-কোনো ছবি ব্যবহার করতে পারতেন। এ সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই নানা টাইমলাইমে নজর দিতে থাকি, বইটির মূল বিষয়বস্তু জানার আগ্রহে। যারা নিন্দা-মন্দ করছেন, তাদের কেউ বইটি আদ্যোপান্ত পড়েছেন বলে মনে হয় না। কারণ, বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কেউ লিখছেন না। এরই মাঝে কোনো গ্রুপ-পেইজে দেখতে পাই, এ-সব আলোচনার কারণে বইটির বিক্রি বেড়ে গেছে। হয়ত-বা তা সত্যি অথবা মিথ্যা। সে যাই হোক, এর মাঝে কেউ কেউ লেখকের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার, বই নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন। কোনো কোনো খতিব জুমার বয়ানে এ নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো কোনো তরুণ এ-বই পোড়ানোর জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বইটি সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে না পেরে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। যা দিনকাল পড়েছে! ধর্মীয় কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা বেশ কঠিন। অথচ ধর্মীয় বক্তব্য গুলিয়ে বা মিশেল দিয়ে জল-ঘোলা করে মাছ শিকার করা অনেক সহজ। এমনতর পরিস্থিতিতে বইটি পড়তে হল। বইটি শেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অহিংসা’ উপন্যাস সম্পর্কিত একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়। তা হল, এক পাঠক ‘অহিংসা’ উপন্যাস শেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখা পেয়ে বলে বসেন, “‘অহিংসা’ উপন্যাস পড়েও তো পেলাম না!” মানিক বলেন, “কী পান নি?” পাঠক বলেন, “অহিংসা!” মানিক তখন বলেন, “যা নেই, তা খুঁজতে গেলেন কেন?” আমার সঙ্গে লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের কখনো দেখা হবে কি-না, জানা নেই। এনিয়ে কোনো আগ্রহও নেই। কিন্তু দেখা হলেও এবিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করব না নিশ্চয়ই। কারণ, ধর্মীয় অবমাননা খুঁজতে গিয়ে তা পাই নি বলে সেই সব ছিদ্রান্বেষী তরুণদের প্রতিই বিরাগ বাড়ছে শুধু।
এ পর্যন্ত মুহাম্মদ জাফর ইকবাল রচিত চারটি বই পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। এ-সব নামের ব্যাপারে স্মৃতি সহযোগিতা করবে কি-না, জানা নেই। ‘দেশের বাইরে দেশ’ পড়তে হয়েছিল প্রবাসী শিক্ষার্থীদের জীবনযাপন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। তখন আমার এক ছোট ভাই বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার পথে। সেখানে তার জীবন-পদ্ধতি কেমন হবে, তা জানার জন্য এর সঙ্গে তখন আরো একাধিক বই পড়তে হয়েছিল। একবার মেধা-পুরস্কারের জন্য বই কেনার উদ্যোগ নিলে মেধাবীরা নিজেই ‘একটুখানি বিজ্ঞান’-এর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে। বইটি কিনে পুরস্কার প্রদানের পূর্বে তা পড়ে শেষ করি তাদের কৌতূহলের রহস্য ধরার জন্য। নব্বই দশকের একেবারে অন্তিম পর্বে, বোধকরি, ‘ধানশালিকের দেশে’র বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘কপট্রনিক ভালোবাসা’ পড়া হয় ঈদের ছুটির অবসরে। না, তার সেই সব লেখা আমাকে খুব বেশি মুগ্ধ করে নি। তাই পড়া হয় না। তবে মাঝে-মধ্যে তরুণদের দেওয়া তথ্য-অনুসারে তার কোনো কোনো কলাম পড়া হয়, পড়তে হয়। কিন্তু এবারে কতিপয় ‘তথাকথিত’ সচেতন তরুণের সমালোচনার ভঙ্গি দেখে পড়তে হল আলোচ্য বইটি।
ধান ভানতে গিয়ে শীবের গীত গাওয়ার মতো আরো বলে নেওয়া ভালো যে, মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেবকে সাহিত্যিক হিসাবে আমার কখনো ভাল লাগে নি, বিশেষ করে তার উপন্যাসগুলো আমাকে একেবারেই টানে না। তবে আমি তাকে ভীষণ রকমের ঈর্ষা করি। যে কাজটির জন্য তাকে ঈর্ষা করি, তা হল শিশু-কিশোরদের মাঝে তিনি স্বপ্নের জগত তৈরি করায় সফল হয়েছেন এবং এখনো স্বপ্ন বিতরণ করে চলেছেন অবিরামভাবে। এক ‘গণিত অলিম্পিয়াড’-এর মাধ্যমেই তো তিনি দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত স্বপ্ন ও সাহস বিস্তার করে চলেছেন উদীয়মান নাগরিকদের মনে। আবার সহজ সহজ শব্দ চয়ন করে, সহজ ভঙ্গিতে তিনি পত্রিকার পাতায় কলাম লিখেন। কিশোর-তরুণরা তা গোগ্রাসে গিলে খায়। অন্যদিকে, তিনি একজন পরিশ্রমী মানুষ। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের লক্ষ্যে অবিচল! শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো উপমহাদেশে এমন স্বাপ্নিক পুরুষ কতজন আছেন, জানতে বড় ইচ্ছে হয়। আমার মনে হয়, কোনো দেশে যদি একসঙ্গে তার মতো দশজন মানুষের উপস্থিতি ঘটে, তাহলে সে দেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। কারণ, কিশোর-তরুণরা স্বপ্নের দিশা পেলে আর পথহারা হয় না। তবে যে-বিষয়টি আমাদের মতো স্বল্পশিক্ষিত দেশে বড় রকমের সমস্যা এবং বেশ স্পর্শকাতর, তা হল ধর্মীয় পরিচিতি, ধর্মীয় আচরণ! যতদূর জানি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ধর্মীয় বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন নি। তিনি কোনো ধর্মের প্রচারক নন, বাহকও নন। জীবনের শুরু থেকে যে দর্শন-চিন্তা ও মানসিকতায় বেড়ে উঠেছেন, তিনি সে অনুসারেই জীবন-যাপন করেন ও কথাবার্তা বলেন। এতে ধর্মীয় মহলের কেউ কেউ তার প্রতি ক্ষুব্ধ। তা হতেই পারে। তাই বলে যেখানে তার কোনো দোষ নেই, তা নিয়ে জলঘোলা করার চেষ্টায় কী লাভ, আমার জানা নেই। তবে বুঝতে পারি, এতে সেই সব অভিযোগকারী ও নিন্দুকদের প্রতি সাধারণ মানুষ, বিশেষত স্কুল-কলেজের কিশোর-তরুণের আস্থায় ভাটা পড়বে।
এবার আসি ধান ভানার মূল প্রসঙ্গে তথা ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ বিষয়ে। অর্থাৎ অভিযোগগুলোর যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করা যাক:
(ক) সোলায়মান নবীর নাম বটে। এনিয়ে কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন নেই। আবার যে কোনো নবীর প্রতি ইমান আনা ও সেই মতে শ্রদ্ধা জানানো ইমানের দাবি। কিন্তু প্রশ্ন হল, এ নামটি কি শুধু নবীর জন্যই সংরক্ষিত, নাকি এ-দিয়ে সাধারণ মানুষের নামকরণও হতে পারে? যতটুকু জানা যায়, তা বললে ভুল হবে না যে, নবীদের নাম অনুসরণ করে নামকরণ করার ব্যাপারে ইসলামে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু সেই সব নবীর নামধারী সকল ব্যক্তিই কি নামের মাহাত্ম্য অনুসারে কাজ করেন? জীবন চালান? সেই নামধারী কেউ যদি কোনো অপরাধ/ গর্হিত কাজে জড়িয়ে পড়ে, তাতে কি নবীর কোনো অ-সম্মান হয়? নবীর নামের ক্ষতি হয়? তাহলে বর্তমানের বাংলাদেশে মুসা-ঈসা নামধারী যে-সব চোর-ছ্যাঁচড় আছে, ভারতের দাউদ ইবরাহিম তো দু-দুজন মহান নবীর নাম নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে, সে-সব ব্যাপারে তরুণরা উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন? প্রশ্নটি অন্যভাবে করলে তা এভাবে দাঁড়ায় যে, সকল সোলায়মানই কি নবী? তা যদি না হয়, তাহলে একটি বইয়ের নামের ক্ষেত্রে সোলায়মান নবীর প্রসঙ্গটাই টেনে আনার চেষ্টা কেন?
(খ) বইটা পড়ে কেউ যদি বুঝিয়ে দিতেন, কীভাবে তা ইসলামি আকিদা-বিশ্বাসের বিপক্ষে গেছে, তাহলে আমার মতো স্বল্পবুদ্ধি মানুষের জন্য সুবিধে হত। কিন্তু আমার নিজের ক্ষুদ্র এন্টেনা দিয়ে এতে তেমন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় নি। একি এন্টেনার দোষ, না রুচির, তাও বোঝা দায়। কিন্তু গ্রাম্য অনেক রীতিপদ্ধতির কথা জানি, যা জিনকে হাজির করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এ বইয়ে তেমন একটি পদ্ধতির বিবরণ আছে। সে পদ্ধতি অনুসারেই একটি বাচ্চা জিন উপস্থিত হয়, যার নাম সোলায়মান। এ রকম নানা কাহিনি তো মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের মাঝেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলো যদি ধর্মকে কলুষিত করতে না পারে, উপন্যাসের কাহিনি করবে কেন?
(গ) প্রচ্ছদে অবশ্য আরবীয় পদ্ধতির জুব্বাপরা একটি লোকের ছবি আছে। জুব্বা পরলেই তিনি হুজুর বা হুজুরের প্রতিনিধি হতে যাবেন কেন? আরব দেশে যারা জুব্বা পরেন, তারা সবা-ই কি হুজুর বা ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন? আবার এ জুব্বা পরেই যখন এরা কোনো আকাম করেন, নারীঘটিত নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন কি জুব্বার দোষ হয়, না মানুষটির? মধ্যপ্রাচ্যের শাইখরা তো সেই জুব্বা পরেই দেশের বাইরে গিয়ে ভিন্ন নারীর স্বাদ নিতে কসুর করেন না, তখন কি পোশাকের অবমাননা হয়? তাহলে আরবের ধর্মীয় শাইখরা এনিয়ে প্রতিবাদ করেন না কেন? অন্যদিকে, ছবির লোকটির মাথায় একটি রশি বাঁধা রয়েছে, যা বেদুইনত্বের প্রতীক। আমাদের দেশের আলেমগণ জুব্বা ও রুমাল পরলেও রশি পরেন না। তাহলে এটি ধর্মের অবমাননা হয় কী করে? উপরন্তু জুব্বা যে শুধুই আরবীয় মুসলিমদের পোশাক, তা নয়। ইসলামের ঘোরশত্রু আবু জাহাল ও আবু লাহাবও তা পরতো, তাহলে জুব্বার প্রসঙ্গে শুধু ইসলাম-মুসলিম প্রসঙ্গ আসবে কেন?
মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইয়ের পক্ষে ওকালতি নয়, উদ্দেশ্য হল যে-কোনো প্রতিক্রিয়া/ প্রতিবাদের সময় যৌক্তিকতার ন্যূনতম মানটুকু বজায় রাখার কথাটা বলা। কারণ, অন্যকে ঠাট্টা করার করতে গিয়ে নিজে হাস্যস্পদ হয়ে উঠলে তা আরো করুণ দেখায়। অযৌক্তিক, অবাস্তব ও বায়বীয় বিষয় নিয়ে অতিরকম বাড়াবাড়ি করলে এ রকম পরিস্থিতিই তৈরিই হয়। কিন্তু তথাকথিত সচেতন আবেগী তরুণরা কি তা বুঝতে পারবেন?
বিষয়: বিবিধ
২০০১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দাদা, উপভোগের জন্য রুচি লাগে। সে আপনার আছে। আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনার মন্তব্যটি দেখে কবি শহিদ কাদরী লিখিত একটি কবিতার লাইন মনে পড়লো। তা নিম্নরূপঃ
বন্য শুকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা/
মাছরাঙ্গা পাবে অন্বেষণের মাছ।।
আপনার মঙ্গল হোক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন