কওমি মাদরাসা: জাগরণের ঢেউ বনাম একলব্যের সাধনা
লিখেছেন লিখেছেন রওশন জমির ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৬:০৪:৩৬ সন্ধ্যা
থেকে থেকে কওমি মাদরাসার আলোচনা চাগাড় দিয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এর উপযোগিতা হল, তা ক্ষমতা হাতবদলের অন্যতম নিয়ামক। জনশ্রুতি আছে, এর ঝোঁক সাধারণত অ-আওয়ামী লীগের দিকে বেশি, সংখ্যা ও মাত্রাগত উভয় দিকে থেকেই। তাই বর্তমান সরকার ও এর ধামাধরা নানা শ্রেণির মানুষ বিভিন্নভাবে একে চাপের মুখে রাখতে চায়। আর বিরোধী শিবিরের তো প্রায় সবাই একই সঙ্গে এদের নজর কাড়তে চায়। ইদানিং মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এখানে কৌশলী আচরণে উৎসাহী।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কওমি মাদরাসা মোটামুটি অস্বস্তির কারণ। বিশ্বব্যাপী যে শিক্ষাব্যবস্থা চলমান, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, তা শেষপর্যন্ত একই গন্তব্যের প্রতি ধাবমান। কমিউনিস্ট শাসিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এ শিক্ষার লক্ষ্য এখন শুধু নির্দিষ্ট একটি আদর্শের সঞ্চালন, যা পুঁজিবাদ নামে পরিচিত। কিন্তু বৃহত্তর এশিয়ার একমাত্র কওমি মাদরসার শিক্ষাধারা-ই অন্তত বাহ্যিকভাবে পুঁজিবাদী স্রোতের বাইরে অবস্থান করছে। পুঁজির প্রবল স্রোতে এরা নাকাল হলেও, পুঁজির নানা উপাদান নিজেরা ধারন করলেও, অন্তত মৌখিকভাবে এর সমালোচনা ও নিন্দা-মন্দে মুখর হয়ে ওঠে। তাই নানাভাবে একে শেকল পরানোর বা অন্তত এর অন্তঃশীল প্রতিরোধ ক্ষমতা খুইয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা। আর এজন্যই আলোচনা-সমালোচনায় একে পর্যুদস্ত করার পাঁয়তারা।
২। এসব আলোচনা-সমালোচনা যখন চলমান, তখন বিজ্ঞানের অবদান ইন্টারনেটের সুবাদে কওমি ঘরানার এতোদিনকার আবদ্ধতার জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সামান্য আঙুলের ছোঁয়ায় এরা যেমন ইসলাম ধর্মের অপরাপর মতাদর্শ ও মানুষের ছবি দেখতে পায়ে, তেমনই নিজ ধর্মীয় আওতার বাইরের কোলাহলও জানতে পায়। এসব কোলাহল কখনো তাদের আহত করে, কখনো উৎসাহী। কখনো আবার আপনকার দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য উদ্বুদ্ধ করে। সারা বিশ্বের মুসলিম তো অবশ্যই, বিশেষত কওমি ঘরানা লোকজন ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরে অবস্থান করে বিধায় তাদের ইতি-নেতির প্রতিক্রিয়া মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তাদের উৎসাহও সঠিকভাবে পরিচর্যার অভাবে কলি হয়ে, বড় জোর ফুল হিসাবে বিকশিত হতে পারে; সময় নিয়ে চূড়ান্ত ফল হয়ে দৃশ্যমান হওয়ার অবকাশ পায় না। কারণ, কওমি চিন্তাধারা, ভেতরে এবং বাইরে, ভীষণ রকমের রক্ষণশীল। এই রক্ষণশীলতা খানিকটা শামুকের মতো, সামান্য আলোড়নেই গুটিয়ে যায়। এই গুটিয়ে চলার কিছু ব্যতিক্রম শুরু থেকেই ছিল, যদিও তা কখনোই বৃহৎ স্রোতের জন্ম দিতে পারে নি। তাই রক্ষণশীলতাই যেন এর একমাত্র পরিধেয় ও বৃহৎ পরিচয়।
৩। দেওবন্দের প্রথম দিককার ছাত্র এবং পরবর্তীতে স্বানামধন্য শিক্ষক শাইখুল-হিন্দ খ্যাত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দ মাদরাসা নিজ অভ্যন্তরে গুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতায় ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষকতার পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। মাল্টা জেল থেকে ফিরে উদ্বোধন করলেন জামিয়া মিল্লিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাত মেলালেন আলীগড়ের সাথে। কিন্তু না, এর পরে তা আর সামনে বাড়ে নি। এ ইতিহাস এখানেই স্থবির হয়ে আছে। অপরাপর সমমনা সবার সহযোগিতা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আর কোনো প্রয়াস চলে নি।
ভারত-বিভাজনের পর মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি অবশ্য আলীগড়ের প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হবার কথা বললেও তেমন কিছু ঘটেছে বলে জানা যায় না। কারণ, তখন মুসলিম জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ ভারত ত্যাগ করেছে। অবশিষ্ট মুসলিম জনতা সংখ্যালঘুত্বের চাপে একেবারে দিশেহারা। মাওলানা মাদানি ও মাওলানা আজাদ নিজ সম্প্রদায়কে দিশা ধরিয়ে দিতে গিয়ে সম্পূর্ণ নাকাল! আর তাই শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্ব নিলেও সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজের জন্য স্বতন্ত্র কোনো উদ্যোগ নেওয়ার ফুরসৎ হয়নি মাওলানা আজাদের। মাওলানা মাদানি নিজের কর্মক্ষেত্র বৃহত্তর দেশ থেকে শুধু দেওবন্দের মাঝেই গুটিয়ে নেন, অন্তত রাজনৈতিক দিক থেকে।
এদিকে নতুন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করলেও এরপর কওমি ঘরানার লোকদের তেমন জোরালো উপস্থিতি চোখে পড়ে না। গলার জোরে দু-মেরুর দুজন যথাক্রমে মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ বুখারি এবং মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি নিজের দলে সমাদর পেলেও বৃহত্তর পাকিস্তানি সমাজে কোনো বড় অবদান রাখতে পারেন নি। কারণ, অতীতের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে তারা ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে ছিলেন বিশেষভাবে সঙ্কোচিত, দ্বিধান্বিত। মাওলানা মুফতি শফি সাহেব রাষ্ট্রীয় পদবি নিয়েও রাষ্ট্রে যেমন নিজের প্রভাব গ্রথিত করতে পারেন নি, তেমনই নিজ ঘরানার লোকদেরকেও রাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন নি। এমনকি তার প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম করাচিও রাষ্ট্রযন্ত্রে অবদান রাখার পথ তৈরি করতে পারে নি। এক পুত্র মুফতি তাকি উসমানি শরিয়া আদালতের বিচারপতি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন অবশ্য। এবং অন্য পুত্র রাফি উসমানি এখনও রাষ্ট্রীয় পদবি-ধারী। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও কওমি মাদরাসায় রাষ্ট্রীয় রীতি-পদ্ধতির কোনো আলোড়ন তৈরি হয় নি।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এক মাওলানা আকরাম খাঁ ছাড়া, এ পদবাচ্যে অভিহিত হবার মতোই, খুব বেশি যোগ্য লোকের সন্ধান জানা নেই। সদর সাহেব, খতিব আজম সাহেব, ফখরে বাঙাল সাহেব, শর্ষিণার পীর প্রমুখ আলেমগণ জাতীয় পর্যায়ে কোনো স্রোত তৈরি করতে পারেন নি। আর তাই ভারতের দেওবন্দ-সাহারানপুর-নদওয়া নিজের যোগ্যতা বলে দেশে-বিদেশে সরকারের স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হলেও আমাদের দেশের এই সব রথী-মহারথীদের এ নিয়ে কোনো ভাবনাও তৈরি হয় নি। পাকিস্তানি সরকার সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি রূপরেখার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশে তা ‘হনুজ দূর-অস্ত’! এজন্যই এখানে তাদের আন্দোলন ও দেন-দরবার করতে হয়। যদি যোগ্যতা ও অবদানের ক্ষেত্রে তা প্রশ্নহীন হত, তাহলে এ সমস্যার তৈরি হত না। দুঃখজনক হল, এটি বোঝার মত লোক কওমি মাদরাসায় খুব বেশি নেই।
৪। একাত্তরের ঘনঘটায় ইসলাম ধর্মীয় বৃহৎ দলগুলোর দ্বিধা-সংকোচ, হঠকারিতা, অদূরদর্শিতা এবং সর্বোপরি বিবেকহীনতার জন্য স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কওমি ধারার কণ্ঠ অনুচ্চ হয়ে পড়ে। সদর সাহেব হুজুর ও মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী সাহেবের তত্ত্বাবধানে মাতৃভাষা চর্চার যে পথ তৈরি হয়েছিল, তা মিইয়ে আসে। কওমির সর্বত্র বাংলার তুলনায় উর্দুই হয়ে ওঠে অন্যতম শিক্ষা-মাধ্যম। অথচ যুগচেতনা ধারন না করার কারণে এ উর্দু-চর্চা একাডেমিক কোনো রূপ লাভ করে নি। অর্থাৎ তাদের চর্চাটুকু উর্দুভাষীদের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে নি। শুধু তা মোগল আমলের সেনা ছাউনির মতো লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা হিসাবেই নিজস্ব গণ্ডিতে ভাব আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হয়েছে। বুহত্তর বাঙালি জনতার সাথে তারা ‘যবানি মিশাল’ দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করলেও তা কিন্তু সেই ‘বটতলা’ থেকে খুব বেশি দূর এগুতে পারে নি।
ঊনিশ শ’ নব্বইয়ের পর কওমি-পড়ুয়া কচ্ছপ-সমাজ ঘুম থেকে জেগে ওঠে দেখতে পায়, বাংলা সাহিত্যের সুচতুর খরগোশ না ঘুমিয়ে দৌড়ে দৌড়ে লাফিয়ে চলেছে, এগিয়ে গেছে অনেক দূর। কেউ কেউ তখন কচ্ছপের খোলস ছেড়ে শেয়াল বা সজারুর আবরণ নিতে থাকে। কিন্তু কচ্ছপের পা তো আর সহজে পাল্টানো যায় না। তাই পথ আর ফুরোয় না। অবশ্য এজন্য তাদের কোনো সচতেনতা আছে বলে জানা নেই। কেউ কেউ সচেতন করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। কারণ, যিনি ঘুমের ভাণ করেন, তাকে জাগানো মুশকিল!
আর তাই নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আবহাওয়া তসলিমা নাসরিনের আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করে তোলে। তুখোড় ও তেজি তরুণী! সেই সঙ্গে রয়েছেন মুক্তবুদ্ধি চর্চার উত্যুঙ্গ পাহাড় ডক্টর আহমদ শরীফ গং। তাদের মোকাবিলা করার মতো ভাষা ও বিষয়গত যোগ্যতা পুরো ধর্মীয় মহলে কারো ছিল বলে মনে হয় না। তখন উদ্ভব ঘটে কবিতা সুলতানা নাম্নী এক তরুণীর। ধর্মীয় মহলে তার কাটতিও ছিল বেশ। কিন্তু তসলিমা যতটা সহজবোধ্যতার ভেতর দিয়ে বিষাক্ত বাণ মেরে দিতেন, কবিতা সুলতানার ছিল খিস্তি-খেওড় ও কাঠিন্য। আজ তসলিমা আছে, তার অনুসারীও প্রচুর। আহমদ শরীফ গংদের ভক্ত ও অনুসারী অগুনতি। কিন্তু কবিতা কই? তার অনুসারী কই? আবার, তখন ও এখন, কওমি-পড়ুয়া সমাজ কই?
৫। রাশিয়ার পতনের পর মুসলিম বিশ্বে নড়াচড়া শুরু হলেও ২০১১ সালে টুইনটাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা পৃথিবীর এ-যাবৎকাল প্রচলিত নিয়মনীতির ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। এর ঢেউ বাংলা মুলুকেও লাগে। ততদিনে সীমিত আকারে হলেও ইনাটরনেটের দরোজা খুলতে শুরু করেছে। এই দরোজা দিয়ে যে হাওয়া আসে, তা কওমি ধারাকেও অভিভূত করে। তবে সারা পৃথিবী অবিরামভাবে খরগোশের মতো দৌড়ালেও কওমি মাদরাসার শিক্ষা-ব্যবস্থা কচ্ছপগতিতে, তাও আবার ঘুমিয়ে-জিরিয়ে, আত্মকলহে জড়িয়ে, দ্বিধা-সঙ্কোচে বাধাগ্রস্ত হয়ে, কোনোভাবে পা চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই এক দশক পার হয়ে দ্বিতীয় দশকের অর্ধেকও প্রায় অতিক্রান্ত। ততদিনে কওমি অঙ্গনের কিশোর-তরুণদের হাতে হাতে বৈশ্বিক যোগাযোগের ‘এন্ড্রয়েট সেট’। এতে যুগপৎ ধর্ম ও অধর্মের চরম হুড়োহুড়ি। কিন্তু এর সিংহভাগ ছাত্রই থানবির পাগড়ি, মাদানির জুব্বা, ফখরে বাঙালে লাঠিসহ তাদের ছবি পোস্ট করে দেওবন্দিয়তের পরিচয় জাহির করছে। এদের কেউ কেউ একই ঘরানার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে নানা রকম পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে অনবরত, অপর দলটি তথাকথিত প্রতিপক্ষকে শালীন-অশালীন গালাগাল দিয়ে নিজের ধর্মবোধে শান দিচ্ছে। তাদের ধারনা-বিরোধী যে কোনো বিষয়ের ব্যাপারে এরা ভীষণ রকমের অসহিষ্ণু। এদের স্বল্পসংখ্যক একটি গ্রুপ ভুল বানানে, ভুল বাক্যে, অ-গোছালো উপস্থাপনায় নিজস্ব চিন্তাপ্রবাহ তৈরির চেষ্টা করছে। কোটিকের মাঝে গুটিক অবশ্য ভাষা ও বিষয় তথা আধার ও আধেয়ের ব্যাপারে সচেতনতা ও যোগ্যতার পরিচয় রাখছে। এ কয়জনকে নিয়ে তাদের নর্তন-কুর্দনের শেষ নেই। হাস্যকর হল, এনিয়ে গুটিকের আত্মতৃপ্তিমূলক ঢেকুর বাঘের গর্জনকেও হার মানায়! তখন মনে পড়ে সেই প্রবাদ বাক্য: হাতি-ঘোড়া গেল তল, ছাগল বলে কত জল? বাস্তবতা হল, বিপরীতমুখী স্রোতের তোড়ে ওরা খড়কুটোর মতোই ভেসে যাবেন।
৬। এখন তো তথ্য-বিস্ফোরণের যুগ। কিন্তু তথ্যের পেছনে যদি সুগঠিত কোনো তত্ত্ব কাজ না করে, তাহলে এখনকার তথ্য পরবর্তীতে মিথ্যার আবরণে ঢাকা পড়ে যায়, ঢেকেও যায়। আবার তত্ত্বচর্চার জন্য দরকার ব্যাপক পড়াশোনা; গঠনমূলক ও বৃহদাকারের পড়াশোনা। পাঠ্য বইয়ে, নিজের ঘরানায়, মাসলাকে ও মাজহাবে সীমাবদ্ধ থেকে কুঁয়ো, বড়জোর আবদ্ধ জলাশয় তৈরি করা যায়, যার সঙ্গে নদীর স্রোতের প্রবাহ না থাকায় এক সময় দূষিত হতে বাধ্য। সে দূষিত পানি নিয়ে গর্ব করা যায়, কিন্তু দুর্গন্ধ এড়ানো যায় না। নিজে অভ্যস্ত বিধায় তা সয়ে যায়, কিন্তু অপরের সুস্থ নাসারন্ধ্রে তা নির্ঘাত আঘাত করে। আত্মতৃপ্তির এই যে ব্যাধি, এর কোনো ওষুধ নেই। কারণ, তা ব্যাধি নয়; আধি। ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য যদি ওষুধের ব্যবহার হতে পারে, তাহলে আধি থেকে মুক্তির জন্য দাওয়াইয়ের ব্যবহার হবে না কেন? আর হ্যাঁ, আধির একমাত্র দাওয়াই হল তুলনামূলক পঠন-পাঠন। অথচ কওমি ঘরানায় দেওবন্দি মাসলাক ও হানাফি মাজহাব ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের পাঠ নেই, সে পাঠের সমর্থনও নেই। তাহলে আধি দূর হবে কেন?
৭। বর্তমান তরুণ কওমি-পড়ুয়া যে কয়জনের মাঝে সর্বগামী চিন্তাপ্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা অবশ্যই ভালো। কিন্তু তা যদি মুষ্টিমেয় কয়জনের মাঝেই সীমিত থাকে, তাতে নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ সমাজে নায়ক তৈরি হবে ঠিকই। এই নায়কত্ব দিয়ে ব্যক্তি লাভবান হতে পারবে। বৃহত্তর জাতির জমিন তৈরি হবে না। কারণ, যোগ্য লোকের মূল্যায়নের জন্য আরো অধিক সংখ্যক যোগ্য লোকের জন্ম দিতে হয়। যোগ্য ব্যক্তির যোগ্যতা-চর্চার অভ্যাস সাধারণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়। তা না হলে সেই ব্যক্তি নিজস্ব কাল পেরুনোর পর বিস্মৃতির গর্বে হারিয়ে যায়।
এর চেয়ে বড় কথা হল, পরবর্তী কালের জন্য বা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্রোতের তৈরি করতে হলে ব্যাপক লোকের সজ্ঞান চর্চা ও অংশগ্রহণ দরকার। যত মহৎ ও দূরদর্শী হোক না কেন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো ধারা যদি এক বা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের মাঝেই সীমিত থাকে, তাহলে তা বেশিদিন টেকে না। এর জন্য পরম্পরাগত সৃজনশীলতার সুযোগ থাকতে হয়। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেওবন্দি ধারা যে আজও বহমান, তার মূল রহস্যের একটি হল একই সময়ে অসংখ্য যোগ্য লোকের সমন্বয় ও কর্মক্ষমতা প্রয়োগ। মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক ইখওয়ানও পাহাড় সমান বাধাবিপত্তির মাঝে আজও সচল শুধু যোগ্য লোকের প্রাচুর্যের সুবাদে। পুরো ভারত উপমহাদেশে একাধিক ব্যানারে একাধিক আন্দোলন গড়ে উঠলেও শুধু ইখওয়ানের প্রাণ-প্রাচুর্যের সমাবেশ ঘটেনি বলে রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই ধর্মীয় কোনো দলই স্মরণযোগ্য স্রোতের সৃষ্টি করতে পারে নি।
পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলার ভূখণ্ডেও শিখা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কতিপয় স্বপ্নবাজ তরুণদের হাতেই। সে আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার একাধিক কারণের মাঝে এটাও সত্য যে, তা ছিল মুষ্টিমেয় বোদ্ধাদের মস্তিষ্কজাত। তা যদি আরো অসংখ্য যোগ্য মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করতে পারত, তাহলে সূচনাতেই এভাবে এর বিপর্যয় ঘটত না। রামমোহন বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে যে বাঙালি হিন্দু জাগরণের সূচনা হয়েছিল, তা ক্রমপরম্পরায় টিকে যাওয়ার কারণ হল এর দক্ষ-যোগ্য অনুসারীর অভাব হয় নি; এখনও তা হিন্দু সমাজে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে।
৮। বলেছি, কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরেই কঠিন রকমের টানাপড়েন বিদ্যমান। কওমি ধারার প্রতি বাইরের উন্নাসিকতা তো আছেই, এটা ততটা ভয়ঙ্কর না, যতটা অভ্যন্তরীণ বাধাবিপত্তি। এখন অতি উৎসাহী কতিপয় তরুণ কওমির দোষগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। এর পূর্বে এমন তরুণদের দেখা মেলে নি। থাকলেও ইতিহাসে এর ছাপ নেই। ভারতের মাটির প্রবণতাই হল এই রকম: আত্মনিবেদন তথা আত্মবিস্মৃতি। তা না হলে দেওবন্দি ধারার গর্ব, আল্লামা কাশ্মীরির যে রকম ধীমনতার কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে, যদি এর সঙ্গে সামান্য ব্যক্তিক স্ফূরণের তেজস্বিতা থাকতো, তাহলে ইবনে তাইমিয়ার চেয়ে বিশ্বব্যাপী বড় রকমের কোনো স্রোত তৈরি হত নিশ্চয়। ইবনে তাইমিয়া হাম্বলি মাজহাবের আওতাধীন হয়েও শরিয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যে মৌলিকতার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তার ছিঁটে-ফোটা কাশ্মীরির মাঝে নেই! বরং কাশ্মিীরির মাঝে শুধু আত্মনিবেদনের কারিশমা। অথচ কাশ্মিরির তিরোধানের পরেও কিন্তু ইসলামি শরিয়ায় অসংখ্যা ব্যক্তির একাধিক সংযোজনের নজির আছে। বর্তমানে কওমির সেই সব তরুণদের নিবেদনে ঘাটতি আছে, তা বলবো না, তবে তারা যে প্রশ্ন উত্থাপনের সাহস দেখিয়েছেন, তা ধরে রাখতে সংখ্যালঘুত্বের গণ্ডি পার হতে হবে। সামান্য বিষয় নিয়ে আত্মগর্ব বা আত্মতৃপ্তি নয়, নয় প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধগলিতে মুগ্ধ বিচরণ। বরং সৃজনশীলতাকে আশ্রয় করে, ব্যক্তিক তেজস্বিতা নিয়ে স্বদেশে-স্বকালে নিজে বাঁচার, অন্যকে বাঁচানোর তাগিদে প্রশস্তহৃদয় ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই।
তা বলতে হল এ জন্য যে, কওমির সেই সব তরুণদের আচরণে বেশ অপরিপক্বতা দৃশ্যমান। এর জন্য অবশ্য সময়ের প্রয়োজন। কারো কারো মাঝে সেই অপরিপক্বতা মোকাবেলার যে ইতিবাচক মানসিকতা আছে, তা আশান্বিত হবার মতো। তবে এ আশা তখনই সফল হবে, যখন তা ব্যক্তিক কোটর থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর স্রোতের জন্ম দিতে পারবে। আর না হয়, তা মহাভারতের সেই ব্রাত্যজন একলব্যের সাধনা হিসাবেই পরিগণিত হবে। একলব্যের সাধনা কিন্তু সফল ছিল। স্বয়ং দ্রোণাচার্য তার মেধায় মুগ্ধ। কিন্তু স্বীকৃতির জন্য একলব্যকে দ্রোণের কাছেই যেতে হয়ে ছিল। কারণ, তার সমাজের স্বীকৃতি দেবার মতো লোক ছিল না। স্বীকৃতির নামে আচার্য দ্রোণ কিন্তু যোগ্য সেই শিষ্যের আঙুলকেই গুরু দক্ষিণা হিসাবে চেয়ে বসলেন। শেষ পর্যন্ত একলব্যকে তাই করতে হল। কওমির মাঝে যারা সাহিত্যের ধনুর্বিদ্যা চর্চা করতে চায়, জাগরণের মন্ত্রে দীক্ষিত হতে চায়, তাদের নিজেদের মূল্যায়নের জন্য নিজেদের ভেতর থেকেই বিচারক নির্ণয় করতে হবে, সে বিচারকের জন্মও দিতে হবে। কিন্তু এতো সহজে হবার নয়। তাই কালের দহন ও বহনের বেদনা নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে যারা সাধনায় মগ্ন, তাদের উচিত যোগ্য বিচারক, অনুসারী তৈরির চেষ্টা করা।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন।
বিষয়: বিবিধ
১২০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন